অবাধ্য পিছুটান পর্ব ৩৭
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩৭
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তুর্য থমকে গেল দিল। গোল গোল দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। হতবাক কন্ঠে বলল,
-“এখনও অব্দি আমার বউকে চু’মু খাওয়ার হলো না, বউয়ের সাথে বাসর করা হলো না এর মধ্যে বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইছে?”
পৃথা একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো তুর্যের পানে। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“আপনি কি ভালো হবেন না? সব সময় শুধু বাজে কথা।”
তুর্য হাতের কফির মগটা পাশের টেবিলে রাখলো। ঐ কফির স্বাদ পৃথার বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনেই উড়ে গেছে। তুর্যের মুখশ্রী থমথমে হলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“সে তুমি যাই বলো না কেন বাসর ছাড়া আমি আমার বউকে ছাড়বো না। তার উপর আবার ও বাড়িতে সব রা’জাকা’র, আল ব’দ’র, আল শা’ম’সে ভরপুর। পরবর্তীতে যদি ওরা জোর করে আমার বউকে আটকে রাখে। তখন কি হবে আমার?”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। তুর্যের কথাগুলো সে গুরুত্বের সাথে নিবে নাকি লাগাম ছাড়াভাবে নিবে ঠিক বোধগম্য হলো না। লোকটা গুরুত্বপূর্ণ কথাতেও যে ধরনের শব্দের ব্যবহার করে তাতে তা গুরুত্বপূর্ণের তালিকায় ফেলা যায় না। পৃথা এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপরে বসলো। কিছুটা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“তাদের জোর করে আমাকে আটকে রাখার প্রয়োজন হবে না। আমি নিজেই আসবো না আর এখানে। একটা অ’স’ভ্য নি’র্ল’জ্জ পুরুষ।”
তুর্য পাত্তা দিল না পৃথার কথায়। ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
-“আগে একটু যাই তোমার বাপের বাড়িতে যেতে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল এখন তাও নেই। বাপ, মা, ভাইদের দেখার ইচ্ছে হলে বলো তাদের খবর দিচ্ছি এখানে আসার জন্য কিন্তু তোমাকে ও বাড়ি পাঠিয়ে আবারও বউ হারা হওয়ার ঝুঁকিটা আমি আপাতত নিতে চাইছি না।”
পৃথা বিষন্নভরা দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। ম্লান কন্ঠে বলল,
-“সেদিন হুট করে অভিমানের বশে আপনার সাথে চলে এসেছিলাম। বন্ধু, বান্ধব, আত্মীয় স্বজন কারো থেকে বিদায় পর্যন্ত আনিনি। কারো সাথে আর আর কথাও হয়নি। তাছাড়া ইদানীং বাবা মা আর ভাইয়াদের জন্য আমার মন কেমন করছে আমার, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কতদিন দেখি না বাবা, মা, আর ভাইয়াদের।”
তুর্যের কন্ঠস্বর নরম হলো। এগিয়ে গিয়ে বসলো পৃথার পাশে। কোমল কন্ঠে বলল,
-“আমার কাজের চাপটা একটু কমুক, ছুটি পাই। তারপর তোমাকে নিয়ে রাজশাহী যাব বউ। ততদিন একটু ধৈর্য্য ধরো।”
পৃথাও আর তেমন কথা বাড়ালো না বিষয়টা নিয়ে। চোটপাট কিংবা জোর জবরদস্তি করলো না। এই কয়দিন তুর্যের ব্যস্ততা সে দেখেছে। রাত নেই দিন নেই ছেলেটা নিজের কাজের পিছনে ছুটেছে সর্বক্ষন। যদিও পৃথা বলতে পারতো যে,
