অফিস কলিগদের নিয়ে স্ট্যাটাস কি বিচিত্র জীবন
সকালে কাজে এসেই আমার সহকর্মীর টেক্সট পেলাম , ” আমি আজকে কাজে আসতে পারছি না , আমার স্ত্রী ভয়ানক অসুস্থ। আমি তাকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। ” আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। আরে , এই মর্কট বলে কি ? ভুল লিখলো নাতো ?” যা হোক , দুইজনের কাজ একজনে করা বেশ কঠিন। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে দিন গেলো। আরো দুইদিন সে এলো না। তৃতীয় দিন তার দেখা পেলাম। এসেই সে অভিযোগের রেলগাড়ি ছুটালো।
– তুমি তো জানো, আমার এক বছরের দুটি যমজ ছেলে আছে। এই দুইজন ভয়ানক বিচ্ছু। আমি জানি না , ওদের মা ওদেরকে কেমন করে সামলায়। এই দুই দিনে আমার জীবন বের হওয়ার যোগাড়। আমার ওজন কিছুটা কমে গেছে না ?”
– আমার কাছে তো তোমাকে আগের চেয়ে তাজা লাগছে।
– বলো কি ? দশ মিনিট ঘুমাতে পারি নাই।
আমি অবাক বিস্ময়ে মেয়েটির মুখের দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। same sex marriage এর কথা আমি শুনেছি। এই হাসি খুশি বত্রিশ বছরের মেয়েটা যে আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করে বসে আছে আমি সেটা এতোদিনেও বুঝতে পারিনি দেখে আমার নিজের উপরেই রাগ হচ্ছিলো।
অবশ্য মেয়েটি ছেলেকে বিয়ে করলেই কি আর একটি মেয়েকে বিয়ে করলেই আমার কি ? তাই আর তেমন কোনো মাথা ঘামালাম না।
দিনে দিনে মেয়েটির সাথে আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। তার নাম এলি। অবসর সময়ে আমি এলির গল্প শুনি।
– আমি সাত বছর আমার বয়ফ্রয়েন্ডের সাথে লিভ টুগেদার করেছি। শেষে একদিন হঠাৎ করেই সে আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দিলো। আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নেই, বিশ্বাসঘাতক পুরুষ আর নয়। আমি একটি সংসারী মেয়েকেই বিয়ে করবো। যে আমার সন্তানদের দেখে রাখবে।
– তুমি কি তেমন স্ত্রী পেয়েছো?
– একেবারে যেমন চেয়েছি , তেমনি পেয়েছি।
– ও আচ্ছা
-আমার স্ত্রী বাইরে কাজ করে না। সে ঘরে থেকে আমার দুই ছেলে দেখাশোনা করে।
– ও আচ্ছা !
– আমি কিন্তু সমকামী নই।
– ও আচ্ছা।
– কি ব্যাপার ? তুমি কেন ভাঙা রেকর্ডের মতো একই কথা বলে যাচ্ছ ?
– কি বলবো বুঝতে পারছি না , তোমার জীবন যাপন আমার কাছে পরিচিত নয়। আমি বত্রিশ বছর আগে একজন পুরুষকে বিয়ে করেছি এবং আজ পর্যন্ত তার সাথেই ঝুলে আছি। আমার জীবনকে মনে হচ্ছে সাদা কালো, নির্বাক চলচিত্র , তোমারটা ইস্টম্যান কালারে নির্মিত ধুমধাড়াক্কা হিট ছবি।
– আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
– না বোঝাই ভালো , আমি নিজেও খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত। তোমার দুই ছেলে কে জন্ম দিয়েছে ? তুমি নাকি তোমার স্ত্রী ? নাকি পালক নিয়েছো?
– আমার স্ত্রী আমাদের দুই যমজ ছেলে জন্ম দিয়েছে। আমরা স্পার্মব্যাঙ্কের কথা ভাবছিলাম। পরে সেই চিন্তা বাদ দিলাম। তার একজন ভালো বয়ফ্রেন্ড আছে। মনে হয় সেই আমার বাচ্চাদের বাবা।
– মনে হয় বলছো কেন?
– আমিই তো আসলে আমার বাচ্চাদের বাবা। তারা আমাকে ড্যাড বলে। তবু জন্মসূত্রে তো আমি তাদের বাবা নই।
– ও আচ্ছা।
ছিপছিপে স্বর্ণকেশী , পিঙ্গল নয়না , দীর্ঘাঙ্গী ,আপাত দৃষ্টিতে সুন্দরী মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠলো।
– তুমি যদি আর একবার ও আচ্ছা বলো , আমি তোমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবো।
– আর বলবো না। কাঁচা বা রান্না করে কোনোভাবেই আমাকে খেয়ে ফেলা যাবে না এলি।
আমি জীবনে অনেক সহকর্মীর সাথে কাজ করেছি। এলির মতো ভালো মেয়ে সচরাচর চোখে পরে না। সে অবশ্য কিছুদিন পর পর কাজে আসতে পারে না। হয় তার স্ত্রী, না হয় তার বাচ্চা অসুস্থ থাকে। কিছুদিন পর পর টেক্সট পাই। ” আজকে আসতে পারছি না … ইত্যাদি, ইত্যাদি। ” একদিন সে বললো,
– আমি প্রেগন্যান্ট .
আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
– কিছু বলছোনা কেন ?
– কাঁচা খেয়ে ফেলার ভয়ে কিছু বলছি না।
– হা হা হা , আমি যে কি খুশি কি বলবো ? আমাকে কংগ্রাচুলেট করো। তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে।
মেয়েটি আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলো। হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে মেয়েটি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো।
– কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে ? মা হয় তো আনন্দের ব্যাপার।
– আবার ভুলে যাচ্ছো ,আমি বাবা হচ্ছি। মা হচ্ছে আমার স্ত্রী। আমার কথা তুলে নিলাম। তোমাকে কাঁচা খাবো না।
– ও আচ্ছা।
– হা হা হা।
– বাচ্চাতো তোমার গর্ভে , তাই না?
– তবে আর কি বলছি ?
পাঠক ভাববেন না আমি কোনো আকাশ কুসুম গল্প ফেঁদে বসেছি। আমার এই লিখার প্রতিটা চরণ একেবারে সূর্যের আলোকরশ্মির মতো সত্য।
অত্যন্ত আধুনিক মার্কিন মুলুকের একটি অতি সাধারণ মেয়ের জীবন কাহিনী এটা। পুরুষের সীমাহীন বিশ্বাসঘাতকতা , অবমাননা ,অবহেলা আর অপমানসুলভ আচরণ এই মেয়েটিকে জীবনের কোন জটিলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে , আপনারা হয়তো এখনো কল্পনা করতে পারছেন না।
ফিরে আসি এলির কাছে । এলি আবার দুই সপ্তাহ অনুপস্থিত। তার গর্ভসংক্রাত জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডাক্তার তাকে পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেছে । আমি টেক্সট করে দুইবেলা আমার সহকর্মীর খবর নেই। ” খবর কি, এলি ? ” ” অবস্থা গুরুচরণ। ” ” মানে কি ?” ” আমার গর্ভস্থ ভ্রূণের এক জটিল রোগ সনাক্ত করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে , এই রোগ যদি বংশগত হয়ে থাকে , তাহলে এই বাচ্চা জন্ম দেয়া সম্ভব হবে না। ” আমি ঠিক বুঝলাম না , ” তোমার বংশে কি এই রোগ আছে ?” ” না না। ” ” তাহলে তোমার বাচ্চার জন্মদাতা বাবার বংশে কি এই রোগ আছে ?” , ” আমি তো সেটা জানি না। ” ” তাকে জিজ্ঞাসা করো। ” ” এখানেই তো সমস্যা, বাচ্চার বাবা কে আমি তা ঠিক ভাবে বলতে পারছি না। ” ” এলি, তোমার কথা বুঝতে পারছি না। ” ” আমি বলতে চাচ্ছি, তিন জন পুরুষের মধ্যে যে কোনো একজন এই বাচ্চার বাবা হতে পারে , আমি কাকে জিজ্ঞাসা করবো ? ” ” তুমি তো ভালো বিপদে আছো। এক কাজ করো , তিন জন কেই আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করে দেখো ?” ” একজনের সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে। সে চীন চলে গেছে , তাকে খুঁজে পাবো না। ” ” বাকি দুইজনকে জিজ্ঞাসা করো। ” ” একজন একোহলিক , তাকে তো ধরতেই পারছি না। সে সারাদিন মদের নেশায় চুর হয়ে থাকে। কখনো ফোন ধরে না। টেক্সটের উত্তরও দেয় না। ” ” আর তৃতীয় জন?” , ” সে বলেছে তার বংশে এই রোগ নাই। ” ” তোমার জন্য দোআ করা ছাড়া আর কি করতে পারবো ?” ” তোমার দোয়াই আমার দরকার, প্লিজ , আমার জন্য দোআ করো। ”
আমি দোআ করলাম। কয়েক মাস পরে এলির কোল আলো করে জন্ম নিলো দেবশিশুর মতো সুন্দর ফুটদুটি একটা পুত্রসন্তান। মায়ের গর্ভে আগের দুই যমজ পুত্র আর বাবার (?) গর্ভে নতুন একটি শিশু পূত্র , এই তিনপুত্র নিয়ে এলি আর তার স্ত্রীর সংসার। পুরুষের কপটতা , ভণ্ডামি, আর নোংরামি কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুই নারী গড়ে তুলেছে তাদের সুখের সংসার।
আমার কাছে ওদের জীবনটাকে খুব জটিল লাগলেও , এক অর্থে তারা ভালোই আছে। আমাদের তথাকথিত দুঃখিনী নারীর নয়নের নীর দেখে অভ্যাস , তাই এতো সুখী নারী জীবন দেখে চমৎকৃত হতে পারি না। এলির জন্য আমার এক আকাশ ভালোবাসা।
” সুখে আছে যারা, সুখে থাক তারা
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা “
Nazmun Nahar
New York