অচেনা পর্ব ১০ (শেষ পর্ব)
সন্ধ্যা হতে হতে বাড়ি থেকে বিয়ের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলা হলো। সন্ধ্যার সময় শুধু বড় ভাইয়াকে গেইটের কাছে দেখলাম একটা জরি আর কিসব রঙিন কাগজের বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ফেলে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। রুনি টুনি পড়তে বসে গিয়েছে। ছোট চাচী আলু ভর্তার জন্য মরিচ পোড়াচ্ছে। ফুপা খকখক করে সেই গন্ধে কাশছে। রুনি টুনি বই নিয়ে বসেছে। ওদের অংক দেখায় শিবলী ভাই। উনি একঘেয়ে সুরে কি জানি বলছে। বাবা আর ছোট চাচা মুখ শুকনা করে ঘুরঘুর করছে। বাচ্চাদের পড়া শেষ হলে রাতের খাবার পর উনারা টিভি দেখার অনুমতি পায়। সন্ধ্যা থেকে উনারা এই সময়ের অপেক্ষায় মন খারাপ করে ঘুরে বেড়ান। আমার মা বরাবরের মতোই শুয়ে আছেন। ফুপু প্রতিবার আসলে বাবাদের সাথে তার টাকা জোড়া দিয়ে সংসার চালানোর একটা গতি করার চেষ্টা করেন। সে হিসাবে বসে গিয়েছেন। সবই শোনা যাচ্ছে। শুনেও না শোনার ভান করে আমি বারান্দায় বসে আছি। রুনন আর শ্রাবণ আমার সামনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যার পর ওদের উঠানে যেতে দেওয়া হয় না। বাড়িতে অস্বাভাবিকতা বলতে এটুকুই।
আমার কেমন লাগছে জানি না। খুব ফাঁকা লাগতে শুরু করেছে নিজের ভেতর। খুব বেশি না হলেও মনের মাঝে কেমন একটা আবেশ কাজ করছিলো। হঠাৎ করে সেটা নাই হয়ে গিয়েছে। বিকাল থেকে আমার মেহেদী দেওয়া হাতটা জ্বলছে। খুবই জ্বলছে। আমি ঠান্ডা পানির মধ্যে হাত ডুবিয়ে বসে আছি। কোথা থেকে জানি ছোট চাচী কিছু বরফ এনে পানিতে ঢেলে দিয়েছে। ঠান্ডা লাগছে। তবুও হাতটা উঠাতে পারছি না। মেজচাচী একবার এসে আমাকে ধমক দিলো। আরেকবার জোর করে হাত কিছুক্ষণ উঠিয়ে রাখলো। আমি বুঝছি না মেজচাচী এত রাগ কেন করছে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত হাত পানিতে ডুবিয়ে রেখেও কোন লাভ হলো না। একটা হাতেই মেহেদী। সেই হাতটা মনে হচ্ছে ফুলে গিয়েছে। আমি আরেক হাত দিয়ে বরফ ঘষতে থাকলাম। চারিদিক অন্ধকার হবার পর মেজচাচী এসে সামনে বসলো। ঢোলা ম্যাক্সি পরে উনাকে কেমন বেঢপ দেখাচ্ছে। ওড়না দিয়ে বাতাস করতে করতে বললো,
“তোর হাতে বরফ ঘষাঘষি বন্ধ করবি? নিউমোনিয়া হবে তো!”
“মেজচাচী, তুমি কি আমাকে তুই করে বলো?”
মেজচাচী মুখ খিচিয়ে বললো,
“মনে নাই। তোকে ডাকি। তুই মনে রাখতে পারিস না?”
আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। মেজচাচী এত রেগে আছে কেন!
“এই মেহেদী বাড়ির সবাই পড়েছে। শুধু তোর হাত কেন জ্বলছে? ঢঙ!”
একটু চুপ করে থেকে মেজচাচী বললো,
“চৌদ্দ বছর ধরে এই বাড়ি ডেভেলপারকে দেওয়ার কথা হচ্ছে। দেয়নি কেন?”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
“জানি না।”
“কারণ তোর বাপ চাচারা অথর্ব।”
“ও আচ্ছা!”
“ও আচ্ছা! আবার বলে ও আচ্ছা!!”
এরপর মেজচাচী গড়গড় করে কথা বলা শুরু করলো।
“আমার অসহ্য লাগে এই সংসারে। ঢাকা শহরে জায়গা আছে কিন্তু আমরা থাকি ভাঙা বাসায়। আবার সার্ভেন্ট রুমও আছে দামী ফিটিংসওয়ালা! মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। কতবার বললাম অপেক্ষা করতে। মেয়েটা বড় হোক। চাকরি করুক। কিন্তু না আবার খুঁজতে যেতে হবে ছেলে সেই কষ্ট তারা কেন করবে? এরপর বললাম যে চলো ছেলের সাথে আগে কথা বলি। বিয়ের তো তাড়া নাই। এক দুই সপ্তাহ দেখি! কিন্তু না। আমার নাকি শখ বেশি। আমার সবকিছুতে বলে ‘বিদেশী কায়দা’।”
মেজচাচী ফোস ফোস করতে লাগলো। কিসের সাথে কি মিলিয়ে উনি কি যে বলছেন। মেজচাচীকে আগে কখনো এরকম দেখিনি। তাছাড়া অবাক হচ্ছি যে মেজচাচী খুশি মনেই নাচানাচি করছিলো বলে ভেবেছিলাম। মেজচাচী অনেকক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে গলাটা একটু স্বাভাবিক করে বললো,
“এখন তোর সাথে স্পর্শর বিয়ে দিবে ভাবছে। কি ছেলে কেমন ছেলে এসব কিছুই জানে না। হাতের কাছে আছে আর দিয়ে দিলো। অসহ্য লাগে এদেরকে আমার!”
মেজচাচী আবার অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“শোন বিয়ে এমন কোন বড় ব্যাপার না জীবনে। বিয়ে ভাঙ্গাতে কেঁদে বুক ভাসানোর কিছু নাই। বিয়ে ভেঙেছে আবার হবে। তুই কোন হাটে নাই যে তোকে বিক্রি না করে হাট ছেড়ে আমরা যাবো না।”
এতক্ষণে মেজচাচী ঠান্ডা হয়ে এসেছেন। এবার আমার দিকে উনি তাকালেন শান্তভাবে। তাকিয়ে বললেন,
“আমি একটা কথা বলি। মন দিয়ে শোন। বিয়ে করে কি হবে তা তো বলা মুশকিল। এভাবে কি জীবন চলবে! নিজের জীবন নিজের। কাউকে জড়ানোর আগে চিন্তা করে জড়াতে হয়। তারও আগে ভাবতে হয় নিজেকে নিয়ে। নিজে ভালো না থাকলে কি তোর আশেপাশের মানুষরা ভালো থাকবে?”
এরপর মেজচাচী হাসতে হাসতে বললো,
“চিন্তা ভাবনা না করে ‘বিদেশী কায়দায়’ প্রেম করলে তোর মেজচাচার মতো জুটে কপালে। হি হি হি।”
মেজচাচী আবারও নিজের রূপে ফেরত এসেছে। শান্তি লাগছে আমার। মেজচাচী ওড়না দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে করতে ঘরে চলে গেলেন। আমি বারান্দার জানালাটা হাত দিয়ে একটু খুললাম। এই জানালা দিয়ে আমাদের ঘরটা দেখা যায়। মা শুয়ে আছে খাটের কোণায়। কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছোট চাচী মায়ের গায়ে হাত দিয়ে বসে বসে চোখ মুছছেন।
এই এক রাতে আমি বড় হয়ে গেলাম। প্রেমের প্রস্তাব, বিয়ের ইচ্ছা সব একেবারে উধাও হয়ে গেলো। মনেই থাকলো না যে এই জন্মে আমার আমিনুল নামের কারো সাথে বিয়ের কথা হয়েছিলো। হাতের জ্বলা ভাবটাও নাই হয়ে গেলো।
এরপর আমি ধীরে ধীরে অচেনা এক আমিকে দেখতে পেলাম। যে কথা বলতে পারে, তার যা চায় তাই চাইতে পারে। আবার যারা তার উপর নির্ভরশীল তাদেরকে দিতেও পারে।
