নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৩৩
#WriterঃMousumi_Akter
“তুমি আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে কোথায় হারিয়ে গেলে শ্রাবণ? সত্যিকারের ভালবাসা কি এতটাও ভুল হয়। সত্যিকারের ভালবাসার মত পবিত্র অনুভূতিকে তুমি কেনো কলঙ্কিত করলে শ্রাবণ। তুমি আমার না হলেও আমি বেঁচে থাকতে পারতাম।কিন্তু তোমার করা বেইমানির আঘাতে আমি ম’রে যাবো।তুমি আমার না হলেও এই শান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম আমি যাকে ভালবেসেছিলাম সেও আমাকে ভালবেসেছিলো।প্লিজ শ্রাবণ ফিরে এসো। একবারের জন্য হলেও ফিরে এসো। ফিরে এসে বলো, এসব মিথ্যা, সব ভুল, আমাদের ভালবাসায় কোনো খাঁদ ছিলনা। এই চিঠি মিথ্যা,সব কথা মিথ্যা।প্লিজ শ্রাবণ তুমি আমার বিশ্বাস কে মিথ্যা হতে দিওনা।সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। তুমি ফিরে এসে প্রমান করে দাও এসব মিথ্যা। “
প্রিয়তার করুণ আর্তনাদে চার দেওয়ালের ইট -পাথর ও বোধহয় কষ্ট পাচ্ছে। জড়-বস্তুও যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
রজনী এই মুহুর্তে প্রান্তিক কে নিয়ে যে কষ্টটা পেয়েছে সেদিক দিয়ে প্রিয়তার যন্ত্রণা খুব ভাল ভাবে অনুভব করতে পারছে।রজনি প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে বলছে,
“বেইমানদের জন্য কাদতে নেই প্রিয়তা। ওরা কখনো ভালবাসেনা। ওরা জীবনে আসে জীবন টা এলোমেলো করতে।ও প্রতিশোধ নিতে এসছিলো,প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গিয়েছে চলে গিয়েছে।”
“এটা কেমন প্রতিশোধ?আমাকে মে’রে ফেলল না ক্যানো?”
“মৃ’ত্যু কোনো প্রতিশোধ নয়, বিচক্ষণ রা মানুষকে বাঁচিয়ে রেখে মৃত্যু যন্ত্রণা প্রতিটা দিন অনুভব করায়। কাউকে ভালবেসে মাঝ পথে ছেড়ে যাবার চেয়ে বড় প্রতিশোধ আর কিছুতে নেই। কাউকে কষ্ট দিতে চাইলে আগে তার সাথে ভালবাসার নাটক করে ছেড়ে দেয় মানুষ। কারণ মন ভা’গ’লে যে আওয়াজ টা হয় ওটা কেউ শুনতে পায়না কিন্তু আঘাত টা ভয়ানক রকমের হয়। “
“আমি এখন কি করব রজনি? কীভাবে বাঁচব। এই যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে পারব না।”
“নিজের জন্য বাঁচবি। কোনো বেঈমানের জন্য মরার কথা ভাববিনা। তোর মৃতুতে তার কিছুই যাবে আসবে না।পৃথিবীর সব থেকে বোকা আর নির্বোধ এর কাজ কি জানিস? যে আমাদের ঠকায়, আমাদের কষ্ট দেয়, আমাদের স্বপ্ন ভাঙে,আমাদের নরম হৃদয় টা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে আমারা তাদের জন্যই মরে যেতে চাই।অথচ আমরা এটা বুঝতেই পারিনা যারা আমাদের কষ্ট দিতে পারে,আমাদের চোখের পানি ঝরাতে পারে আমাদের মৃত্যুতেও তাদের কিছু যাবে আসবেনা।অনুভূতি এমন একটা জিনিস যা জোর করে আদায় করা যায় না এমন কি মরে গেলেও না। যে ভালবাসে তার জন্য মরা লাগেনা বরং সে জানে ভালবাসার মানুষ ছাড়া বেঁচে থাকা কত কঠিন তাই যে ভালবাসে সে কখনো মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়না সে চেষ্টা করে কীভাবে ভাল রাখা যায়, কীভাবে ভালবাসার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। চোখের পানি ঝরে পড়ার আগেই তারা ধরে ফেলে।আমাদের উচিৎ যারা আমাদের ভালবাসে তাদের জন্য বেঁচে থাকার।