১.
ডোরা ব্যস্ত হাতে লাগেজটা গোছাচ্ছে, দু’জোড়া কেডস, ফতুয়া, জিন্স, উম একটা শাড়িও। শাড়িটা রাখতে যেয়ে মুখে একটা কোমল আলো খেলা করে সাথে একটু লাজুক হাসি। একবার দরজার দিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে দেখে, তারপর শাড়িটা লুকিয়ে ব্যাগে ভরে। মা যদি দেখে তাহলে হাজারটা প্রশ্ন করবে, ট্রেকিং করতে যেয়ে কেউ শাড়ি নেয় না। তাতে মা ঠিক বুঝে যাবে, ও আসলে ট্রেকিং করতে যাচ্ছে না। মাকে মিথ্যেটা বলত না, কিন্তু সেক্ষেত্রে জনের সাথে একা একা ঘুরতে ওকে যেতে দিত না কিছুতেই। জনের কথা মনে হতেই মনটা ভালো হয়ে যায়, ফেসবুকেই ওর সাথে পরিচয়। দারুণ লাগে জনকে, যেমন দেখতে সুন্দর, তেমন মনটাও ভালো।
কাল থেকে তিনদিনের টানা ছুটি, এটা জেনে আগেই ও জনের সাথে প্ল্যান করেছিল কোথাও ঘুরতে যাবে। তখন জনই ওকে বলেছিল ওর যে খামার আছে সেখানে যাওয়ার। তা ডোরার খুব আগ্রহ হয়েছিল ওর খামারটা দেখার। জায়গাটা মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী একটা জায়গায়। জন বলেছিল জায়গাটা সুন্দর আর সেইসাথে ওখানে নাকি ও কী কী নতুন আবিষ্কার করেছে যেটা দিয়ে ওর নতুন ব্যবসাটা চালু করবে। তা করুক, ডোরা জনের সান্নিধ্য পাবে এটা ভাবতেই শিহরণ হচ্ছে।
এবার ঘুরে এসেই মা বাবাকে ওর বিয়ের কথা বলবে। ওর প্রথম বিয়েটা ভেঙে যাবার পর বহুদিন বিয়ের নামই শুনতে পেত না। কিন্তু এখন জনকে দেখে ওর সাথে কথা বলে ও মত বদলেছে। মা নিশ্চয়ই খুশি হবে। জনের সাথে ঘুরতে যাবার এটাও একটা উদ্দেশ্য, কাছ থেকে মানুষটা আসলে কি রকম সেটাও জানা দরকার। এবার আর ও ঠকতে চায় না। একটাই চিন্তা, অত কাছে পেয়ে যদি ডোরাই নিজেকে সামলাতে না পারে! ভাবনাটা ভাবতেই ডোরা ঠোঁটটা কামড়ে মাথা নিচু করে ভাবতে থাকে।
ঠিক এমন সময় মনোয়ারা রুমে ঢুকেই কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘তোর এই ট্রেকিং এ যাওয়া আমার একদম পছন্দ না। সেবারও গেলি, পুরো একটা দিন তোর মোবাইল বন্ধ। অমন জায়গায় যাস কেন যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না। আর এদিকে আমি চিন্তায় মরি।’
ডোরা হাসে, মা জানে ও বান্দরবনে ট্রেকিং করতে যাচ্ছে। মাকে বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘আরে, ওসব জায়গা লোকালয় থেকে অনেক দূরে হয়, তাই মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না। আমি এবার মাঝে মাঝে মেসেজ দিয়ে জানাব। তুমি চিন্তা করো না মা।’
ডোরার কথায় আশ্বস্ত হতে পারেন না মনোয়ারা, একটা চিন্তা থেকেই যায়। প্রথম বিয়েটা ভেঙে যাবার পর মেয়েটা যেন কেমন হয়ে গেছে। কেমন হুটহাট একা একা ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ে। তা ও যদি এতে একটু ভালো থাকে, থাকুক।
মনোয়ারা নিশ্চিত হতে বলে, ‘তুই হাসপাতাল থেকে ছুটি নিছিস?’
ডোরা মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ মা, ছুটি নিয়েছি, তবে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এই তিনদিনের ছুটি দেখে সবাই ছুটি নেবার জন্য লম্বা লাইন দিয়েছে। সব ডাক্তার ছুটি নিলে হাসপাতাল চলবে কী করে? তাই আমার মতো সৌভাগ্যবান কয়েকজন ছুটিটা পেয়েছে।’
মনোয়ারা একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবেন, ছুটি না পেলেই ভালো হতো।
পরদিন ভোর সকালেই ডোরা বের হবার জন্য রেডি হয়। মা এই সকালেই নাস্তা বানিয়ে ফেলেছেন যদিও ডোরা না করেছিল। জোর করে ওকে খাইয়ে দেয়, বের হবার সময় দোয়া পড়ে ওর মুখে ‘ফু’ দেয়। তারপর কাছে টেনে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে, ‘সাবধানে থাকিস মা। কেন জানি বুকটা কেমন করছে, তোকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না।’
মায়ের এমন কথায় ডোরার মনটাও কেমন দূর্বল হয়ে যায়। মা ছাড়া যে আর কেউ নেই ওর এই পৃথিবীতে। মনটা নরম হয়ে আসে কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে ডোরা একটু বিরক্ত সুরে বলে, ‘যাবার সময় কী যে অলক্ষুণে কথা বলো। আমার কিছুই হবে না, তোমার দোয়া আছে না আমার সাথে।’
মনোয়ারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর বলে, ‘ইনশাল্লাহ, কিছু হবে না। সাবধানে আয় মা।’
ডোরা মাকে একটু জড়িয়ে ধরে, তারপর বেরিয়ে পড়ে। মোড়েই একটা সিএনজি পেয়ে যায়। উত্তরা থেকে তিনশ ফিটের মোড়, খুব বেশি দূরে না। ওখানেই জন গাড়ি নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। ওকে বাসার কাছ থেকেই উঠিয়ে নিতে চেয়েছিল, ডোরাই না করেছিল। অযথা মানুষের কৌতুহল বাড়িয়ে লাভ নেই। সিএনজিটা ছাড়তেই একটা অজানা আনন্দ টের পায় ডোরা, আহ, আগামী তিনটা দিন শুধু ও আর জন!
২.
জন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে, ৮.২১ বাজে। ডোরা এতক্ষণে চলে আসার কথা। ও মেসেঞ্জারে বের হবার কথা লিখেছে তাও আধাঘন্টা হয়ে গেছে। জন এবার লিখে, ‘কই আমার ডোরা, এখনও তাকে দেখি না কেন?’
সাথে সাথেই মেসেজ আসে, ‘একটু ডানপাশে তাকান মশাই।’
জন দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে তাকাতেই দেখে ডোরা একটা সিএনজি থেকে নামছে, গাঢ় নীল রঙের ফতুয়ার সাথে ফেডেড জিন্স, চোখে বড় গ্লাসের কালো রোদচশমা, পায়ে সুন্দর একটা আকাশি নীল কেডস। কী যে সুন্দর লাগছে ডোরাকে, একদম নীল পরী!
জন দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ডোরার লাগেজটা প্রথমে ওঠায়, তারপর হাতটা ধরে মৃদু হেসে ওকে গাড়িতে ওঠায়। জনের এই কেয়ারটুকু ভীষণ ভালো লাগে ডোরার। আড়চোখে খেয়াল করে জন সাদা কালো একটা শার্ট হাতা গুটিয়ে পরেছে সাথে গ্রে কালারের একটা প্যান্ট, কালো জুতো। দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছে ওকে।
জন ড্রাইভিং সিটে বসে ডোরার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘ভীষণ সুন্দর লাগছে তোমাকে। আমি আজ গাড়ি চালাব কী করে! পাশে বসলে যে তোমার দিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে।’
ডোরা দুষ্টুমি করে বলে, ‘তাহলে আমি পেছনে গিয়ে বসি?’
জন বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ে, ‘না না, তা হবে না। আমি যখন তোমার দিকে তাকাব তুমি তখন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে।’
ডোরা এবার চোখ পাকিয়ে বলে, ‘আমাকে দেখার অনেক সময় পাবে, এখন গাড়িটা মন দিয়ে চালাও দেখি।’
জন হেসে গাড়িটা ছাড়ে, সাথে পছন্দের সব গান। গাড়িটা ফাঁকা রাস্তায় আসতেই ডোরার মনটা একটা সুখে ভেসে যেতে থাকে। আকাশে বর্ষার কালো মেঘ, একটু পরেই হয়ত বৃষ্টি নামবে। জন মাঝে মাঝেই ওর হাত ধরছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে। ডোরার খুব ইচ্ছে করছে জনের গায়ে হেলান দিয়ে বসতে। কিন্তু ভাবনাটা প্রশ্রয় দেয় না, তাতে ওর গাড়ি চালানোতে মনোযোগ থাকবে না। অবশ্য এমনিতেও জনের অবস্থা খারাপ, একটু পর পরই ওর দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। ডোরা মিটিমিটি হাসতে থাকে। জীবনটা অনেক সুন্দর লাগে ডোরার। প্রিয় মানুষের সাথে এমন ভাবনাহীন ঘুরে বেড়ানোতে একটা আলাদা সুখ আছে।
ঠিক দুই ঘন্টা পর ভৈরব নদী পার হয়ে ওরা যখন উজান ভাটি রেস্টুরেন্টটা পার হয়ে যায় ডোরা হইহই করে ওঠে, ‘এখানে থামবে না? একটু নাস্তা করে নিতাম, সাথে একটু চা।’
জন হেসে বলে, ‘সামনে আরেকটা ভালো রেস্টুরেন্টে আছে, উজান ভাটির মতো এত পরিপাটি না, কিন্তু ওদের রান্না দারুণ।’
ডোরা মাথা নাড়ে, খাওয়া মজা হলেই হলো।
একটু পর ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টের সামনে জন গাড়িটা থামায়। ওকে হাত ধরে নামিয়ে ভেতরে গিয়ে বসে। ডোরা খেয়াল করে ওর ক্ষুধা পেয়েছে, সকালে ভালো করে খাওয়া হয়নি। দু’জনে এক বাটি মাংস আর গরম গরম পরোটা নিয়ে বসে। মুখে দিতেই টের পায় আসলেই খুব মজা তো। মাংসটা মুখে দিতে যেন গলে যাচ্ছে।
খেতে খেতে ও বলে, ‘জন, পানি নিয়ে নিও। পরোটা খেলে আমার একটু পর পর পানি পিপাসা পায়।’
জন মাথা নাড়ে, বলে, ‘আমার অবশ্য এমনিতেই অনেক পিপাসা পাচ্ছে। মানে তোমাকে দেখার পর থেকে।’
ডোরা হেসে চোখ পাকিয়ে বলে, ‘তাই, না। আচ্ছা, তোমার খামারে দোলনা আছে?’
জন আশ্বস্ত করে বলে, ‘একদম বড় কড়ই গাছ থেকে ঝোলানো দোলনা আছে।’
ডোরা হাত তালি দিতে গিয়েও থেমে যায়, তারপর ফিক করে হেসে নিচু গলায় বলে, ‘শুধু এর জন্য তোমাকে ভালোবাসা যায়।’
জন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে ডোরার দিকে।
গাড়িতে উঠেই ডোরা এবার হেলান দিয়ে জনের গা ঘেঁষে বসে। মিষ্টি একটা শ্যানেল-৫ এর ঘ্রাণ ভেসে আসছে। জন ঘ্রাণটা বুকে পুরে গাড়িটা ছাড়ে। কিছুদূর চলার পর ডোরা আলতো করে বলে, ‘জন, পানি দাও। খাব।’
জন বাঁ হাতে স্টিয়ারিংটা ধরে ডান হাতে ডোর পকেট থেকে একটা বোতল বের করে ডোরার দিকে বাড়িয়ে দেয়। বোতলটার মুখ খোলা। একটু ইতস্তত করতেই জন একবার তাকায়, তারপর হেসে বলে, ‘আমি খেয়েছিলাম, তোমার খেতে অসুবিধে হবে?’
ডোরা জোরে মাথাটা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আরে নাহ।’
বলেই ঢকঢক করে অনেকখানি পানি খেয়ে ফেলে। তারপর মুখটা মুছে বোতলটা ওর পাশেই রেখে দেয়। গাড়ি এখন একশ কিলোমিটার বেগে চলছে। জনের গাড়িটা খুব আরামদায়ক, টিনটেড গ্লাস, বাইরের রোদটা গায়ে পড়ে না, আবার দেখাও যায় না। ডোরার কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ও জনের গায়ে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করে।
৩.
ডোরার যখন ঘুম ভাঙে তখন ও টের পায় চারদিক কেমন নিঝুম, গাড়িটা চলছে না। ঘুম ঘুম চোখে ও জনের দিকে তাকাতেই নরম গলায় বলে, ‘ঘুম ভাঙল?’
ডোরা এবার জেগে ওঠে, চোখ কচলে দেখে সামনে একটা সুন্দর বাংলো, পাশে একটা মাঠের মতো, এক পাশে উঁচু টিলার মতো। ও ঠিক বুঝতে পারে না ও ঠিক কোথায়। এলোমেলো গলায় বলে, ‘আমরা কোথায়?’
জন হেসে বলে, ‘আমরা এখন মৌলভীবাজার, আমার খামারে।’
ডোরা চোখ কপালে তুলে, ‘কী বলো! আমি এতক্ষণ ঘুমিয়েছি? ক’টা বাজে এখন?’
জন যে হাতে ঘড়ি সে হাতটা বাড়িয়ে দিতেই ডোরা আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে, বিকাল তিনটা বাজে! ও কিছুতেই মেলাতে পারে না, এতক্ষণ ঘুমিয়েছে ও! এমন করে যাত্রাপথে ও তো কখনও এমন ঘুমায় না।
লজ্জিত গলায় বলে, ‘তুমি আমাকে ডাকোনি কেন? এখানে এসেছি কতক্ষণ?’
জন ঠোঁটটা কামড়ে বলে, ‘উম, তাও আধাঘন্টা।’
এবার ডোরা আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘ইশ, তুমি এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছ কখন আমার ঘুম ভাঙবে? আর আমি স্বার্থপরের মতো ঘুমাচ্ছি?’
জন গাঢ় গলায় বলে, ‘তোমার ঘুমিয়ে থাকা মুখটা দেখতে দারুণ লাগছিল। আর সেই সাথে মায়া হচ্ছিল, তুমি আরাম করে ঘুমুচ্ছিলে।’
এরপর আর কথা বাড়ায় না ডোরা, দ্রুত নেমে পড়ে। একজন লোক এসে ওদের লাগজগুলো নিয়ে যায়। ডোরা হাতব্যাগটা খুলে মোবাইলটা বের করে, মাকে ফোন করে জানাতে হবে। সেই রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় একবার কথা হয়েছিল।
মোবাইলটা বের করতেই ও অবাক হয়ে খেয়াল করে ওর মোবাইলটা বন্ধ। ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবে, ওর যতদূর মনে পড়ে ও তো মোবাইলটা বন্ধ করেনি। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। মাথা নেড়ে ও মোবাইলটা অন করতেই খেয়াল করে স্ক্রিনে ‘নো নেটওয়ার্ক’ দেখাচ্ছে। এবার ও দিশেহারা বোধ করে। নেটওয়ার্ক নাই এখানে!
কথাটা জানাতেই জন বিব্রত গলায় বলে, ‘আসলে এই জায়গাটা অনেক ভেতরে তো, এদিকে নেটওয়ার্ক নেই। এখান থেকে বারো কিলোমিটার দূরে মূল রাস্তার ওখানটায় গেলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এই জায়গার এই একটাই সীমাবদ্ধতা। আর বাকি সব তোমার মন মতো পাবে।’
ডোরা এবার চারপাশে ভালো করে তাকায়, কী নির্জন! গাছগাছালিতে ভরা চারদিক, উঁচু উঁচু টিলা। সবুজ সবুজ কমলা গাছ। এই বাংলোটাও একটা টিলার উপর। বর্ষাকাল বলে চারদিক আরও বেশি সবুজ, সুন্দর। সবই সুন্দর, কিন্তু বাসায় যে ওর একটা ফোন করা দরকার।
কথাটা বলতেই জন বলে, ‘চিন্তা করো না, রাতে তোমাকে আমি নিয়ে যাব, যেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। তখন বাসায় জানিয়ে দিও। আপাতত ফ্রেশ হয়ে নাও, তোমাকে আমার ফার্মটা ঘুরে দেখাই।’
ডোরা ঘাড় কাৎ করে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। জন নিজে এসে ওকে ওর রুম দেখিয়ে দেয়। রুমে ঢুকতেই ডোরার মনটা ভালো হয়ে যায়। পেছনের দিকে ব্যালকনি দিয়ে তাকালে অনেক দূর পর্যন্ত ঘন বনের মতো। একটা সবুজ যেন ওর চোখে প্রশান্তি এনে দেয়।
জন ওর দিকে তাকিয়ে আদর গলায় বলে, ‘তুমি গোসল করে নাও, তারপর একটু খাবে।’
কথাটা বলে জন দরজাটা ভেজিয়ে বের হয়ে যায়। ভালো লাগে ডোরার, জন ইচ্ছে করলে এই নির্জনে ওকে একা রুমে পেয়েই জড়িয়ে ধরতে পারত, কিন্তু তা করেনি। ব্যাপারটা ওর ভালো লাগে।
ডোরা সময় নিয়ে গোসল করে। টাওয়ালটা মাথায় পেচিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়। কেমন একটা ক্লান্তি চেপে ধরেছে। আশ্চর্য হয়ে ভাবে, এখনও ওর ঘুম পাচ্ছে! এতটা রাস্তা ঘুমিয়ে এসে আবার ঘুম পাচ্ছে? বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে ডোরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
৪.
ভীষণ ক্ষুধা নিয়ে ডোরার ঘুম ভাঙে। কেমন অন্ধকার চারদিক, কোথায় ও? চোখটা সয়ে আসতেই ওর সব মনে পড়ে যায়। মায়ের কথা মনে হতেই ধড়ফড় করে ও ওঠে পড়ে। মোবাইলটা হাতড়ে খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু পায় না। চিন্তিত মুখে দরজা খুলে নিচে নামতেই জন উদবিঘ্ন গলায় বলে, ‘তোমার ঘুম ভাঙল? অনেক ঘুমিয়েছ, রাত দশটা বাজে।’
ডোরা অবাক হয়ে যায়, এতক্ষণ আবার ঘুমাল ও! তারপর তাড়াহুড়ো গলায় বলে, ‘জন, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো বাইরে। মাকে ফোন দেব। এখানে তো নেটওয়ার্ক নেই।’
জন ওকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আসলে এত রাতে এই পাহাড়ি এলাকায় বের হওয়া নিরাপদ না। আমি সন্ধ্যার দিকে বাইরে গিয়েছিলাম একটা কাজে, তখন তোমার মোবাইল নিয়ে গিয়েছিলাম, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই আর ডাকিনি। আমিই একটা মেসেজ দিয়ে দিয়েছি। এই যে তোমার মোবাইল।’
ডোরা প্রথমে অবাক হয়, তারপর বিরক্ত হয়ে মোবাইলটা নেয়, দেখে সত্যিই মাকে একটা মেসেজ দেওয়া হয়েছে, ‘মা, আমি ঠিকঠাক পৌঁছাতে পেরেছি। এখানে নেটওয়ার্ক নেই।’ নামটা মা নামেই সেভ করা আছে, আর কল লিস্টে প্রথমেই ছিল, তাই হয়ত জন পেয়েছে। কথাটা ভাবে ডোরা।
ডোরা মেসেজটা দেখে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, তাও তো জন বুদ্ধি করে মেসেজটা দিয়েছে। কিন্তু মনে মনে একটা খুঁতখুঁত থেকেই যায়। মায়ের সাথে কথা হলো না।
জন এবার ওকে নিয়ে খেতে বসে। ঝাল ঝাল বন মোরগ, সবজি, ঘন ডাল, অমৃতের মতো স্বাদ হয়েছে। একজন মাঝবয়েসী কুক ওদের খাবারটা দেয়। ডোরা বহুদিন পর এতগুলো খাবার খায়।
আহ, শান্তি। ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছিল। খাওয়া শেষে যে লোকটা খাবার দিচ্ছিল সে প্লেটগুলো সরিয়ে নেবার সময় হঠাৎ করেই হাত থেকে একটা প্লেট পড়ে ভেঙে যায়। লোকটা কেঁপে ওঠে একবার জনের দিকে তাকায়, তারপর দ্রুত ভাঙা প্লেটটা কুড়িয়ে নিয়ে যায়। ডোরা ভ্রু কুঁচকে একবার জনের দিকে তাকায়, ওর মুখটায় একটা নিষ্ঠুরতা দেখে যা এতদিন দেখেনি। ডোরাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যায়, তারপর বলে, ‘দেখেছ, কী ক্যালাস লোক।’
ডোরা কিছু বলে না, ও মাথা নাড়ে। মনে মনে ভাবে, একটা প্লেট ভেঙে যাওয়াতে জনের মুখটা অমন নিষ্ঠুরের মতো হয়ে গেল কেন!
এবার ওরা দু’জনে বাংলোর বারান্দায় চা নিয়ে বসে। বাংলোটা আশ্চর্য রকম নীরব। অবশ্য নীরবতাটা ভালো লাগছে, বিশেষ করে জন পাশে থাকাতে। কিন্তু জনও এখন কেমন যেন চুপচাপ।
রাত বাড়তেই ডোরার ঘুম পেতে থাকে। ও বিদায় নিয়ে ওর রুমে এসে ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে পড়ে।
গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে আজকের দিনের তিনটা অসঙ্গতি নিয়ে ভাবে – এক, রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে গাড়িতে ওঠার পর থেকেই ও ঘুমুচ্ছে। কখনও এমন হয়নি।
দুই, ঘুম থেকে উঠে ও ওর মোবাইলটা সুইচ অফ পেয়েছে। অথচ ওর পরিস্কার মনে আছে ও মোবাইলের সুইচ অফ করেনি।
তিন, জন নাকি নিজেই ওর মোবাইলটা নিয়ে গিয়েছিল যেখানে নেটওয়ার্ক আছে, সেখান থেকে ওর মায়ের নাম্বারে মেসেজ করেছে। কাজটা ভালোই করেছে, কিন্তু ওকে ডাকল না কেন?? ও যতই ঘুমুক।
হঠাৎ করেই ওর আতংক হতে থাকে, জনকে কতটা বিশ্বাস করা যায়? জন কী ইচ্ছে করে কোনোভাবে ওর খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল? কিন্তু কেন? ঘুমিয়ে যাবার আগে ওর মনে হয়, আচ্ছা দরজাটা কী বন্ধ করা আছে?
(চলবে)
#ভয়ংকর নির্জন পর্ব ১
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর