ইলমা বেহরোজ
জুলফা চোখ মেলে নিজেকে এক বিশাল বটগাছের কুঞ্জিত শিকড়ে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখতে পায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাভেদ, হাতে ধরা ঘোড়ার লাগাম। তখন সকালের কোমল আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল আকাশের গায়ে।
জুলফা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই তার শরীর বিদ্রোহ ঘোষণা করে। দীর্ঘ অনাহার আর মনের গভীর উদ্বেগে তার দেহ অবসন্ন, প্রায় নিস্পন্দ। সে কষ্টে হাত বাড়িয়ে গাছের খসখসে বাকল ধরে উঠতে চেষ্টা করল। নাভেদ দ্রুত এগিয়ে এল, তার চোখে মৃদু উদ্বেগের ছায়া। সে জুলফাকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ায়, তার কণ্ঠস্বরে গভীর মমতা, “সাবধানে,” সে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “আপনি এখনও খুব দুর্বল। আস্তে আস্তে উঠুন।”
জুলফা নাভেদের দিকে কৃতজ্ঞতা আর লজ্জা ভাব নিয়ে তাকাল। কোনোমতে বলল, “আমি… আমি ঠিক আছি।”
নাভেদ একটু পিছিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে বলল, “আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে আপনার সম্মানে আঘাত লাগতে পারে। সমাজের চোখে… আপনি বুঝতেই পারছেন। তাই এখানেই অপেক্ষা করতে হলো।”
জুলফার মনে পড়ে যায় গত রাতের ঘটনা, একটা অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো। সে যখন জ্ঞান হারিয়েছিল, ঠিক তখনই নাভেদ ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া থেকে তাকে বাঁচিয়েছিল। লজ্জায় তার গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠল, যেন সকালের সূর্যের আভা তার মুখে প্রতিফলিত হচ্ছে।
“আপনি… আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন,” জুলফা প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, তার কণ্ঠে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা। “আমি কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ দেব, তা জানি না।”
নাভেদের ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠল, যা তার চোখে পৌঁছাল না। সে নম্রভাবে বলল, “ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। আপনি নিরাপদে আছেন, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট। আমি যা করেছি, তা যে কেউই করত।”
জুলফা তার শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে বলল, “আপনি না থাকলে…” কথাটা শেষ করতে পারল না, গলায় কী যেন আটকে গেল।
নাভেদ জুলফার অস্বস্তি অনুভব করে একটু দূরে সরে যায়। ধীরে ধীরে বলল, “আপনি এখন নিরাপদে বাড়ি ফিরে যান। আমি এখানে থাকব, যতক্ষণ না আপনাকে নিরাপদে ঢুকতে দেখি।”
জুলফা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তার চোখে অজানা এক আবেগের ঝলক। সে ধীরে ধীরে জমিদার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। পিছনে শোনা যায় নাভেদের ঘোড়ার ক্ষুরের মৃদু শব্দ, যা ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। খামারবাড়ি থেকে ভেসে আসা গরু-ছাগলের ডাক জুলফাকে ফিরিয়ে আনে বাস্তবের মাটিতে। বাড়িতে ঢুকে সে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়ে মেঝেতে। এ কী স্বপ্ন ছিল নাকি বাস্তব!
