বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন স্নিগ্ধার খুব ভালোই সময় কেটেছে। শশুর-শাশুড়ি ,স্বামী শাওন সহ সবাই খুব খুশী।
কিন্তু সমস্যাটা শুরু হলো তার কিছুদিন পর থেকে। আচরণ পাল্টে যেতে লাগলো স্নিগ্ধার। অকারণ ভয়, হঠাৎ চমকে ওঠা, অন্য মনস্ক হয়ে থাকা সবকিছুই স্নিগ্ধাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সবাই চিন্তিত। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার ? এই বাড়িতে তো কেউ তাকে কখনো ছেলের বউ এর মতো ব্যবহার করেনি বরং মেয়ের মতো দেখে এসেছে তাহলে এমন কেন করছে, এতটা ডিপ্রেসড হওয়ার মতো কি হয়েছে?
শাওন অবশ্য পুরোপুরি চেষ্টা করছে স্নিগ্ধাকে নরমাল করতে।
খাবারের টেবিলে বসে শাওন বলে উঠলো,
-আমার মনে হয়, তোমার মনটা খারাপ চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি
-আমি কোথাও যাবো না। বিড়বিড় করে বলে উঠলো স্নিগ্ধা
-যাও না মা ঘুরে এসো, ভালো লাগবে। শাশুড়ি মা মাথায় হাত রেখে বললেন।
স্নিগ্ধা এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিয়ে খাবার ঠেলে উঠে চলে গেল।
এক কাকডাকা ভোরে স্নিগ্ধার অবস্থা এতটাই খারাপ হলো যে রীতিমতো প্যানিক করতে শুরু করলো। চিৎকার-চেঁচামেচিতে বাড়ি মাথায় তুললো। শেষে ডাক্তার এনে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াতে হলো।
স্নিগ্ধা ঘুমোচ্ছে। সবাই খাবার টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। কেউ খাচ্ছে না।
-মেয়েটা তো তোমার অফিসেই চাকরি করতো, কোন খোঁজ খবর না নিয়ে এভাবে ছেলেকে বিয়ে করানোটা কি ঠিক হলো? বংশগত রোগ নাকি? শাশুড়ি আগুন চোখে শশুরের দিকে তাকালো
-তোমাকে কে বললো আমি খোঁজখবর নেই নি ?তাছাড়া মেয়েটাকে আমি দুই বছর ধরে চিনি, ওর মতো ভালো মেয়ে আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।
-তাহলে দয়া করে আমাকে বলো এমন কেন হচ্ছে? আমরা তো বেশ সুখেই ছিলাম।
-দেখো আসমা, মেয়েটি যখন আমার কাছে আসে তখন আমার অফিসে কোন পোস্ট খালি ছিল না। স্নিগ্ধা আমার কাছ থেকে দশ মিনিট সময় চেয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে ও ওর জীবনের গল্পটা আমাকে বলতে চায়। একটা চাকরি কেন ভীষণ প্রয়োজন সেটাও জানাতে চায়। বিশ্বাস করো আসমা এত সৎ মেয়ে আমি কখনো দেখিনি।
খুব ছোট বয়সেই স্নিগ্ধা তার মাকে বাবার হাতে নির্মমভাবে অত্যাচারিত হতে দেখেছে, প্রায় প্রতি রাতেই অমানুষের মত লোকটা ওর মায়ের গায়ে হাত তুলতো । ওই ছোট্ট মেয়েটা আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতো। তবুও ওর মা চুপ ছিল কারণ এই সমাজে হাজবেন্ড ছাড়া নারীদের যে পরিমাণ অসম্মানিত হতে হয় তা তুমি আমি সবাই জানি। কিন্তু অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন আর ওর মা চুপ থাকতে পারেনি, লোকটা সিগারেটের ছ্যাকা দিতো গায়ে। মহিলা পালালেন স্নিগ্ধাকে নিয়ে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে । ডিভোর্স হবার পরে স্নিগ্ধার মায়ের আবার বিয়ে হয়, ততদিনে স্নিগ্ধা ক্লাস ফাইভে পড়ে। যে মানুষটার সাথে বিয়ে হয় সে দেখতে সহজ সরল স্বাভাবিক মানুষ। স্নিগ্ধা কেউ সাথে করে নিয়ে যেতে তার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু কিছুদিন পর তার ভোল পাল্টে গেল, মা বাড়িতে না থাকলে লোকটা তার সাথে অন্য রকম আচরণ করে বুঝতে পারছো তো আমি কি বলতে চাচ্ছি? ওই বয়সে মেয়েটা এত কিছু বোঝেনি, শুধু বুঝে ছিল খুব খারাপ কিছু হচ্ছে। একদিন মাকে সবকিছু খুলে বলে। মহিলার কিছু করার ছিল না, এমনিতেই প্রথম সংসার ভেঙেছে আবার যদি সংসার ভাঙ্গে সমাজ-সংসার সবাই তাকেই ভৎসর্না করবে। বাধ্য হয়ে মহিলা স্নিগ্ধাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়। স্নিগ্ধার ঈদের ছুটি গুলো কাটতো নানুর বাড়িতে। নানা-নানি ছিল না তাই মামারা কোনমতে ওই কয়েকটা দিন ওকে সহ্য করে নিতো। এভাবে দিন কাটছিল কিন্তু হঠাৎ করে ওর মায়ের স্ট্রোক করে মৃত্যু হয়ে যায়। মেয়েটা পড়ে যায় অথৈ সাগরে। থাকা খাওয়ার খরচ জোগানো মুশকিল। হন্য হয়ে স্টুডেন্ট অবস্থাতেই চাকরি খুঁজতে থাকে আর এই অবস্থাতেই আমার কাছে আসে। জানো আসমা আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছিল। একটা মেয়ের জীবনে এতো স্ট্রাগল!
-আগে বলোনি কেন? আমি আরো ভালো করে মেয়েটার যত্ন নিতাম নিশ্চয়ই আমাদের কোন ভুল হয়েছে।আসমার চোখেও পানি চিকচিক করতে লাগলো।
-চিরকালীন বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্বে আমি আর ঘি ঢালতে চাইনি ভেবেছিলাম তুমি ব্যাপারটা খুব নেগেটিভ ভাবে নেবে। তবে বিয়ের আগে শাওনকে সব জানিয়েছিলাম।
-বাবা-মা তোমরা কেউ কিছু চিন্তা করো না আমি ওকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবো, কথা দিচ্ছি। শাওন বললো।
দিনদিন স্নিগ্ধার অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। অনেক ডাক্তার দেখানো হলো কিন্তু লাভ হলো না এক গোধূলি বেলায় স্নিগ্ধার নিথর দেহ পাওয়া গেল ফ্যানের সাথে ঝুলছে। বাবা অফিসে ছিল, শাওন ছিল বন্ধুদের আড্ডায় আর মা গিয়েছিলেন তার বোনের বাড়ি। থানা-পুলিশ সব হলো। সবাই খুব ভেঙে পড়লো, তার মধ্যে পুলিশের জেরা যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। সুইসাইড কেস, এতে আর তদন্ত করার কিছু নেই, স্নিগ্ধার ফাইল বন্ধ হয়ে গেল।
আজকাল শাওন বেশ অন্যমনস্ক থাকে। ওকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে বাবা-মা। অল্প কিছু দিনেই স্নিগ্ধা ওর মনে জায়গা করে নিয়েছিল।
-শোনো আমার ছেলের এই অবস্থা আমি আর দেখতে পারছি না আমি ওকে আবার বিয়ে করাবো তুমি কিছু বলতে পারবে না।
-এটা সঠিক সময় না আসমা বোঝার চেষ্টা করো। আর তাছাড়া কিছুদিন আগে যার স্ত্রী আত্মহত্যা করে মারা গেছে তার কাছে কে তার মেয়েকে দিতে চাইবে?
-মেয়ে আছে আমার কাছে, লাবণ্য ,আমার বোনের মেয়ে। তুমিতো ভালো করেই জানো আর তাছাড়া শাওন নিজেও ওকে কিছুটা পছন্দ করতো। আমার মনে হয় না ওরা আমাদেরকে ফেরাবে, তুমি তখন মত দাওনি, এখন পুরো বিষয়টা ওদের হাতে।
সপ্তাহখানেক পরেই লাবণ্য আর শাওনের বিয়ে। শাওনের মধ্যে কোন উৎফুল্ল ভাব দেখা যাচ্ছে না।
শাওন রাতে শোয়ার আয়োজন করলো, আর মনে মনে ভাবতে লাগল, বাবার কাছে যখন ও লাবণ্যর কথা বলেছিল বাবা এককথায় নাকচ করে দিয়েছিলেন উল্টো স্নিগ্ধাকে তার উপযুক্ত মনে করেছেন। আবার স্নিগ্ধাকে বিয়ে না করলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে এই ধরনের একটা আভাসও দিয়েছিলেন। স্নিগ্ধার সমস্ত অতীত জেনে শাওনের কোন ইচ্ছাই ছিলনা স্নিগ্ধাকে বিয়ে করার আর তাছাড়া ও তো ভালোবাসে লাবণ্যকে। স্নিগ্ধার সাথে শাওনের বিয়ে হয়ে যায়, বেশ হাসিখুশি মেয়ে কিন্তু দেখলেই শাওনের মেজাজ গরম হয়ে যায়। তবে স্নিগ্ধার অতীত জীবন জানাতে শাওনের বেশ খানিকটা লাভ হলো। শাওন দেখা করে ওর সাইকিয়াট্রিস্ট এক বন্ধুর সাথে, খুলে বলে স্নিগ্ধার অতীত জীবনের কথা সাথে এটাও বলে স্নিগ্ধা অস্বাভাবিক আচরণ করছে যদিও স্নিগ্ধা তখন একদম স্বাভাবিক ছিল। বন্ধুটি তাকে পরামর্শ দেয় যেসব জিনিসে স্নিগ্ধার ভয় সবকিছু যেন ওর চোখের আড়ালে রাখা হয়। শাওন শুরু করে নতুন খেলা, বাইরে থেকে ফিরেই বেল্ট টা ঠিক বিছানার সামনে ক্যালেন্ডারের হূকের সাথে ঝুলিয়ে রাখতো, কোনদিনও সিগারেট না খাওয়া শাওন অকারণেই স্নিগ্ধার সামনে সিগারেট জ্বালাতো। আর রাত হলেই পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়তো স্নিগ্ধার উপর, স্নিগ্ধা না করা সত্ত্বেও যেমন করে স্নিগ্ধা না করতো তার সৎ বাবাকে। যে ভোরে স্নিগ্ধার প্যানিক অ্যাটাক হয় সেই রাতে পুরোটাই ওকে পশুর মত ছিঁড়ে খেয়েছিল শাওন।
যাক আপদ গেছে এখন আর বাবার অমত করার কিছু নেই আর কিছুদিন পরেই তার ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পেতে যাচ্ছে।
একি! বেল্ট টা ওখানে ঝুলছে কেন? শাওনের স্পষ্ট মনে আছে সে ওটা ওখানে রাখেনি। পাশ ফিরতেই শাওন দেখলো বেড সাইড টেবিল একটা জ্বলন্ত সিগারেট । শাওন স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
Kobitor কবিতর