#ভয়ংকর নির্জন
পর্ব ২
ডোরার ঘুম ভাঙে বৃষ্টির শব্দে। একটা মন খারাপ ঘিরে ধরে আছে। ভেবেছিল অনেক গল্প করবে, ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু কালকের অসঙ্গতিগুলো ওকে ভাবাচ্ছে। যদিও জন এখন পর্যন্ত ওর সাথে কোনো উল্টাপাল্টা কিছু করেনি। আচ্ছা, ও কী বেশি বেশি ভাবছে?
এই যখন ভাবছে ঠিক তখন নিচ থেকে একটা আর্ত চিৎকার ভেসে আসে, ‘বাঁচান আমারে, মইরা গেলাম।’
ডোরার বুকটা চলকে ওঠে বুক হিম করা চিৎকারে। দ্রুত ও পরনের এলোমেলো কাপড় ঠিকঠাক করে নিচে নামতেই দেখে মাঝবয়েসী একটা লোক পা চেপে ধরে মুখ বিকৃত করে চিৎকার করছে, ‘সাপে কাটছে আমারে।’
এর মধ্যে জনও চলে এসেছে, ও দ্রুত একটা কাপড় দিয়ে কামড় দেবার জায়গাটা বেঁধে দেয়। ডোরার চিকিৎসক সত্তাটা জেগে ওঠে, ও দ্রুত লোকটার কাছে আসে, তারপর ভালো করে সাপের কামড়ের জায়গাটুকু দেখে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলে, ‘জন, ওকে তো বিষাক্ত সাপ কামড়েছে।’
জন ঝট করে মাথা ঘোরায়, একটু কঠিন গলায় বলে, ‘আমজাদ মিয়াকে বিষাক্ত সাপ কামড়েছে, তুমি জানলে কী করে!’
ডোরা মুখ গম্ভীর করে বলে, ‘তুমি ভুলে গেছ, আমি একজন ডাক্তার। ওর ক্ষতটা দেখো, পরিস্কার দুটো দাঁত বসানোর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বিষাক্ত সাপের কামড় এমন হয়, এরা এদের দুই দাঁত বসিয়ে দেই। আর বিষহীন সাপগুলোর দাঁত থাকে না, এরা পুরো মুখ দিয়ে চেপে ধরে, তাতে গোল একটা দাগ হয়।’
আমজাদ নামের লোকটা এবার ব্যথায় ককিয়ে ওঠে, তারপর ডোরার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে, হাউমাউ করে বলে, ‘আফা, আমারে বাঁচান। আমি মরতে চাই না।’
ডোরা একটা জোরে নিশ্বাস ফেলে, জরুরি গলায় বলে, ‘জন, এন্টিভেনম লাগবে। যত দ্রুত সম্ভব। না হলে একে বাঁচানো যাবে না। চলো একে হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
জন ঠান্ডা গলায় বলে, ‘কোথাও নিতে হবে না, আমার কাছেই এন্টিভেনম আছে। আমি এনে দিচ্ছি, তুমি কষ্ট করে ওকে একটু দিয়ে দাও।’
ডোরা চোখ কপালে তুলে, ‘কী বলছ! এটার জন্য তো হসপিটাল সেটিং লাগে। অনেকক্ষণ ধরে দিতে হয়।’
জন ওকে আশ্বস্ত করে, বলে, ‘আমি তোমাকে পরে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি। আগে এন্টিভেনম ইঞ্জেকশনটা দাও, তারপর।’
কথাটা বলেই জন বাংলো থেকে বের হয়ে যায়। পাশের একটা বিল্ডিং থেকে একটু পরেই দশটা এন্টিভেনম ভায়াল নিয়ে আসে। ডোরা ভ্রু কুঁচকে ভাবে, এমন নির্জন একটা ফার্মে কেউ এন্টিভেনম রাখে!? উম, হয়ত পাহাড়ি এলাকা, সাপের প্রকোপ বেশি, এজন্যই রাখা।
ডোরা আর দেরি করে না, ইঞ্জেকশনটা রেডি করে। আমজাদ মিয়ার মধ্যে সাপের বিষ ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। লোকটা ঘামছে, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। পালস রেট কমে আসছে। নাহ, দ্রুত এন্টিভেনম দিতে হবে। হঠাৎ করেই ওর এক স্যারের কথা মনে পড়ে যায়, সাপে কাটার পর প্রথম ১০০ মিনিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্যার বলেছিলেন, এন্টিভেনম দেবার গোল্ডেন রুল হলো ১০০ মিনিটে ১০০ মিলি এন্টিভেনম দিতে হবে। তাতে রোগী বাঁচবেই।