বাড়ির প্রাঙ্গণে রোদ্দুর ঝলমল করছে। হঠাৎ করে বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল সাইকেলের ঘণ্টির শব্দে। দারোয়ান মতিন মিঞা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল লোহার গেটের দিকে।
“কে?” মতিন মিঞার গলায় চিরাচরিত সতর্কতার সুর।
“আমি ডাকপিয়ন। একখান চিঠি আছে,” উত্তর এল গেটের ওপার থেকে।
মতিন মিঞা তালা খুলে গেট ফাঁক করতেই দেখা যায় এক মধ্যবয়সী লোককে। তার পরনে খাকি রঙের হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্ট, মাথায় একটা পুরনো ক্যাপ। কাঁধে ঝুলছে একটা ময়লা ব্যাগ।
“কার নামে চিঠি?” মতিন মিঞা জানতে চাইল।
“ছোট জমিদারের নামে,” ডাকপিয়ন জবাব দিল, ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে।
মতিন মিঞা খামটা নিয়ে জমিদার বাড়িতে যায়। সেখানে মনিরকে পেয়ে তার হাতে তুলে দেয়। মনির খাম নিয়ে দোতলায় যায়, জাওয়াদের ঘরের সামনে। আস্তে আস্তে দরজায় কড়া নাড়ে।
“কে ?” ভেতর থেকে জাওয়াদের তেজি গলা শোনা গেল।
“হুজুর, আমি মনির। আপনের নামে চিঠি এসেছে,” মনির জবাব দিল।
“ভিতরে আয়।”
মনির ধীরে ধীরে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। জাওয়াদ তখন তার পুরনো কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিল।
“রাখ ওইখানে,” জাওয়াদ টেবিলের একপাশে ইশারা করে।
মনির খামটা রেখে চলে যায়। জাওয়াদ ধীরে ধীরে খামটা খুলে। চিঠির প্রথম কয়েকটা লাইন পড়তেই তার ভ্রু কুঁচকে যায়। যত পড়তে লাগল, তার মুখের রেখাগুলো তত কঠিন হতে লাগল।
চিঠি শেষ করে জাওয়াদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সে জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাইরে দেখা যাচ্ছিল পুকুরপাড়ে বসে থাকা কয়েকজন মানুষ, সুফিয়ান কোনো কাজে এদের এখানে এনেছে।
হঠাৎ করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সোজা এগিয়ে গেল দ্বিতীয় তলার শেষ প্রান্তে অবস্থিত রাইহার ঘরের দিকে। তার পদক্ষেপে একটা স্পষ্ট অস্থিরতা।
রাইহার ঘরের সামনে এসে জাওয়াদ থমকে দাঁড়াল। সে একটু ইতস্তত করল। তারপর, একটা গভীর শ্বাস নিয়ে, দৃঢ়তার সাথে দরজায় কড়া নাড়ল।
“কে?” রাইহার মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
জাওয়াদ উত্তর দিল না। রাইহা ধীরে ধীরে দরজা খুলতেই, জাওয়াদ ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে পড়ে। সে খামটা বিছানার উপর রেখে, কিছুটা অস্থির স্বরে বলল, “আসিফ চিঠি পাঠিয়েছে।”
রাইহার চেহারায় হঠাৎ আলো ফুটে ওঠে। তার কালো চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল আশায়। সে উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কী বলেছে? কোনো ভালো খবর আছে?”
জাওয়াদের মুখে একটা বিরক্তির ছায়া নেমে এল। সে একটু কঠিন স্বরে বলল, “পাসপোর্ট এখনো নিতে পারেনি। আর কতদিন তোমাকে নিয়ে এখানে থাকতে হবে? আমি সত্যিই বিরক্ত হয়ে গেছি, রাইহা। ওটা তোমার বাপ নাকি শত্রু?”
রাইহার মুখের হাসি মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। চোখে জ্বলে একটা অদ্ভুত আগুন। সে চোয়াল শক্ত করে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তুমি ভেবো না, আমিও এখানে থাকতে চাই না। আমি কালই চলে যাব।”
এ কথায় জাওয়াদ অবাক হয়। তার চোখে ফুটে উঠে বিস্ময়। সে কিছুটা নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবে? তোমার কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে নাকি?”
রাইহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকায়। তার চোখে মুখে ফুটে উঠে একটা গভীর ব্যথা আর অভিমান। সে ধীরে ধীরে বলল, “সে তোমাকে জানতে হবে না। প্রথম দিন থেকে আমার সঙ্গে তোমার আচরণ ছিল অমানবিক। এইবার তোমারও মুক্তি, আমারও। দেখো, আমার ব্যাগপত্র গুছানো শেষ।”
জাওয়াদ বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত চোখ পিটপিট করে বলল, “ঠিক আছে। তবে যাবার আগে একটা কাগজে সই করে যেও। লিখে দিও, তুমি স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছ। রাস্তাঘাটে যদি মরে-টরে যাও, যেন আমাকে কেউ দায়ী না করে।”
রাইহা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল জাওয়াদের দিকে। এই ছেলেটা কী করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় বসল। জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “তোমাকে এতদিন জ্বালাতন করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত, জাওয়াদ। আমি কেবল বিপদে পড়েছিলাম বলেই তোমার এতসব কথা সহ্য করেও এখানে থেকেছি। আমি এইবার সত্যি চলে…”
রাইহা কথা শেষ করার আগেই ঘুরে দেখে, জাওয়াদ নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।
জাওয়াদ রাইহার ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা ছাদে এসে দাঁড়ায়৷ উঁচু থেকে সে নীরবে পর্যবেক্ষণ করে বাগানের দৃশ্য। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় গুলনূরের ওপর। বাগানে নানা ধরনের কাজ চলছে। কিছু দাসী গাছের গোড়ায় জল দিচ্ছে, কেউ আগাছা তুলছে, আবার কেউ পাকা ফল তুলছে ঝুড়িতে। গুলনূর একটা ছোট কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে বীজ বোনার জন্য জমি তৈরি করছে। তার অবস্থান অন্য দাসীদের থেকে কিছুটা দূরে। তাই খুব সহজেই অন্য দাসীরা বুঝতে পারে জাওয়াদ ছাদ থেকে গুলনূরকেই দেখছে। তারা একে অপরের দিকে তাকায়। তাদের চোখে চোখে কথা হয়। তারপর তারা ধীরে ধীরে গুলনূরের কাছে এগিয়ে গেল, যেন কোনো গোপন ষড়যন্ত্রের অংশ হতে যাচ্ছে।
প্রথম দাসী ফিসফিস করে বলল, “ও গুলনূর, তোর কপালে যে আজ চাঁদ উঠেছে গো! দেখছিস না? ছোট জমিদার ছাদ থেকে তোকে এমন তাকিয়ে দেখছে, যেন তুই আসমানের পরী!”
দ্বিতীয় দাসী হাসতে হাসতে যোগ করল, “হ্যাঁ গো, আমি তো ভাবছি এবার থেকে তোকে ‘বেগম গুলনূর’ বলে ডাকব! তোর হাতের কোদালটা যে এখন রাজদণ্ড হয়ে গেল!”
তৃতীয় দাসী গুলনূরের কানের কাছে মুখ এনে বলল, “শোন্ লো, এই সুযোগটা হাতছাড়া করিস না। একটু হাসি দিয়ে দে ছোট জমিদারের দিকে। দেখবি, কাল থেকে তোকে আর এই রোদে পুড়ে কাজ করতে হবে না।”
দাসীদের কথায় গুলনূরের বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে ওঠে। সে অবাক হয়ে ধীরে ধীরে মাথা তুলল। চোখ পড়ল জাওয়াদের চোখে। মুহূর্তের জন্য দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়। যতবার জাওয়াদের সঙ্গে তার দৃষ্টি মিলন ঘটে একটা শিরশির অনুভূতি হয় বুকের ভেতর। সেই মুহূর্তে সময় থেমে গেল। বাতাসে ভেসে এল চাঁপা ফুলের মিষ্টি গন্ধ। দূরে একটা পাখি ডেকে উঠল।
এই রোমাঞ্চকর মুহূর্তটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। দাসীদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু হতেই জাওয়াদের মুখভাব পাল্টে যায়। সে হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠে নিজের অবস্থান সম্পর্কে। একজন জমিদারপুত্রের পক্ষে এভাবে একজন দাসীকে দেখা উচিত নয়। জাওয়াদ দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এবার তার চোখে মুখে ফুটে উঠে একটা কঠোর, নিরাসক্ত ভাব। সে এমনভাবে চারদিকে তাকাতে লাগল যেন সে শুধু সামগ্রিকভাবে বাগানের কাজকর্ম তদারকি করছে। তার ভঙ্গিতে স্পষ্ট একজন দায়িত্বশীল জমিদারপুত্রের ছাপ, যে তার পিতার সম্পত্তির যত্ন নিচ্ছে।