-“আপনার যাওয়ার দরকার নেই, অন্য কেউ দিয়ে আসুক।”
কিন্তু পৃথার হৃদয়ই এ বাক্যে সায় দেয়নি। ইদানীং তার সবচেয়ে বড় অভ্যাস তুর্য নাম পুরুষটা। মানুষটাকে ছাড়া এক মুহুর্তও যেন বহুবছর মনে হয় পৃথার। এই যে আগে তুর্যের যে উদ্ভট কথাগুলোর জন্য বিরক্ত হতো এখন সেই কথাগুলোই ভালো লাগে। সারাদিনের হাজারটা চিন্তা, ক্লান্তি তু্র্যের ঐ উদ্ভট কথাগুলোর সম্মুখে এসে ফিকে পড়ে যায়। প্রাণ খুলে তখন হাসতে ইচ্ছে হয়। পৃথার ছোট্ট হৃদয়টা তুর্য নামক ঐ বলিষ্ঠ পুরুষটাকে আজকাল অনুভব করে। মেয়েটার বয়স কম। বাবা মা ভাইরা কখনও তাকে পুরুষ স্বান্নিধ্যে যেতে দেয়নি ততটা। সব সময় আগলে রেখেছে, হয়তো ছোট বেলার ঐ বিয়েটার কারনেই তারা পৃথাকে নিয়ে ভয়ে ছিল। সে যাই হোক এক কথায় বলা যায় তুর্যই তার জীবনে আসা ভালোবাসাময় প্রথম পুরুষ। যার সাথে মেয়েটা এতটা প্রেয়ময় বাক্যালাপে জড়িত হয়েছে, এতটা কাছাকাছি এসেছে। যার দরুন তুর্যের প্রতি পৃথার অনুভূতি তৈরি হতে সময় নেয়নি বেশি। তাছাড়া বিয়ে নামক এক পবিত্র বন্ধন তো রয়েছেই। যে বন্ধনের জেরে বিয়ে না মেনে, বিয়ের আসর ত্যাগ করে, এত বছর দূরে থেকেও ফিরে আসতে হয়েছে তুর্যকে সেই বন্ধনের টান পৃথার মধ্যেও তো আছে। ইদানীং পৃথার মন তুর্যের ভালো মন্দের জন্য চিন্তা করে। তুর্যের জন্য উতালা হয়, তুর্যকে একটা নজর দেখার জন্য ছটফট করে। মানুষটাকে একটা বার জড়িয়ে ধরার জন্যও ছটফট করে পৃথার হৃদয়। আচ্ছা এই অনুভূতির নাম কি? এই অনুভূতিই কি তবে ভালোবাসা? জানে না পৃথা। তবে সে এইটুকু জানে তুর্য নামক ঐ পুরুষটার মধ্যে সে বাজেভাবে আঁটকে গেছে। তাকে ছেড়ে বের হওয়ার আর উপায় নেই। পৃথার ভাবনার মধ্যেই তুর্য হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো। বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল,
-“আমার ভীষন বুকে ব্যথা হচ্ছে বউ।”
পৃথা চমকালো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তুর্যের পানে। ছেলেটাকে বুকে হাত দিয়ে থাকতে দেখে হৃদয় কাঁপলো। এই মাত্রই তো একদম ঠিক ছিল লোকটা। কত কি বলল, এর মধ্যে হঠাৎ কি হলো? অস্থির হলো পৃথা। বিচলিত কন্ঠে বলল,
-“বেশি ব্যথা হচ্ছে? কোথায় ব্যথা হচ্ছে দেখি? আমাকে দেখান।”
তুর্য বুকে হাত দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,
-“আমার বোধহয় হার্ট অ্যা’টা’ক হয়েছে বউ। হার্টের মধ্যে কেমন করছে।”
থামলো তুর্য। নিঃশ্বাস আটকে থেমে থেমে আবার বলল,
-“উফফফ কি চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বুকের মধ্যে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি বোধহয় আজকেই শেষ।”
শেষ! মানে কি? পৃথা আরও অস্থির হলো। দুমড়ে মুচড়ে উঠলো তার কলিজাটা। সত্যিই যদি হার্ট অ্যাটাক করে মানুষটা তখন কি হবে। আজকাল তো আর রোগ শোকের কোনো বয়স নেই। যখন ইচ্ছে হানা দেয়। পৃথার ভয় জাগলো। হারানোর ভয়ে দিশেহারা হয়ে উঠলো মেয়েটা। ব্যাকুল হয়ে বলল,
-“আপনার কিচ্ছু হবে না। আমি এখনই আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
কথাটা বলেই পৃথা তড়িঘড়ি করে নামতে শুরু করলো বিছানা থেকে। তুর্য তৎক্ষণাৎ হাত টেনে ধরলো পৃথার। আগের ন্যায় বুকে হাত দিয়েই বলল,
-“কারো কাছে নিতে হবে না। তুমি শুধু আমার ঠোঁটে একটা গাঢ় চু’মু খাও তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পৃথা ভরকে গেল প্রথমে। তবে পরক্ষনেই পুরো ঘটনা মস্তিষ্কে হানা দিতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো মেয়েটার। তার মানে এই লোকটা এতক্ষন নাটক করছিলো তার সাথে? আর সে কতটা ভয় পেয়েছিল। এখনও বুকটা কাঁপছে দুরু দুরু। পৃথার রাগে, দুঃখে এই মুহূর্তে কান্না পেয়ে গেল। লোকটা এতটা বর্বর কেন? ছলছল করে উঠলো মেয়েটার চোখ দুটো। তুর্য চমকালো। পৃথার চোখে পানি কেন? সে কি কোনোভাবে পৃথাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে? বিচলিত হলো তুর্য। দ্রুত নিজের অভিনয় বাদ দিয়ে উঠে বসলো সে। অস্থির কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
পৃথা তুর্যের নিকট থেকে দূরে সরে গেল। দুই হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলো নিজের। অভিমানী কন্ঠে বলল,
-“আপনার সাথে আর কোনো কথাই নেই আমার। আপনি আপনার মতো থাকেন আর আমি আমার মতো। আপনাকে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে। একটা মিথ্যাবাদী, শ’য়’তা’ন লোক।”
তুর্য বোধহয় বুঝলো পৃথার কথাগুলোর মানে। সে এগিয়ে গেল মেয়েটার পানে। আদুরে কন্ঠে বলল,
-“তুমি কি সবটা সত্যি ভেবে নিয়েছিলে? আমি তো মজা করছিলাম। স্যরি আমি বুঝতে পারিনি তুমি এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়বে।”
পৃথা মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। অভিমানী কন্ঠে আবার বলল,
-“আপনাকে কিছু বুঝতে হবে না। শুধুমাত্র দূরে থাকুন আমার থেকে। আর কথাও বলবেন না আমার সাথে।”
তুর্য হাসলো। স্ত্রীর অভিমানে তার বিচলিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রশান্তি অনুভব করলো। পৃথা তাকে নিয়ে ভেবেছে, তার একটু অভিনয়ে দিশেহারা হয়েছে এর থেকে সুখকর আর কি হতে পারে? পৃথার কথা অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ালো না তুর্য। বরং নিজের দুই হাত বাড়িয়ে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো স্ত্রীকে। আদুরে কন্ঠে বলল,
-“তোমার থেকে দূরে সরে থাকা এ জীবনে হয়তো আমার সম্ভব নয় বউ। আর কথা না বলে থাকা তো অসম্ভবের উপরেও অসম্ভব। আমার বউয়ের সাথে আমি কথা না বলে কিভাবে থাকবো?”
অভিমানের মধ্যে প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্য পেলে অভিমান প্রথম পর্যায়ে বাড়ে বই কমে না। পরবর্তীতে হয়তো প্রিয় মানুষের আদর ভালোবাসায় একটু একটু করে কমে যায়। পৃথার অভিমানটাও ঠিক তেমন আকারই ধারন করলো। হাত চালিয়ে তুর্যের থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো নিজেকে। তুর্য ছাড়লো না। হুট করেই সে প্রশ্ন করে বসলো,
-“ভালোবাসো আমায়?”
পৃথা থমকে গেল। হৃদয়ে কম্পন ধরলো তার। ভালোবাসা! সত্যিই কি সে ভালোবাসে তুর্যকে? যদি ভালো নাই বাসতো তবে তার হৃদয়ে তুর্যকে নিয়ে এই অনুভূতিগুলো কিসের? পৃথা চোখ তুলে তাকালো তুর্যের পানে। তুর্য আলতোভাবে চু’মু খেল স্ত্রীর ললাটে। মৃদু কন্ঠে আবার শুধালো,
-“ভালোবাসো আমায়?”
পৃথা ড্যাব ড্যাব করে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো তুর্যের পানে। অতঃপর ওষ্ঠ ফাঁক করলো কিছু বলার উদ্দেশ্যে কিন্তু বলতে আর পারলো না। তার আগেই বিছানায় ফেলে রাখা তুর্যের মোবাইলটা বেজে উঠলো প্রবল ঝংকার তুলে। তুর্য বিরক্ত হলো। বউয়ের সাথে এত সুন্দর একটা মুহূর্তে আবার কে বিরক্ত করে? অবশ্য সব সময় এমনই হয়। পোড়া কপাল তার। বউয়ের একটু সান্নিধ্যে গেলেই পুরো পৃথিবী বিপক্ষে চলে যায়। তার জীবনের একটু ভালো মুহুর্তও সহ্য হয় না কারো। মনের মধ্যে এক রাশ বিরক্তি নিয়েই নাম্বার না দেখেই কলটা ধরলো সে। পৃথার পানে দৃষ্টি রেখেই বলল,
-“হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম। কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না তবে মুহুর্তেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো তুর্যের। পৃথাকে ধরে রাখা হাতটাও আলগা হলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“আসছি আমি।”
কথাটা বলেই কল কাটলো তুর্য। পৃথাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বাসায় পড়া টিশার্ট আর ট্রাউজার শরীরে নিয়েই পা বাড়ালো বাইরের দিকে। যেতে যেতে পৃথাকে বলল,
-“আমার আসতে দেরী হতে পারে। ঘুমিয়ে পড়ো তাড়াতাড়ি।”
আগে কখনও পৃথা পিছু না ডাকলেও আজ কেন যেন মেয়েটা পিছু ডাকলো তুর্যের। হুট করেই বলল,
-“শুনুন।”
তুর্য থমকে দাঁড়ালো। পিছু ফিরে বলল,
-“বলবে কিছু?”
এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো পৃথা। ইতস্তত করে বলল,
-“তাড়াতাড়ি ফিরবেন। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো।”
তুর্যের হৃদয়ে শিহরণ জাগলো। প্রশান্তিতে ভরে উঠলো মন প্রাণ। এতদিন প্রতিবার কাজে বের হওয়ার আগে পৃথার মুখ থেকে যে বাক্যটা শোনার জন্য ছটফট করতো সে, আজ ঠিক সেই বাক্যটাই শোনার সৌভাগ্য তার হলো। পৃথার কথার পরিপ্রেক্ষিতে তুর্যের ভীষণভাবে বলতে ইচ্ছে হলো,
-“অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে যেও তুমি।”
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বাক্যটা কন্ঠে ধারন করতে হৃদয় সায় জানালো না। হৃদয় চাইলো পৃথা তার অপেক্ষায় থাকুক। নিজের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে বউটাকে তার অপেক্ষায়রত থাকতেই দেখুক। তুর্য আবার পিছন ঘুরে এগিয়ে এলো পৃথার পানে। একটু ঝুঁকে মেয়েটার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
-“আসছি আমি।”
চলবে…..