অপেক্ষা
——-
দীর্ঘ নয় বছর সাত মাস পরে তীর্থকে দেখে আমি প্রায় জমে গেলাম। একটু আগেও খুব মজা করছিলাম। একটা বিয়েতে এসেছি। আমার কলিগ সোমার ছোট বোন রুমার বিয়েতে। মাসি আমাকে নিজের মেয়ের মতই আদর করেন। সোমা এবং রুমাও আমাকে আপন বোনের মতোই দেখে।
তাই বলা যায়, আমার ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে।
বরযাত্রীর সাথে রাসেল দাদাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। সোমা জানালো, উনি নাকি বরের বড় ভাই। আমি সামনে যেয়ে নমস্কার দিয়ে বললাম, ” দাদা, আমাকে চিনতে পেরেছেন ?
” ভেবেছিলাম, দাদা চিনতে পেরে অবাক এবং খুশি হবেন। দাদা চিনতে পারলেন ঠিকই , কিন্তু খুব খুশি হলেন না। বরং তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। ব্যাপারটায় খুব বিব্রত হলাম আমি। যদিও দাদার সাথে দীর্ঘ দিন যোগাযোগ নেই, কিন্তু কিছু কিছু সম্পর্ক এমন, যোগাযোগ না থাকলেও সম্পর্কটা কখনো মুছে যায় না। রাসেলদা ছিলেন তীর্থের রুমমেট। শুধু রুমমেট বললে ভুল হবে।
ছিলেন তীর্থের বড় ভাই, গুরু, বন্ধু। দুইজন দুই ধর্মের, কিন্তু একজনের প্রতি আরেকজনের এতটা ভালোবাসা, যে মনেই হতো না, দুইজন দুই মায়ের পেটে জন্ম নিয়েছে। যে মানুষটা তীর্থের এতটা আপন, সে আমার আপন হবে না, তাই কি হয় ? অনেক বার আমি ওনার হাতে জোর করে রাখি ও পরিয়েছি। সেই আপন মানুষ টা এমন অপরিচিত মানুষের মত আচরণ করবেন আমি চিন্তা ই করিনি। একটু পরেই ওনার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে পারলাম।
বরযাত্রীরা যে জায়গায় বসে আছে, সেখানে হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম, তীর্থ বসে আছে ! ওর সেই অদ্ভুত সুরেলা গলায় গান গেয়ে গেয়ে সবাই কে মাতিয়ে রেখেছে। আমি অবাক হওয়ার ক্ষমতা ও হারিয়ে ফেললাম। বুঝতে পারলাম, এজন্যই রাসেলদা আমার সাথে এমন অদ্ভুত আচরণ করেছেন। বুঝতে পারলাম, তীর্থের জীবনে আমার আর কোন অবস্থান নেই।
ভার্সিটিতে তীর্থ আমার এক বছরের সিনিয়র ছিল। দুজন দুজনকে ভালোবাসতাম। কথা ছিল, খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করবো। তীর্থ আমাকে একটা রুপার সিদূরের কৌটা উপহার দিয়েছিল। এত সুন্দর কারুকাজ করা কৌটাটা, যে দেখতো সেই পছন্দ করতো। তীর্থ বলতো, ” আর কিছুদিন পরেই আমরা বিয়ে করবো। তখন সিদূর কিনে দেবো। রোজ রাতে ঘুমানোর আগে আমি নিজ হাতে তোমার সিঁথি তে সিদূর পরিয়ে দেবো। “
সেই তীর্থ হঠাৎ করেই একদিন হাওয়া হয়ে গেল। কোথায় গেল কেউ বলতে পারে না। কত খোঁজ করেছি, বলে বোঝাতে পারবো না। রাসেলদার কাছে ও অনেক বার গিয়েছি, ওর কোন খোঁজ জানে কিনা, সেটা জানার জন্য। রাসেল দা সব সময় ই বলেছেন, উনি জানেন না, তীর্থ কোথায়। অথচ সেই তীর্থ আজ তার সাথেই বিয়ে বাড়িতে এসেছে। তারমানে উনি জানতেন, তীর্থ কোথায়। তাহলে আমার সাথে এই ছলনা কেন ? আমি তো ওনার হাতে রাখি বেঁধেছিলাম, তাহলে উনি আমাকে এভাবে ধোঁকা দিলেন কেন ?
দুঃখ পেতে তখন ও কিছু বাদ ছিল। খেয়াল করে দেখলাম, তীর্থ আশেপাশের সবার সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। আমার সাথে তিনবার চোখাচোখি হলো। কিন্তু ওকে দেখে মনেই হলো না, ও আমাকে কোন দিন চিনতো !!!
কাউকে কিছু না বলে বিয়ে বাড়ি থেকে চলে এলাম। নয় বছর আগে যে কষ্টটা পেয়েছিলাম, সেই কষ্টটা আজ আবার পাচ্ছি। আসলে তারচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি। তখন শুধু হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট ছিল। আজ তার সাথে যোগ হলো বিশ্বাসঘাতকতার কষ্ট। বাবা মা এক সময় বিয়ে দেওয়ার খুব চেষ্টা করেছিল। কোনদিন রাজি হইনি। মনের দুঃখেই আমার মা মারা গেলেন। তিন বছর আগে বাবা ও মারা গেলেন। কোন ভাই বোন না থাকায় একা হয়ে গেলাম। স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে তখন ঢাকায় এসে এই চাকরিতে ঢুকি।
সিদূরের কৌটা টা খুব যত্ন করে রেখেছি গত নয় বছর। ঢাকায় আসার পরে একদিন শখ করে সিদুর কিনেছিলাম। রোজ রাতে ঘুমানোর আগে সিঁথিতে সিঁদুরের হালকা একটা আচড় দিই। কল্পনা করতাম তীর্থ আমার সিঁথি তে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেই কেউ দেখার আগে ধূয়ে ফেলি সিঁদুর।
আজ আমার পুতুল খেলা জীবনের সাঙ্গ হয়েছে। ঘরে ফিরে সিঁদুরের কৌটাটা বের করে ময়লা ফেলার বালতিতে ফেলে দিলাম। যে কৌটাটা এতগুলো বছর আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই কৌটাটাকেই হঠাৎ করে বিষের কৌটা মনে হচ্ছিলো।
সাত দিন পরে সোমা বিয়ের ছুটি শেষ করে যেদিন অফিসে এলো সেদিন ই বললো,
– দিদি, তুমি রাসেল ভাইয়া কে আগের থেকে চিনতে নাকি ?
আমি স্বাভাবিক ভাবে ই বললাম,
– হুমম, আমরা একই ভার্সিটিতে পড়তাম।
– ও তাই বলো। উনি তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন। উনি তোমার সাথে দেখা করতে চান।
– আমার সাথে দেখা করার কি আছে ?
– ঠিক জানি না। তুমি ওনার ঠিকানাটা রাখো।
আমি ঠিকানাটা রাখলাম, কিন্তু দেখা করলাম না।
আমার কাকাবাবু অনেক দিন থেকেই একটা ছেলের কথা বলছিল। খুব নাকি ভালো ছেলে। ওরা আমাকে দেখেছে, ওদের খুব পছন্দ।
তীর্থ এর জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।আমি কাকাবাবু কে জানিয়ে দিলাম আমি বিয়ে করতে রাজি আছি। অল্প সময়ের ভিতরেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে। বিয়ের বাজারও শেষ। অবাক করা ব্যাপার হলো, বিয়ের তিন দিন আগে আমার হবু বর অনিন্দ্য যেদিন আমার সাথে প্রথম দেখা করতে বাইরে যায়, সেদিন আমার জন্য সুন্দর কারুকাজ করা রূপার একটা সিদূরের কৌটা উপহার দেয়। খুব রোমান্টিক ভাবে বলে, ” আমি কিন্তু প্রতিদিন নিজ হাতে তোমাকে সিদূর পরিয়ে দেবো। ” আমার খুব ভালো লেগেছিল। অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, আমার কপালে তাহলে শুধু বিশ্বাসঘাতকতা ই নেই, ভালোবাসাও আছে।
আমার বিয়ে হয়ে গেল। অনিন্দ্য খুব ভালো ছেলে।
বিয়ের বারো দিন পরে একদিন শপিং মলে রাসেলদার সাথে দেখা। বললো,
– সোমা তোকে বলেনি, আমি তোকে দেখা করতে বলেছি ?
– বলেছে। বলেন, কি বলবেন?
– তীর্থের ব্যাপারে।
– বলেন।
হঠাৎ করেই রাসেলদার নজর আমার মাথার দিকে গেল। কি বলতে যেয়েও থমকে গেলেন। বললেন,
– থাক, তার আর প্রয়োজন নেই।
এবার আমি জেদ ধরে বললাম,
– বিশ্বাসঘাতকটার কথা কি বলতে চাচ্ছিলেন, বলে ফেলেন।
– ও বিশ্বাসঘাতক নয়। বরং ও যেটা চেয়েছিল, অর্থাৎ তোর মঙ্গল, আজ সেটাই হয়েছে।
– মানে?!!
– একটা এক্সিডেন্ট এ ওর দুইটা চোখ ই নষ্ট হয়ে যায়। তোর জীবনটা কে নষ্ট করবে না বলেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে যায়। কারণ ও জানতো, অন্ধ হলেও তুই ওকে বিয়ে করবি। গত বছর যশোর বেড়াতে যেয়ে হঠাৎ করে ওর সাথে দেখা হয়। তখন জানতে পারি। আমার ধারণা ছিল, তোর এতদিনে বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ে বাড়িতে তোকে যখন দেখি, তখন কনফিউশনে ছিলাম, তোর বিয়ে হয়েছে কিনা, এ ব্যাপারে। পরে সোমার কাছ থেকে শুনেছি, তুই এখনও বিয়ে করিসনি। মনে হলো তীর্থের অপেক্ষাতেই করিসনি। তীর্থ কে তোর কথা বলিনি। ভাবলাম, আগে তোর সাথে কথা বলে নিই। তীর্থ অন্ধ জেনেও যদি তুই বিয়ে করতে রাজি হোস, তবেই তীর্থ কে জানাবো, তোর সাথে দেখা হয়েছে। তা না হলে বেচারা আবার নতুন করে কষ্ট পাবে। কিন্তু আজ তোর সিঁথির সিঁদুর দেখে বুঝতে পারছি, তার আর কোন দরকার নেই।
আমার মাথাটা হঠাৎ করেই চক্কর দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে, গভীর কোন খাদে তলিয়ে যাচ্ছি আমি।