গুলনূর আবার মাথা নিচু করে কাজে মন দেয়। অন্য দাসীরা এই ঘটনাটাকে নিয়ে হাসাহাসি চালিয়ে যেতে লাগল। তাদের চাপা হাসি আর ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তায় বাগানটা মুখর হয়ে উঠেছে।
সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে গুলনূর তার ভিজে চুল নিয়ে ঘরে ঢুকে। গোসলের পর তার গায়ে এখনও পানির ছোঁয়া লেগে আছে। ঠিক তখনই জাওয়াদ এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে, হাতে একটা চিঠি নিয়ে। সে দরজায় আলতো করে আঘাত করে। দরজা খুলে জাওয়াদকে দেখেই গুলনূরের মাথা অবনত হয়ে গেল।
জাওয়াদের চোখে-মুখে কৃত্রিম অহংকারী ভাব। সে দরজায় হাত রেখে জোরে ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল চওড়া হয়ে। সে ঘরে ঢুকে দৃঢ় পায়ে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ঘোষণা করছে – “এই বাড়ি আমার। আমিই এর একমাত্র উত্তরাধিকারী।” গুলনূর তখনও দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে, একটি লজ্জাবতী লতার মতো। জাওয়াদ বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে গুলনূরের দিকে তাকিয়ে বলল, একটু হাসির ছোঁয়া মিশিয়ে কিন্তু কণ্ঠে অহংকার ঢেলে, “আরে বাহ্! কি ব্যাপার? মাথাটা কি এতই ভারী যে তুলতে পারছো না? নাকি আমার সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে গেছো? যাই হোক, একটু সোজা হয়ে দাঁড়াও দেখি। দেখা যাক, তোমার মেরুদণ্ড আছে কি না!”
জাওয়াদের কথা শুনে গুলনূর বিব্রতবোধ করে। সে ধীরে ধীরে মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তার শরীরের ভাষা এখনও বলছে যে সে নিজেকে ছোট করে রাখতে চায়।
গুলনূরের ঘরটি খাসমহলের একটি ছোট ঘর। দেয়ালে ঝুলানো কয়েকটি পুরনো তসবির। একটি ছোট জানালা দিয়ে বাইরের উঠানের একটুখানি দেখা যায়। ঘরের এক কোণে একটি সাদাসিধে খাট, উপরে পরিপাটি করে ভাঁজ করা কাপড়চোপড়। অন্য দিকে একটি ছোট আলমারি, গুলনূরের সামান্য জিনিসপত্রের আধার।
ঘরের মাঝখানে একটি ছোট গালিচা পাতা, গুলনূরের নিত্য নামাজের স্থান। দেয়ালের গায়ে টাঙানো একটি আয়না নীরবে সাক্ষী হয়ে আছে। ঘরের এক কোণে একটি ছোট টেবিল, যা অদ্ভুতভাবে খালি। জাওয়াদের চোখে বিস্ময়, সে ভেবেছিল এখানে বইখাতা, কালি কলম দেখতে পাবে।
জাওয়াদ ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে হাতের চিঠিটি গুলনূরের সামনে মেলে ধরল। তার কণ্ঠে একটা মৃদু কৌতুক ঝরে পড়ে, “বেশ ভালো লিখো তো।”
গুলনূর নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, তার পায়ের আঙ্গুল দিয়ে মেঝে খোঁড়ার অসহায় চেষ্টা করছে। জাওয়াদ তার এই অস্বস্তি লক্ষ্য করে, কিন্তু তা উপেক্ষা করে বলে, “দ্রুত আমাকে একটা চিঠি লিখে দাও, প্রেমিকাকে দেব।”
গুলনূর পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল। জাওয়াদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার উপক্রম। তার অভিধানে ধৈর্য বলতে কিছু নেই। জাওয়াদের কণ্ঠস্বরে এবার একটু তীক্ষ্ণতা ফুটে উঠল, ” যা বললাম, তাই করো। কালি-কলম কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? বের করো।”
জাওয়াদ ঘরময় চোখ বোলায়। তার দৃষ্টিতে কৌতূহল আর সন্দেহ। গুলনূর নীরবে ঘরের কোণে রাখা একটি পুরনো ট্রাঙ্কের দিকে এগিয়ে যায়। ট্রাঙ্কটি খুলে সে একটি মলাটহীন খাতা আর একটি পুরনো কলম বের করে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে একটা অনিচ্ছা। তবুও বাধ্য মেয়ের মতো সে জাওয়াদের নির্দেশ পালন করছে। জাওয়াদের ঠোঁটে একটা চাপা হাসি ফুটে ওঠে। তার সন্দেহ যে সত্য প্রমাণিত হয়েছে, সেই আত্মতৃপ্তি তার চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে বলল, “তাহলে তুমি সত্যিই লিখতে পারো। এটা বাড়ির কেউ জানে না কেন?”
