অচেনা পর্ব ৬
সকাল সকাল খুব চেচামেচির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। আমি শুয়ে শুয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম যে বিয়ের আর কতদিন বাকি। কেন যেন মনে পড়লো না। মাথাটা খুব ফাঁকা লাগছে। দুই বা তিনদিন পর বিয়ে। এখনো ছেলের একটা ছবি দেখলাম না। বিয়ের আগেরদিন সন্ধ্যায় অবশ্য আমার বাবারা চার ভাই বোন যাবে আমিনুলকে দেখতে। সে এসে পৌছাবে দুপুরে। রাতে গিয়ে সামান্য কথাবার্তা বলবে আর হাতে শপিং-এর জন্য কিছু টাকা দিয়ে আসবে। এখন আমি তো আর বলতে পারি না যে আমি সাথে যাবো। তাছাড়া এরপর তো কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। তারপর বিয়েই হয়ে যাবে। চেহারা দেখলেও কি না দেখলেও কি!
আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বারান্দায় তুমুল ঝগড়া চলছে। এক পক্ষে শিবলী ভাই আর আরেক পক্ষে মেজ চাচী আর ছোট চাচী। মেজ চাচী রেগে রেগে বলছে,
“তুমি এসবের দাম জানো? বারোশো তেরোশো টাকা প্লেট নেয়।”
“আহ হা! চাচী আমার কথা একটু বুঝেন। আমি প্যাকেট কিনে আনবো। সস্তা পড়বে। কাজ কম করতে হবে।”
ছোট চাচী উত্তেজিত হয়ে,
“তোমার কি মনে হয় আমরা কাজের না? মোটে তো চল্লিশ জন মানুষ। এটুকু রান্না আমরা করতে পারবো না?”
ঝগড়া চলতেই থাকলো। উঠানের একদিকে ঝগড়া চলছে আরেকদিকে দেখি স্পর্শ রেডি হয়ে অফিসের গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে। পেছনেই চামেলি দাঁড়িয়ে কি যেন বলছে। চামেলি আর লুবনা এত সকালে কিভাবে আসলো কে জানে! চামেলি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন সে স্পর্শের স্ত্রী হয়। একদিনে সম্পর্ক বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। লুবনা বারান্দায় রুনি টুনিকে দিয়ে কাগজ কাটাচ্ছে। নিজে শিলপাটায় মেহেদি পিষছে। পুরো উঠান জুড়ে রুনন আর শ্রাবণ দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশ।
আমি লক্ষ্য করে দেখলাম আমার আর লিস্টের কথা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে কেউ প্রেমের প্রস্তাব না দেওয়াতে। ইচ্ছা করছে আমিনুলের সাথে কথা বলতে। তার সাথে কোন একটা পার্কে গিয়ে বসতে। রাস্তায় চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে কিংবা কোথাও বসে ফুচকা খেতে। সব মেয়েরই এরকম ইচ্ছা হয় কিনা কে জানে!
হঠাৎ ফুপু উত্তেজিত হয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বললো,
“ছেলের ছবি পাওয়া গিয়েছে। ছবি! এই যে আমার ফোনে।”
সবাই গোল হয়ে ঘিরে দেখতে লাগলো। লুবনা দুই হাত উঁচু করে মন দিয়ে গোলের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো। শিবলী ভাই আর স্পর্শ কোন ফাঁকে যে চলে গিয়েছে! চামেলিকেও আশেপাশে দেখছি না। আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে আমাকে কেউ ছবি দেখাচ্ছে না বা দেখানোর কথা ভাবছেও না। ছবি দেখে যে যার মতো কাজে চলে গেলো।
সবাই চলে গেলে রুনি টুনি এসে আমাকে ফুপুর ফোনটা দিলো। ফোন হাতে দিয়ে তারা ফিকফিক করে হাসতে থাকলো। আমি এই প্রথম আমার হবু বরকে দেখলাম। লম্বা না খুব একটা কিন্তু খাটোও বলা যায় না। চুল মাথায় নাই বললেই চলে। কিন্তু অসম্ভব গৌর বর্ণ। মনে হচ্ছে গায়ের ধবধবে সাদা রঙের চোটে লোকটার মাথায় থাকা সামান্য চুলগুলো লাল হয়ে গিয়েছে।
লুবনা আবারও মেহেদী পিষতে বসে গিয়েছে। রুনি টুনি কাগজ কাটা বাদ দিয়ে ফিকফিক করে হেসেই যাচ্ছে। আমি একটা ধমক দিলাম। এবার দেখি লুবনাও ওদের সাথে হাসছে। কি একটা ঝামেলায় পড়লাম!
সারাটা দিন এভাবেই পার হলো। বিকাল হতে হতে রুনি, টুনি, লুবনার সাথে রুনন আর শ্রাবণও হাসিতে যোগ দিয়েছে। আমাকে দেখলেই তারা ফিকফিক করে হাসে!
চামেলি অবশ্য সম্পূর্ণভাবে অন্য দুনিয়ায় বসবাস করছে। একটু পর পর আমাকে স্পর্শ সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে। সারাদিনে আমি স্পর্শ সম্পর্কে যা জানলাম আমিনুল ইসলাম সম্পর্কেও এতটা জানি না। সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্যটি হলো স্পর্শ কানাডা যাচ্ছে। সে এটার প্রিপারেশন এর জন্য গত এক বছর ধরে ঢাকায় আছে। চামেলি খুব আদুরে গলায় বললো,
“স্পর্শ ভাইয়া কি বললো শোন। তার একা যাওয়ার ইচ্ছা নাই। বউ নিয়ে যেতে চায়। মানে বিয়েটা করে গেলো। বউ কয়েকদিন পরেই গেলো। কিন্তু এত অল্প সময়ে বউ কোথায় পাবে সেই চিন্তায় অস্থির। আসলে পুরুষ মানুষ তো। বউ ছাড়া কি আর থাকতে পারে!”
খুবই প্রেমময় সময় পার করছে চামেলি। এদিকে আমার মনে কেন যেন প্রেমের ভাব উদয় হচ্ছে না। অবশ্য ছবি দেখে কতটুকু কি আর হবে!
বিকালে আমার হবু শাশুড়ি আসলেন। অনেক বড় একটা স্যুটকেস নিয়ে উনি বাসায় ঢুকলেন। বাসার সবার মুখ কালো হয়ে গেলো। আমি এর কারণটা জানি। ছেলেপক্ষ যত জিনিস দিবে আমাদের তার সমান বা দ্বিগুণ দিতে হবে। কত টাকার ধাক্কা কে জানে! মুখে অবশ্য কেউ এসব বললো না। আমার হবু শাশুড়ি একটা করে জিনিস বের করে তার বর্ণনা দিতে লাগলেন আর আমার ছোট চাচী প্রশংসা করতে থাকলো। পাশ থেকে লুবনাও মাঝে মাঝে প্রশংসাসূচক বাক্য ছুড়তে লাগলো। রুনি টুনি স্যুটকেসের ডালা ধরে অত্যন্ত আনন্দের সাথে ভেতরের জিনিস দেখছে।
“বিয়ের শাড়িটা বেনারসি পল্লী থেকে নেওয়া। সিদুর লালই আমার পছন্দ। মা তোমার পছন্দ হয়েছে?”
আমি ঘাড় নাড়লাম।
“এইটা আনলাম যদি আপনারা হলুদ করেন তাই। পারটা তো দেখতেই পাচ্ছেন লাল। শাড়ির আঁচলটাও এই রঙ। খুলে দেখালাম না। আপনারা সময়মত খুলেন। মা তোমার পছন্দ হয়েছে?”
