#ভয়ংকর নির্জন পর্ব ৩
১.
ডোরার বুকটা ভয়ে কাঁপছে। জনকে নিয়ে ওর ভাবনাটা এখন সত্যি মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এখানে ও একদম নিরাপদ না। ওকে যদি জন মেরেও ফেলে তাহলেও কেউ জানবে ওর কথা। এখন ওর একটা জিনিস সন্দেহ হয়, জন ওকে মোবাইল নাম্বারে ফোন খুব কম দিত। বেশিরভাগ সময় মেসেঞ্জারে কল করত। এমনকি আসার দিনেও মেসেঞ্জারেই কথা হয়েছে। এসব তাহলে ওর প্ল্যানের অংশ ছিল! কিন্তু এমন কেন করবে, ও কি একজন সাইকোপ্যাথ? হরর মুভির মতো কাউকে দীর্ঘদিন আটকে রেখে নির্যাতন করে সুখ পায়, জন কি এমন কেউ?
ডোরা অস্থির হয়ে বাংলো থেকে বের হয়ে আসে। জন এখনও ফিরে আসেনি। চারপাশে একবার দেখে নেয়৷ অল্প কিছু বাতি জ্বলছে। ডোরা হাঁটতে হাঁটতে মেইন গেটটার কাছে আসে। দারুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ডোরা একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বুকের ধুকপুকটা কমায়, তারপর কাছে এসে স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘গেটটা খোল তো, একটু বাইরে হাঁটতে যাব।’
দারুল গম্ভীরমুখে বলে, ‘স্যারের পারমিশন ছাড়া বাইরে যাওয়া নিষেধ।’
ডোরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, দারুলের চোখমুখে একটা কাঠিন্য দেখা যায়। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল, কালো মোটা ঠোঁট, পাথুরে চোখের চাউনিতে ওকে এখন নিষ্ঠুর লাগছে। ও গেটের সামনে দুই হাত ভাঁজ করে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। ডোরা স্পষ্ট বুঝতে পারে ওকে কোনো অবস্থাতেই এই লোক বাইরে যেতে দেবে না।
ডোরা কিছু না বলে এবার খামারটার চারপাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। পুরোটা খামার উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এখান থেকে বের হতে হলে এটা টপকে বের হতে হবে। ডোরা অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখতে থাকে, কোথাও পাঁচিল ভাঙা আছে কিনা। কিন্তু জায়গাটা এত বড়, আর এত অন্ধকার যে খুব একটা কিছু দেখা যাচ্ছে তাও না।
ডোরা একটু পায়ের পাতা উঁচু করে সামনের পাঁচিলটা দেখার চেষ্টা করছিল ঠিক তখন ও কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পায়, চমকে ওঠে পেছন তাকায়।
জন কেমন একটা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে একটু রুক্ষ গলায় বলে, ‘তুমি এখানে কী করছ? আমি সারা বাংলোয় খুঁজে খুঁজে হয়রান।’
ডোরা ভয় পেয়ে যায়, তোতলানো গলায় বলে, ‘না, তোমার আসতে দেরি দেখে একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম।’
জন গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আমাকে না বলে আসা উচিত হয়নি। সাপখোপ আছে, আর রাতের বেলা কত কী ঘুরে বেড়ায়।’
ডোরা মাথা নাড়ে, যেন বুঝতে পেরেছে এমন গলায় বলে, ‘সত্যিই ভুল হয়ে গেছে।’
তারপর জনের সাথে বাংলোতে যাবার পথে পা বাড়ায়। ডোরা নিচু গলায় বলে, ‘জন, আমার এখানে মন টিকছে না। আমি কাল চলে যাব। তোমার কাজ থাকলে কিছুদিন থাকো, আমাকে শুধু মেইন রাস্তায় নামিয়ে একটা বাসে উঠিয়ে দিলেই হবে।’
জন ঝট করে ওর দিকে ঘুরে তাকায়, তারপর ঠান্ডা গলায় বলে, ‘তুমি হঠাৎ চলে যেতে চাইছ কেন? একটু আগেও তো ঠিক ছিলে। আর মেইন রোডে যাবার রাস্তাটা এখনও ঠিক হয়নি। ওরা বলেছে আরও কয়েকদিন লেগে যাবে। আপাতত এখানেই থাকতে হবে।’
শেষ কথাটা বেশ জোরের সাথেই বলে জন।
ডোরা কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। জন ওর সাথে মিথ্যা বলছে, রাস্তাটা যে বন্ধ না তা তো সন্ধ্যাতেই ও জানল। এবার আর সন্দেহ থাকে না, জন ওকে এক প্রকার বন্দিই করে রেখেছে। এমনকি এই বাংলো থেকে ও যাতে বের হতে না পারে তা দারুলকেও বলে রেখেছে। একটা অজানা ভয়ের শীতল স্রোত ডোরার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। জন ধীরে ধীরে ওর খোলস ছেড়ে বের হচ্ছে। একটা জিনিস ও বুঝতে পারে ও যতদিন চুপচাপ সব মেনে নেবে ততদিন হয়ত ও কিছু করবে না। কিন্তু এভাবে তো থাকা অসম্ভব। ডোরা সিদ্ধান্ত নেয়, আজ ও পালাবেই এই জায়গা থেকে।
সেদিন রাতে ওরা দু’জন চুপচাপ খেয়ে নেয়। ডোরা চেষ্টা করেও স্বাভাবিক থাকতে পারে না। জন ওকে বাংলোর বারান্দায় ডেকে নিয়ে বসায়, তারপর চা খেতে খেতে ওকে একটা হাতে জড়িয়ে কাছে টানে। এই প্রথম জনের সান্নিধ্য ওর একটুও ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ পর ডোরা জনের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে অস্বস্তির সাথে বলে, ‘জন, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি একটু ঘুমাতে যাই।’
জন শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তারপর সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
ডোরা চেষ্টা করে স্বাভাবিক থাকতে, কিন্তু কেন জানি ওর পা কাঁপছে। রুমে আসার এইটুকু পথ আসতেই ওর যেন মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। জনের চাহনি, কথা বার্তায় ধীরে ধীরে একটা কর্তৃত্ব ফুটে উঠছে।
ডোরা রুমে এসে ভালো করে দরজাটা বন্ধ করে। তারপর ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করতে যেতেই হঠাৎ একটা জিনিস মনে হয়। প্রথম যেদিন আসে, সেদিন এদিকটা যতদূর চোখ যায় ও গাছ গাছালিতে ভরা দেখেছে, কোনো উঁচু পাঁচিল চোখে পড়েনি। একটু ভাবে, এই দিকটা বাংলোর পেছনের দিক, পালাতে হলে এদিকটায় নিরাপদ। শুধু এই দোতলা থেকে নামাটা রিস্কি। ডোরার অবশ্য এর আগে ট্রেকিংয়ে যাবার অভিজ্ঞতা আছে। একটা গাছ বেয়ে ও নেমে যেতে পারবে। একটাই সমস্যা, অন্ধকার হাতড়ে সামনে যাওয়া।
ডোরা মনে মনে প্ল্যানটা করে ফেলে। মোবাইলটা ফুল চার্জ দিয়ে রাখতে হবে। আর ভালো একটা কেডস, জিন্সের প্যান্ট পরে নিতে হবে। সাপের ভয় আছে। একটা লাঠির মতো কিছু নিতে পারলে ভালো হতো। যদি রাত দুটো সময় ও নামে তাহলে ভোর ছয়টা, মোট চার ঘন্টায় ষোলো কিলোমিটারের বেশি পাড়ি দিতে পারবে। তাতে ও নিশ্চয়ই মোবাইলের নেটওয়ার্ক এর আওতায় চলে আসবে। সবার আগে ৯৯৯ এ ফোন দিতে হবে। ডোরা নাম্বারটা কল করে ডায়াল লিস্টে এনে রাখে। নেটেওয়ার্ক পাওয়া মাত্রই ফোনটা করতে হবে। অবশ্য এটা নিশ্চিত ও জানে না যে মেইন রোডটা কোনদিকে।
ডোরা অপেক্ষা করতে থাকে, কখন রাত গভীর হবে।
২.