গুলনূর নিঃশব্দে টেবিলে বসে। তার হাতের কম্পন লক্ষণীয়। ধীরে ধীরে সে লিখতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্ত পর, সে খাতাটি জাওয়াদের দিকে এগিয়ে দিল। জাওয়াদ পড়ল, “কেউ কখনো জিজ্ঞেস করেনি, জানতে চায়নি।”
গুলনূরের হাতের লেখা দেখে জাওয়াদ মুগ্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি অক্ষর ছবির মতো সুন্দর, নিখুঁত, আর ভাবপূর্ণ। হয়তো বোবা বলেই তার হাতের লেখায় এমন নৈপুণ্য। তার মৌন কথাগুলো হাতের লেখায় প্রাণ পেয়েছে। সৃষ্টিকর্তা সত্যিই অদ্ভুত। তিনি প্রত্যেককেই কোনো না কোনো অনন্য গুণ দিয়েছেন। গুলনূরের ক্ষেত্রে, তার নীরবতার পাশাপাশি দিয়েছেন এক অসাধারণ অভিব্যক্তির ক্ষমতা, তার লেখনীর মাধ্যমে।
ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে সন্ধ্যার শেষ আলোর রেশটুকুও ঢুকতে পারছে না। ঘরটি অন্ধকারের গভীর গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। গুলনূরের চোখে ফুটে উঠে গভীর আতঙ্কের ছায়া। তার মনের পর্দায় ভেসে উঠে অতীতের সেইসব কালো স্মৃতি, যা তাকে তাড়া করে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। অন্ধকার ঘরে পুরুষ মানুষের উপস্থিতি মাত্রই তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে, বুকের ভেতর পাথর চেপে বসে।
হঠাৎ করেই সে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। তাড়াহুড়োয় পা জড়িয়ে যায় চেয়ারের পায়ায়। টলমল করে পড়ে যাচ্ছিল সে। জাওয়াদ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু তার স্পর্শের আশঙ্কায় গুলনূর আরও বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।
জাওয়াদ থমকে দাঁড়ায়। গুলনূরের মুখে ফুটে ওঠা সেই গভীর আতঙ্ক তাকে বিস্মিত করে। হঠাৎ কী হলো মেয়েটার?
“কী হয়েছে গুলনূর? এত ভয় পাচ্ছ কেন?” জাওয়াদের কণ্ঠে ফুটে উঠে উদ্বেগ মেশানো কোমলতা। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল গুলনূরের দিকে।
“তোমার কি অসুখ করেছে? এমন থরথর করে কাঁপছ কেন?” জাওয়াদ গুলনূরের থুতনি ধরে মুখটা তুলে ধরল। “আমাকে দেখে এত ভয় কিসের? আমি কি এতই ভয়ঙ্কর?”
জাওয়াদের স্পর্শে গুলনূরের সারা শরীর শিউরে উঠে। সে পিছু হটতে লাগল, যেন কোনো বিষধর সাপের সামনে পড়ে গেছে। তার চোখে ফুটে উঠল এক নির্বাক আর্তনাদ – “আমাকে ছুঁবেন না, দয়া করে দূরে সরে যান।”
চলবে…