#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব ৪৪
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
[ প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
৪৭.
রাত বেড়েছে। চারিদিকটা আঁধারের চাদরে মুড়ে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। হয়তো ইতমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। তবে আজ রাতটাতেও ঘুম নেই তুর্য এবং পৃথা নামক দুই নর নারীর আঁখিদ্বয়ে। পৃথা আজ শাড়ি পড়েছে। নিজেকে খুব সুন্দরভাবে পরিপাটি করে সাজিয়েছে। যদিও আজকের রাতটা নিয়ে পরিকল্পনা ছিল অনেক তবে তার কিছুই তুর্যের জন্য পূর্ণতা দিতে পারেনি। পৃথা খুব করে ভেবে রেখেছিল। ঐ নাটক, সিনেমা কিংবা গল্পের ন্যায় আজ পুরো কক্ষটা সে মোমের আলোয় সাজাবে। সাথে নিজেও শাড়ি পড়ে সুন্দরভাবে সেজেগুজে তুর্যের নিকট ধরা দিবে। তুর্যকে চমকে দিয়ে সে লাজুক ভঙ্গিতে বলবে,
-“ভালোবাসি প্রিয়।”
কিন্তু তার কিছুই হলো না আজ। কি হতো গতকালকের মাত্র একটা রজনী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলে! কত রজনীই তো নিয়ন্ত্রণে কাটালো। তা না, নিজেও নিয়ন্ত্রণ হারালো আর তাকেও উস্কে দিল। সকাল সকাল উঠে আবার পরিবারে লাগিয়ে দিল আরুশ আর ইরার বিয়ের কথাটা। সব মিলিয়ে একটা হযবরল অবস্থা। এর
মধ্যে আবার নিজ কক্ষে বিবাহ বার্ষিকীর আয়োজন করবে কখন? তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল পৃথা। তার সকল পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেওয়ার জন্য যদিও লোকটার উপরে রাগ লাগছে ভীষন তবুও আজ নিশ্চুপ রয়েছে। আজ এমন একটা দিনে আর কোনো রাগ, অভিমান, খারাপ লাগা নিয়ে থাকতে চায় না পৃথা। পিছনের সকল খারাপকে ভুলে সে নতুনভাবে জীবনটা শুরু করতে চায় তুর্যের সাথে।
পৃথা নিজেকে পরিপাটিভাবে সাজিয়ে আয়নায় দেখে নিল আরেকটি বার। অতঃপর দরজার নিকটে গিয়ে খুলে দিল দরজাটা। মৃদু কন্ঠে বলল,
-“ভিতরে আসুন।”
তুর্য কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাটছিলো। মূলত পৃথাই তাকে বের করে দিয়েছিল। শক্ত কন্ঠে বলে দিয়েছিল,
-“আমার সব প্ল্যানিং এ তো জল ঢেলেছেন এখন অন্তত কিছুটা সময় বাইরে থেকে আমাকে উদ্ধার করুন।”
তুর্যও আর কথা বাড়ায়নি। এমনিই কম অন্যায় সে করেনি। সবচেয়ে বড় অন্যায় বিবাহ বার্ষিকীর তারিখ ভুলে যাওয়া। এটা নিয়ে যে পৃথা এখনও কোনো ঝামেলা করেনি এই তো অনেক। তারপর যদি আবার বউয়ের কথাও না শোনে তবে আজ আর রক্ষা থাকবে না। পৃথার কন্ঠস্বর কর্ণে পৌঁছাতেই চোখ তুলে তাকালো তুর্য। অমনি থমকে গেল বেচারা। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বেড়ে গেল আগের থেকে দ্বিগুণ হারে। সম্মুখে দাঁড়ানো এ কাকে দেখছে তুর্য? এই মুহূর্তে পৃথাকে তার নিকট কোনো পরীর তুলনায় কম লাগছে না। তুর্য পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা শরীরে মেয়েটা এক খানা লাল রঙের শাড়ি জড়িয়েছে আজ। এই শাড়িটা তারই কেনা। প্রথমদিন মেয়েটা এ বাড়িতে আসার পর যে জামা কাপড় পরিপূর্ণ লাগেজটা পৃথাকে সে দিয়েছিল এটা তার মধ্যেই ছিল। আঁখিদ্বয়ে মোটা করে কাজল লেপেছে পৃথা, ওষ্ঠদ্বয়ে আবার হালকা গোলাপি লিপস্টিক লাগিয়েছে। মেয়েটার ঐ উষ্ণ ওষ্ঠজোড়া তুর্যের নিকট যেন আরও উষ্ণ হয়ে উঠেছে এই সময়ে। ইচ্ছে করছে এখনই ঐ ওষ্ঠের উপরে হামলে পড়ে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিতে। তুর্য মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে গেল কক্ষে ভিতরে পৃথার পানে। দরজাটা লাগিয়েই দুই হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটাকে একটু জড়িয়ে ধরতে। পৃথা সরে গেল সাথে সাথে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
-“এখন না।”
তুর্য আশাহত হলো। অসহায় কন্ঠে বলল,
-“তাহলে কখন?”
পৃথা উত্তর দিল না কোনো। তুর্যের পানে এক পলক তাকিয়ে এগিয়ে গেলো কক্ষে স্থান পাওয়া টেবিলের পানে। একটা বাক্স থেকে ছোট একটা কেক বের করে রাখলো টেবিলে। অতঃপর একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকালো আবার তুর্যের পানে। মৃদু হেসে বলল,
-“শুভ বিবাহ বার্ষিকী প্রিয় স্বামী। আমরা একে অপরের না হয়েই আটটা বছর কাটিয়ে দিয়েছি।”
পৃথার কথা শেষ হতে না হতেই তুর্য ফট করে বলল,
-“আট বছরের থেকে একটা রাত কম হবে। কারন আমরা গত রাতে এক হয়ে গেছি।”
পৃথার মেজাজ বিগড়ালো। কথাটা বলার সময়ে কি সুন্দর একটা অনুভূতি ছিল পৃথার ভিতরে অথচ এই পুরুষ মাত্র একটা বাক্যবান দিয়েই সে অনুভূতি ধূলিসাৎ করে ছাড়লো। এর কি সর্বদা মুখটা চালাতেই হবে? পাঁচটা মিনিটের জন্যও এর মুখ বন্ধ রাখা যায় না? পৃথা দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,
-“ওটা আট বছরই হবে। কাল রাত ১২ টার পরে আপনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন।”
তুর্য ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো। দুষ্টুমির স্বরে বলল,
-“বাহ ভালোই হিসেব রেখেছো দেখছি। তা আর কি কি হিসেবে রেখেছো?”
পৃথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। থমথমে কন্ঠে বলল,
-“অনেক কিছুরই হিসেব রেখেছি। আগে কেকটা কাটি তারপর বলছি। এদিকে আসুন।”
তুর্য এগিয়ে গেল টেবিলের নিকট। তবে সে পৃথার পাশে না দাঁড়িয়ে দাঁড়ালো পিছনে। আলতোভাবে মেয়েটার পিছন থেকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। পৃথার এক হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে টেবিলের উপরে রাখা প্লাস্টিকের ছুড়িটা তুলে নিয়ে নিল হাতে। কেকের উপরে আস্তে ধীরে সে ছুড়িটা চালাতে চালাতে মেয়েটার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“ভালোবাসি বউ।”
পৃথার ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। কেক কাটার ছুড়িটা ছেড়ে দিয়ে এক টুকরো কেক হাত তুলে নিল সে। তুর্যের মুখের সম্মুখে ধরে বলল,
-“ভালোবাসি প্রিয়।”
তুর্য পরম তৃপ্তি নিয়ে কেকের টুকরোটা মুখে পুরে নিল। নিজেও এক টুকরো কেক তুলে ধরলো পৃথার মুখের সম্মুখে। পৃথা হা করলো কেক খাওয়ার জন্য। কিন্তু তুর্য কেকের টুকরোটা পৃথার মুখে না দিয়ে লাগিয়ে দিল গালে। হকচকিয়ে উঠলো পৃথা। ফুঁসে উঠে তাকালো তুর্যের পানে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
-“এটা কি করলেন আপনি?”
তুর্য ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। একটু ঝুঁকে পৃথার গালের সাথে নিজের গাল লাগিয়ে দিল। কেকের তৈলাক্ত ক্রীমের অবস্থান নিজের গালে নিয়ে নে’শা’লো কন্ঠে বলল,
-“ভালোবেসেছি।”
পৃথা শিউরে উঠলো। কেঁপে উঠলো তার বক্ষস্থল। হাত বাড়িয়ে মেয়েটা খামচে ধরলো ধরলো স্বামীর বাহু। তুর্য টুপ করে এক খানা চু’মু খেল পৃথার গালে। অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
-“তোমার জন্য একটা জিনিস আছে।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
-“কি?”
তুর্য উত্তর দিল না পৃথার কথার। পা বাড়িয়ে সে এগিয়ে গেল আলমারির নিকট। আলমারির উপর থেকে একটা গোলাপী রঙা লাগেজ নামিয়ে রাখলো পৃথার সম্মুখে। শান্ত কন্ঠে বলল,
-“এটা তোমার। আমি যখন দেশে ফিরেছিলাম তখন এনেছিলাম।”
পৃথা কৌতুহল অনুভব করলো। উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি আছে এতে?”
-“তুমি খুলে দেখো।”
পৃথা দেরী করলো না, বেশ উৎসুক হয়ে খুললো লাগেজটা। সাথে সাথেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো অসংখ্য চকলেট, ছোট ছোট পুতুল, চুলের ব্যান্ড, হাতের ব্রেসলেট, কানের দুলসহ আরও অসংখ্য মেয়েলী সামগ্রী। পৃথার চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো। উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
-“এসব আমার?”
তুর্য মুখ বাঁকালো। ঠোঁট কামড়ে বলল,
-“নাহ, আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউয়ের।”
পৃথা ভেংচি কাটলো। চটপট করে চকলেট গুলো খুলে খেতেও শুরু করে দিল। অনেক দিন আগে চকলেটগুলো আনলেও যেহেতু খোলা হয়নি তাই ভালোই ছিল সেগুলো। স্ত্রীর বাচ্চাদের ন্যায় এমন কর্মকাণ্ড দেখে হাসলো তুর্য। একটু এগিয়ে গিয়ে বসলো পৃথার পাশে। ওষ্ঠে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল,
-“একা একাই খাবে? আমাকে একটু দিবে না?”
পৃথা চট করে একটা চকলেট এগিয়ে দিল তুর্যের পানে। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,
-“নিন।”
-“আমার এই চকলেটে হবে না। অন্য চকলেট লাগবে।”
তুর্যের ঘোর লাগা কন্ঠস্বর। পৃথা থমকালো, দুই সেকেন্ড লাগলো তার কথাটা মস্তিষ্কে ধারন করতে। তুর্যের কথার মানে বুঝতে পেরেই লাজে রাঙা হলো মেয়েটা। সরে যেতে চাইলো তুর্যের পাশ থেকে। কিন্তু তুর্য তাকে যেতে দিল না। কোমড় চেপে মিশিয়ে নিল নিজের সাথে। হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে ধরলো স্ত্রীর থুতনি। বল প্রয়োগে মুখটা একটু তুলে বলল,
-“তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে বউ।”
পৃথা লজ্জা পেল আরও, নিজের চোখ জোড়া নামিয়ে নিল সাথে সাথে। তুর্য একটু একটু করে এগিয়ে গেল মেয়েটার ওষ্ঠের পানে। খুব যতণে ওষ্ঠজোড়া আঁকড়ে নিল নিজ ওষ্ঠের ভাঁজে। পৃথা নিজের আঁখিদ্বয় বন্ধ করে নিল পরম আবেশে। আগে পিছে আর না ভেবে মত্ত হলো স্বামীর ভালোবাসায়।
৪৮.
সময় প্রবাহমান। এরই মধ্যে কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। আজ আরুশ এবং ইরার আকদের তারিখ। সেদিন পরিবারে আরুশ এবং ইরার বিয়ের কথাটা তুলে দেওয়ার পরে পরিবারের সকলে বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে বেশ। আরুশ ছেলে ভালো। এমন ছেলেকে মেয়ে দিবে না খুব কম লোকই আছে। ইরার কাছেও বিয়ের ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে সে হ্যা বলে দিয়েছে এক বাক্যে। যেখানে মেয়ে নিজেই রাজী সেখানে আর ঝামেলা করে লাভ কি? তবুও বাড়ির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখন বিয়ের কথা পাকাপাকি করে রাখবে পরে ইরার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলে বিয়ে দিবে কিন্তু বাঁধ সাধলো তুর্য। সে বেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে আরুশ আর ইরার বিয়ের জন্য। তার মাতামাতি দেখে মনে হয় এ যেন আরুশের বিয়ে নয় তার নিজেরই বিয়ে। তুর্যের এক কথা তুলে নেওয়া পরে হোক কিন্তু আকদটা এখনই হয়ে যাক। বাড়ির লোকও শেষ পর্যন্ত তার জোরাজুরিতে মেনে নিয়েছে বিষয়টা। সেই অনুপাতেই আজ আরুশ এবং ইরার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে।
****
সন্ধ্যার সময়টা অতিবাহিত হয়ে কেবলই রাতের পানে পা বাড়িয়েছে। আরুশ বেশ পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে নিজের বাড়ির লোকদের নিয়ে চলে এসেছে তুর্যদের বাড়িতে। আজ তার বিয়ে তাও প্রিয় নারীর সাথে। তাদের প্রেম হলো না, পাশাপাশি বসে দুই চারটা কথা হলো না অথচ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের করে নিতে পারছে প্রেয়সিকে। ভাবতেই প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে আরুশের হৃদয়। এই প্রথম ছেলেটার মনে হচ্ছে তুর্য ভীষণ ভালো, তার থেকে উত্তম পুরুষ আর এই পৃথিবীতে নেই। আরুশদের আসার পর পরই তাদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বসার কক্ষে। কাজী সাহেবও চলে এসেছে ইতমধ্যে। এখন শুধু আসার বাকি ইরার। তাও পৃথা নিয়ে আসছে।
ক্ষানিক বাদেই ইরাকে নিয়ে পৃথা প্রবেশ করলো বসার কক্ষে। ইরার ফর্সা শরীরে আজ গোলাপী রঙা শাড়ি রঙের এক খানা শাড়ি জড়ানো হয়েছে, মাথায় ঘোমটা। মুখে সাজগোজের প্রলেপ নেই মোটেই। আরুশ যেন থমকে গেল ওখানেই। হৃদ স্পন্দনের গতি বেড়ে গেল তার। আজ এ কোন ইরাকে সে দেখছে! শাড়িতে কোনো নারীকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে জানা ছিল বেচারার। আরুশের চিন্তা ভাবনার মধ্যেই পৃথা ইরাকে বসালো আরুশের পাশে। অতঃপর নিজেও ইরার পাশে বসবে ঠিক তখনই চোখ গেল তার অপরপাশে তুর্যের পানে। আর ঠিক এই সুযোগটাই নিল তুর্য। সে যেন এতক্ষন অপেক্ষায় বসে ছিল একটাবার পৃথার তাকানোর জন্য। বেচারী তাকানোর সাথে সাথেই সকলের অগোচরে তুর্য এক খানা উড়ন্ত চু’মু ছুঁড়ে মা’র’লো বউয়ের পানে। বুকে হাত দিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বুঝালো,
-“চলো আর একবার বিয়ে করে করে ফেলি, আর তারপর আরেকবার বাসর।”
চলবে…..