যারা আমাদের ভালবাসে না তাদের জন্য কেনো কষ্ট পাবো? বরং তাদের দেখিয়ে দেওয়া উচিৎ তাদের ছাড়া আমরা কত ভাল থাকতে পারি। তাদের না থাকায় আমাদের কিছু যায় আসেনা। তাদের কোনো জায়গা নেই আমাদের জীবনে।একটু কষ্ট হবে এটা স্বাভাবিক তবে একটু সময় নিয়ে ধৈর্য ধরলেই তখন সব কষ্ট মুছে যায়। নিজেরাই বুঝতে পারা যায় ইশ আমরা কতই না বোকা ছিলাম।আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে সৃষ্টিকর্তা যখন আমাদের জীবন থেকে কাউকে কেড়ে নেয় নিশ্চয়ই তার পেছনে ভাল কোনো কারণ আছে। কারণ তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী।”
আঞ্জুমান বলল, ” প্রিয়তা এতকিছুর পরেও নিশ্চয়ই তুমি আর আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো কথা বলবেনা।তোমার বিয়ে আজ এখনি হবে।একদিন তুমি বুঝবে তুমি যাকে সত্যিকারের ভালবাসা ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলে ওটা সত্যিকারের ভালবাসা ছিলনা।”
“আমি আর কোনদিন কারো সাথে নিজেকে জড়াব না আম্মু।”
“আমাদের মান -সম্মান এর প্রশ্ন এখানে।একটা টোকাই আমার মেয়েকে ছেড়ে গেছে বিয়ের আসর থেকে।আমার মেয়েকে সেই আসরেই বিয়ে দিয়ে দেখব আমার মেয়ে কোনো ফেলনা নয়।”
রজনি বলল, ” কিন্তু এখন পাত্র কোথায় পাবো?”
“আমি তো সব সময় অন্তর সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।অন্তর মা -বাবা অনেক বার প্রস্তাব দিয়েছে। ভেবেছিলাম ওর লেখাপড়া শেষ হলে বিয়ে দিবো। আমাদের ফ্যামিলির মত ভাল একটা ফ্যামিলি অন্তদের। তাছাড়া অন্ত ছেলেটাও ভদ্র।”
অন্তর কানে কথাটা যেতেই কি বলবে বুঝতে পারছেনা।কি বলা উচিৎ জানেনা। প্রিয়তার অনুভূতির কথা ভেবে না বলতে হবে। কিন্তু না বললে প্রান্তিক ভাববে ‘প্রিয়তাকে রিজেক্ট করছে।’
প্রান্তিক অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল, ” আমার বোনকে বিয়ে করতে তোর আপত্তি আছে? এক কথায় উত্তর দিবি। না বা হ্যাঁ! “
অন্ত প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারল না। মাথা নিচু করে বলল, ” না ভাই আপত্তি নেই।”
আঞ্জুমান বলল, ” অন্ত তোমার মা-বাবা বাইরে আছেনা? কথা বলে আসো।”
অন্ত যাওয়ার সময় প্রিয়তার দিকে তাকাল।অশ্রুভেজা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখল, তাকে বিয়ে করার জন্য কতটা ঘৃণা চোখ দুটোতে।অন্ত বাইরে গিয়ে নিজের মা-বাবার সাথে কথা বলে এল।
অন্তর মা-বাবা বরং এই প্রস্তাবে খুশি।
মাহবুব বলল, ” আবার কোনো ভুল করছি না তো আমরা।”
প্রান্তিক বলল, ” আমার উপর ভরসা রাখো বাবা। আমি ঠিক পথেই এগোচ্ছি।”
প্রিয়তা বিয়ে করবে না বলে কাকুতি-মিনতি করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এই মুহুর্তে প্রিয়তার কথা শোনার মত কেউ নেই। এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্তকে বিয়ে করা মানে ডাবল যন্ত্রণা প্রিয়তার কাছে।যাকে কখনো ভালই বাসেনি তাকে বিয়ে করার মত যন্ত্রণা আর কীসে আছে? প্রিয়তাকে বোঝার মত কেউ নেই এই পৃথিবীতে।যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি কেউ বুঝতে পারছেনা।কিছুক্ষন পরেই অন্ত ওর মা -বাবাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল।
অন্ত প্রান্তিক কে বলল,
“প্রিয়তার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে ভাই?”
“এর চেয়ে সোজাসাপটা বল, তুই বিয়ে করবিনা।”
” না ভাই এরকম কিছুই না।”
“তাহলে চুপচাপ কবুল বল। আর শোন আমার বোনের দায়িত্ব তোর। আমি তোর উপর আমার বোনের দায়িত্ব দিলাম। আমার হৃদয় ভাঙা বোনকে তোর হাতে তুলে দিলাম। হৃদয় টা তুই তোর ভালবাসা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিস। আজ আমার বোন কাদতে কাদতে যাবে তোর বাড়ি।একদিন যেন হাসতে হাসতে ফিরে আসে। আজ আমার বোন ম-রে যেতে চাইছে। একদিন যেন বাঁচতে চায় তোর জন্য বাঁচতে চায়।আমার বোন যেন বলে তুই ই ঠিক ওর জন্য।কীভাবে করবি আমি জানিনা।”
“আমার জীবন দিয়ে চেষ্টা করব ভাই।”
রুমের ভেতর কাজী ডেকে অন্ত আর প্রিয়তার বিয়ে হয়ে গেল। কবুল বলতে ঘন্টা খানিক লেগে গেল প্রিয়তার। সে তখন ও অপেক্ষা করছিল হয়ত এখনি শ্রাবন আসবে। কবুল বলে চিৎকার দিয়ে কেদে উঠল।
জীবন বড়ই অদ্ভুত! কি হওয়ার ছিল আর কি হয়ে গেল।মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। প্রিয়তা আর শ্রাবনের প্রণয়ে কোনো বাঁধা ছিলনা তবুঈ নিয়তির অদ্ভুত এক বিধানে অন্তর সাথে জুড়ে গেল প্রিয়তার জীবন। দুই জন দুই মেরুর মানুষের প্রণয়ে আদেও কি ভালবাসা বলে কিছু আসবে।এর প্রণয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে! শ্রাবন কি কোনদিন ফিরে আসবে? একজনের ভালবাসা বুকে নিয়ে কি অন্য জনের সাথে সংসার করা যায়।
তখন রাত বারোটা বাজে। অন্তর হাতে প্রিয়তার হাত ধরিয়ে দিল মাহবুব চৌধুরী। গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার সময় বলল,
” তুমি সব জেনেই বিয়েটা করেছো অন্ত। আশা করি আমার মেয়ে আর কাদবে না।”
“আমি চেষ্টা করব আঙ্কেল। সব রকম ভাবে চেষ্টা করব।”
অন্তর মা-বাবা বলল,
”আমরা আছি। ভাববেন না একটুও।”
প্রিয়তাকে নিয়ে চলে গেল।মাহবুব আর আঞ্জুমান কাদতে কাদতে ঘরে প্রবেশ করল।রজনি বাইরে দাঁড়িয়ে কাদছে। প্রিয়তার জন্য কষ্ট হচ্ছে।
প্রান্তিক রজনির দিকে তাকিয়ে বলল,
” ঘরে চলো।”
রজনি রাগি চোখে প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে হনহন গতিতে রওনা দিল রুমে।
প্রান্তিকের মাথার পেছনের চুল চুলকাতে চুলকাতে বলল,
” দুনিয়ার সব ঝামেলা সামলানো সহজ কিন্তু বউ সামলানো সহজ নয়।মাইয়া মানুষ এত রা’গি ভাই কি বলব। “
চলবে?…