ডোরা লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে পেশাদার ভঙ্গিতে কাজটা শুরু করে। লোকটা ভীষণ ভয় পেয়েছে, মৃত্যুকে হয়ত কাছ থেকে দেখছে।
দুই ঘন্টা পর আমজাদ মিয়া ধীরে ধীরে অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ওকে একটা আলাদা রুমে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়। আসার সময় ডোরার দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আফা, আইজ আপনি আমার জান বাঁচাইলেন।’
ডোরা মাথা নাড়ে, বলে, ‘সময়মতো ওষুধ পড়েছে বলেই বেঁচে গেলা। তোমার জন স্যারকে ধন্যবাদ দাও, তোমাদের কথা ভেবে এত দামী একটা ওষুধ এখানে রেখেছে।’
জনের কথা উঠতেই লোকটার মুখ কেমন কালো হয়ে যায়, মাথা নিচু করে থাকে, কিছু বলে না।
জন পাশেই দাঁড়িয়েছিল, ও ঠান্ডা গলায় বলে, ‘আমজাদ, তুমি আজ বিশ্রাম নাও। ওপাশটা আমিই সামলাব আজ। ডোরা চলো, আজ তোমাকে ফার্মটা ঘুরে দেখাই।’
ডোরা অসহিষ্ণু গলায় বলে, ‘জন, আমি আগে বাসায় একটু কথায় বলব, তারপর অন্যকিছু।’
জন এবার মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে, ‘সরি ডোরা, আমি সকালেই গাড়ি রেডি করেছিলাম যে তোমাকে নিয়ে যাব। কিন্তু কাল রাতে এত বৃষ্টি হয়েছে যে আমাদের যাবার পথে একটা জায়গায় পাহাড় ধস হয়ে রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেছে।’
ডোরা বিস্মিত হয়ে বলে, ‘কী বলছ! হায় হায়, আমার তো বাসায় কথা বলা লাগবে। আম্মু ভীষণ চিন্তা করবে তো।’
জন এবার কাছে এসে ওর একটা হাত ধরে, বলে, ‘আজকের দিনটা অপেক্ষা করো, প্লিজ। আমি খবর নিয়েছি, ওরা আজকের মধ্যেই রাস্তা ক্লিয়ার করে দেবে। আর রাতে হলে, রাতেই যাব, প্রমিজ।’
ডোরার মনটা একটু শান্ত হয়। মাথা নেড়ে মনের ছোট্ট দুশ্চিন্তাটা দূর করে দেয়, নাহ, ও অযথা চিন্তা করছে। মাকে কাল তো মেসেজ দেওয়াই আছে যে ও পৌঁছেছে। কিন্তু, এখানে আসা অবধি একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। এগুলোকে স্বাভাবিক ঘটনা বলা যায় কিনা ও বুঝছে না।
জন ওর হাত ধরে টান দেয়, ‘ডোরা, আসো একটু নাস্তা করে নেই। তারপর আমার খামারটা তোমাকে ঘুরে দেখাই। এখানে আসার পর থেকে তোমাকে কাছেই পাচ্ছি না।’
ডোরা এবার একটু হাসে, কথাটা ঠিক। ও কাল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করল। জনের জন্য একটু মায়াই হয়। ওর সাথে ডাইনিং এ যায়। নাস্তা শেষে বের হয় জনের সাথে।
বৃষ্টি থেমে রোদ উঠে গেছে। সকালের হলুদ রোদ বৃষ্টিস্নাত সবুজ পাতায় পড়ে চিকচিক করছে। জন ওর হাতটা মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে থাকে। ডোরা এবার ভালো করে খেয়াল করে জায়গাটা অনেক ঝোপ জঙ্গলে ভরা। একদম নির্জন। মাঝে মাঝে কিছু অচেনা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা জায়গায় আসে। ডোরা অবাক হয়ে খেয়াল করে একটা ছাউনির ভেতর অনেকগুলো ঘোড়া। খুশিতে ও জনের বাহুটা খামচে ধরে বলে, ‘এখানে ঘোড়া আছে, জানতাম না তো! এতগুলো ঘোড়া, কেন?’
জন এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এটা দেখাতেই নিয়ে আসলাম। এই ঘোড়াগুলো ওই আমজাদই দেখাশোনা করে। এগুলো একটা বিশেষ এক্সপেরিমেন্টের জন্যই রাখা।’
ডোরা ঘোড়াগুলোর কাছে এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে যায়, পেছন ঘুরে বলে, ‘এক্সপেরিমেন্ট?’
জন আবার কাছে এসে বলে, ‘আসলে এই ঘোড়াগুলো থেকে আমি সাপে কাটার ওষুধ ‘এন্টিভেনম’ তৈরি করি। কিছু বিষাক্ত সাপ সংগ্রহ করেছি, যেগুলোর বিষ এই ঘোড়াগুলোকে পুশ করলে ওদের শরীরে একটা এন্টিবডি তৈরি হয়। পরে ঘোড়ার রক্ত সংগ্রহ করে তা থেকে সিরাম আলাদা করে এন্টিবডিগুলো নেওয়া হয়। আজ আমজাদকে তুমি যে এন্টিভেনম দিয়ে বাঁচালে সেটা আমার তৈরি। বাংলাদেশে এখন সাপে কাটার যে এন্টিভেনম পাওয়া যায় তা ভারত থেকে আসা, ওরাও এভাবেই বানায়। কিন্তু আমার এন্টিভেনম একদম এদেশের দেশীয় সাপের বিষ এর রেসপন্সে এন্টিবডি, তাই এটা বেশি কার্যকর।’
ডোরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো জনের কথাগুলো শুনছিল। এন্টিভেনম বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে ও অতটা জানত না। ও বিস্মিত গলায় বলে, ‘এ তো দারুণ ব্যাপার। এত বড় একটা কাজ তুমি করছ, আমাকে কখনও তুমি বলোনি তো?’
জন হাসে, বলে, ‘ভেবেছিলাম তোমাকে এনে দেখাব। তবে এটা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। বাণিজ্যিকভাবে শুরু করতে সময় লাগবে।’
ডোরার মনটা গর্বে ভরে যায়, জন এত উঁচু মানের একজন বিজ্ঞানী তা ওর ধারণাতেই ছিল না। কাল রাতে উল্টো ওর সম্পর্কে কীসব উল্টোপাল্টা ভাবল। ও খুব কৌতুহল নিয়ে বলে, ‘কী কী সাপ আছে তোমার এখানে, দেখি?’
জন উৎসাহের গলায় বলে, ‘ওই বিল্ডিংটায় চলো, ওখানে সাপগুলো রাখা।’
ডোরা এবার জনের একটা হাত শক্ত করে ধরে এগোয়। যদিও ওর ভয় করছে, তবুও ও এগিয়ে যায়। ছোট্ট একতলা পুরনো একটা বিল্ডিং। আশেপাশে কাউকে দেখা যায় না। ডোরা জিজ্ঞেস করতেই ও বলে, ‘আমজাদই আসলে এগুলো আপাতত সব দেখাশোনা করে। মূল কাজটা আমিই করি।’
ভেতরে ঢুকতেই একটা রুমের ভেতর কাচঘেরা জায়গায় সাপগুলো দেখতে পায়। দেখেই কেমন যেন একটা শিরশির অনুভূতি হয় ডোরার। জন এবার উৎসাহের সাথে বলে, ‘এটা কোবরা বা গোখরা, এটা ক্রেইট বা কেউটে বা শঙখিনী, এটা রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া। মূলত এই তিন ধরনের বিষাক্ত সাপ বেশি দেখা যায়।’
ডোরা নিশ্বাস বন্ধ করে কাচের ভেতর দিয়ে সাপগুলো দেখতে থাকে। শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগতে থাকে। আলতো করে বলে, ‘জন, বাইরে চলো।’
