নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৫৪.
মাথার উপর তপ্ত সূর্য। শহরজুড়ে তার দগদগে তেজ। ছাঁদের তপ্ত পাটাতনে পা রাখা ভার। ক্ষনিকেই যেন ত্বক ঝলসে যাওয়ার ভয়। ছাঁদঘরের টিনে ঢাকা চালে আর গাছের পাতায় দাউদাউ করে জ্বলছে তীব্র রোদের আগুন। এমনই উত্তপ্ত দুপুরে ছাঁদের দড়িতে কাপড় মেলছে এক রমণী। পরনে তার আধভেজা পাতলা শাড়ি। হাতে মোটা স্বর্ণের বালা। রোদের তাপে লাল হয়ে উঠা ফর্সা নাকে জ্বলজ্বল করতে থাকা ছোট্ট নাকফুল। কপালে তার ঘামের নহর। বালতি ভর্তি কাপড়ের বেশ খানিকটা ফেলে রেখেই পায়ের দিকে তাকাল নীরা। উত্তপ্ত পাটাতনের তপ্ততা থেকে বাঁচতে পা উঁচু করে বুড়ো আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল। হাত দিয়ে আড়াল করল চোখ। পরমুহূর্তেই কিছুটা স্বস্তির জন্য ছাঁদের ডানপাশে থাকা বিশাল আমগাছের ছায়ায় দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল সে। একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। কিন্তু চোখ তুলে তাকাতেই থমকে গেল নজর। আম গাছের ছাঁয়ায় উল্টোদিক ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে চোখের পলকেই চিনে ফেলল নীরা। টি-শার্টের কলারটা পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্তু। পরনে ছাইরঙা থ্রী কোয়াটার প্যান্ট আর চটি জুতো। একহাতে জ্বলন্ত সিগারেট আর অন্যহাতে ফোন। অন্তুর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট দেখেই চটে গেল নীরা। কয়েক সেকেন্ড ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে থেকে উল্টো ঘুরে কাপড় মেলায় মন দিল। বালতিটা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় রাখতে গিয়ে ইচ্ছে করেই অতিরিক্ত শব্দ করল। অন্তু ঘাড় ফিরিয়ে একপলক তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিল। তপ্ত রোদের মতোই শাড়ি পরিহিতা উত্তপ্ত নীরাকে দেখেও যেন দেখল না সে। নীরার রাগটা যেন থিতিয়ে গেল। কাপড় মেলতে মেলতেই রাগ ভুলে ভয়ানক মন খারাপ হয়ে গেল। যে মানুষ রাগকেই পাত্তায় দেয় না তাকে রাগ দেখিয়ে কি লাভ? নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মস্তিষ্কে কড়া নাড়ল উত্তরহীন কিছু প্রশ্ন, অন্তু কেন এত সিগারেট খায় আজকাল? আগে তো খেতো না। নীরাকে কী সে একদমই মেনে নিতে পারছে না? নাকি শাশুড়ী মায়ের কথায় সত্যি? অন্তু কী বাইরে কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে? ভাবনাগুলো নিজের কাছেই কেমন বিদঘুটে শোনায় নীরার। শেষ কাপড়টা মেলতে মেলতে নিজেকে শাসায়, ছিঃ! কি বিশ্রী চিন্তা! বালতি নিয়ে নিচে নামার সময় পেছন ফিরে একটিবার তাকাল নীরা। অথচ বুঝতেই পারল না, পাশের বিল্ডিংয়ের জানালার গ্লাসে অত্যন্ত মনোযোগী দর্শক হয়ে তাকেই দেখছিল অন্তু। পাতলা শাড়িতে স্পষ্ট হয়ে উঠা নারীসুলভ বাঁক। কাপড় মেলতে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া মেদহীন কোমর। ঘামে ভেজা মুখশ্রীতে আবেদনময়ী ঠোঁট!
বেশ কিছুক্ষণ হলো ছাঁদ থেকে নেমে এসেছে অন্তু। মন-মেজাজ তিরিক্ষি। নীরার ‘শাড়ি, শাড়ি’ ঢঙটা একদম পছন্দ হচ্ছে না তার। বাসায় কি সালোয়ার-কামিজ নেই? সারাবাড়ি, সর্বক্ষণ শাড়ি পরে টই টই করে ঘুরতে হবে কেন? আর যদিও-বা পরে তাতে ন্যূনতম সাবধানতার বালাই-ই-বা থাকবে না কেন? একটা মেয়ে কতটা কেয়ারলেস হলে আধভেজা পাতলা শাড়ি পরে ছাঁদে উঠে যেতে পারে, তাই ভেবে পাচ্ছে না অন্তু। আশেপাশে এতোগুলো বিল্ডিং। প্রত্যেকটাতেই থাই গ্লাসের ব্যবস্থা। নিজের ঘরে বসেও পাশের ছাঁদের রমণীকে দেখার সুবর্ণ সুযোগ। ‘নীরাকে ওই অবস্থায় অন্যকেউও হয়ত দেখেছে’, কথাটা ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে অন্তুর। নীরাকে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। অন্তু হাতের ফোন কিছুটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বালিশে ঠেস দিয়ে বসল। কপালে ডানহাত রেখে চোখ বন্ধ করল। ঠিক সেই সময়ই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো নীরা। দরজার শব্দে হাত সরিয়ে চোখ খুলল অন্তু। ওয়াশ রুমের দরজার দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে এলো। বিগড়ে থাকা মেজাজটা এবার চূড়ান্ত বিগড়ে গেল। নীরার গায়ে আবারও পাতলা শাড়ি!
গোসল সেড়ে বেরিয়েই অন্তুর শীতল চাহনির খপ্পরে পড়ে কিছুটা ভরকে গেল নীরা। কিছু বুঝতে না পেরে ভীত চোখে চেয়ে রইল। অন্তু কিছু বলল না। আগের মতোই কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করল। ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে ভেতরে আসতেই অয়নের নাম ধরে তারস্বরে ডেকে উঠল অন্তু। অন্তুর হঠাৎ চিৎকারে চমকে উঠল নীরা। তটস্থ চোখে অন্তুর দিকে তাকাল। দুই-তিনবার ডাকার পর অলস ভঙ্গিতে ভেতরে এলো অয়ন। গায়ে পাতলা টি-শার্ট। হাতে ফোন। অয়ন বিরস কন্ঠে বলল,
‘ ডাকছ কেন ভাইয়া? নীরাপু থুক্কু ভাবী তো এখন ঘরেই আছে। কিছু বলতে হলে সরাসরি বলে ফেলো। আমাকে কেন দরকার?’
অন্তু সোজা হয়ে বসল। শীতল কন্ঠে বলল,
‘ কাছে আয়।’
অয়ন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সেকেন্ড বিলম্ব না করেই ভাইয়ের গালে ভয়ানক এক চড় বসাল অন্তু। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে দু-পা পিছিয়ে গেল নীরা। অন্তুর এমন রূপে ভীত হয়ে উঠল মন। অন্তু রাগত কন্ঠে বলল,
‘ সারাদিন গেইম খেলিস পড়াশোনা নাই? এই পড়াশোনা দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিবি তুই? থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে ফেলব, বেয়াদব।’
অয়ন গালে হাত দিয়ে অভিমানী চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। অন্তু হাতে থাকা ফোনের দিকে ইশারা করে ধমকে উঠল,
‘ এই তুই গেইম খেলার জন্য ফোন কোথায় পাস? আব্বা তো দেয় না। আমার ফোনও নিস নাই। তাহলে এই ফোন পেলি কোথায়?’
অয়ন মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। উত্তর দেয় না। অন্তু আবারও ধমকে উঠল,
‘ আমি জিজ্ঞেস করেছি, ফোনটা কার?’
অয়ন মিনমিন করে বলল,
‘ নীরাপুর।’
অন্তু এবার নীরার দিকে তাকাল। অন্তুর কুঞ্চিত ভ্রু আর শীতল চাহনী দেখেই আত্মা ধরফর করে উঠল নীরার। একবার অসহায় চোখে অয়নকে দেখে নিয়েই অন্তুর দিকে তাকাল। অন্তুকে কিছু বলার সাহস জোগাতে না পেরে আবারও অয়নের দিকে তাকাল। অয়নের হাত থেকে ফোনটা নিয়েই দ্রুত পায়ে ঘর ত্যাগ করল। নীরার যাওয়ার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ভাইকে কাছে টানল অন্তু। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ বেশি ব্যথা লেগেছে?’