এই ঘটনার পর আমি মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। শিবলী ভাই একটা ছোট চাকরি যোগাড় করে দিলো। বড় ভাইয়া চাকরি পেয়েই রুনি টুনির পড়ার খরচ দেওয়া শুরু করেছিলো। আমার অল্প বেতন দিয়েই তাই রুননের স্কুলের বেতনটা দেওয়া শুরু করলাম। সাথে সপ্তাহে দুইদিন করে নাস্তায় সবাইকে পাউরুটি জেলি খাওয়ানো শুরু করলাম। এতেই আমাদের সংসারের চেহারা কিছুটা ফিরে আসলো। প্রায়ই মাছ-মাংস খাওয়া শুরু হলো। এরপর মাস্টার্স শেষ করতে করতে আমার ছোট চাকরি বড় হয়ে গেলো। বেতন বেড়ে গেলো। মাসে দুইবার ঢাকার বাইরে আর দুই তিন মাস অন্তর অন্তর দেশের বাইরে যেতে লাগলাম। ধীরে ধীরে আমিনুল নামের একজন ব্যক্তির উপর অসীম কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে যেতে লাগলো। যে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বেধে দিয়েছে অচেনা এক আমার সাথে।
পরিশিষ্ট: মেজচাচী আর বড় ভাইয়ার জোড়াজুড়িতে আমাদের সাততলা ভবন উঠেছে। আমরা দশটা ফ্ল্যাট পেয়েছি। তিনটায় আমরা থাকি আর বাকি সাতটার ভাড়ায় রাজার হালে আমাদের সংসার চলে। আমাদের বাপ চাচারা আরও অলস হয়েছে। উনারা উনাদের দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন। ছোট চাচাও এখন সারাদিন বাড়িতেই থাকেন। মেজচাচী আর ছোটচাচী খুবই সুন্দর করে নিজেদের রান্নাঘর সাজিয়েছেন। কিন্তু তবুও উনারা কেন জানি আমাদের বাড়িতে রান্না করেন। কয়েকবার আলাদা খাওয়ার কথা উঠেছে। কিন্তু ছোটচাচী চোখ কপালে তুলে আমার মায়ের অসুস্থতার দোহাই দিয়েছে। আমাদের চরচরে গরমে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করা অলস দুপুরের সুখ এই দালান এখনো কেড়ে নিতে পারেনি। এখন অবশ্য আমার বাবারা ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভিতে নাটক দেখেন। এটুকুই শুধু পার্থক্য।
আমার বিয়ে ভাঙ্গার পর থেকে নানা ঘটনার সাক্ষী হয় আমার জীবন। এর সাত বছর পর উনত্রিশ বছর বয়সে আমার আবারও বিয়ে ঠিক হয়। এবারও খোঁজ খবর করা হয় না। এবার পাত্র নিজে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে যায়। মেজচাচী এবারো রাগারাগি করেন আবার নাচানাচিও করেন। বিয়ের আগে তিনবার আমাকে NewLee Beauty Parlour-এ নিয়ে গিয়ে কি কি জানি করান। এবার গোল্ড ফেসিয়াল নামের কি একটা করে সারা শরীর চকচকে করার ব্যবস্থা করেন। ঝিকমিকে চেহারা নিয়ে আমি নিজের বিয়ের আসরে ঘুরে বেড়াই। মেডিকেলে পড়া রুনি আর ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে পড়া টুনি এবারো আমাদের হলুদের জিনিস সাজায়। রুনন শ্রাবণ বড় হয়েও পুরো বিয়ে মারামারি করে মাতিয়ে রাখে। এরপর সত্যিই আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের দিন আমি অনেকক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু সেই বাইশ বছরের মেয়েটাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। এই ঝরঝরে আত্মবিশ্বাসী যুবতী এতগুলো বছর কোথায় লুকিয়ে ছিলো কে জানে! এবার আমি সত্যিই অনেকগুলো মায়া পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছি বরফের দেশে!
(সমাপ্ত)