আমি ঘাড় নাড়লাম।
এভাবে উনি শাড়ি, ব্যাগ, কসমেটিকস সব দেখালেন। একটা জিনিস বের করেন আমার মা আর মেজচাচী চোখাচোখি করেন। তাদের মুখ একটু করে ছোট হয়ে যায়।
ফুপু রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়েছেন। উনি চামেলির হাতে নাস্তা পাঠালেন একবার। দুই প্রকারের বিস্কিট, চানাচুর আর নুডলস। এরপর জিনিস পত্রের বহর দেখে কাকে জানি দোকানে পাঠালেন। তারপর আবারও নাস্তা পাঠালেন। এবার দুইটি পরোটা, গরুর মাংস তিন পিস (সম্ভবত মেজচাচীর বান্দবীর বাড়ি থেকে ধার করে আনা), দুধ সেমাই আর একটা সাদা মিষ্টি আর আপেল। এটুকু করতেই ফুপু একেবারে লাল হয়ে গেলো। এই গরমে ফুপুর রান্নাঘরের দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু আসলে ভাত, ডাল, ভাজি করতে এক ঘন্টার বেশি লাগে না। তাছাড়া বিয়ের সব রান্না চাচীরাই করবে। আগে দুই তিনদিনের ছুটি আর কি!
ফুপু রাতের রান্না চাপিয়ে সবাইকে একজন একজন করে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বললো যে একটা মুরগী রান্না করেছে ৪০০ গ্রামের। আগে আমার হবু শাশুড়ি আর তার সাথে আসা ছেলেটা খাবে। সাথে আমি বসবো। এরপর বাঁচলে বাড়ির অন্য বাচ্চারা খাবে। রুনি, টুনি, রুননের চোখ একেবারে চকচক করে উঠলো। রাতে আমার হবু শাশুড়ি না খেয়েই চলে গেলেন। অনেকদিন পর সবাই মাংস খেতে পেলো। রুনন খুশিমনে রান হাতে নিয়ে বললো,
“আপা, তুমি বিদেশ গেলে কিন্তু আমাদের জন্য টাকা পাঠাবা। আমি একটা গোটা মুরগী একা খাবো।”
আমার চোখ ভিজে আসলো। এদের জন্য আমার যে কিছু করণীয় আছে এটা কখনো মনে হয়নি। হঠাৎ করে ইচ্ছা হলো সব বাদ দিয়ে অনেকগুলো টাকা ইনকাম করি। বাচ্চাগুলোকে প্রতিদিন ডিম, দুধ, মাংস খেতে দেই।
রাতে ঘুমোবার আগে একটা ফোন আসলো।
“আপা, আমি মন্টু। আজমল খালার সাথে আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম।”
“কোন খালা?”
“আমি আমিনুল ভাইয়ের খালাতো ভাই। আজকে বিকালে স্যুটকেসে দিতে গিয়েছিলাম।”
“ও! আচ্ছা।”
“আপনি একটু খালাকে বলে আমিনুল ভাইয়ের সাথে কথা বলেন।”
“উনি এখন প্লেনে না?”
“না। এখনো উঠেনি। আগামীকাল উঠবে। আপনি দয়া করে কথা বলেন। প্লিজ।”
“কেন?”
“কি আশ্চর্য। বিয়ে করবেন তাই আগে কথা বলেন। প্লিজ একটু ফোন করেন।”
“আচ্ছা।”
ফোনটা রেখে আমি শুয়ে পড়লাম। কিন্তু মনটা উশখুশ করতে থাকলো। তাই ব্যাপারটা ম্যাসেজ করে লুবনাকে জানালাম। সকালে ও যখন আসবে তখন আলোচনা করা যাবে। কিন্তু রাতেই লুবনা আমার মেজচাচীকে ফোন করে সব জানিয়ে দিলো। আমি, মা আর রুনি টুনি যে ঘরে ঘুমোই সেই ঘরে রাত এগারোটায় বৈঠক বসলো। ফুপু, দুই চাচী আর মা। তাদের কাছে মন্টুর আচরণ সন্দেহজনক লাগছে। রুনি টুনি আগ্রহের সাথে ঘুম ঘুম চোখে উনাদের আলোচনা শুনতে লাগলো। এরমধ্যে আমি কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরও পেলাম না।
(চলবে)