জন মাথা নাড়ে, তারপর ওকে নিয়ে বাইরে আসে। তারপর দু’জনে হেঁটে বাংলোতে চলে আসে। ডোরা আমজাদকে একটু দেখে যায়, লোকটা এখন ঠিক আছে।
দুপুরে খেয়ে ডোরা বলে, ‘জন, আমার দোলনা কই? তুমি না বলছিলে এখানে একটা গাছ থেকে ঝোলানো দোলনা আছে।’
জন হেসে বলে, ‘চলো, তোমাকে নিয়ে যাই।’
ওরা দু’জন হেঁটে হেঁটে একটা পুকুরের কাছাকাছি আসতেই ডোরা দেখতে পায় একটা বিশাল কড়ই গাছ, পুরো পুকুর পাড়টা ছড়িয়ে আছে ডালগুলো। একটা সুন্দর নৌকা ঘাটে বাঁধা। গাছের ডাল থেকে একটা দোলনা বাতাসে একা একাই হালকা করে দুলছে। দেখেই ডোরার খুব ভালো লেগে যায়। এক দৌড়ে ও দোলনায় উঠে বসতেই জন পেছন থকে ওর কাঁধে হাত রাখে। ডোরার সারা শরীর রিমঝিম করে ওঠে, একটা ভালো লাগা ছুঁয়ে যায়।
জন এবার আলতো করে ধাক্কা দিতেই ডোরা দুলে ওঠে। তারপর আরেকটু জোরে ধাক্কা দিতেই দোলনাটা সামনে অনেক দূর এগিয়ে যায়। জন আস্তে আস্তে ডোরার পিঠে ধাক্কাটা বাড়ায়। একসময় মনে হয় দোলনাটা আকাশে উঠে যাবে। ডোরা চোখ বন্ধ করে, মনে হচ্ছে ও যেন সেই ছোট্ট বেলায় ফিরে গেছে। দোলনাটা এমন করে দুলছে যে ডোরা একবার পুকুরের উপর কিছুটা যেয়ে আবার পেছনে ফিরে আসছে।
একটা সময় জন বলে, ‘তুমি একটু দোল খাও, আমি হাতের কিছু কাজ সেরে আসছি।’
ডোরা মাথা নেড়ে সায় দেয়। এই জায়গাটা ছেড়ে ওর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। ওর এখনই বলতে ইচ্ছে করছে ও জনকে বিয়ে করবে। আর বিয়ের পর ওর বাসরঘর এখানেই হবে।
ডোরা পা দিয়ে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে দুলতে থাকে। একটা ঠান্ডা বাতাস ওকে যেন ছুঁয়ে যায়। কেমন একটা ঘুম ঘুম আসছে। হঠাৎ একটা খসখস শব্দে ডোরা চমকে পেছন ফিরে তাকায়, অবাক হয়ে দেখে আমজাদ আলি দাঁড়িয়ে আছে, পায়ে গামছা বাঁধা এখনও।
ডোরা দোলনা থামিয়ে ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘আমজাদ, কিছু বলবেন?’
আমজাদ আশেপাশে একবার সতর্কতার সাথে তাকায়, তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘আফা, আপনি এখান থেকে পালাই যান। সাহেব কিন্তু আপনারে এইখানে আটকাই রাখার লাইগা নিয়া আসছে। এর আগেও তিনজন মাইয়ারে নিয়া আসছিল। তারা কেউ বাঁইচা ফেরত যায় নাই।’
কথাটা বলেই লোকটা আর দাঁড়ায় না, হনহন করে চলে যায়। ডোরা বিস্ফারিত চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে, লোকটা কী বলল! সাপের কামড় খেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! ডোরা ভ্রু কুঁচকে ভাবে, কিন্তু লোকটা হঠাৎ করে যেচে ওকে এ কথাগুলো বলল কেন?
এই যখন ভাবছে ঠিক তখন জনকে আসতে দেখা যায়। জন এর মাঝেই একটা কালো টি-শার্ট পরেছে। হাতের সুঠাম মাসলগুলো বের হয়ে আছে, সুন্দর লাগছে ওকে। ও ভেবেই পায় না, জন ওকে আটকে রাখবে কেন? ও তো নিজেই জনের কাছে সারা জীবনের জন্য আটকে থাকতে এসেছে।
জন কাছে আসতেই হেসে বলে, ‘আরও কিছুক্ষণ থাকবে? চলো বাংলোতে বসে চা খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখি।’
জনের এমন রোমান্টিক কথাতে ডোরার মনের সন্দেহের মেঘটা এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়। ও দোলনা থেকে নেমে জনের হাতটা ধরে, তারপর ওর গা ঘেঁষে বাংলোর দিকে হাঁটতে থাকে।
সন্ধ্যার সূর্য ডুবছে, দূর আকাশে একটা লাল লালিমা ছড়িয়ে পড়ছে। ডোরা গুটিশুটি মেরে জনের একদম কাছে চলে আসে। খুব ইচ্ছে করছে জনকে একটা চুমু খেতে।
জন ওর গালে একটা গরম নিশ্বাস পড়তেই পাশ ফিরে তাকায়, দেখে ডোরা মোহময়ী চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, উদ্দাম আহবান যেন ওর চোখে। ডোরা আড়চোখে একবার আশেপাশে তাকায়, নাহ এই নির্জন জায়গায় কেউ নেই যে ওদের দেখছে। এবার ও ঝাপিয়ে পড়ে জনের বুকে। দ্রুত নিশ্বাস পড়তে থাকে। জন দু’হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে। ডোরা এবার মুখটা উঁচু করে ছোট ছোট করে চুমু খেতে থাকে। একটা হাত দিয়ে জনের টি-শার্টের বোতাম খুলে বুকে চুমু খেতে যেয়েই একটা জিনিস দেখে ও থেমে যায়। সন্ধ্যার আধো আলোয় ও দেখে জনের বুকে তিনটা অদ্ভুত ট্যাটু আঁকানো, তিনটা মেয়ের মুখ। মুখগুলোতে আড়াআড়ি দাগ কাটা। হঠাৎ করেই আমজাদের কথা মনে পড়ে যায়, তিনটা মেয়ে নাকি এখানে এসে আর ফিরে যায়নি। কথাটা মনে হতেই ডোরা একটু সরে আসে, তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
জন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কোনো সমস্যা?’
ডোরা একটু চুপ থাকে, বলবে না ভেবেও বলেই ফেলে, ‘আচ্ছা, তোমার বুকে এমন তিনটা মেয়ের ট্যাটু কেন?’
জন একটু থমকায়, একটা পরিস্কার অস্বস্তি ওর চোখেমুখে ফুটে ওঠে। মাথা নেড়ে কোনোমতে বলে, ‘থ্রি ওম্যান নামে আমেরিকান লেখক লিসা ট্যাডের বইটা পড়ে খুব ভালো লেগেছিল। ২০১৯ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লিস্টে বইটা ছিল। বইটার সাথে মিলিয়ে শখের বশে করেছিলাম আর কি। আচ্ছা, তুমি একটু রেস্ট করো, আমি চারপাশটা একটু ঘুরে দেখে আসি।’
ডোরা মাথা নাড়ে। ব্যাখ্যাটা ওর কাছে সন্তোষজনক মনে হয় না। জন চলে যেতেই ও চুপ করে অন্ধকারে বসে থাকে। মনে কুডাক ডাকছে, কিছু একটা ঝামেলা আছে, কিন্তু সেটা কী ও ঠিক ধরতে পারছে না। আমজাদ লোকটা ওকে হঠাৎ করে কেন ওই কথাগুলো বলল? এমন কী হতে পারে ও আমজাদের জীবন বাঁচিয়েছে তাই লোকটা ওর জীবন বাঁচাতে চাইল? নাহ, ও কাল চলে যাবে এখান থেকে। এই জায়গাটায় ভীষণ গোলমেলে কিছু আছে। ভাবতে ভাবতে মাথাটা ধরে যায়, নিচে নেমে বাবুর্চি কালামকে এক কাপ কড়া করে কফি দিতে বলে।
একটু পর কালাম মিয়া কফি আনতেই ও হাত বাড়িয়ে কফিটা নেয়। লোকটার চেহারায় একটা নিষ্ঠুরতা আছে, ডোরা প্রথম দিনই খেয়াল করেছে। এমন কি আমজাদের মুখটাও রুক্ষ। এই একটা জায়গায় দু’জনের মিল আছে।
ডোরা কফিতে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বাহ, এত ভালো কফি কই পেলে?’
