তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো_ঘর (৩৫)
শুক্রবার সকাল বেলা।তাহেরা বেগম ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছেন।দীর্ঘদিন ধরে রান্নাবান্না থেকে দূরে থাকায় তার মনে হচ্ছে কোনো কিছুই যেনো ঠিকমতো হচ্ছে না।
লুবনার আজকে এনগেজমেন্ট হবে।তাহেরা বেগমের ইচ্ছে যতো শীঘ্রই সম্ভব বিয়ের তারিখ ধার্য করার।সম্ভব হলে কুরবানির ঈদের আগেই।
এরকম পাত্র হাতছাড়া হয়ে গেলে দ্বিতীয় বার আর সুযোগ পাবেন না।ভাগ্য বারবার তাকে সুযোগ দিবেন না।
রান্নাবান্নায় দিশা,লুবনা কেউ-ই একটু সাহায্য করতে আসছে না।তাহেরা বেগম কোনটা রেখে কোনটা করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।মেইন ডিশ,ডেজার্ট কোনোটাই হচ্ছে না ঠিকঠাক। হাতে হাতে কেউ একজন এগিয়ে দিলে কাজটা যেমন সহজ হয়,সেই সাহায্য করবার মতো মানুষ নেই তার।
নিজের ভাগ্যকে দুটো গালাগাল দিয়ে তাহেরা বেগম কাজে লেগে গেলেন আবার।
মশলা নেই,মশলা ব্লেন্ড করতে হবে।তাহেরা বেগম উঁচু গলায় লুবনা,দিশা দুজনকে ডাকলেন।দিশা আর লুবনা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে,ফোন টিপছে।তাহেরা বেগমের ডাক শুনে দিশা অস্ফুটে একটা গালি দিয়ে কানে হেডসোন গুঁজে নিলো।
লুবনাও পাত্তা দিলো না তেমন। আজকে তার এনগেজমেন্ট,এই সময় রান্নাঘরের আশেপাশে ও লুবনা যেতে রাজি না।
তাহেরা বেগমের প্রচন্ড রাগ হলো।দুজনেই সামনের রুমে বসে আছে,স্পষ্ট তার ডাক শুনছে ইথচ এগিয়ে আসছে না।
আদা রসুন কুচি করতে গিয়ে তাহেরা বেগম পোড়া গন্ধ পেলেন।গরুর মাংস পুড়ে গেছে কিছুটা।রাগে তাহেরা বেগমের গা জ্বলে গেলো।প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে কিচেন থেকে বের হলেন।তারপর ক্ষোভ মেটাতে লুবনার চুল চেওএ ধরে দুইটা থাপ্পড় মেরে বললেন,”বুড়ি ধুমসি মেয়ে,বসে আছিস এখানে।আমি রান্নাঘরে ডাকতে ডাকতে মরে যাচ্ছি সেদিকে কোনো খেয়াল নেই কারো।শ্বশুর বাড়ির ভাত এতো মিঠা না।এমনে এমনে গলা দিয়ে নামে না ওই ভাত।”
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো লুবনার।ঝি’কে মেরে বউকে শেখানোর প্রবাদটা অজানা থাকায় মায়ের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না সে।উল্টো আজকের দিনে মা তাকে মা/রায় তেড়ে জবাব দিলো,”শ্বশুর বাড়ির ভাত যে কতো তিতা তা আমি আরো তিন বছর আগে থেকেই জানি।নবনী,নিতুর সাথে তুমি যেভাবে ব্যবহার করেছ তা দেখেই আমার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।তোমার মতো শাশুড়ী হলে কোনো মেয়েই সংসার করতে পারবে না।”
তাহেরা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন মেয়ের কথা শুনে। নিজের পেটের মেয়ে কি-না তার বিরুদ্ধে কথা বলছে!মেয়ে ও বুঝলো না তিনি কথাগুলো মেয়েকে নয় দিশাকে বলেছেন?
এই ছিলো মেয়ের মনে?
তবে কি মেয়েও তাকে খারাপ মা হিসেবে জানে?
এক বুক হাহাকার নিয়ে তাহেরা বেগম নিরবে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।সেই সাথে আড়াল করলেন তার দুই চোখ ভরা অশ্রু।
দিশা শুধু শুধু কানে হেডফোন দিয়ে গান শোনার ভং ধরে বসে ছিলো। মা মেয়ের এই নাটক দেখে দিশার পৈশাচিক মন একটা অন্যরকম সুখ পেলো।মোবাইলের দিকে তাকিয়ে মজার কিছু দেখছে এরকম ভান করে হাহাহা করে হাসতে লাগলো দিশা।
তাহেরা বেগম মোটামুটি ২০ জন মেহমানের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।পাত্রপক্ষ বলেছে ১২-১৩ জন আসবে এনগেজমেন্ট করতে।
মেহমান আসার পর দেখা গেলো মেহমান এসেছে ২৬ জন।
তাহেরা বেগমের মাথায় হাত পড়ে গেলো।এদিকে সামিম তামিম কেউই নেই বাসায়।দিশা সং সেজে বাপের বাড়ির লোকদের কোলে নিয়ে বসে আছে আর হাহা হিহি করছে।
তাহেরা বেগমের প্রেশার হাই হয়ে গেলো চিন্তায়।কিভাবে সামলাবেন তিনি এখন?
এই প্রথম তাহেরা বেগম নিতুর অভাব বোধ করলেন।মেয়েটা মুখরা,ঝগড়াটে,বেয়াদব,অভদ্র যাই হয়ে থাকুক না কেনো,এরকম পরিস্থিতি নিশ্চয় সামলে নিতে পারতো।
পাত্রপক্ষ দেখতে আসার দিনেও তো সে-ই সব সামলেছে।আজকে তো সে ও নেই।
অথৈ জলে পড়ে হাহুতাশ করতে লাগলেন তাহেরা বেগম। খেতে বসে দিশার চাচী আমেনা ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,”আজকের খাবারের চেহারা দেখেই তো কেমন লাগছে।গতবারের রান্না সবই ভালো ছিলো পোলাও ছাড়া। এবার তো দেখছি সবই কেমন কেমন যেনো।”
তাহেরা বেগমের মুখ শুকিয়ে গেলো শুনে।আমতাআমতা করে বললেন,”আসলে আপা,একা হাতে সব সামলাতে হয় তো তাই আরকি।খান না আপনারা, খেতে ভালোই হয়েছে। “
পাত্রের বোন রোস্টে কামড় দিয়ে বললো, “কি রে দিশা,এনগেজমেন্টের খাবার না-কি হয় বিয়ের খাবারের চাইতেও ভালো। সবাই বলে বিয়েসাদীর ক্ষেত্রে এনগেজমেন্টের খাবারই হচ্ছে মেইন।এখন তোর শ্বশুর বাড়িতে এনগেজমেন্টের আইটেম যদি এতো কম হয়,তো বিয়েতে কি করবে কে জানে!
আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে এসব কি যায় না-কি? “
তাহেরা বেগমের মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো শুনে।কলিজা শুকিয়ে গেলো ভয়ে।পাত্রপক্ষের মুখ থেকে এজাতীয় কথা শোনা যে ভালো লক্ষণ নয় তা তাহেরা বেগমের চাইতে ভালো কে জানে!
নবনীকে ও তো তিনি এরকম করেই বলতেন!
খাবারের শেষের দিকে কেউ কেউ খাসির মাংস পায় নি,কেউ রোস্ট পায় নি,গরুর মাংস হয় নি সবার।
মেহমানরা সবাই মুখ বাঁকাতে লাগলো। কেউ কেউ কটাক্ষ করে বললেন,”এই কোথায় আত্মীয়তা করছেন?আজকেই এই অবস্থা, বিয়ের পর না জানি কেমন করবে এরা।”
লজ্জায়,অপমানে তাহেরা বেগম টিকতে পারলেন না এক দন্ড আর মেহমানদের সামনে। রান্নাঘরে সিংকের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিলেন।তারপর সিংকে মুখ ধুয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে বের হয়ে এলেন সবার সামনে। বুক ভরা ব্যথা চাপা দিয়ে তাহেরা বেগম মেহমানের সাথে কথা বলতে এলেন।
পাত্রের নাম মুবিন। হাতে একটা ডায়মন্ডের রিং নিয়ে লুবনার হাতে পরিয়ে দিলো মুবিন। লুবনা একটা সোনার রিং পাত্রকে পরিয়ে দিলো।
তাহেরা বেগমকে শুনিয়ে পাত্রের বোন মালিহা বললো, “কি রে দিশা,তোর শ্বশুর বাড়ির কালচার এরকম না-কি?
আমাদের সব ভাইবোনের এনগেজমেন্টের রিং ডায়মন্ডের ছিলো তোর মনে নেই।আর দেখ,এরা মুবিনকে এটা কি দিলো?
এটা দিয়ে লোক হাসানোর তো দরকার ছিলো না। সমাজে আমাদের তো একটা সম্মান আছে না-কি?
এতো আত্মীয় এসেছে,সবাই বাসায় গিয়ে আমাদের নিয়ে সমালোচনা করবে।তুই আগে থেকে বলে রাখলি না কেনো?”
তাহেরা বেগমের অন্তরে তীরের মতো বিঁধলো কথাগুলো। কিন্তু আজ তিনি নিরুপায়। সামিম ও টাকা পয়সা দিচ্ছে না,তামিম ও বাসার খোঁজ খবর নেয় না।হামিদুর রহমান ও তেমন কোনো টাকা পয়সা রেখে যান নি।এরকম টানাটানিতে তাহেরা বেগম আগে পড়েন নি।অভাব যখন আসে সব দিক দিয়েই আসে।
অন্য সময় হলে তিনিও পাত্রের জন্য ডায়মন্ডের রিং নিতেন।কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই।
নিরবে সব অপমান সহ্য করা ছাড়া আর কিছু করার নেই তাহেরা বেগমের।
যিনি সৃষ্টি জগতের মালিক তার ইশারা বুঝা কি এতো সহজ! তুচ্ছ মানুষ আমরা,কিভাবে বুঝবো তার ইশারা?
