হারিকেনের আলোয় ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। পালঙ্কের ওপর জুলফা মুখ ফিরিয়ে বসে আছে, তার সারা শরীর পাথরের মতো শক্ত। চোখে-মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। শব্দর ধীরে ধীরে জুলফার দিকে এগিয়ে এল। তার কণ্ঠস্বরে অনুতাপের সুর ঝরে পড়ল, “জুলফা, তুমি আমার স্ত্রী, আমার সর্বস্ব। আমি আর কখনোই তোমার সম্মান ক্ষুণ্ণ করব না।”
জুলফা নিঃশব্দে বসে রইল একটা নির্জীব মূর্তি হয়ে। শব্দর সাহস করে তার হাত ধরল। অনুনয়ের সুরে বলল, “আমাকে ক্ষমা করো। আর কখনো আমি এমন ভুল করব না।”
জুলফার মুখে রাগের ছায়া এখনও অটুট। সেই তিক্ত ভাবটা নিয়েই সে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল। বসন্তের মৃদু বাতাস তার এলোমেলো চুলে খেলা করছে, প্রকৃতি নিজেই তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে।
শব্দর পেছন থেকে এগিয়ে এসে আচমকা জুলফাকে কোলে তুলে নিল। তার কণ্ঠে এবার একটু হাস্যরসের আভাস, “দয়া করুন বেগম সাহেবা, রাগ ত্যাগ করুন। আর কখনো আপনাকে কষ্ট দেব না।”
এতেও কোনো লাভ হয় না। জুলফা হাত-পা ছুঁড়ে কোল থেকে নেমে শব্দরকে ঠেলে দিয়ে আবার পালঙ্কে গিয়ে বসে। তার চোখে-মুখে রাগের সাথে একটা গভীর ব্যথার ছাপ ফুটে উঠেছে। শব্দর কিছুক্ষণ তার দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। জুলফার মুখের রেখায় রেখায় সে নিজের অপরাধের গভীরতা অনুভব করছে। তারপর আবার জুলফার কাছে যাওয়ার উপক্রম করতেই…
জুলফা হঠাৎ মুখ খুলল। তার কণ্ঠে এক ধরনের ক্লান্তি ও বিরক্তি, “ক্ষমা করলাম। আর এমন ভুল করবেন না।”
শব্দর জুলফার হাত চেপে ধরে। তার চোখে-মুখে গভীর অনুশোচনার ছাপ, “ঠিক আছে, আর কখনো তোমার সম্মানে আঘাত করব না। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমি কি ইচ্ছে করে তোমাকে দুঃখ দিতে পারি? এমন ভুল আর কখনো হবে না।”
জুলফা ক্লান্তভাবে শুয়ে পড়ল। সে আস্তে আস্তে বলল, “আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আপনিও শুয়ে পড়ুন।”
শব্দর ধীর স্বরে বলল, “এখনই ঘুমিয়ে পড়বে? জুলফা, এই জুলফা?” সে একটু উৎকণ্ঠার সুরে তার নাম ধরে ডাকল, কিন্তু জুলফার কোনো প্রতিক্রিয়া পেল না।
শব্দর উদ্বিগ্ন হয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। তার মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে লক্ষ্য করে, জুলফা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার ফর্সা মুখখানি অদ্ভুতভাবে শান্ত দেখাচ্ছে, যেন সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়েছে। “নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে,” ভাবল শব্দর। সে ধীরে ধীরে জুলফার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল, তাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল।
পয়তাল্লিশ বছরের জীবনে শব্দর কখনও প্রকৃত প্রেমের স্বাদ পায়নি। এমনকি এক তরফা ভালবাসার অনুভূতিও তার অজানা ছিল। তারপর একদিন এই ছোট মেয়েটিকে দেখার পর থেকে তার প্রাণে এক অপরূপ অনুভূতি জেগে উঠে। সেই অনুভূতি, সেই এক তরফা ভালবাসা এখন তার অন্তরের গভীরে শিকড় গেড়েছে। সে জানে, জুলফা এখনো তার ভালবাসাকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান একটা বড় বাধা। এতে সে জুলফার কোনো দোষ দেখে না। তাকেই এই ছোট মনটিকে বিশ্বাস ও সম্মান দিয়ে ধীরে ধীরে জয় করে নিতে হবে। এই চিন্তা নিয়েই শব্দর জুলফাকে তার আদরের আলিঙ্গনে আরও শক্ত করে জড়িয়ে রাখে। তারপর ধীরে ধীরে তারও চোখের পাতা ভারী হয়ে এল, পাড়ি জমাল ঘুমের দেশে। রাতের অন্ধকারে ঘরটা নিঝুম হয়ে গেল। বাইরে থেকে ভেসে আসা পেঁচার ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে রাতের নীরবতা ভেঙে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো দুজনের ঘুমন্ত মুখে এক অদ্ভুত শান্তির ছায়া ফেলেছে।
শব্দরের নিঃশ্বাসের ছন্দ যখন ধীর হয়ে এল, জুলফা সন্তর্পণে চোখ খুলল। তার চোখে একটা গভীর চিন্তার ছায়া। মনের গহনে তখন শুধুই নাভেদের চিন্তা। সেই মানুষটি, যার প্রতি তার হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে। সে তখন ইচ্ছে করেই শব্দরের সঙ্গে কথা বাড়ায়নি। কারণ সে জানে, কথা বাড়লে শব্দর আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে। আর সেটা এখন জুলফার কাছে সবচেয়ে অসহনীয়বোধ হবে। শরীরে শরীরে ভালোবাসা কি কখনও মনের টান ছাড়া পূর্ণতা পায়? যার প্রতি হৃদয়ের কোনো আকর্ষণ নেই, তার সঙ্গে দাম্পত্য জীবন কাটানো যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে, তা শুধু তারাই বোঝে যারা এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছে।
চাঁদের আলোয় জুলফার মুখে একটা গভীর বেদনার ছায়া পড়ে। সে নিজেকেই প্রশ্ন করল, “কতদিন? কতদিন এভাবে চলবে?” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক চিরে। সে তো এই স্বামী, এই সংসারে মানিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। নাভেদকে দেখার পর থেকে সেই মানিয়ে নেওয়ার দরজাটা যেন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।
জুলফা উৎকর্ণ হয়ে কিছু শুনতে চেষ্টা করে। আজ কেন বেহালার সেই মধুর সুর ভেসে আসছে না? কেন নাভেদ আজ তার প্রাণের বেহালায় সুর তুলছে না? জুলফা অপলক নয়নে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। তার কান সজাগ, যদি নাভেদের বেহালার সুর ভেসে আসে। কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু দূরে কোথাও একটা পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছিল। একটা মৃদু বাতাস এসে জুলফার চুলে খেলা করে গেল। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো, এই বাতাস নাভেদেরই স্পর্শ। এই জীবনটা কি এমনই চলতে থাকবে? একদিকে স্বামীর, অন্যদিকে নাভেদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা – এই দ্বন্দ্বে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে যেন একটা সুতোয় বাঁধা পতঙ্গ, যে উড়তে চায় অথচ পারে না। তার চোখ দিয়ে অজান্তে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
হঠাৎ জুলফার মনে একটা উদ্ভট চিন্তা খেলে গেল। আচ্ছা, এমন কী হতে পারে না যে নাভেদও তাকে সমান তীব্রতায় ভালোবেসে ফেলবে? তারপর দুজনে মিলে দূর কোনো অজানা জায়গায় পালিয়ে যাবে? যেখানে কেউ তাদের চিনবে না, যেখানে তারা শুধু তাদের ভালোবাসার জগতে বিচরণ করতে পারবে? এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই জুলফার সারা শরীরে একটা উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। তার রক্তের প্রতিটি কণা উত্তেজনায় নেচে উঠল। তার শরীরের প্রতিটি কোষ চিৎকার করে বলতে লাগল, “হতে পারে কি? হতে পারে?”
জুলফা চোখ বন্ধ করে কল্পনার জগতে ডুবে যায়। সে দেখতে পায়, নাভেদ তার হাত ধরে একটা অজানা পথে হেঁটে চলেছে। চারপাশে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আর তাদের দুজনের মাঝে প্রেমের অফুরন্ত বন্ধন। সেখানে না আছে সমাজের বাধা, না আছে পারিবারিক দায়িত্বের বোঝা।
পরক্ষণেই বাস্তবতার কঠিন আঘাতে সে ফিরে এল। মনে পড়ে যায় শব্দরের কথা, যে এখনও ঘুমিয়ে আছে তার পাশে। এই পলায়নের চিন্তা কি শুধুই একটা মরীচিকা নয়?
জুলফা আবার জানালার বাইরে তাকাল। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া রাতের আকাশ তার অন্তরেরই প্রতিচ্ছবি। উজ্জ্বল, কিন্তু রহস্যময়।
সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “আমি কি সত্যিই সব কিছু ত্যাগ করে নাভেদের সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারব? নাকি এটা শুধুই একটা মধুর স্বপ্ন, যা কখনোই বাস্তবে রূপ নেবে না?”
হঠাৎ তার অন্তরের গভীর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো। সে কণ্ঠস্বর ক্ষীণ নয়, দুর্বল নয়। বরং তা দৃঢ়, অটল, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেই কণ্ঠস্বর বলে উঠল,
“নাভেদ পাটোয়ারী যদি একবার হাত বাড়িয়ে ডাকে, তবে ওই মুহূর্তেই উড়ে যাব তার কাছে। এই পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাকে আটকাতে পারবে না। না সমাজের বাঁধন, না পরিবারের দায়িত্ব, না এই বিয়ের বন্ধন, কিছুই না। আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন শুধু নাভেদের জন্য। তার একটি ইশারায় আমি সব কিছু ভুলে যাব, সব বন্ধন ছিন্ন করব। আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত শুধু তারই হয়ে যাবে। এই জগতের কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। কেউ না।”
||
ভোরের আলো ফুটতেই রাইহা ঘুম থেকে জেগে ওঠে। সে তার বিশাল সুটকেস থেকে বের করে একটি হালকা নীল রঙের মিনি স্কার্ট আর সাদা ব্লাউজ। পোশাকটি পরিধান করে সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। রাইহার পরনে স্কার্টটি হাঁটুর অনেক উপরে এসে থেমেছে। ব্লাউজটি তার কোমরের কাছে এসে শেষ হয়েছে, উন্মুক্ত করে রেখেছে তার নাভি। পায়ে গলিয়ে নিল উঁচু হিলের জুতো। চুলগুলো বাঁধল উঁচু করে।
সে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামে, তখন বাড়ির পরিচারক মনির মিঞা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। “মা গো! এ কী দেখলাম!” সে বিড়বিড় করে বলে।
বাগানে পা রাখতেই মালি সিদ্দিক তার কাজ থেকে মুখ তুলে রাইহাকে দেখে, তার হাত থেকে কাঁচি পড়ে যায়। “আস্তাগফিরুল্লাহ্! আস্তাগফিরুল্লাহ!” সে নিজের মনে বলেই গামছা দিয়ে চোখমুখ ঢেকে সেখান থেকে চলে যায়।
রান্নাঘরের দিক থেকে আসা গৌতমের মা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিল। “ভগবান! ভগবান!” জপতে জপতে পালিয়ে বাঁচে। যেন ভয়ংকর কিছু দেখেছে।
রাইহা এসব প্রতিক্রিয়ার দিকে ভ্রুক্ষেপ করল না। সে জানত, তার এই আধুনিক পোশাক এখানকার মানুষদের কাছে অপরিচিত। সে শহুরে মেয়ে, অনেকটা সময় ইংল্যান্ডে কাটিয়েছে। সে প্রগতিশীল, শিক্ষিত, আর স্বাধীনচেতা।
রাইহা বাগানের পথ ধরে হাঁটতে থাকে সামনে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল নাভেদকে। বাতাসে তার স্কার্টের পাড় উড়ছে। সামনের দৃশ্য দেখে সে থমকে দাঁড়াল।
সবুজ ঘাসের গালিচায় নাভেদ যোগাসনে মগ্ন। তার ঘামে ভেজা শরীরে রোদের আলো পড়ে ঝিলিক দিচ্ছে। পা দুটো সামনে সোজা করে বসে আছে, হাত দুটো মাথার ওপরে তুলে আকাশকে ছুঁতে চাইছে। চোখ বন্ধ, মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, যেন পৃথিবীর কোনো চিন্তাই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না।
রাইহা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল নাভেদের দেহের প্রতিটি অঙ্গ। চওড়া কাঁধ, সুগঠিত বুক, আর হাতের মাংসপেশিগুলো কোনো ভাস্করের হাতে গড়া। তার শরীরের প্রতিটি নড়াচড়ায় একটা অদ্ভুত সংযম আর শক্তি ফুটে উঠছে। পেছনে বাঁধা বাবরি চুলগুলো এতটাই গোছানো যে কোনো হাওয়াতেই নড়ছে না। এই দেশে, গ্রামের পরিবেশে এমন একজন স্বাস্থ্য সচেতন, আকর্ষণীয় পুরুষের সন্ধান পাবে তা সে কল্পনাও করেনি। নাভেদের এই রূপ দেখে তার যৌবনে ঢেউ খেলে গেল।
নাভেদ যখন চোখ খুলল, তখন তাদের চারচোখ এক হয়ে গেল। নাভেদের চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে তার মনে পড়ে যায় সেলিমের মুখ থেকে শোনা ঘটনাটি। জাওয়াদ নাকি বিলেত থেকে এক সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে এসেছে। এই মেয়েটিই নিশ্চয় সেই বিলেতি হবু বউ।
রাইহা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। তার চোখে কৌতূহল আর মুখে মৃদু হাসি। সে নাভেদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি জানতে পারি, আপনি জাওয়াদের কে হোন?”
নাভেদের চোখ কপালে উঠল। এ কী! মেয়েটা এমন সাবলীল বাংলায় কথা বলছে! কথার ধরনে মনে হচ্ছে সে জন্মের পর থেকেই বাংলা বলে। নাভেদ নিজের বিস্ময় চেপে রেখে উত্তর দিল, “আমি এই বাড়িতে একজন অতিথি। জমিদারদের সাথে আমার কিছু ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে।”
রাইহা এবার আরও কৌতূহলী হয়ে বলল, “ওহ, তাই নাকি! কী মজার ব্যাপার! আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো এখানকার কেউ। আপনার যোগব্যায়াম দেখে মনে হচ্ছে আপনি বেশ নিয়মিত।”
নাভেদ হেসে ফেলল। “হ্যাঁ, আপনি কি…”
রাইহা তার কথা শেষ করার আগেই বলে উঠল, “আমি রাইহা। জাওয়াদের…” সে একটু থেমে গেল, “বন্ধু। লন্ডন থেকে এসেছি।”
নাভেদ মাথা নাড়ল, “আহা, তাই বলুন। আমি নাভেদ। আপনার বাংলা শুনে তো অবাক হয়েছি। এত সুন্দর করে বাংলা বলছেন!”
রাইহা হেসে ফেলল, “ধন্যবাদ। আসলে আমার বাবা-মা দুজনেই বাঙালি। লন্ডনে থাকলেও বাড়িতে আমরা সবসময় বাংলাতেই কথা বলি। তবে আমার দাদি ছিল ফরেনার।”
নাভেদের চোখে এবার বিস্ময়ের সাথে একটু কৌতূহলও মিশে গেল, “বাহ, এ তো খুব ভালো কথা! আপনার মতো প্রবাসী বাঙালিদের দেখলে খুব ভালো লাগে। নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ভোলেননি।”
রাইহা মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, সেটা তো ঠিকই। কিন্তু আপনি? আপনার এই যোগব্যায়াম দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি বেশ আধুনিক চিন্তার মানুষ।”
নাভেদ একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “এমন কিছু নয়। বরং আমি তো বেশ পুরোনো ধাঁচের মানুষ। তবে হ্যাঁ, স্বাস্থ্য নিয়ে একটু সচেতন।”
কথায় কথায় সকালের মৃদু রোদে, বাগানের সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে, তারা ভুলেই গেল যে তারা এই মাত্র পরিচিত হয়েছে। বরং দেখে মনে হচ্ছে তারা অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু।
জুলফা বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে, চোখের কোণ দিয়ে বাগানের দৃশ্য দেখছে। নাভেদের সাথে রাইহার হাসি-গল্প দেখে তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। শঙ্খিনীকে কাছে ডেকে গলায় তীব্র জ্বালা নিয়ে বলল,
“দেখছিস শঙ্খিনী? ঐ মেয়েছেলেটার কাণ্ড! নাভেদ পাটোয়ারীর সাথে কী হাসাহাসি করছে।”
শঙ্খিনী সাবধানে জবাব দিল, “বেগম সাহেবা, ওরা তো কথা বলছে মাত্র।”
জুলফার চোখ জ্বলে উঠল। “কথা! তুই বুঝবি না। জমিদার বাড়ির বউ হবে, আর এখন থেকেই এত বেহায়াপনা! লজ্জা-শরম বলে কিছু নেই! পর পুরুষের সাথে এভাবে কথা বলে কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে? দেখ না, কী ছোট জামা পরেছে।”
সকালের সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে বাগানের ফুলগুলোর ওপর। রঙিন প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। রাইহা তন্ময় হয়ে ফুল তুলছে।
হঠাৎ ভেসে আসা ঢং ঢং শব্দে চমকে উঠল সে। বারান্দায় টাঙানো পুরনো দেয়াল ঘড়িটা নয়টা বাজার ঘোষণা করছে। রাইহার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ” নয়টা বেজে গেছে!” ভাবতে ভাবতে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়াল রাইহা। খাসমহলের দরজা খুলতেই বজ্রাঘাত হলো সে। সামনেই দাঁড়িয়ে সুফিয়ান ভুঁইয়া। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দেহটাকে লাঠির সাহায্যে সোজা রেখেছেন তিনি। তবে চোখে এখনো বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। রাইহার বুকের ভেতর ধক করে উঠল।
সুফিয়ান ভুঁইয়ার চোখ পড়ল রাইহার পোশাকের ওপর। তার মিনি স্কার্ট দেখে আগুন জ্বলে উঠল তার চোখে। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের রঙ লাল হয়ে উঠল, শিরাগুলো ফুলে উঠল কপালে।
গর্জন করে উঠলেন তিনি, “এ কী! এ কী বেহায়াপনা! কোন সাহসে তুমি এমন পোশাক পরে আমার বাড়িতে ঢুকছো?”
রাইহা ভয়ে পাথর হয়ে গেল। তার পা কাঁপতে শুরু করে, মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। মনে হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকে পড়েছে সে।
সুফিয়ান ভুঁইয়া তখন প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, “জাওয়াদ! জাওয়াদ!”
জাওয়াদ তখনও ঘুমের ঘোরে ছিল। বাবার চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসে। বিরক্তির ছায়া নেমে আসে তার মুখে। সে ধীরে সুস্থে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল । রাইহাকে এক পলক দেখে, বাবার দিকে ফিরে বলল, “কী হয়েছে ? এত চেঁচামেচি করছেন কেন?”
সুফিয়ান ভুঁইয়া আরও জ্বলে উঠলেন। “চেঁচামেচি? তুই জিজ্ঞেস করছিস কেন চেঁচামেচি করছি? এই মেয়ে…” রাইহার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “এই মেয়ে এভাবে অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তুই জিজ্ঞেস করছিস কেন চেঁচামেচি করছি? আমাদের বংশমর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিবি তুই?”
জাওয়াদ তাকাল রাইহার দিকে। তার চোখে বিব্রত ভাব। কিছু বলতে যাচ্ছিল, সুফিয়ান ভুঁইয়া তখন আবার গর্জে উঠলেন।
“ললিতা! ললিতা! কোথায় তুমি? এদিকে এসো, দেখো তোমার ছেলের কীর্তিকলাপ!”
ললিতা ছুটে এল। তার চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ, “কী হয়েছে? আবার কী হয়েছে?”
সুফিয়ান ভুঁইয়া রাইহার দিকে ইশারা করে বললেন, “দেখো! দেখো তোমার ছেলের কাণ্ড! এই মেয়েটাকে এনেছে বাড়িতে। কী পোশাক দেখেছো? আমাদের বাড়িতে এসব চলবে না।”
ললিতা হতভম্ব হয়ে তাকালেন রাইহার দিকে। তার চোখেও বিস্ময় আর ক্ষোভের ছায়া। কিন্তু সেই সঙ্গে একটু করুণাও মিশে ছিল। যা তার ছেলের জন্য।
ইতিমধ্যে বাড়ির দাস-দাসীরা ছুটে এসেছে। তারা দূরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। “ওমা! কী বেহায়া মেয়ে!”
“কী সর্বনাশ! ছোট জমিদারের বউ কী পরেছে!”
রাইহার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না কী করবে। পালিয়ে যাবে? না দাঁড়িয়ে থাকবে? মাটি ফেটে তার ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে৷
সুফিয়ান ভুঁইয়া আবার গর্জে উঠলেন, “এই মেয়ে এখনই এই পোশাক পরিবর্তন করবে। ভদ্র মেয়ের মতো পোশাক পরবে। নয়তো…” তিনি একটু থামলেন, তারপর আরও কঠোর স্বরে বললেন, “নয়তো এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমার বাড়িতে এসব অশ্লীলতা বরদাস্ত করা হবে না।”
জাওয়াদ বুঝল, পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে কিছু একটা করতে হবে। সে ধীরে ধীরে রাইহার কাছে গিয়ে বলল, “যাও, ঘরে গিয়ে আরেকটু বড় পোশাক পরে নাও।”
রাইহা মাথা নত করে চলে যেতে লাগল। সুফিয়ান ভুঁইয়ার পাশ কাটানোর সময় তার বুক ধড়ফড় করছিল। সে ভাবতেই পারেনি যে জাওয়াদের বাবা পোশাকের জন্য এতটা রেগে যাবেন। মানুষ বোধহয় খুনির সঙ্গেও এমন আচরণ করে না।
জাওয়াদ ঘুরে চলে যাচ্ছিল, মনে মনে ভাবছিল কীভাবে এই জটিল পরিস্থিতি থেকে পালানো যায়। হঠাৎ বাজ পড়ল।
“দাঁড়াও!” সুফিয়ান ভুঁইয়ার গর্জনে থমকে দাঁড়াল জাওয়াদ।
সেই আদেশের স্বরে গোটা বাড়িটা কেঁপে উঠল। দাস-দাসীরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। ছেলের প্রতি মায়ায় ললিতার মুখ শুকিয়ে গেল।
জাওয়াদ ঘুরে দাঁড়ায়। তার মুখে একটা অলস, বিরক্ত ভাব। সে বলতে চাইছে – “আবার কী?”
সুফিয়ান ভুঁইয়া তার ছেলের দিকে তাকালেন। “বিয়ে করার জন্য আর কোনো মেয়ে পেলে না তুমি?” সুফিয়ানের কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ল তীব্র ব্যঙ্গ। “একটা রক্ষণশীল, সংস্কৃতিপূর্ণ, বাঙালি মেয়ে চোখে পড়ল না তোমার? আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের মূল্যবোধ – সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে তুমি বেছে নিলে…এর থেকে তুমি বাড়ির কোনো কাজের…”
হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। তার চোখ চারপাশে ঘুরে বেড়াতে থাকে, তারপর, একটি মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি আটকে গেল কোণের দিকে। সুফিয়ান আবার কথা শুরু করলেন, তার কণ্ঠস্বরে এবার একটু নরম সুর, “ধরো, গুলনূরকে বিয়ে করতে চাইলেও একটু স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারতাম। অন্তত সে তো আমাদের সংস্কৃতি বোঝে, আমাদের মতোই বাঙালি।”
কথা শেষ হতেই একটা তীব্র শব্দ ভেসে এল। যেন কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ার আওয়াজ। চমকে উঠে সবাই দ্রুত ঘাড় ফেরাল।
একটি তরুণী, মাথায় রঙিন ওড়নার আড়াল টেনে, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে-মুখে বিব্রত ভাব, সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইছে। মেয়েটির পায়ের কাছে ছড়িয়ে মাটির বাসনের টুকরো, যেগুলো এই মাত্র তার হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
এমন সময় ললিতার কণ্ঠস্বর ভেসে এল বিদ্যুৎ চমকানোর মতো, “ওর নাম গুলনূর নয়, রেণু।” তার গলায় দৃঢ়তা।
সুফিয়ান তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে উঠলেন, “না, ওর নাম গুলনূর।”
ললিতা ছাড়বার পাত্রী নয়। সে আরও জোর দিয়ে বলল, “ওর নাম রেণু। রেণু বলবেন।” তার চোখে জ্বলজ্বল করছে একটা অদম্য সংকল্প।
সুফিয়ান এবার রেগে টং হয়ে গেলেন। তিনি হাতের লাঠি দিয়ে মেঝেতে জোরে আঘাত করলেন। শব্দটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, “তুমি কারো নাম কেড়ে নিতে পারো না। ও গুলনূর, ও’কে গুলনূর বলবে।” তার কথায় হুকুমের সুর।
এই বিতর্কের মাঝে, রেণু – যার আসল নাম গুলনূর – নীরবে দাঁড়িয়েছিল। তার পায়ে লেগেছে ভাঙা বাসনের ধারালো কোণ। রক্তের ধারা বেয়ে নেমে আসছে পায়ের পাতা থেকে।
জাওয়াদ এই দৃশ্য দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে। তার চোখে গভীর উদ্বেগ, “আপনি ঠিক আছেন তো?” তার কণ্ঠস্বরে আন্তরিক উৎকণ্ঠা।
গুলনূর কোনো উত্তর দিল না। সে দ্রুত হাতে ভাঙা বাসনের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিল। তারপর সেগুলো ওড়নায় জড়িয়ে নিয়ে, একটা মূল্যবান সম্পদ বহন করছে এমনভাবে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে গেল। পিছনে রেখে গেল তার ভবিতব্য।
চলবে…
~ ইলমা বেহরোজ