অয়ন অভিমানী চোখে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। অন্তু হাসল। অয়নের চুলে হাত চালাতে চালাতে বলল,
‘ আচ্ছা যা, সরি। এবার তোর ভাবিকে গিয়ে বল, সে যেন এই মুহূর্তে শাড়ি পাল্টে সালোয়ার-কামিজ পরে। শাড়িতে তাকে বিশ্রী লাগে। এমন বিশ্রী দৃশ্য চোখের সামনে সহ্য করা যাচ্ছে না।’
অয়ন অসহায় চোখে তাকাল। ক্ষোভ নিয়ে বলল,
‘ বারবার আমিই কেন? ভাবি তো ঘরেই ছিল। তখন কেন বললে না? তুমি ইচ্ছে করেই ভাবিকে বাইরে পাঠালে। সব আমাকে কাজ করানোর ধান্দা। আমি কিছু বলতে টলতে পারব না। নীরাপু তো আমার বউ নয়। আমার বউকে আমি বলব। তোমার বউকে তুমি বল, যাও।’
সাথে সাথেই আরেকটা চড় পড়ল পিঠে। অন্তু ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ যাবি? নাকি আরেকটা খাবি?’
অয়ন ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল। ভাইয়ের থেকে সরে গিয়ে বলল,
‘ সব কাজ তো আমাকে দিয়েই করাও। বিয়েটাও করিয়ে দিতে৷ করে ফেলতাম বিয়ে।’
_
সারারাত জেগে থাকায় ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বারোটা বেজে গেল নম্রতার। ঘুমু ঘুমু চোখ আর ভার মাথা নিয়ে বিছানা ছাড়তেই ছুটে এলো নন্দিতা। কন্ঠে একরাশ চঞ্চলতা আর কৌতূহল নিয়ে বলল,
‘ ডাক্তার ভাইয়ার বাড়ি থেকে ঘটক এসেছে আপু। সিভি আম্মুর ডিপার্টমেন্টে জমা হয়ে গিয়েছে। একবার যদি কনফার্ম হয়ে যায় তাহলেই ডিরেক্ট শ্বশুড়বাড়ি।’
কথাটা বলেই ঠোঁট গোল করে সিটি বাজাল নন্দিতা। হাতটাকে প্ল্যানের মতো উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিমা করে চোখ টিপল। তারপর দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ তোমার হবু শাশুড়ি বাবাকে ফোন দিয়ে লাঞ্চের দাওয়াতও দিয়ে ফেলেছেন। বলেছেন, উনারা মেয়ে দেখেছেন। মা-শা-আল্লাহ মেয়ে তাদের পছন্দ। মেয়ে পছন্দ বলেই মাধ্যম হিসেবে ঘটকের আয়োজন। এবার আমাদের দেখাদেখির পালা। আমাদের যদি ছেলে পছন্দ হয় তাহলেই আলহামদুলিল্লাহ। আম্মু যদি ‘হ্যাঁ’ বলে তাহলেই চট করে দাওয়াতের ব্যাপারটা তুলবে বাবা। নয়তো সন্দেহ টন্দেহ করে বসতে পারে। আম্মুর তো বিশ্বাস নাই।’
নম্রতা হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল। এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু হয়ে গেল আর সে টেরই পেল না? নম্রতার ঘোলাটে ভাবনার মাঝেই নম্রতাকে ঝাপটে ধরল নন্দিতা। উত্তেজনায় লাফাতে লাফাতে বলল,
‘ উফ! আমার যে কি মজা লাগছে আপু! আবার একটু মন খারাপও লাগছে। সিভিতে দেখলাম ডাক্তার ভাইয়ার নাকি ছোট ভাই টাই নাই? খুব দুঃখের সংবাদ। আমার প্রেমটা হতে হতেও হলো না। ‘দিদি তেরি দেবর দিওয়ানা’ গানটার উপর জবরদস্ত নাচ শেখাটাও কাজে লাগল না। ওয়েস্ট, সব ওয়েস্ট!’
#চলবে….
[ রি-চেইক করা হয়নি।]