রাত দুটো বাজতেই ডোরা সন্তর্পণে ব্যালকনিতে আসে। প্রথমে বাতিটা বন্ধ করে, তারপর পকেটে হাত দিয়ে একবার নিশ্চিত হয়ে নেয় মোবাইলটা পকেটে আছে কি না। এরপর পাশের ব্যালকনিতে তাকায়, অন্ধকার। জন নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডোরা নিশ্চিত হবার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসে। আকাশে আজ গতকালের চেয়ে জ্যোৎস্নার আলো কম, অবশ্য এতে একদিকে সুবিধেই হয়েছে।
ডোরা ব্যালকনিতে ঝুঁকে রেলিংটা টপকায়, তারপর লোহার রডগুলো ধরে বসে পড়ে, ধীরে ধীরে পা দুটো নামিয়ে দিয়ে ঝুলে পড়ে। নিচে ঘাস আছে, আগেই দেখে রেখেছিল। এবার হাত দুটো আলগা করে দিতেই ঝপ করে নিচে পড়ে, মড়াৎ করে একটা মড়া ডাল ভাঙার শব্দ হয়। ডোরার মনে হয় যেন বোমা ফাটার শব্দ হলো। বুকটা কেঁপে ওঠে, দ্রুত একবার জনের রুমের দিকে তাকায়, নাহ, অন্ধকার।
পায়ে একটু ব্যথা পেয়েছে, ডোরা নিশ্বাস বন্ধ করে ব্যথাটা সামলায়, তারপর দ্রুত উঠে সামনের দিকে এগোতেই হঠাৎ একটা আলো এসে পড়ে। বুকটা ধক করে ওঠে ডোরার, পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে জনের রুমে আলো জ্বলছে, সর্বনাশ! তারমানে শব্দটা জন পেয়েছে। এখনই ও দরজা খুলে বারান্দায় আসবে। ডোরা পাগলের মতো চারপাশে একটা ঘন ঝোপ খোঁজে। সামনেই একটা ঘন ঝোপ দেখে তার ভেতরে ঢুকে পড়ে, টের পায় হাত, মুখ ছড়ে যাচ্ছে কাঁটার আঘাতে।
ডোরা নিশ্বাস বন্ধ করে দেখে জনের বারান্দার দরজাটা খুলে গেল, বারান্দার লাইট জ্বেলে জন দ্রুত রেলিঙে ঝুঁকে নিচের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। একবার ডোরার রুমের দিকে তাকাতেই ডোরা আতংকিত হয়ে মনে করার চেষ্টা করে ও কী ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে এসেছিল? ঠিক মনে করতে পারে না।
জন এখনও চোখ কুঁচকে ওর রুমের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। এবার জন দ্রুত রুমের ভেতর যায়। হায় খোদা এখনই তো জন ওর রুমে ধাক্কা দেবে। ওর সাড়া না পেলেই তো সন্দেহ করবে।
ডোরা দ্রুত ভাবতে থাকে। জন যদি ব্যালকনি দিয়ে ওর রুমে ঢোকে তাহলে ও একটুও সময় পাবে না। আর যদি ও মেইন দরজা দিয়ে ঢুকে তাহলে দরজার লক ভাঙতে কিছুটা সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে ও কিছুটা হলেও সময় পাবে।
ডোরা লম্বা একটা করে নিশ্বাস নেয়, তারপর ঝুঁকি নিয়েই ও ঝোপ থেকে বের হয়ে দৌড় শুরু করে। কিন্তু আধো অন্ধকারে খুব দ্রুত এগোনো যায় না। হাত মুখ সব ছড়ে যাচ্ছে।
কতক্ষণ ছুটেছে ডোরা মনে করতে পারে না, শুধু এটুকু বোঝে ওর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, পানি পিপাসা পেয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে একটা জায়গায় এসে বসে। তারপর পকেট থেকে ছোট্ট একটা পানির বোতল বের করে। ভাগ্যিস এই পানিটুকু সাথে করে নিয়ে এসেছিল। এক চুমুকে অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে নেয়। মোবাইলটা খুলে সময় দেখে, হতাশ হয়ে ও খেয়াল করে মাত্র এক ঘন্টা হয়েছে ও পালিয়েছে! আর সবচেয়ে বড় হতাশাজনক ব্যাপার হলো ও এখনও মোবাইলের নেটওয়ার্কে এসে পৌঁছাতে পারেনি। আরও অনেক দূর যেতে হবে ওকে। একটাই বাঁচোয়া, এই জঙ্গলে কোনো বন্য পশু নেই, অন্তত এখন পর্যন্ত চোখে পড়ে নাই ওর। ডোরা অবশ্য একটা ডাল ভেঙে লাঠি বানিয়ে নিয়েছে যাতে কিছু আসলে অন্তত একটু হলেও প্রতিরোধ করতে পারে।
ডোরা এবার দ্রুত মোবাইলের স্ক্রিনটা অফ করে যাতে দূর থেকে আলো দেখা না যায়। কান পেতে বোঝার চেষ্টা করে কেউ পিছু পিছু আসছে কি না। নাহ কেউ আসছে না।
ডোরা উঠে দাঁড়াতেই স্থির হয়ে যায়, কয়েক জোড়া সবুজ চোখ জ্বলজ্বল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্বাসটা বন্ধ হয়ে যায়, এগুলো বন্য প্রাণি। ডোরা দ্রুত মনে করার চেষ্টা করে কোন প্রাণির চোখ রাতের অন্ধকারে এমন সবুজ হতে পারে। ক’দিন আগেই একটা আর্টিকেলে ও পড়ছিল। ভালুক বা প্যান্থার যে না সেটা নিশ্চিত। ওদের চোখ অন্ধকারে হলুদ বা সোনালী রঙের হয়। সবুজ চোখ হয় শিয়ালের। কথাটা মনে পড়তেই ডোরার শরীরটা ভয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শিয়াল এমনিতে মানুষ দেখলে ভয়ে আড়ালে চলে যায়। কিন্তু দলবদ্ধ শিয়াল ভয়ংকর হতে পারে, যেকোনো মুহুর্তে আক্রমণ করতে পারে। ডোরার যতদূর মনে পড়ে এসব ক্ষেত্রে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, আর পশুগুলির যাওয়ার পথটা ছেড়ে দিতে হয়।
ডোরা লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে একটা গাছের কোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। খেয়াল করে সবুজ বিন্দুগুলো ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসছে। ডোরা দম বন্ধ করে গাছের সাথে লেপ্টে দাঁড়ায়, হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরে রাখে। নিজেকে সাহস দেয়, একটুও নাড়াচাড়া করা যাবে না, তাতে এরা এদের পথে চলে যাবে।
শিয়ালগুলো ওর কাছে এসে থামে, জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে থাকে। ডোরার বুকে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। ও একবার গাছটার উপরে তাকায়, একটা ডাল নিচে নেমে আছে, লাফিয়ে ধরা যাবে।
শিয়ালগুলো বিপদজনকভাবে ওকে ঘিরে ঘুরছে এখন। হঠাৎ একটা শিয়াল ঝাপ দেয়, ডোরা আতংকে চিৎকার করে ওঠে, হাতের লাঠিটা সর্বশক্তি দিয়ে চালায় পশুটার উপর। তীক্ষ্ণ একটা শব্দ করে শিয়ালটা সরে পড়ে। অন্যান্য শিয়ালগুলো থেমে যায়। পাগুলো টান টান করে চোখা সরু মুখগুলো বাগিয়ে ওর দিকে হিংস্র মুখে তাকিয়ে আছে। তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে।
এরা ঝাপিয়ে পড়বে।
ডোরা আর দেরি করে না, হাতের লাঠিটা জোরে সামনের শিয়ালটার দিকে ছুড়ে মেরেই দুই হাত দিয়ে লাফিয়ে গাছের ডালটা ধরে ঝুলে পড়ে। শিয়ালগুলো এবার নিচ থেকে লাফিয়ে ওর ঝুলে থাকা পায়ের নাগাল পাবার চেষ্টা করে। ডোরা বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, দুই হাতের উপর চাপ দিয়ে পা দুটো একটু কোণাকুণি উঠিয়ে গাছের গায়ের উপর জোরে চাপ দিয়ে ধরে। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে পা দুটো টেনে হিঁচড়ে ডালটার উপর ওঠায়। ডোরা দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ডালটা ধরে তার উপর লম্বা হয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। এখন এরা নাগাল পাবে না। বুকটা হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে, ডোরা টের পায়।
শিয়ালগুলো নিচ থেকে তীক্ষ্ণ শব্দে চেচিয়ে যাচ্ছে। ডোরা ঠোঁট কামড়ে ভাবে এরা তো ওকে ধরিয়ে দেবে। আবার ওকে যদি এই গাছেই থাকতে হয় তাহলে তো ও সকালে ধরাই পড়ে যাবে। কী করা যায়? এগুলোকে তাড়ানো যায় কী করে? হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। ডালটা বেয়ে বেয়ে ও গাছটার মোটা কান্ডের কাছে এসে হেলান দিয়ে বসে। তারপর সাবধানে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে খোলে, একটা অডিও ফাইল বের করে। কিছুদিন আগে একজন মজা করে কুকুরের ঘেউঘেউ ডাক পাঠিয়েছিল। শিয়াল যে কুকুর ভয় পায় এটা ও জানে। মোবাইলের সাউন্ড পুরো বাড়িয়ে এবার অডিওটা ছাড়ে। একটা ম্যাজিক হয়, শিয়ালগুলো হঠাৎ করেই থেমে যায় তারপর ধীরে ধীরে পিছু হটেই দৌড় লাগায়। একটু পর এদের আর দেখা যায় না। ডোরার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে, স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে।
ডোরা গাছের উপর থেকে অন্ধকারে চারপাশে চোখ বোলায়, নাহ, এখন আর কোনো সবুজ চোখ দেখা যাচ্ছে না। দূরে গাছের উপর এক জোড়া লাল চোখ দেখা যায়। ডোরা জানে এটা পেঁচার চোখ, রাতে এদের চোখ লাল দেখায়। এদের ভয় নেই। ডোরা এবার একটু ঝুলে পা টা নামিয়ে দিয়ে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে নেমে পড়ে।
নাহ, অনেকখানি সময় নষ্ট হয়ে গেল। হাতে সময় খুব কম। শিয়ালের ডাক যদি জনের কানে গিয়ে থাকে তাহলে খুঁজে খুঁজে ঠিক চলে আসবে। জনের কথা মনে হতেই বুকটা কেঁপে ওঠে। লম্বা একটা নিশ্বাস নেয় ডোরা, স্বাভাবিক হতেই ও আবার উঠে পড়ে। তারপর আবার ছোটা শুরু করে।
আরও কিছুক্ষণ ছোটার পর ডোরা হঠাৎ করেই একটা পাঁচিলের সামনে এসে থামে। ডোরা ভীষণ অবাক হয়, ও এতক্ষণ দৌড়ে মাত্র এই ফার্মের দেয়াল অবধি এসেছে? তার মানে কী পেছনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ওর ফার্ম? নাকি ও অন্ধকারে একই জায়গাতেই ঘুরেফিরে দৌড়িয়েছে? জংগলের ভেতর এমন হয়, দেখা যায় ঘুরেফিরে একই জায়গায় দিকভ্রান্তের মতো ঘুরছে। আর রাতের বেলা তো আরও বেশি। নাকি এটা অন্য কোনো ফার্মের পাঁচিল?
ডোরা আর ভাবে না, দ্রুত দেয়ালটার কাছে এসে খুঁজে পেতে একটা ছোট গাছ বের করে। তারপর গাছটায় উঠতে যেয়েই টের পায় ভেজা গাছে উঠতে গিয়ে বারবার জুতো হড়কে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর গাছটাতে উঠে ও এবার একটা ডাল ধরে দাঁড়িয়ে পাঁচিলটার উপর জোরে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে ঝুলে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে প্রথমে ডান পা টা পাঁচিলের উপর উঠিয়ে আরেকটা পা উঠাতে যেতেই হঠাৎ পেছনে একটা সড়সড় আওয়াজ শুনতে পায়। ঠিক সেইসাথে ওর ঝুলে থাকা বাম পায়ে কেউ শক্ত হাতে ধরে হ্যাঁচকা টান মারে।
ডোরা তীব্র আতংকে একটা চিৎকার দেয়, তারপর প্রাণপণে পা টা ছাড়ানোর চেষ্টা করে। এর মাঝে ডান পাটাও নেমে এসেছে। ডোরা ডান পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করে। কিন্তু নিচ থেকে টেনে ধরাটা সুবিধাজনক, আর যে লোকটা ধরেছে সে খুব শক্তিশালী। ডোরা পারে না, একটা সময় পাঁচিল চেপে ধরা হাত দুটো দূর্বল হয়ে আসে, ধপাস করে উঁচু পাঁচিল থেকে পড়ে যায়।
এই প্রথম একটা হিসহিস গলা পাওয়া যায়, ‘আমার এখান থেকে কেউ পালিয়ে যেতে পারেনি। তুমিও আর কোনোদিন এখান থেকে বেরোতে পারবে না। পুলিশও কোনোদিন খুঁজে পাবে না।’
ডোরা মাটিতে পড়েই ব্যথায় ককিয়ে ওঠে, কোমরে জোর লেগেছে। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে আধো অন্ধকারে জনের মুখটা দেখার চেষ্টা করে। দারুল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘স্যার, এই ম্যাডাম বাইরে যাইতে চাইছিল, আমি দেই নাই।’
জন এবার মুখটা ডোরার কাছে এনে হিংস্র গলায় বলে, ‘আমার আজ সন্ধ্যা থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল তুমি পালানোর চেষ্টা করছ। দারুলকে গেট খোলার কথা জিজ্ঞেস করেছিলে আর সেটা দারুল আমাকে পরে বলেছিল। আর ওই বাবুর্চি গাধাটা বলেছে যে শহর থেকে কফি নিয়ে আসার। ওরে শাস্তি দিয়েছি। বেশি না, একটা সাপ ওর গায়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম। বেচার ভয়ে প্রস্রাব করে দিয়েছে। সাপের চার পাঁচটা কামড় খেয়েছে। অবশ্য আমার এক্সপেরিমেন্ট এর এন্টিভেনম দিয়ে এসেছি, বাঁচতে পারে আবার নাও পারে। কিন্তু তুমি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে বিরাট ভুল করেছ। এবার আমার আসল রূপ তুমি দেখবা।’
ডোরার সারা মুখের রক্ত কেউ যেন শুষে নিয়েছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা চলছে জনের কথা শুনে। লোকটা একটা সাইকো! ও একটা সাইকোর পাল্লায় পড়েছে। ওকে বন্দি করে ওর উপর নির্যাতন চালাবে? সেটা কী ধরনের নির্যাতন? একটা ভীষণ ভয়ংকর ভাবনা মাথায় আসতেই ও কুঁকড়ে যায়। ভুলেও ও এই ভাবনাটা ভাবতে চায় না। ও মরে যেতে রাজি আছে কিন্তু ওই কাজটা যেন ওর সাথে না হয়!
ডোরা এবার শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে আকুল গলায় বলে, ‘জন, প্লিজ আমাকে যেতে দাও। আমার মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তুমি কেন আমার সাথে এমন করছ? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি।’
জন শীতল গলায় বলে, ‘আমার ক্ষতি করবে তুমি! কী করে? আমার ক্ষতি কেউ করতে পারে না। আমিই তোমাকে এমন শাস্তি দেব যাতে কোনোদিন এই ফার্ম হাউস থেকে পালানোর কথা মাথায়ও না আসে।’
ডোরা কেঁপে ওঠে ওর কথায়। ও কিছুতেই বুঝতে পারে না জন আসলে কেন এমন করছে ওর সাথে? আর ওর সাথের এই লোকগুলো, এরাও কী মানসিকভাবে অসুস্থ?
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর