ইলমা বেহরোজ
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়ে জাওয়াদের চাপা পায়ের শব্দে। বাড়ির অন্য সবাই হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু জাওয়াদের ঘরে জ্বলছে একটা ম্লান আলো, যার রঙিন ছায়া পড়েছে মেঝেতে ছড়ানো জিনিসপত্রের ওপর। একে একে সব কিছু ব্যাগে ভরছে সে।
রাইহার জন্যই এই বাড়িতে তার আগমন। এখন রাইহার জীবনে এসেছে নতুন সূর্যোদয়। বাবা সব সত্য জেনে স্বীকৃতি দিয়েছে তার অস্তিত্বকে। জাওয়াদের কাঁধ থেকে নেমে গেছে একটা বিশাল দায়িত্বের বোঝা।
এখন নিজের মুক্তির পালা।
বাইরে থেকে দেখলে এই বাড়িটা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু জাওয়াদের কাছে এটা একটা সোনার পিঞ্জর। এ বাড়িতে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মানুষ কখনো বিনা কারণে নিজের আশ্রয় ছেড়ে যায় না। যখন বাড়ির দেয়ালগুলো অশান্তির ছায়া বিস্তার করে, তখন মানুষ পালাতে চায় দূরে, অনেক দূরে।
রাতের অন্ধকারে ব্যাগ হাতে দরজার দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় জাওয়াদ। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে গুলনূরের মুখ। সেই ভীত চোখ দুটো, থরথর করে কাঁপা ঠোঁট, অসহায় চাহনি। মনির এখন গুলনূরের গ্রামে। কাল সকালে নিশ্চয়ই কিছু খবর পাওয়া যাবে। হয়তো জানা যাবে গুলনূরের সাথে কী ঘটেছে, কেন তার চোখে ছিল সেই ভয়।
জাওয়াদের হাত থেকে ব্যাগটা যেন নিজে থেকেই নেমে আসে। এক রাতের জন্য আর কী এমন ক্ষতি? একটা রাতের অপেক্ষায় হয়তো জানা যাবে গুলনূরের জীবনের সব কিছু। হয়তো সে সাহায্য করতে পারবে। না, আজ রাতে যাওয়া নয়।
ধীরে ধীরে পা ফেরায় জাওয়াদ। হাঁটতে থাকে নিজের ঘরের দিকে। জানালার বাইরে তারাখচিত আকাশ। নীরব রাত্রি। শুধু দূরে কোথাও একটা পেঁচা ডাকছে।
হঠাৎ করে সামনে পড়ে যাওয়া একটি ছায়ামূর্তি দেখে তার পা থমকে দাঁড়ায়। চোখ সরে যায় সেদিকে। কয়েক হাত দূরেই গুলনূর, যার প্রতিটি চলনে, প্রতিটি ভঙ্গিতে একটা অদ্ভুত মোহ আছে। অন্য সবার থেকে কেমন যেন আলাদা।
গুলনূরের মাথায় সাদা রঙের ওড়না। জাওয়াদকে দেখে সে তৎক্ষণাৎ কুর্নিশ করে। তার চোখ দুটো নত, কপালে চিন্তার ভাঁজ।
জাওয়াদ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তার দিকে।
“তোমার জন্যই আমি যেতে পারিনি। পালাতে পারিনি।” জাওয়াদের কণ্ঠস্বরে একটা গভীর আবেগ, “তোমার চোখের করুণ চাহনি আমাকে আটকে রেখেছে।”
কথাটি শুনে গুলনূরের চোখে একটা চমক খেলে যায়। ধীরে ধীরে সে মুখ তোলে। সরাসরি তাকায় জাওয়াদের দিকে। তার চোখে ভয় নয়, বিস্ময়। সেই চাহনিতে প্রশ্ন। কেন? কেন সে থেকে গেল? কেন তার কথা ভাবছে?
জাওয়াদ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। রাতের নিস্তব্ধতায় মিলিয়ে যায় তার পায়ের শব্দ।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আকাশের তারাগুলো একে একে মুছে যেতে শুরু করেছে। পূর্ব দিগন্তে সূর্যের আগমনী বার্তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। জমিদার বাড়ির প্রাচীন প্রাসাদটি এখনো নিস্তব্ধতার গভীর আবরণে ঢাকা। কেবল দূরে কোথাও একটা ভোরের পাখি ডাকছে মৃদু সুরে।
জুলফার চোখে সারা রাত ঘুম আসেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বারবার কানে বেজেছে নাভেদের কথাগুলো – “আপনি যদি আমার সঙ্গী হন, তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।”
জমিদার বাড়ির বউ হয়ে আসার পর থেকে তার জীবন সোনার খাঁচায় বন্দি এক পাখির মতো। প্রতিদিন একই রকম নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। কিন্তু আজ সকালে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও, সে সেই খাঁচা থেকে মুক্তি চায়।
নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠল জুলফা। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল আয়নার সামনে। হালকা নীল রঙের শাড়িটা বের করল আলমারি থেকে। এই শাড়িটা পরলে তার গায়ের রং আরও ফর্সা দেখায়। সে শাড়িটি ধুতির মতো পরল। গলায় পরল সেই সোনার হারটা, যা শব্দর দিয়েছিল প্রথম দিন। আর কানে পরল নাভেদের দেওয়া দুল জোড়া। এলোমেলো চুলগুলো খুলে রাখল পিঠের ওপর। কপালে পরল একটি ছোট্ট নীল টিপ। তারপর আয়নায় নিজেকে দেখে মৃদু হাসল।
রান্নাঘরের পাশের ঘরটায় লুকিয়ে আছে একটা গোপন দরজা। এই দরজার অস্তিত্ব জানে শুধু জমিদার পরিবারের কয়েকজন। শব্দরই দেখিয়েছিল জুলফাকে এই গোপন পথ। জানিয়েছিল যে এই সুরঙ্গ দিয়ে সোজা বনে বেরিয়ে যাওয়া যায়। একসময় বিপদে পড়লে জমিদাররা এই পথেই পালিয়ে যেতেন।
দেয়ালের প্যানেল সরাতেই বেরিয়ে এল ভ্যাপসা গন্ধ। অন্ধকার সিঁড়িগুলো নেমে গেছে অতল গহ্বরের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে একবার উপরের দিকে তাকাল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এখনই ফিরে আসবে। শুধু কিছুক্ষণের জন্য। একবার নাভেদের ঘোড়ায় চড়বে, তারপর আবার ফিরে আসবে তার সোনার খাঁচায়।
সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল জুলফা। চারদিকে নিকশ কালো অন্ধকার। হাত বাড়িয়ে দেয়াল স্পর্শ করে করে পথ খুঁজে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে বাদুড়ের ডানার ঝাপটা লাগছে গায়ে। কোথাও কোথাও সিলিং থেকে টুপটাপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে। তার হৃদয়ে তীব্র উত্তেজনা। কয়েক ঘণ্টার জন্য সে ভুলে যেতে চায় তার পরিচয়, তার সামাজিক বন্ধন। একবারের জন্য নিজের মনের মতো করে বাঁচতে চায়।
হঠাৎ করেই কানে এল মানুষের কথাবার্তার শব্দ। জুলফার পা থমকে যায়। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। এই নির্জন সুড়ঙ্গে আবার কারা কথা বলছে? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল জুলফা। পায়ের শব্দ যাতে না হয়, সেজন্য পা টিপে টিপে হাঁটছে। সুড়ঙ্গের বাঁক ঘুরতেই অস্পষ্ট আলোর রেখা চোখে পড়ে। ভোরের আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে কোনো ফাটল দিয়ে। সেই আবছা আলোয় দুটি ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে।
জুলফার বুক শুকিয়ে গেল। একজনকে চিনতে পারল সে, বাড়ির বড় বেগম ললিতা। কিন্তু আরেকজন কে? লোকটার পরনে গেরুয়া রঙের লম্বা পোশাক, চোখে অদ্ভুত এক চাহনি। তান্ত্রিক! জুলফা একবার দেখেছিল এমন এক তান্ত্রিককে গ্রামের মেলায়।
“সব ঠিক হয়ে যাবে, বেগম সাহেবা। আপনি শুধু পূর্ণিমার রাতে একটি কালো মোমবাতি জ্বালাবেন। বাকি সব আমি দেখে নেব।” তান্ত্রিকের কর্কশ গলা।
ললিতা বেগমের গলায় উদ্বেগ, “কিন্তু…”
“না, না, আপনি কিছু জানতে চাইবেন না। যত কম জানবেন, তত ভালো। শুধু মনে রাখবেন, পূর্ণিমার রাত। কালো মোমবাতি।”
জুলফার মনে প্রশ্নের ঝড় ওঠে। কী হতে চলেছে? কী এই রহস্যময় পরিকল্পনা? এখন এসব ভাবার সময় নেই। তার হৃদয় টানছে অন্য দিকে – বনের ধারে, যেখানে নাভেদ অপেক্ষা করছে।
সে আবার পা টিপে টিপে পিছিয়ে এল। সুড়ঙ্গের বাঁক ঘুরে আবার সেই অন্ধকার পথে। মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। বড় বেগম কী করতে যাচ্ছে? কাকে বলবে? কীভাবে বলবে? আর বললেই বা কে বিশ্বাস করবে তার কথা?
কিন্তু এই মুহূর্তে তার কাছে সবচেয়ে বড় সত্য হলো নাভেদ। তার প্রতীক্ষা। বনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটি। যার জন্য সাহস করে বেরিয়ে এসেছে সোনার-খাঁচা থেকে।
সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে এসে জুলফা একবার থমকে দাঁড়াল। পিছনে ফেলে আসা রহস্যময় কথোপকথন, সামনে অপেক্ষমান নাভেদ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আজ তার কাছে প্রেম বড়, ভালোবাসা বড়। বাকি সব পরের কথা।
ভোরের আলো এখন আরও স্পষ্ট। বনের দিক থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। জুলফা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল। আজ সে শুধু নাভেদের। শুধু ভালোবাসার। বাকি সব চিন্তা আজ থাক অন্য একদিনের জন্য।
বনের শেষ প্রান্তে ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিল নাভেদ। জুলফাকে আসতে দেখে তার চোখ থমকে গেল। সকালের মৃদু বাতাসে জুলফার নীল শাড়ির আঁচল উড়ছে, এলো চুল নাচছে হাওয়ায়। কানের দুলে লেগে সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে। মেয়েটা সত্যি সুন্দর! ভোরের নরম আলোর মতো!
জুলফা লাজুক পায়ে এগিয়ে আসছে। মাথা নিচু করে, চোখের কোণে চাহনি। প্রতিটি পদক্ষেপে একটা ছন্দ, একটা সুর। নাভেদ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছে। দেখছে কীভাবে ভোরের আলো জুলফার গায়ের রঙে মিশে গিয়ে এক অপূর্ব আভা তৈরি করেছে।
“আপনি এসেছেন…” নাভেদের কণ্ঠে বিনম্র বিস্ময়। “সত্যি আসবেন, ভাবিনি।”
জুলফা কিছু বলল না। শুধু আঁচলটা সামলে নিল। তার মুখে লজ্জার আভা।
“এত ভোরে আপনাকে কষ্ট দিলাম।” নাভেদ একটু ইতস্তত করে বলল।
“না… না… কোনো কষ্ট হয়নি,” জুলফার কন্ঠে মৃদু কম্পন। “আমি তো রোজই এই সময় উঠি।”
“আপনি কি কখনো হাওরের সূর্যোদয় দেখেছেন?” নাভেদের চোখে উৎসাহ।
জুলফা মৃদু হেসে বলল, “না।” অথচ সে হাওরের সূর্যোদয় দেখেই বড় হয়েছে।
“আজ দেখবেন।” নাভেদের চোখে উৎসাহ। “সূর্য উঠলে হাওরের জলে যে আলোর খেলা শুরু হয়, তা দেখার মতো। প্রতিদিন একই দৃশ্য, কিন্তু প্রতিদিন নতুন।”
ঘোড়াটি এতক্ষণ মাথা নিচু করে ঘাস খাচ্ছিল। নাভেদ আলতো করে তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “ও বড় শান্ত স্বভাবের।”
“আসুন,” তার দৃষ্টিতে একটা নরম আমন্ত্রণ।
জুলফা এক পা পিছিয়ে গেল। তার বুকের ভেতর টিপ্-টিপ্ করছে। মনের ভেতর একটা অজানা ভয়, একটা মিষ্টি উত্তেজনা।
“ভয় পাবেন না,” নাভেদ মৃদু হেসে বলল। “আমি আছি। আপনার পাশে।”
জুলফার মুখ লাল হয়ে উঠল। সে আঁচলটা আরও শক্ত করে ধরল।
“প্রথমবার সবাই ভয় পায়,” নাভেদ ধীরে ধীরে বলল। “আমিও প্রথম যেদিন চড়েছিলাম, সেদিন আমার বাবা ধরে ছিলেন।”
জুলফার চোখে একটু সাহস ফিরে এল। নাভেদ হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “হাঁটুতে পা রাখুন। তারপর আস্তে আস্তে উঠুন।”
জুলফা পিছিয়ে গেল, “না… না… আমি…” তার কণ্ঠে সংকোচ। নাভেদের গায়ে পা রাখা – এ তো অসম্ভব।
নাভেদ উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। কাছেই একটা ছোট টিলা ছিল। “আসুন,” সে জুলফাকে সেদিকে নিয়ে যায়। “এখান থেকে সহজে উঠতে পারবেন।”
জুলফা টিলার দিকে তাকায়। এটা অনেক বেশি সহজ মনে হলো তার কাছে। নাভেদ আশ্বস্ত করল, “আমি ঘোড়াটাকে ধরে থাকব। আপনি টিলার ওপর থেকে আস্তে করে বসুন।”
নাভেদ ঘোড়াটাকে টিলার পাশে নিয়ে যায়। এখন ঘোড়ার পিঠ আর টিলার উচ্চতা প্রায় সমান সমান।
“এখন অনেক সহজ, তাই না?” নাভেদ মৃদু হেসে বলল।
জুলফা লজ্জা পেল। নাভেদ তার সংকোচ বুঝতে পেরেছে। তার মধ্যে কোনো বিদ্রূপ নেই, বরং একটা সহানুভূতিশীল বোঝাপড়া আছে।
“হ্যাঁ…” জুলফা মৃদু স্বরে বলল। টিলার ওপর উঠে সে সাবধানে ঘোড়ার পিঠে বসল।
নাভেদও লাফিয়ে ঘোড়ায় উঠে বসে। তার শরীরের উষ্ণতা জুলফার পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে জুলফার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।
“সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসুন,” নাভেদ নরম স্বরে বলল। “আর দুই পাশে পা শক্ত করে রাখুন।”
ঘোড়াটা যখন আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করে, তখন ভোরের আকাশে সূর্যের প্রথম আভাস দেখা যায়। দূরে হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে সূর্যের প্রথম আলো পড়ে নানা রঙের খেলা শুরু করেছে। কখনো সোনালি, কখনো রূপালি আভা ছড়িয়ে পড়ছে জলের বুকে।
ঘোড়ার ছন্দে ছন্দে দুজনের শরীর দুলছে। নাভেদের বুকের স্পন্দন জুলফার পিঠে লাগছে, আর সেই স্পর্শে জুলফার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। দুজনের শরীরের ছন্দ এমনভাবে মিলে যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে তারা যেন একই সুরের দুটি তান।
“ওই দেখুন,” নাভেদ জুলফার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল। তার নিশ্বাসের উষ্ণ ছোঁয়া জুলফার কানের লতিতে লাগল। “সূর্য উঠছে। দেখুন কেমন লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশ জুড়ে।”
জুলফার মনে হলো সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। তার বুকের ভেতর দ্রুত স্পন্দন হচ্ছে, সেটা কি শুধুই ঘোড়ার ক্ষুরের তালে? নাকি তার নিজের হৃদয়ের উত্তাল কম্পন?
“ভয় লাগছে না তো?” নাভেদ আবার জিজ্ঞেস করল।
“না,” জুলফা এবার অনেকটা সাহস নিয়ে বলল। “এখন আর না।”
ঘোড়াটা এবার হাওরের পথ ধরে পুষ্পনদীর দিকে দ্রুত এগোতে লাগল।
সতেরো মাইলের পথ শেষ হতে হতে তারা পৌঁছে গেল হাওরের শেষ প্রান্তে। সতেরো ফুট নীচে পুষ্পনদীর প্রবল স্রোত, আর নদীর চারদিকে অফুরন্ত সবুজ। জুলফা ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল। তার চোখে জল।
“এত সুন্দর!” জুলফা মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছে।
নাভেদ কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে করে বলল, “আজ সকালের হাওয়াটা অন্যরকম। কেমন যেন একটা সুরভি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে…”
জুলফা মৃদু হেসে বলল, “হাওয়া তো সবসময়ই বয়…”
“কিন্তু আজকের হাওয়ায় ফুলের গন্ধ পাচ্ছি।” সে জুলফার দিকে তাকাল, “জানেন, কখনও ভাবিনি, নীল রঙের এত রূপ থাকতে পারে! আকাশে এক নীল, জলে আরেক নীল, আর আপনার শাড়িতে… সবচেয়ে সুন্দর নীল।”
জুলফা এবার একটু ঘুরে দাঁড়াল। “আপনি কবিতা লেখেন নাকি?”
“না,” নাভেদ মৃদু হাসল, “তবে কেউ কেউ আছে, যারা মানুষকে কবি বানিয়ে দেয়।”
দুজনই চুপ হয়ে যায়, তাদের দৃষ্টি জলের দিকে। নদীর কলতান ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই চারপাশে। দুটি মানুষ, নাভেদ আর জুলফা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নদীর তীরে, দুজনের মাঝে দূরত্বের একটি অদৃশ্য দেয়াল। সময়ের বালি ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে। জুলফা ভাবছে, এই মুহূর্তটা আর ফিরে আসবে না। তাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে। তার চোখের কোণে জমা হয় অশ্রুবিন্দু।
নাভেদ লক্ষ্য করল জুলফার চোখের সেই করুণ ছায়া। তার কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল গভীর অনুভূতি, “দেখুন পুষ্পনদীর এই অবিরাম স্রোতধারা। কত পাথর, কত বাধা, তবু থেমে যায় না। এগিয়ে চলে অবিরত…”
জুলফা করুণ স্বরে বলল, “কিছু বাধা এমন হয় নাভেদ সাহেব, যা পেরোনো যায় না। যা ভেঙে ফেলা যায় না…”
নাভেদ তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখাল একটি উড়ন্ত পাখি, “ওই পাখিটাকে দেখুন। আকাশে কোথাও কোনো পথ আঁকা নেই, তবু সে উড়ে যায় যেখানে তার মন চায়। জীবনের বাধা একটা নিয়ম হতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের নিয়ম সম্পূর্ণ আলাদা।”
“সমাজের বেড়াজাল পাখির পাখা ভেঙে দেয়…”
“কিন্তু মনের পাখা? সমাজ কি মনের পাখা ভাঙতে পারে? যে হৃদয় শুধু যন্ত্রণায় ভরে আছে, সেই হৃদয় কি চিরকাল বন্দী হয়ে থাকবে?”
জুলফা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে তার অন্তরের দ্বন্দ্ব।
নাভেদ আবার নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই জল শত বছর ধরে বয়ে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে নতুন জল আসে, নতুন সুর বাজে। পুরনো বেদনা ভুলে নতুন করে বাঁচতে শেখে। জীবনও তাই। প্রতি মুহূর্তে নতুন সম্ভাবনার জন্ম নেয়।”
জুলফার চোখে আশার আলো।
নাভেদ এবার সরাসরি জুলফার দিকে তাকিয়ে বলল, “জীবন অনেক ছোট, জুলফা। এই ক্ষণিক জীবনে শুধু অভিনয় করে যাওয়া, নিজের হৃদয়কে মিথ্যার বোঝা বহন করতে বাধ্য করা, এটাই কি জীবনের উদ্দেশ্য? এই বিশাল প্রকৃতির সামনে মানুষের তৈরি ছোট্ট বেড়াগুলো কতটুকু? আপনার চোখের জলের প্রতিটি ফোঁটায় যে বেদনা লুকিয়ে আছে, তা কি কেউ বোঝে? আপনার হৃদয়ের গভীরে যে আগুন জ্বলে, তার দহন কি কেউ অনুভব করে?”
জুলফা এবার সোজা তাকাল নাভেদের চোখে। সে জিজ্ঞেস করল, “কী বলতে চাইছেন?”
“আমি শুধু বলছি, এই ছোট্ট জীবনে নিজের সুখ খুঁজে নেওয়া পাপ নয়। পাপ হল নিজের হৃদয়কে মিথ্যার বোঝা বহন করতে বাধ্য করা।”
নাভেদ তার কথা শেষ করে ভাবছে, তার কথাগুলো কি জুলফার হৃদয়ে পৌঁছেছে? প্রভাবিত হচ্ছে? সে কি বুঝতে পেরেছে যে জীবনের সত্যিকারের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় শুধু নিজের হৃদয়ের কথা শুনলে? জুলফার চোখে জ্বলে ওঠা আলো দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো সে বুঝেছে।
নাভেদ তার ঘোড়ার কাছে গিয়ে ঝুলানো চামড়ার ব্যাগটা নামায়। ব্যাগ থেকে বের করে একটা মাটির সুরাহি আর ছোট কাপড়ে মোড়ানো একটা পুঁটলি। ফিরে এসে জুলফাকে নিয়ে একটা গাছের শিকড়ে বসে।
“আপনাদের বাড়ির কূপের জল। অনেক পথ পাড়ি দিয়েছেন, একটু জল খান,” বলে সুরাহি থেকে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিল একটা পেয়ালায়।
জুলফা ধীরে ধীরে পেয়ালাটা হাতে নিল। অনেকক্ষণ নীরবে থেকে, জলের স্পর্শে নিজেকে প্রশান্ত করে সে হঠাৎ নাভেদের দিকে ফিরল।
“আপনাকে প্রায়ই একা দেখি। কখনো ভেবেছেন নিজের সংসার নিয়ে? বিয়ে-টিয়ে?”
নাভেদ অবাক হলেও একটু হেসে কথাটা নিল। চোখে-মুখে বিস্ময় মিশ্রিত কৌতুক, “আমি? আমার আবার বিয়ে কোথায়? অনেক বছর তো একাই আছি।”
জুলফা একটু ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু আপনার বয়স তো… মানে, পরিবার থেকে কেউ বলে না? চাপ দেয় না?”
“আসে বৈকি। আম্মা প্রায়ই বলেন,” একটু থেমে গিয়ে আবার শুরু করল, “কিন্তু কী জানেন, মনের মতো মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন।”
“কেমন মানুষ খুঁজছেন?”
নাভেদ নদীর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল, “এমন একজন, যার চোখে স্বপ্ন থাকবে… যার হৃদয়ে থাকবে গভীর ভালোবাসা। যে শুধু দায়িত্ব নয়, অনুভূতি বোঝে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পাশে থাকবে, সুখে-দুঃখে সঙ্গী হবে…” একটু থেমে হাসল, “পেলে তো এক পায়ে খাড়া, সঙ্গে সঙ্গে কবুল বলে দেব।”
জুলফার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, “কবুল… আমি তো কবুল বলিনি কখনো…”
নাভেদ একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “এখনকার দিনে অনেকে তো টিপসই দিয়েই… মানে, কবুল না বললেও…”
“আমি… আমি সেটাও করিনি। কিছুই মনে নেই আমার।”
নাভেদের কপালে চিন্তার রেখা ফুটল। “তাহলে বিয়েটা কীভাবে হলো? আপনি কি…”
জুলফা তখন অন্য কোথাও। অতীতের সেই রাতে। চোখ বুজে ধীরে ধীরে বলল, “শুধু মনে আছে, বিয়ের লাল শাড়ি পরানো হচ্ছিল। তারপর সব অন্ধকার… জ্ঞান ফিরে শুনলাম বিয়ে হয়ে গেছে…”
নাভেদ চমকে তাকায়। এ আবার কোন চমক! তার মাথায় একটা ভয়ঙ্কর চিন্তা খেলে গেল। জুলফা কি তবে নিজের অজান্তেই কারো রক্ষিতা?
“জুলফা,” নাভেদ সাবধানে শব্দ বেছে নিল, “আপনি কি কখনো খোঁজ নিয়েছেন, সেই বিয়েটা আইনি ছিল কি না?”
“বিয়ে তো বিয়েই, আইনি আবার কী?” জুলফার কণ্ঠে বিস্ময়, “আমি… আমি তো কিছুই জানি না এসব নিয়ে। শুধু জানি, হঠাৎ একদিন জমিদার বাড়ির বউ হয়ে উঠলাম। এখন আছি তাদের বাড়িতে।” একটু থেমে তিক্ত হাসি ফুটল তার ঠোঁটের কোণে, “লোকে বলে ভাগ্যবতী… জমিদার বাড়ির বউ হওয়া আমার ভাগ্য।”
চলবে…