অচেনা পর্ব ৮
বিয়ের আগেরদিন উপলক্ষ্যে আমি বিউটি পার্লারে বসে আছি। মেজচাচীর এক বড়লোক বান্ধবীর পার্লার আছে। সে আমাকে নানা ধরনের ফ্রি সার্ভিস দিয়েছে। আমি সেগুলো নিতে এসেছি। এগুলো দিয়ে কি উপকার হবে কিছুই বুঝছি না। মেজচাচীর খুবই শখ যে বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাকে পার্লারে কিছু একটা করানো। বউ সাজার মতো টাকা তো আর আমাদের নেই। আসার সময় ফুপা হাতে দুই হাজার টাকা দিয়ে বলেছে যা ইচ্ছা করাতে। পার্লারে এসে আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। এখানে বেশিরভাগ সার্ভিসই দুই হাজার টাকা থেকে শুরু। অর্ধেক সার্ভিসের ভূমিকা কি মানুষের ত্বকে সেটাই বুঝছি না। যেমন-
আমরা ঢুকতেই ম্যানেজার হাসিমুখে এগিয়ে এসে কিছুক্ষণ মেজচাচীর সাথে কথা বললো। বোঝা যাচ্ছে ভালোই পরিচয় আছে। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপা, পেডিকিউর মেনিকিউর কোনটা করাবেন? ডিলাক্স না নরমালটা?”
আমি কিছুই বুঝলাম না। এরপর একে একে গোল্ড ফেসিয়াল, স্পা আরও কি কি যে বললো। আমি ভয়ে ভয়ে সবকিছুতেই বললাম,
“নরমালটা করবো।”
সারা শরীর ঘষাঘষি করার পর শুধু পা সামান্য চকচকে মনে হলো। তবে চুল একদম ঝিকমিক করতে লাগলো। আমি মন খারাপ করে আয়নার দিকে তাকালাম। এই চুল দেখে রুনি টুনি মন খারাপ করবে। ওদেরও যদি এরকম কোন কিছু করাতে পারতাম।
মেজচাচী অবশ্য ডায়মন্ড ফেসিয়াল নামের একটা ফেসিয়াল করে চকচকে মুখে আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে একটা বেজে গিয়েছে। এখন মা আমাকে গোসল করাতে চায়। এদিকে ছোট চাচীর ইচ্ছা আগে সংগীত করার। এটা নিয়ে ফুপুর সাথে ছোট চাচীর ছোট খাটো ঝগড়া লেগে গেলো। ফুপু সংগীতের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বললো,
“গান কে গাইবে? বাসায় তো কেউ গান পারে না।”
ছোট চাচী খুব বুঝদার গলায় বললো,
“বড়বুবু, সংগীতে গান গায় না। সংগীতে নাচানাচি হয়। বউ বসে থাকে সবাই ঘিরে নাচে। শেষে বউও নাচে।”
“কালকে তো একবার নাচানাচি হলো হলুদে। আবার কেন?”
এই নিয়ে ছোট চাচীর সাথে ঝগড়া লেগে গেলো। মাঝখান দিয়ে মা ঢুকে গেলো। আমাকে ঘরে নিয়ে পুরানো একটা লাল শাড়ি পরিয়ে উঠানে বসিয়ে দিলো। আমি ভেবেছিলাম ছোট চাচী হয়তো রাগ করে থাকবে। কিন্তু দেখা গেলো সে বাচ্চাদের মতো ছোটাছুটি করে পানি ছিটাচ্ছে সবার গায়ে। এক ফাঁকে লুবনা আমার কানে কানে বলে গেলো,
“ফুপু নাকি সংগীত করতে দিবে না। কোন অসুবিধা নাই। আমরা মেহেদীর সাথে করে নিবো। তখন তো ফুপু থাকবে না।”
ওদিকে রুমকিকে চামেলি পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে এটা নিয়ে সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করেছে। রুনন আর রুনি টুনি এটা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করেছে। শ্রাবণ না বুঝেই হেসে যাচ্ছে। ফুপু বেশিক্ষণ এসবে থাকতে পারলো না। পানি ছিটাছিটির মাঝেই বাবারা চার ভাইবোন তৈরি হয়ে বের হয়ে গেলো। ফুপা আজকে একটা গাড়ি ভাড়া করে দিয়েছে। দশ কেজি মিষ্টি, দশ কেজি ফল সাথে দিয়েছে। একটা কেকের বড় বাক্সও দেখলাম। আরও দুইটা ডালায় কি বুঝলাম না। তবে ফুপুর হাতে সবার সামনেই লুকিয়ে দুইটা টাকার বান্ডিল দিলো। এখন বোঝা যাচ্ছে যে কেন দেশে আসার পর থেকে ফুপু ফুপা তেমন কোন খরচ করছে না। উনারা মূল অনুষ্ঠানের জন্য সব টাকা জমিয়ে রেখেছে। সবাই ভেজা গায়ে গাড়িকে বিদায় দিলো। মেজচাচী, ছোটচাচী আর লুবনা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত টাকার জিনিস গেলো তার হিসাব করলো। মিষ্টি সতেরো হাজার টাকার আর ফল নাকি তেরো হাজার টাকার। বাকি জিনিসের দাম নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা চলতে থাকলো। হঠাৎ রুনি টুনি ফস করে বলে ফেললো,
“কেকটা থাকলে ভালো হতো। আমরা কতদিন ক্রিম কেক খাইনি।”
মুহুর্তেই সবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মা ওদের মাথায় একটু চাটি মেরে বললো,
“এমনিতেই আমরা অনুষ্ঠান করছি না। দশজনকে শুধু খাওয়াচ্ছি। ভালো মন্দ না পাঠালে হয়!”
মা বললো ঠিকই। কিন্তু মায়ের গলাটা কেমন ধরে আসলো! আমার সাদামাটা বিয়ের জন্য নাকি রুনি টুনির কথায় কে জানে!!
এরপর অনুষ্ঠানে একটু ভাটা পড়লো। গোসল করে যে যার ঘরে চলে গেলো। বাচ্চারা উঠানে ছোটাছুটি করতে লাগলো। চামেলি আর স্পর্শ কোথায় জানি নাই হয়ে গিয়েছে। লুবনা ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়লো। আমি শুধু বারান্দায় বসে বসে আমিনুলের বাসার কথা ভাবতে লাগলাম। ওদের বাসায় এখন কি আলোচনা হচ্ছে! আমি কি সত্যিই কানাডা যাবো!! বরফের দেশে!!!
আমার মনে হচ্ছে আগামীকাল আমার পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে সাজেশনের জন্য আমি অপেক্ষায় আছি। মাত্র এক ঘন্টা হয়েছে। ঢাকার যে রাস্তা পৌছাতেই তো লাগবে এক ঘন্টার উপর। ওখানে বসে কথা বলতে আরও দুই ঘন্টা। এরপর আবার দেড় ঘন্টা রাস্তায়। আমি অনেক ভাবে সময়টা হিসাব করে কমানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু লাভ হচ্ছে না।
হিসাব করছি আর ফুপাকে দেখছি। ফুপা স্পর্শের ঘরেই সারাদিন থাকে। এখন ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। ঘরে সম্ভবত নেটওয়ার্কের সমস্যা। ফুপা মানুষটা ছোট খাটো। এমনিতেই মোটা। উনার মুখের মোচ কেন যেন আরও মোটা বানিয়ে দেয় উনার অবয়বকে। দেখলেই একজন সাধাসিধা মানুষ মনে হয়। অথচ উনি আমেরিকাতে অদ্ভুত একটা পেশার সাথে জড়িত। উনি ঘুরে ঘুরে বয়স্ক আমেরিকানদের বাড়ি কিনে। শেষ বয়সে তারা অল্প দামে তাদের বাড়ি বেচে কোন প্রাইভেট ওল্ড হোমে চলে যায় বা কেউ কেউ সস্তা হোটেলে থাকে। এইসব বাড়ি কিনে সাজিয়ে গুছিয়ে উনি চড়া দামে বিক্রি করেন। এই পেশায় উনার মতো সাধারণ মানুষ কিভাবে ঢুকলো কে জানে!
ফুপা ফোন রেখে আমার দিকে হেসে এগিয়ে আসলো,
“কিছু লাগবে রাবেয়া?”
“না ফুপা।”
“কিছু লাগলে বলো। আমি এখানেই আছি। বিয়েতে তো মেয়েদের অনেককিছু লাগে। মেকাপ টেকাপ কিসব। তোমার কিছু লাগবে না?”
আমি হেসে ফেললাম। ফুপা আবার ফোন নিয়ে কথা বলতে লাগলো।
আমার ফুপা ফুপু অনেকভাবে আমাদের উপকারের চেষ্টা করে। কিন্তু কেন যেন আমরা কোনটাই কাজে লাগাতে পারি না। উনারা একবার বাড়ি ঠিকঠাক করতে টাকা দিলো। দুইটা ঘরে অন্তত এসি লাগাতে বললো। আমার বাবা ও চাচারা মিলে চিন্তা করলো যে এই বাড়ি কিছুদিনের মধ্যেই ডেভেলপারকে দিয়ে দিবে তাই এসব খরচে কাজ নেই। তার থেকে একটা সার্ভেন্ট রুম করে নেই। ওই কোনার অংশে তো আর বিল্ডিং উঠবে না। ঘর তুলে বাথরুম করার পর দেখা গেলো থাকার জন্য কোন সার্ভেন্ট নেই। বুদ্ধি করে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হলো। ভালো ভালো ফিটিংস এর জন্য ভাড়া বেশ ভালো পাওয়া যায়। এক কোনায় চেপেচুপে একটা রান্নাঘরও নাকি বানিয়েছে। এসব বারো বছর আগের কথা। বারো বছরে এই গলিতে সব হাইরাইজ বিল্ডিং হয়ে গেলো শুধু আমাদের বাড়িটাই আগের মতো থেকে গেলো। এরপর ফুপা বড় ভাইয়াকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। সেই আশার গুড়েও বালি। তবে একটা জিনিস আমাদের খুব উপকারে লাগে। সেটা হলো দুই ঈদে ফুপুর পাঠানো জামা কাপড়। ফুপু কার হাত দিয়ে কিভাবে জানি দুই ঈদে সবার জন্য কাপড় দেয়। এটা আমাদের সারা বছর খুবই কাজে লাগে।
বিকাল হতেই আমার দুই চাচী ছোটাছুটি শুরু করে দিলো। আমাকে ভালো কাপড় পরিয়ে ঘরে বসানো হলো। মেহেদি লাগানোর জন্য মেজচাচীর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় এসেছে। সে একবার নায়িকা শবনমকে মেহেদি পরিয়েছে। এছাড়া নায়ক ইমন খান তার মেহেদির এলবাম দেখে প্রশংসা করেছে এই গল্প কয়েকবার শুনলাম। রুনি টুনি আত্মীয় হওয়ায় অগ্রাধিকার পেলো। তারা আগেই মেহেদি দিয়ে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। শ্রাবণও হাতে একটা গোল একে নিলো। রুনন বেচারা কিছুটা বড় ছেলে হওয়ায় মেহেদি দিতে পারলো না। শুকনো মুখে ঘুরতে লাগলো। শ্রাবণকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সে উল্টো ভেংচি কেটে রুননের মনটা আরও খারাপ করে দিলো।
আমার এক হাতে মেহেদি দিয়ে আরেক হাতে শুরু হবে তখন আমার বাবারা বাসায় আসলো। আমার বুকে কেমন যেন করে উঠলো। ঈদের আগের দিন যেমন লাগে তেমন। ঘরে ঢুকতেই বাসার সবাই বাবাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সবার চোখে প্রশ্ন। ছোটচাচী দৌড়ে গিয়ে চুলাটা বন্ধ করে আসলো। পুরো গল্প শুনতে চায়। বাবা আস্তে করে বললো,
“কালকে বিয়েটা দেওয়া যাচ্ছে না। ওদের কিছু সমস্যা আছে। আগামীকাল ছেলেমেয়ে একবার নাহয় কথা বলুক।”
বলে বাবা আর চাচারা ঘরে চলে গেলো। বাবা ভেতরের বারান্দায় ঘুমায়। সে সেখানে গিয়ে গ্রীলটা লাগিয়ে দিলো। ফুপু আমাদের ঘরেই শাড়ির উপরের ওড়না খুলে চুলগুলো ছড়াতে লাগলো। ছড়াতে ছড়াতে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মেহেদি এক হাতেই থাক। দুই হাতে দিলে বাথরুম টাথরুম যেতে অসুবিধা।”
আমার খুব জানতে ইচ্ছা করলো যে কি এমন হয়েছে। কিন্তু আমি কখনো প্রশ্ন করিনি। আজকেও অন্যদিনের মতো চুপচাপ থাকলাম। এই প্রথম নিজেকে অসম্ভব অথর্ব মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে জোর করে একটা নম্র ভদ্র ভীতু মেয়ে হয়ে ডালপালা মেলছি যা সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয়।
(চলবে)