বারান্দায় পায়চারি করছিলেন সুফিয়ান ভুঁইয়া। তার হাতের লাঠিটি মাঝে মাঝে মেঝেতে ঠুকে উঠছিল, সেটাই তার অস্থিরতার প্রতিধ্বনি। বৃদ্ধের চোখে উদ্বেগের কালো মেঘ জমেছে, আর মুখের প্রতিটি রেখায় গভীর চিন্তার ছাপ।
হঠাৎ দূর থেকে একটি গাড়ির ইঞ্জিনের গুঞ্জন ভেসে এল। সেই শব্দে বিদ্যুৎ খেলে গেল সুফিয়ানের শরীরে। তিনি ঝুঁকে পড়লেন বারান্দার রেলিং-এর ওপর, চোখ দুটো কুঁচকে তাকালেন দূরের পথের দিকে। একটি চকচকে গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাদের বাড়ির দিকে। সুফিয়ানের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার মতো ধক্ ধক্ শব্দ শুরু হয়। তিনি লাঠি ঠুকতে ঠুকতে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন। প্রতিটি ধাপে তার পা কাঁপছিল, শুধু মনের জোরে তিনি এগিয়ে চললেন।
গাড়িটি এসে থামল বাড়ির সামনে। দরজা খুলে প্রথমে নামল একজন তরুণ। তার পিছনে একজন তরুণী। যুবকটিকে দেখেই সুফিয়ানের চোখ ছলছলিয়ে উঠল, “জাওয়াদ!” নাম ধরে ডাকতেই তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এল আবেগে।
সুফিয়ান ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। তার বুড়ো শরীরটা কাঁপছে। “জাওয়াদ! এতদিন কোথায় ছিলি বাবা?”
জাওয়াদের মুখে কোনো আবেগের ছাপ ফুটল না। সে শুধু শান্ত স্বরে বলল, “আমি ভালোই আছি।”
বাবার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে জাওয়াদ পিছনে তাকাল। সুফিয়ান তখন লক্ষ্য করলেন জাওয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত তরুণীকে। মেয়েটির চোখে-মুখে একটা অস্বস্তি। সুফিয়ান প্রশ্ন করলেন, “ও কে?”
জাওয়াদ একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, “ও আমার বন্ধু রাইহা। আমরা কয়েকদিনের জন্য এসেছি। আপনি চিন্তা করবেন না।”
এই বলে জাওয়াদ রাইহার হাত ধরে টেনে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। সুফিয়ান দাঁড়িয়ে রইলেন বাইরে পাথরের মূর্তির মতো। তার মুখে ছড়িয়ে পড়ল গভীর হতাশা আর বিষাদের ছায়া। কেন এমন ব্যবহার করল তার ছেলে?
বাতাসে ভেসে আসা ফুলের সুগন্ধ হঠাৎ তিক্ত লাগে সুফিয়ানের কাছে। তিনি ধীরে ধীরে ফিরে চললেন বাড়ির দিকে।
বাড়ির ভেতরটা থমথমে, নীরবতায় ভরা। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে দোতলার সিঁড়ি থেকে একটা তীব্র চিৎকার ভেসে এল, “জাওয়াদ! আমার বাবা!”
ললিতা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সিঁড়ি থেকে প্রায় ছুটে নামতে লাগল। তার চোখে-মুখে উন্মাদনার ছাপ, বাতাসে উড়ন্ত মেঘের মতো চুলগুলো এলোমেলো। সে পাগলিনীর মতো ছুটে এসে জাওয়াদকে জড়িয়ে ধরল।
“বাবা আমার, কোথায় ছিলি এতদিন? তোর জন্য কত কেঁদেছি, কত ডেকেছি!” ললিতার কণ্ঠে কান্নার সুর। তার চোখে জল ঝরছে, সেই জলের ফোঁটাতেও আনন্দের রঙধনু ফুটে উঠেছে। সে জাওয়াদের মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, নিশ্চিত হতে চাইছে যে এটা সত্যিই তার হারানো ছেলে, কোনো স্বপ্ন নয়।
জাওয়াদ মায়ের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিল। তার মুখে কোনো আবেগের ছাপ নেই, চোখে শুধু বিরক্তি। সে যেন একটা অচেনা দ্বীপে এসে পড়েছে, যেখানে তার কোনো আগ্রহ নেই। “মা, থামুন। আমি ভালোই আছি।” তার কণ্ঠস্বরে শীতলতা।
ললিতা হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। তার চোখে বিস্ময় আর অবিশ্বাস, “কি হয়েছে তোর? এভাবে কথা বলছিস কেন?”
জাওয়াদের চোখে কোনো আবেগ নেই, “কিছু হয়নি। আমি বড় হয়েছি, নিজের জীবন নিজে চালাতে শিখেছি। আপনারা অযথা চিন্তা করছেন।”
ললিতা আবার ছেলের চোখেমুখে হাত বুলাতে থাকেন। তার চোখ বেয়ে খুশিতে অশ্রু ঝরছে। তিনি জাওয়াদের বুকে মাথা রেখে কাঁদেন, “বাবা, আমার বাবা।”
জাওয়াদ মাকে সরাতে গিয়েও সরাল না। তবে হাত তুলে জড়িয়েও ধরল না। সে একটা পাথরের মূর্তি হয়ে আছে, যার মধ্যে কোনো স্পন্দন নেই।
ললিতা আরও আবেগমাখা কণ্ঠে বলল, “বাবা, কোথায় ছিলি এতদিন? আমরা কত খুঁজেছি তোকে। পুলিশে খবর দিয়েছি, সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি।”
জাওয়াদ শীতল কণ্ঠে উত্তর দিল, “রাজধানীতে ছিলাম, মা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম।”
ললিতার হৃদয় উচ্ছ্বসিত আনন্দে ভরে উঠেছে। সে তার হারানো রত্নকে ফিরে পেয়েছে। তাই উৎফুল্ল হয়ে দাসীদের ডেকে বলল, “শোনো গো, আজ আমার বাবা ফিরে এসেছে। তাই খাসা খানার আয়োজন করতে হবে।”
সে উচ্চস্বরে ঘোষণা করল, “আজ রান্না হবে পোলাও, কালিয়া, দই-ইলিশ, চিংড়ি মালাইকারি আর চাটনি। মিষ্টির থালায় থাকবে রসগোল্লা, সন্দেশ আর পাটিসাপটা। এসব তো জাওয়াদের প্রিয় খাবার।”
জাওয়াদের মুখে কোনো আনন্দের ছায়া পড়ল না। সে নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল, “মা, এত আয়োজনের দরকার নেই। আমি এখন সাধারণ খাবারই খাই।”
ললিতার মুখের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। সে বিস্ময়ে ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেখানে সে খুঁজছিল তার সেই ছোট্ট জাওয়াদকে, যে তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাত। কিন্তু সেখানে দেখতে পেল শুধু একজন অপরিচিত যুবককে, যার চোখে কোনো ভালোবাসা নেই।
ললিতার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ল যখন সে রাইহাকে লক্ষ্য করল। তার কণ্ঠস্বরে একটা অনিশ্চয়তা ফুটে উঠল, “মেয়েটা কে?”
জাওয়াদের উত্তর এল হিমশীতল সুরে, একটি অচেনা পথিকের মতো, “ও রাইহা, আমার বন্ধু। আমরা কয়েকটা দিন এখানে থাকব।”
ললিতার চোখে জল জমে এল। সে কষ্টে গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করল, “তুই… তুই কি আমাদের সঙ্গে থাকবি না, বাবা?”
জাওয়াদের মুখে ফুটে উঠল একটু বিরক্তির ছায়া। সে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলছে, এমন ভঙ্গিতে বলল, “মা, আমি এখন ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নিতে চাই।”
তারপর সে রাইহার দিকে ফিরে বলল, “চলো, তোমাকে তোমার ঘর দেখিয়ে দিই।” তাদের পদশব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময়।
পিছনে রয়ে গেল হতভম্ব সুফিয়ান ভুঁইয়া আর ললিতা। ললিতা অসহায়ভাবে স্বামীর দিকে তাকাল, চোখের ভাষায় বলতে চাইল, “এ কী হলো? আমাদের ছেলে কেন এমন হয়ে গেল?”
সুফিয়া ভুঁইয়া নীরব। তার চোখেও বিস্ময় আর হতাশার ছায়া। দাসীদের মুখেও ফুটে উঠেছে একই অবাক ভাব। তারা চিনতেই পারছে না জমিদার বাড়ির সেই হাসিখুশি ছেলেটিকে, যে এখন ফিরে এসেছে একজন অপরিচিত যুবক হয়ে।
||
শব্দরের কণ্ঠস্বরে প্রচণ্ড ক্রোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তার চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে উঠেছে। সে জুলফার দিকে তাকিয়ে হিংস্র বাঘের মতো গর্জে উঠল, “শত শতবার বলেছি তোমাকে! ভাবির সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবে না। এতে ভাইজান কষ্ট পায়। এতটুকু বুদ্ধি নেই তোমার ঐ ফাঁপা মাথায়?”
জুলফা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তার চোখে জলের বন্যা নেমে এল। সে তীব্র বিষাক্ত স্বরে জবাব দিল, “আমার কী অপরাধ? উনি আমাকে দেখলেই সাপের মতো ছোবল মারেন। আমাকে দেখলে উনার গা জ্বলে যায়। আপনি কেন সবসময় আমাকেই খাগড়ার মতো পুড়িয়ে মারেন?”
“তোমার মাথায় কি গোবর ভরা? বুঝতে পারছ না? ভাই-ভাবি আমাকে মানুষ করেছেন। তাদের প্রতি আমার যে কৃতজ্ঞতা, তা শতজন্মেও শোধ করতে পারব না। তুমি ভাবির সাথে তর্ক করবে আর এতে ভাইজান কষ্ট পাবে, এটা আমি মরেও সহ্য করব না!” শব্দর চিৎকার করে উঠল।
জুলফার চোখে আগুন জ্বলে উঠল। “আপনার সেই তুচ্ছ কৃতজ্ঞতা দেখাতে গিয়ে আমাকে পায়ের ধুলোর মতো মাড়িয়ে যাবেন? আমি কি মানুষ নই? কুকুরের চেয়েও হীন? আমারও একটা সম্মান আছে। আপনি কি তা বুঝতে পারেন না?”
শব্দর রাগে পাগলের মতো হয়ে গেল। “সম্মান! তোমার আবার সম্মান! একটা ছিন্নমূল বেদের মেয়ে হয়ে এত বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছ! তোমার মুখে এসব শোভা পায় না!”
জুলফার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, “হ্যাঁ, আমি বেদের মেয়ে। আপনি কি ভুলে গেছেন? আপনি তো আমাকে জেনেশুনেই বিয়ে করেছেন। এখন আমার পরিবারকে নিয়ে কুৎসিত কথা বলার কী অধিকার আছে আপনার?”
শব্দর নিজের কথা শুনে নিজেই পাথরের মতো স্তম্ভিত হয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে রাগের মাথায় সে সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে। কিন্তু এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। জিততে হবে, “যদি লোকে জানে আমি কাকে বিয়ে করেছি, ছিঃ ছিঃ করে থুথু ফেলবে। আমার মুখে চুনকালি মাখাবে।”
জুলফা প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল, “তাহলে আমাকে বিয়ে করেছিলেন কেন? আমি কি আপনাকে প্রতারণা করেছি? আপনি তো জানতেন আমি কে, তবুও বিয়ে করেছেন। এখন আমার পরিবার নিয়ে কুৎসিত কথা বলার অধিকার আপনার নেই। আপনি একটা কাপুরুষ! নিজের অপরাধ ঢাকতে আমাকে দোষ দিচ্ছেন!”
শব্দর হতবাক হয়ে যায়। তার মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা যখন সে জুলফাকে প্রথম দেখেছিল। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে সে সব কিছু ভুলে গিয়েছিল। সেদিন তার কাছে জুলফার পরিচয় কোনো বাধা ছিল না। জুলফা কান্নায় ভেঙে পড়ে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায়। শব্দর দাঁড়িয়ে রইল, নিজের অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে। সে বুঝতে পারে, ভাই-ভাবির তথাকথিত সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে সে আবার জুলফাকে আঘাত করেছে। মাঝেমধ্যে তার যে কী হয়, নিজেই বুঝতে পারে না।
জুলফা ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল। তার বুকের ভেতরটা তখনও জ্বলছে শব্দরের কথাগুলোয় – যেন কেউ নুনের ছিটে দিয়েছে তাজা ক্ষতের উপর। মাথার ভেতর গুনগুন করছে সেই তীক্ষ্ণ বাক্যগুলো, ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে তার আত্মমর্যাদাবোধকে।
হঠাৎ করেই সে ধাক্কা খেল কারও সঙ্গে। যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো তার সারা শরীর। চমকে উঠে সে সামনে তাকাল, চোখ দুটো বিস্ফারিত করে। সামনে দাঁড়িয়ে এক অপরিচিত যুবক। তার পরনে শহুরে আধুনিক পোশাক। চওড়া কাঁধ, সুগঠিত দেহ, আর মুখভরা দাড়িতে তার চেহারা ছিল বেশ আকর্ষণীয়। জুলফা একটু থতমত খেয়ে গেল।
যুবকটি মুখ বিকৃত করে কী যেন বলল ইংরেজিতে। জুলফার কানে তা শুধু অর্থহীন শব্দের ঝংকার। সে বুঝতে পারল না কী বলা হয়েছে, কিন্তু যুবকটির কণ্ঠস্বরে ছিল তীব্র বিরক্তি আর অবজ্ঞা। সেই স্বরের তীক্ষ্ণতা তার অন্তরে বিঁধল কাঁটার মতো। সে অপমানিত বোধ করল, যদিও কেন তা সে নিজেও জানে না। তার মনে হলো, যেন তার সমস্ত অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। ঠিক তখনই জুলফার নজর পড়ল যুবকটির পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। তার পরনে ফ্রক, গোলাপি রঙের। জুলফা অবাক হয়ে ভাবল, এতো বড় মেয়ে ফ্রক পরেছে! তবে দেখতে তো অপূর্ব সুন্দরী। সাদা মসৃণ ত্বক, ঝলমলে কালো চুল, আর নীল চোখ – যেন কোনও স্বর্গীয় পরী নেমে এসেছে এই মর্ত্যলোকে।
জুলফার মন থেকে মুহূর্তেই উবে যায় শব্দরের সঙ্গে হওয়া ঝগড়ার কথা। তার মনে জাগে তীব্র কৌতূহল, এরা কারা? কোথা থেকে এল? কেনই বা এসেছে এই জমিদার বাড়িতে? যেন দুই ভিন্ন জগতের সংঘর্ষ ঘটেছে এই মুহূর্তে, তার চেনা পরিচিত গ্রাম্য জীবন আর এই আগন্তুকদের আধুনিক শহুরে জগৎ।
যুবক-যুবতী দুজনই তাকে অগ্রাহ্য করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাদের পদক্ষেপে অহংকার আর আত্মবিশ্বাস। জুলফার মন জুড়ে তখন শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। সে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই, পাথরের মূর্তির মতো।
হঠাৎ পায়ের শব্দে চমকে উঠল জুলফা। ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ল রাঁধুনি গৌতমের মা। বয়সের ভাঁজে ভাঁজে জীবনের নানা অভিজ্ঞতা লুকিয়ে থাকা এই মহিলার দিকে তাকিয়ে জুলফার মনে হলো, এর চেয়ে নির্ভরযোগ্য আর কেউ নেই।
কৌতূহল দমন করতে না পেরে জুলফা মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “ও মাসি, শোনো। ওই যে নতুন আসা দুজন ছেলে আর মেয়েটি, তারা কারা বলো তো? কোথা থেকে এলেন?”
গৌতমের মা’র চোখে মুহূর্তের জন্য একটা চাঞ্চল্য ফুটে উঠল। সে সম্মানের সঙ্গে মাথা নত করে জুলফার দিকে তাকাল। তারপর চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে, কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলল, “জমিদার বেগম, উনি হলেন বড় জমিদারের ছেলে আর তার বান্ধবী।”
জুলফার চোখ বিস্ময়ে প্রায় কপালে উঠে গেল। সে আরও কাছে সরে এসে উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “সে কি! ভাইজানের ছেলে? কোথা থেকে এলেন তারা?”
গৌতমের মা তখন আরও নম্র ভঙ্গিতে মাথা নত করে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “মাপ করবেন জমিদার বেগম, সেটা তো আমি জানি না। তবে মনে হয় দূর কোনো শহর থেকে এসেছেন। বেশভূষা দেখে তো তাই মনে হয়।”
জুলফা চিন্তিত মুখে বললেন, “আচ্ছা যাও, কাজে যাও।”
গৌতমের মা মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধাভরে প্রণাম জানিয়ে, ধীর পদক্ষেপে সেখান থেকে বিদায় নেয়। তার পদশব্দ মিলিয়ে যেতেই, জুলফা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দুপুরের প্রখর রোদ বাইরে তার উত্তাপ ছড়াচ্ছে। হঠাৎ তার চোখ গিয়ে পড়ল বাগানে নাভেদের ওপর। একমনে হিসাবের খাতায় কলম চালিয়ে যাচ্ছে। জুলফার অন্তরের গভীর থেকে কিছুক্ষণ আগের বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায়। নাভেদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, সে সময়ের সীমানা হারিয়ে ফেলল।
নাভেদের কপালে জমে থাকা ছোট ছোট ঘামের বিন্দু, তার মনোযোগী দৃষ্টি, আর হাতের লেখার ছন্দ সবকিছু মিলে জুলফার হৃদয়ে এক অপূর্ব শিহরণ জাগিয়ে তুলে।
অকস্মাৎ নাভেদ তার চোখ তুলল। মুহূর্তের জন্য দু’জোড়া চোখের মিলন হতেই জুলফার বুকের ভেতর ঝড় উঠে যায়। লজ্জায় তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠল, গোলাপের পাপড়ির মতো। বিদ্যুৎ গতিতে সে নিজেকে আড়ালে নিয়ে গেল।
চলবে…
~ ইলমা বেহরোজ