বিয়ের তারিখ ঠিক হলো পাঁচদিন পরে।কুরবানির ঈদের ৭ দিন আগে বিয়ে।তাহেরা বেগম ভীষণ খুশি হলেন শুনে।একটা তো ভালো খবর পেলেন অন্তত। মেহমান চলে যাবার পর দিশা নিনের রুমে ঢুকে গেলো। লুবনা তাহেরা বেগমের উপর রেগে আছে সকালে তাকে মা/রার জন্য।সেও নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিলো।পুরো বাসায় তাহেরা বেগম একেবারে একা হয়ে গেলেন।নিজেকে তার মনে হলো শূন্যপুরীতে একা বেঁচে থাকা এক মানবী।পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে,এখানে সেখানে খাবার পড়ে আছে,তরকারির ঝোল পড়ে আছে।
এসব এখন একা তার পরিষ্কার করতে হবে। সারাদিন কাজ করার পর শরীর একটু বিশ্রাম চায়।এই মুহুর্তে এসব পরিষ্কার করতে মোটেও ইচ্ছে করছে না তাহেরা বেগমের।
নিজের ভাগ্যকে গালি দিলেন নিজেই আজ।এঁটো প্লেট বাটি, টেবিল,হাড়ি পাতিল সব পরিষ্কার করে তাহেরা বেগম যখন বিছানায় পিঠ লাগালেন তখন চারদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে।
ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই তাহেরা বেগমের চোখ লেগে এলো। সেই চোখ লেগে আসাটা ও বেশীক্ষণ রইলো না যখন মনে পড়লো ঈদে তো লুবনার শ্বশুর বাড়িতে গরু দিতে হবে,সবার জন্য পোশাক দিতে হবে,সেমাই,চিনি এসব কিছু দিতে হবে।
মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো তাহেরা বেগমের। বড় পরিবারে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা তাহেরা বেগমের মনেই ছিলো না সমাজের বানানো এসব নিয়ম নীতি।
চাইলেও যেই নিয়ম তিনি এখন ভাঙ্গতে পারবে না।তাহেরা বেগমের বুকের ভেতর কেমন একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব হলো।
কি করবেন তিনি?
প্রেগন্যান্সি কীট হাতে নিয়ে নিতু বসে আছে থ’ হয়ে।জীবনের সব স্বপ্ন যখন ভেঙে গেছে সেই মুহুর্তে একটা নতুন স্বপ্ন ধরা দিলো।প্রেগন্যান্সি কীটে পজিটিভ এসেছে। মাথার চুল চেপে ধরে নিতু বসে পড়লো। পুরো পৃথিবী তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে নিতুর এই মুহূর্তে।
কিছুদিন আগে ও এই পজিটিভ রেজাল্ট নিতুকে যেই সুখের সাগরে ভাসাতো,আজকে সেই রেজাল্ট নিতুকে গভীর জলে নিমজ্জিত করেছে।
ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো নিতু।
আর কতো পরীক্ষা দিবে সে?
সৃষ্টিকর্তা আর কতো পরীক্ষা নিবে তার থেকে!
জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় তো পাশ করতে পারে নি।আজীবন একসাথে থাকার জন্যই তো বেছে নিতে পারে নি সঠিক মানুষ।
যখন সেই মানুষটাই নেই জীবনে, তখন তার দেওয়া ভালোবাসার চিহ্নকে নিয়ে কিভাবে থাকবে নিতু?
ফ্লোরে গড়িয়ে কাঁদতে লাগলো নিতু।নিতুর কান্না শুনে বাবা মা দুজনেই ছুটে এলেন।অন্ধকার রুমে মেয়ে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে। মেয়ের সেই কান্নায় এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে বাবা মায়ের কলিজা।রেবেকা বেগম মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন,”কি হইছে তোর,এমন করস কেনো মা তুই?এমন করিস না মা।তোর কান্না দেখলে যে আমার আর তোর বাবার বুক ফেটে যায় যন্ত্রণায়। আমরা দুজন মানুষ তোদের দুই বোনের দিকে তাকিয়েই তো বেঁচে আছি।আমাদের মেরে ফেলিস না এভাবে তোরা।”
নিতু মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা’গো,কেনো আমার সাথে এরকম হলো?কেনো আমি এতো যন্ত্রণা পাচ্ছি।আমি তো বিশ্বাস করেছি তাকে,তবে কেনো দিনশেষে আমিই ঠকে গেলাম,আমিই কষ্ট পাচ্ছি।যে আমাকে ঠকালো মা’গো সে তো সুখে আছে।আমি কিভাবে বাঁচবো গো মা?”
চলবে……