#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব ৪০
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
৪১.
সময়ের কাঁটা ঘূর্ণায়মান। সে ঘুরতে ঘুরতে সকালের সময় পেড়িয়ে বিকালের দিকে গড়িয়েছে। তুর্যের মাথার চোট ততটা গাঢ় না হওয়ায় তাকে হাসপাতাল থেকে সসম্মানে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে ইতমধ্যে। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটা দিন পর্যবেক্ষণে থাকতে বলেছিল কিন্তু তুর্য রাজী হয়নি। এই হাসপাতাল, এখানকার ঔষধ ঔষধ গন্ধ এসব বারবারই অপছন্দের তালিকায় তার। তাই একটু তড়িঘড়ি করেই হাসপাতাল ছেড়েছে ছেলেটা। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই যে এতটা সময় তুর্যের জ্ঞান ফিরেছে অথচ সে আরুশের খোঁজ করেনি একবারও। তবে কি মাথায় চোট পেয়ে চোট পাওয়ার কারনটাই ভুলে গেছে নাকি মনে মনে বড়সড় কোনো পরিকল্পনা আটছে, ভেবে পাচ্ছে না আরুশ। ভয়ে আর বেচারা তুর্যের সম্মুখে একটা বারের জন্যও যায়নি। লুকিয়ে চুরিয়ে ছ্যা’কা খাওয়া প্রেমিকের মতো দূর থেকে দেখেছে তার স্যারকে। যদিও দুই একবার সাহস করেছিল, ভেবেছিল একটাবার তুর্যের সাথে দেখা করে মাফ চেয়ে নিবে তবে পরক্ষণেই আবার ভয়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে। বলা তো আর যায় না, পরে দেখা যাবে সে মাফ চাইতে তুর্যের কাছে গেল আর তুর্য প্র’তি’শো’ধ নিতে তার মাথা ফা’টি’য়ে এই হাসপাতালেরই কোনো এক বিছানায় শুইয়ে দিল। তখন কি হবে? তার থেকে কয়েকটা দিন যাক। তুর্য আর একটু সুস্থ হোক এবং এই ঘটনাটাও কিছুটা ভুলুক তারপর না হয় তার সম্মুখে যাওয়া যাবে।
৪২.
রাতের আঁধার ঘনিয়েছে। দিনের উজ্জ্বল সূর্যটা বিদায় নিয়ে প্রাকৃতিকে বিলিয়ে দিয়েছে আঁধারের মাঝে। ব্যস্ত শহরটা সেজে উঠেছে কৃত্রিম সোডিয়ামের আলোয়। তুর্য আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে নিজ কক্ষের বিছানায়। একটু পরপর আবার অধৈর্য্য ভঙ্গিতে দরজার পানে উঁকি ঝুঁকি মে’রে দেখছে পৃথা আসছে কিনা। সেই যে মেয়েটা কক্ষ থেকে বেরুলো আর এলো না। হাসপাতালে তো নিজ পরিবারের জনগোষ্ঠীর কৃপায় বউয়ের মুখটা পর্যন্ত ভালোভাবে দেখার সুযোগ পায়নি তুর্য। তারপর এলো বাড়িতে, ভেবেছিল এখানে এসে অন্তত বউয়ের সাথে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবে। গতকাল রাতে অর্থাৎ মাথা ফা’টা’র আগে পৃথার সাথে তার কথা বলার যতটুকু সৌভাগ্য হয়েছিল তাতে তুর্য এই টুকু অন্তত বুঝেছিল পৃথার হৃদয়ে তার জন্য অনুভূতির সঞ্চার ঘটেছে। তবে তখন তাড়াহুড়োতে থাকায় এ বিষয়ে পৃথার সাথে আর কথা বাড়াতে পারেনি বেচারা। হন্তদন্ত হয়ে ছুটেছে জঙ্গলে। আর তারপর হাসপাতাল। তুর্যের জ্ঞান ফেরার পরে যখনই এই বিষয়টা আবার তার মাথায় হানা দিয়েছে তখন থেকেই সে উতলা হয়ে উঠেছে পৃথার সাথে একটা বার একান্তে কথা বলার জন্য। সে যা ভেবেছে সেটাই সঠিক কিনা নিশ্চিত হতে দিশেহারা হয়ে উঠেছে তুর্যের হৃদয়। অথচ তার পরিবারও তাকে একটু শান্তিতে বউয়ের কাছে থাকতে দিচ্ছে না। আর বউ তো বউই, পাষান মহিলা একটা। যতটা পারছে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তুর্যের ভাবনা চিন্তার মাঝেই পৃথা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ঢুকলো কক্ষে। এগিয়ে গিয়ে প্লেটটা বিছানার উপরে তুর্যের সম্মুখে রেখে বলল,
-“খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি। এরপর ঔষধ আছে আপনার।”
তুর্য একবার তাকালো খাবার প্লেটের দিকে পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি ঘুরালো পৃথার পানে। বেশ স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,
-“খাইয়ে দাও।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
-“কেন আপনার হাতে কি হয়েছে? নিজের হাতে খেয়ে নিন।”
তুর্য ঠোঁট উল্টে দিল। বাচ্চাদের মতো করে বলল,
-“আমি অসুস্থ বউ।”
পৃথার কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় আরও কুঁচকে এলো। আঁখিদ্বয় ছোট ছোট করে সে বলল,
-“মাথায় ফেটেছে। হাত দুইটা তো ঠিকঠাক একদম সোজা লাঠির মতো আছে। তাহলে নিজের হাত দিয়ে খেতে সমস্যা কি?”
তুর্য চোখে মুখে বিষন্ন ভাব ফুটিয়ে তুললো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-“এই অবস্থাতেও তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করছো বউ? আমার মতো এক অবলা স্বামীর জন্য তোমার কি একটুও মায়া লাগছে না? এতটা পাষান তুমি কিভাবে হচ্ছো বউ? ঐ সিনেমার নায়িকাদের মতো আমার অসুস্থতায় তোমার বুকটা কি একটুও কেঁপে কেঁপে উঠছে না?”
তুর্যের এমন অভিনয় মিশ্রিত বাক্য শ্রবণে বিরক্ত হলো পৃথা। আবার মায়াও লাগলো ভীষণ। যতই হোক তুর্য অসুস্থ। মাথা ফাটলেও সেটা তো অসুস্থতাই, কতটা র’ক্ত গতকাল তার মাথা থেকে গড়িয়েছে পৃথা স্বচক্ষে তা অবলোকন করেছে। ঐ র’ক্তে’র কথা স্মরণে আসতে এবার সত্যিই মেয়েটার বুক কেঁপে উঠলো। প্রিয় পুরুষের জন্য হৃদয় হাহাকার করে উঠলো হৃদয়। আর পৃথা না করতে পারলো না তুর্যের মুখের উপরে। যদিও এভাবে হুট করে একজন পুরুষকে খাইয়ে দিতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছে মেয়েটার তবুও হাত বাড়িয়ে সে খাবার প্লেটটা হাতে তুলে নিল। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
-“আসুন খাইয়ে দিচ্ছি।”
তুর্যের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। পৃথার পানে একটু এগিয়ে বসলো সে। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-“দাও তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও বউ।”
পৃথা কোনো দ্বিরুক্তি করলো না, ছোট ছোট লোকমা করে চুপচাপ খাইয়ে দিতে শুরু করলো তুর্যকে। তুর্যও ভদ্র বাচ্চাদের মতো খেয়ে নিতে লাগলো বউয়ের হাতে। আবার মাঝে মাঝে পৃথাকে খাওয়ারও আদেশ দিল। পৃথা হাসলো। হৃদয়ের কোনে এক মুঠো প্রশান্তির স্থান দিয়ে সেও খেয়ে নিতে শুরু করলো তুর্যের সাথে সাথে।
****
সময় গড়ালো কিছুটা। যদিও এখনও তেমন রাত নয়। ঘড়ির কাঁটায় টিক টিক করে জানান দিচ্ছে কেবল রাত্রি নয়টা। চারদিকটা এখনও দিনের আলোর ন্যায়ই কোলাহল পরিপূর্ণ। পৃথা তুর্যকে খাইয়ে দাইয়ে ঔষধ খেতে বলে তখন প্লেট নিয়ে চলে গিয়েছিল নিচে। সবটা গুছিয়ে, সকলের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে কেবলই ফিরেছে আবার কক্ষে। দরজা গলিয়ে কক্ষের ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেল তুর্য চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। পৃথা টা টু কোনো শব্দ করলো না। নিঃশব্দে এগিয়ে গেল তুর্যের পানে, বসলো তার পাশে। কি সুশ্রীই না লাগছে এই পুরুষের ঘুমন্ত মুখশ্রীটা, যেন কোনো নিষ্পাপ বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। অথচ জেগে থাকলে ব্রি’টিশ’গী’রিতে সকলকে হার মানিয়ে ফেলে। মুখ থেকে সারাক্ষণ বু’লে’টে’র ন্যায় লাজ লজ্জাহীন বাক্য ছুঁড়তেই থাকে। পৃথা হাসলো স্বামীর ঘুমন্ত মুখশ্রী দর্শনে। কেন যেন ভীষণ ইচ্ছে হলো হাত বাড়িয়ে প্রিয় পুরুষটার গাল দুটো একটু ছুঁয়ে দিতে। সর্বদা লজ্জায় নিজের ইচ্ছাকে দমন করলেও আজ আর তেমনটা করলো না। নিজের উষ্ণ হাত দ্বারা স্পর্শ করলো তুর্যের এক গাল। সাথে সাথেই যেন ঝংকার তুললো মেয়েটার হৃদয়ে, বিদ্যুৎ খেলে গেল সর্বাঙ্গ জুড়ে। তবুও পৃথা নিজের হাত সরিয়ে নিল না। আলতোভাবে স্পর্শ করতে শুরু করলো স্বামীর পুরো মুখটা জুড়ে। হঠাৎ করেই তার স্মরণে এলো সেদিনের কথা, একটা চু’মু’র জন্য সেদিন কতই না পাগলামী করেছিল তুর্য। পৃথার হৃদয়ে অদ্ভুত অনুভূতি জাগ্রত হলো। ইচ্ছে হলো এবার তুর্যকে একটা চু’মু দিয়েই দিতে। মস্তিষ্ক তার এই ইচ্ছের বিরোধীতা করলেও হৃদয় সায় জানালো। পৃথার হৃদয় স্পষ্টভাবে বলল,
-“তুর্য তার স্বামী। একজন স্বামীকে তার স্ত্রী চু’মু দিতেই পারে তাতে দোষের তো কিছু নেই। তাছাড়া ছেলেটা এখন ঘুমিয়ে আছে। চু’মু দিলেও টের পাবে না।”
পৃথা আর তেমন ভাবলো না। নিজের ইচ্ছেকে পরিনতি দিতে একটু ঝুঁকে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো তুর্যের কপালে। ঠিক তখনই ধপ করে চোখ মেলে তাকালো তুর্য। হকচকিয়ে উঠলো পৃথা। তড়িৎ গতিতে ছিটকে দূরে সরে গেল। মুহুর্তেই লজ্জায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো তার চোখ মুখ জুড়ে। ইসস এই পুরুষের ঠিক এখনই চোখ মেলে তাকাতে হলো? আর একটু পর চোখ খুললে কি হতো? লজ্জা , সংকোচ, ভয়ে হাঁসফাঁস করে উঠলো পৃথা। ইচ্ছে হলো এখনই ছুটে পালাতে। আর সে করলোও তাই। তুর্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।
এর এদিকে বেচারা তুর্য! চড়ম বিস্ময় আর বিরক্তিতে বেহুঁশের মতো পড়ে রয়েছে বিছানাতেই। এতক্ষনও সে জেগেই ছিল। শুধুমাত্র বউয়ের মতিগতি বোঝার জন্য একটু ঘুমের ভান ধরে পড়েছিল। তারপর বউ যা শুরু করলো। রীতিমত তার ধৈর্য্য, সহ্য ক্ষমতার বাঁধ ভেঙে দিচ্ছিলো। তারপরো বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে চোখ বন্ধ করে পড়েছিল শুধুমাত্র বউয়ের একটু ভালোবাসা পেতে। কিন্তু তাও শেষ পর্যন্ত আর পারলো না। পৃথার নরম ওষ্ঠের স্পর্শ পেতেই আপনা আপনি খুলে গেল চোখ দুটো। কেন খুললো? এই মুহূর্তে নিজের চোখের উপরে নিজেই বেজায় বিরক্ত তুর্য। ইচ্ছে তো করছে থাপ্পড় মেরে নিজের চোখ দুটো নিজে খুলে নিতে। কি হতো আর কিছুক্ষন পর চোখ দুটো খুললে? তাহলে হয়তও বউয়ের ওষ্ঠের আরও দুই চারটা চু’মু কপালে জুটতো। তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,
-“আগে ভাবতাম পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষগুলোই আমার শত্রু। কিন্তু না এখন দেখছি নিজের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো আরও বড় শত্রু। বে’ই’মা’ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আমার খাস, আমার পড়িস আবার আমার সাথেই নেম’কহা’রামি করিস।”
****
রাত ১২ টার অধিক। বাড়ির মানুষ ইতমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায় সবাই। চারদিকটাও ধীরে ধীরে নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যায় শহরের বুকে প্রজ্জ্বলিত হওয়া আলো গুলোও এখন নিভে গেছে অনেকটা। তুর্য অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করছে নিজ কক্ষে। পৃথা এখনও ঘরে ফেরেনি। সেই যে লজ্জায় কক্ষ থেকে দৌড়ে পালালো আর তার দেখা নেই। তুর্য আরও কিছুটা সময় নিয়ে অপেক্ষা করলো পৃথার। শেষে অধৈর্য্য হয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়লো কক্ষ থেকে। আশেপাশে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে পা বাড়ালো ইরার কক্ষের পানে। বাড়িতে বসবাসকারী পুরুষদের কক্ষে তো আর যাবে না মেয়েটা। আর অন্যান্য যারা আছে ইরা ব্যতীত বাকি সবাই জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতী। তাদের কক্ষেও যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে পৃথা ইরার কক্ষেই আছে। তুর্য গিয়ে দাঁড়ালো ইরার কক্ষের সম্মুখে। হাত উঠিয়ে আলতোভাবে টোকা দিল কক্ষের দ্বারে। প্রথম বারে দরজা না খুললেও দ্বিতীয়বারে দরজা খুললো ইরা। সম্মুখে না তাকিয়েই বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,
-“এত রাতে কি সমস্যা?”
তুর্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো ইরার পানে। থমথমে কন্ঠে বলল,
-“তোর ভাবী তোর কাছে?”
তুর্যের কন্ঠস্বর শ্রবণেই কেঁপে উঠলো ইরা। একটু আগে চোখ জুড়ে থাকা ঘুম ঘুম ভাবটা উবে গেল নিমেষেই। চোখ বড় বড় করে সে তাকালো তুর্যের পানে। আমতা আমতা করে বলল,
-“জজজ্বী ভাইয়া। তখন এসেছিল, পরে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক ডাকা ডাকির পরও ওঠেনি।”
থামলো ইরা। আবার বলল,
-“আমি এখনই তুলে দিচ্ছি ভাবীকে। একটু দাঁড়াও।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তুর্য। থমথমে কন্ঠে বলল,
-“তার প্রয়োজন নেই। তুই শুধু দরজা থেকে সরে দাঁড়া।”
তুর্যের আদেশ আসতেই ইরা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। তুর্য আর সময় নষ্ট না করে লম্বা লম্বা কদমে কক্ষের ভিতরে ঢুকে পড়লো। বিছানা কাছে গিয়ে খুব সাবধানে কোলে তুলে নিল পৃথাকে যাতে তার ঘুম ভেঙে না যায়। অতঃপর বউয়ের ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বলল,
-“কোথায় আমি অসুস্থ তাই বউ সেবা করবে তা না। এই রাত বিরাতে বউকে কোলে নিয়ে আমার দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।”
চলবে…..