কালাম চলে যাচ্ছিল, ও থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘দারুল মিয়া আইজ শহরে গেছিল, কিছু জিনিসপত্র আনতে। স্যারে তো এইটা পছন্দ করে, তাই নিয়া আসছে।’
ডোরা চমকে ওঠে, বলে, ‘দারুল মানে ওই যে গেটে পাহারা থাকে, ও শহরে গিয়েছিল! কী করে? রাস্তা না পাহাড় চাপা পড়ে বন্ধ?’
কালাম মিয়া একটা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর একটাও কথা না বলে চলে যায়।
ডোরা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। জন ওর সাথে মিথ্যে বলেছে! কেন? মায়ের সাথে ওকে কী কথা বলতে দেবে না? ও তো কালই চলে যাবে, তখন? হঠাৎ আমজাদ মিয়ার একটা কথা মনে হতেই ওর সারা শরীর কেঁপে ওঠে, ওকে নাকি এখান থেকে যেতে দেবে না, মানে আটকে রাখবে? নাহ, মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কিন্তু একটা জিনিস পরিস্কার, সেই প্রথম থেকে জন ওকে বাড়িতে যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। উম, শুধু প্রথম দিন বাসায় একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল। তাও ওই জন। কথাটা ভাবতেই এবার ডোরা মোবাইলটা খোলে, সেদিনের সেই মেসেজটা পড়ে। হঠাৎ মেসেজের উপরে ছোট ছোট করে লেখা সময়টা দেখে, দুপুর ১.২১ মিনিট।
সময়টা দেখে ডোরা স্তম্ভিত হয়ে যায়। তারমানে ওরা যখন কাল সেই রেস্টুরেন্ট থেকে রওনা দিল তার ঠিক পর পরই জনের দেওয়া পানিটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওরা এখানে পৌঁছে বিকাল ৩টার পর। তখনও ও ঘুমে। এবং ঘুম থেকে উঠে ও ওর মোবাইল বন্ধ পেয়েছে। তারমানে, জন ইচ্ছে করেই ওর মাকে মেসেজটা আগেই দিয়েছিল, আর মোবাইলটা বন্ধ করে ফেলেছিল। কিন্তু কেন?
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ডোরার শীত শীত লাগে, জন কী ইচ্ছে করেই ওর মোবাইলটা অনেক আগেই বন্ধ করেছিল যাতে পুলিশ ওর মোবাইল ট্র্যাক করে ওর সন্ধান না পায়!! আর এজন্যই জন উজান ভাটি রেস্টুরেন্টে দাঁড়ায়নি যাতে সিসি ক্যামেরাতে ওরা ধরা না পড়ে!
আরেকটা কথা মনে হতেই ডোরার ভয়টা বেড়ে যায়, ও কী সত্যিই মৌলভীবাজারের কোনো একটা জায়গায় এসেছে? আসার সময় তো ও পুরো পথটা ঘুমিয়ে এসেছিল। যদি অন্য কোথাও ওকে নিয়ে আসে জন??
একটা আতংক এবার ওকে ঘিরে ধরে, অনেক গোলমাল আছে জনের মধ্যে। একে একে ওর সব পরিস্কার হতে থাকে, জন নিশ্চয়ই পানিতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রেখেছিল যাতে ও কোথায় যাচ্ছে এটা বুঝতে না পারে। আবার ওর মোবাইল ইচ্ছে করেই ওর এই গন্তব্যে পৌঁছার অনেক আগেই বন্ধ করা হয়েছে যা ও কাল ঘুমের জন্য খেয়াল করতে পারেনি। আর আজকের মিথ্যাটা তো ভাবার বিষয়, দারুল মিয়া যদি শহরে যেয়ে থাকে ওকে তাহলে জন মিথ্যা বলল কেন? হঠাৎ করেই ডোরার সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে, আমজাদ মিয়ার কথা মনে পড়ে যায়, লোকটা ওকে পালাতে বলেছিল।
ডোরা শক্ত করে চেয়ারের কাঠের হাতলটা খামচে ধরে, জোরে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে, ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ওকে পালাতে হবে, এবং সেটা আজ রাতেই!
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর