#পাপ পর্ব ১
রাশেদ আর নীলিমার বিয়ের দুই বছর হল। রাশেদের দ্বিতীয় স্ত্রী নীলিমা। নীলিমার সাথে রাশেদের পরিচয় হয় নীলিমার কাউন্সিলিং সেশনের মাধ্যমে।
নীলিমার সাইকায়াট্রিস্ট ছিল রাশেদ।
এরপর কিভাবে কিভাবে যেন ভাল লেগে যায়, ভাল লাগা থেকে ভালবাসা, আর ভালবাসা থেকে বিয়ে। রাশেদের আগের ঘরে একটা ছেলে আছে। ক্লাস সিক্সে পড়ে। রিফাত নাম। রিফাত নীলিমাকে খুব একটা পছন্দ করে বলে মনে হয়না।
দূরে দূরে থাকে। নীলিমা চেষ্টা করে সব দিক দিয়ে রিফাতের খেয়াল রাখার কিন্তু নীলিমা আশেপাশে থাকলেই ছেলেটা কোন একটা বাহানা করে দূরে সরে যায়।
নীলিমা নিজেও ডাক্তার। সে একজন সার্জন। অসম্ভব রূপবতী মেয়েদের উদাহরণ দিতে বললে জনসাধারণের চোখের মাঝে যেমন ছবি ভেসে ওঠে তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর নীলিমা। বিধাতা কিছু কিছু মানুষকে বোধহয় পরম যত্নে এই জগৎ এর সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে সৃষ্টি করেন।
তবে বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুল টার যেমন সবথেকে বেশি আঘাত পেতে হয় নীলিমার জীবনটাও তার ব্যতিক্রম না। এ কারণেই সব দিক থেকে পরিপূর্ন হয়েও প্রায় একটা বছর পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে গিয়েছিল তার আর শেষপর্যন্ত সাইকায়াটৃষ্ট এর সরণাপন্ন হতে হয়েছিল তাকে।
যাক সেসব কথা। অতীতের স্মৃতি নীলিমা আর ভাবতে চায়না। ঘুম থেকে উঠে সকালে সবার জন্য নাস্তা রেডি করা, এরপর সারাদিন হসপিটালে কাজে ব্যস্ত থাকা আর রাতে এসে খাবার খেয়ে রাশেদের সাথে হালকা গল্পগুজব করে শুয়ে পড়া। বলতে গেলে এটাই তার ডেইলি রুটিন। আর রিফাতের খেয়াল রাখে রহিমা আপা। রাশেদের আগের স্ত্রী হিমিকা মারা যাবার পর থেকে ইনিই রিফাতের খেয়াল রেখে আসছেন। রহিমা রাশেদ এর দুর সম্পর্কের আত্মীয় হয়। রাশেদ তার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসে হিমিকার মৃত্যুর পর। রান্না বান্নাও বেশিরভাগ সময় তিনিই করেন।
সেদিন রাতে খাবারের পর নীলিমা রিফাতের রুমের দিকে যাচ্ছিল। আসার সময় আজকে একটা বড় চকলেট বার নিয়ে এসেছে রিফাতের জন্য। সেটাই দিতে যাচ্ছিল রিফাতকে। রিফাত এর রুমের সামনে দাঁড়াতেই কেমন একটা আর্তনাদ শুনতে পেল মনে হচ্ছে। মানুষের বাচ্চার কান্নার মত আওয়াজ। কেমন যেন বুকের ভেতর ধাক্কা দিয়ে উঠল নীলিমার। বাচ্চার কান্না কেন আসছে রিফাতের রুম থেকে। দরজা টা হালকা ভেজানো ছিল।
হালকা একটু উকি দিল নীলিমা। যা দেখল তা দেখার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলনা নীলিমা।
রিফাত এর পড়ার টেবিলের নিচে, টেবিলের পায়ার সাথে একটা বিড়াল কে বেঁধে রেখেছে রিফাত। বিড়ালটার সমস্ত শরীরে অজস্র কাটা, ক্ষতের চিহ্ন। দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে রক্তপাত হতে হতে বিড়ালটা প্রায় নিস্তেজ হয়ে এসেছে। রিফাত বিড়ালটার সামনে বসে আছে আর মুচকি হাসছে, হাতে ব্লেড ধরে রেখেছে। সেটা দিয়ে একটু একটু করে বিড়ালটার কান কাটছে সে।
আর নিতে পারলনা নীলিমা, চিৎকার দিয়ে রুমে ঢুকতে যাবে ঠিক এই মূহুর্তে কি একটা ভেবে থেমে গেল নীলিমা।
আর ঢুকল না ঘরে। দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এল।
রাশেদ আধ শোয়া হয়ে টিভি দেখছে।
– কি হল, হাপাচ্ছ কেন এভাবে। মনে হচ্ছে ভুত দেখেছ। আর ইউ ওকে নীলিমা?
কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকল নীলিমা। কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা। কিছু একটা ঠিক নেই। একদম ঠিক নেই। এই মুহুর্তে রাশেদকে সব বলা হয়তো ঠিক হবেনা। আরেকটু ভেবে দেখতে হবে। এতকিছু একসাথে হজম হচ্ছেনা নীলিমার। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– না কিছুনা। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছিল। একজন সিরিয়াস পেশেন্ট এসেছে। না গেলেই না। ইমার্জেনসি অপারেট করতে হতে পারে। আজকে রাতে বাসায় নাও ফিরতে পারি। সরি রাশেদ।
– ঠিকাছে। চল আমি দিয়ে আসি তোমাকে।
– না না। তুমি ঘুমাও। তোমার তো সকালে মিটিং আছে। আমি নিজেই ড্রাইভ করে চলে যেতে পারব।
বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে কোনমতে বের হয়ে আসল বাসা থেকে। হসপিটালে নিজের চেম্বারে গিয়ে বসল নীলিমা। চোখে মুখে পানি দিল আগে। এসি টা অন করে রুমটা একদম ঠান্ডা করে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল কিছুক্ষণ।
সব কিছু শুরু থেকে ভাবতে হবে। সুতো জোড়া লাগাতে হবে। চোখ বন্ধ করেই একটার পর একটা হিসেব যেন জোড়া লাগাতে লাগল নীলিমা।
*
প্রথম কথা হচ্ছে একটা বিড়াল কে এভাবে নির্মম ভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে সেটা অনেকটা খোলামেলা ভাবেই রিফাতের ঘরেই করা হচ্ছে।
রহিমা আপা সর্বক্ষণ রিফাতের সাথেই থাকে। সুতরাং তার এ ঘটনা না জানার কোন কারণ নেই।
রাশেদ সবসময় রিফাতের রুমে না গেলেও আজকে রাতে অফিস থেকে এসেই গিয়েছিল। ওর অজানা থাকার কথা না। কিন্তু হতে পারে এমন যে তখন হয়তো কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল। রাশেদ অফিস থেকে ফিরে ঠিক ৭:৩০ টায়। আর ফ্রেশ হয়ে ৮ টা নাগাদ রিফাতের ঘরে যায়। সময় মেনে চলা রাশেদের পুরোনো অভ্যাস। কয়েকদিন ওর সাথে থাকলে এটা সবাই জেনে যাবে। হতে পারে সেই সময় বুঝে তখন লুকিয়ে রেখেছিল।
আর নীলিমা রিফাতের রুমে কখনোই খুব একটা যায়না। কারণ নীলিমা রিফাতের রুমে গেলে রিফাত খুব বাজে রকমের চিল্লা চিল্লি শুরু করে। তাই রাশেদ বুঝিয়ে বলেছিল, রিফাতকে সময় দিতে আসতে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তাই নিলিমাও যেত না।
আর শেষকথা হচ্ছে রিফাত যে কাজটা করছে টা দেখে মনে হয়নি সে এটা প্রথম করেছে। যে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল সেটা তার কাছে থাকার কথা নয়। সে এটা জোগাড় করেছে। পাশে একটা ক্লোরোফর্ম এর বোতল ও ছিল। তার মানে হচ্ছে সে যখন থাকেনা বিড়ালটাকে অজ্ঞান করে রেখে যায়। প্রাণীদের প্রতি অত্যাচার করে আনন্দ পাওয়ার এই জঘন্য স্বভাবটাকে জুওসেডিজম (zoosadism) বলে। সাইকোপ্যাথ ট্রেইট প্রকাশের অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে বাচ্চাদের ভেতর এই জুওসেডিজম প্রকাশ পাওয়া। এটা যদি এখনই চিকিৎসা করা না হয় তাহলে অনেক ভয়ানক রূপ নিতে পারে। বিড়াল টা হয়ত চাইলেও নীলিমা বাঁচাতে পারবে না।
কিন্তু যে জিনিসটা খচখচ করছে তা হচ্ছে রহিমা আপা কেন গোপন করছে! কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তার। এই হিসেব টাই মিলছে না।
*******************************************************
একটা সেমিনারে এটেন্ড করার জন্য ফরেন ট্রিপ দিতে হবে। এই কথা বলে নীলিমা অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চলে গেল রহিমা আপার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার দৌলতপুরে। খুঁজে পাওয়া টা মোটেও সহজ ছিল না। রাশেদের আড়াল হয়ে এগুলো করতে অনেক কাঠ কয়লা পোড়াতে হয়েছে নীলিমাকে। অবশেষে প্রায় দুইদিন হন্যে হয়ে খোঁজার পর খুঁজে পায় রহিমা আপার বাড়ি।
নিতান্তই জীর্ন শীর্ন একটি ছনের বাড়ি। সেখানে কেও এখন আর থাকেনা। আশেপাশের ঘর গুলোতে কড়া নেড়েছে নীলিমা, প্রথমে হাসিমুখে বরণ করলেও রাশেদের স্ত্রী শোনার পর প্রায় সবারই চেহারার রং পাল্টে যায় এবং অনেকটা দুর দুর করেই বের করে দেয় তাকে।
কিছুই বুঝতে পারছিল না নীলিমা। রাশেদের ওপর সবাই এত ক্ষিপ্ত কেন। মনে হচ্ছেনা আর কোন কুল কিনারা পাবে সে। কেউই কিছু বলছে না।
দুপুরের তপ্ত রোদে হতাশার দীর্ঘঃশ্বাস টা যেন বড্ড বেশি লাগছে নীলিমার। কি করবে সে। এভাবে এখান থেকে কোন সুরাহা না করে ফেরত গিয়ে অভিনয় করে সংসার করা সম্ভব না তার পক্ষে। কিন্তু যদি সংসার নাও করতে চায় কি কারণ বলবে সে। কোন প্রমাণ তো তার কাছে নেই।
এসব ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল নীলিমা। এই সময় একটা ১৫-১৬ বছরের মেয়ে হঠাৎ তার পথ আটকালো।
– আপনি রাশেদ ভাই এর বউ?
– হ্যা। আমার নাম নীলিমা। তোমার নাম কি? তুমি চেন রাশেদ কে?
– আমার নাম শেফালী। রাশেদ কাকারে চিনি। আমি ছোট থাকতে বেড়াইতে আইত। কাকলি বুবুজান দের বাড়িত।
– কাকলি কে?
– রহিমা খালার মাইয়া। একটাই মাইয়া ছিল। কি সুন্দর আছিল। আপনের মতন ই সুন্দর আছিল।
– ছিল মানে? এখন নেই?
চুপ করে আছে শেফালী।
– শেফালী আমি তোমার পায়ে ধরছি। তুমিও চুপ করে থেকোনা। আমাকে বল। খুলে বল আমাকে। আমি অনেক নিরুপায় হয়ে এসেছি। আমাকে একটু সাহায্য কর প্লিজ শেফালী। প্লিজ।
বলে শেফালির হাত ধরে কেঁদে ফেলল নীলিমা।
– আপনে এদিকে আসেন। এখানে কিছু কওন যাইব না।
হাত ধরে শেফালী একটু নীরব বাঁশ ঝাড়ে ঘেরা একটা জায়গায় নিয়ে যায়।
– আমি এই গল্প আমার মার কাছ থেইকা শুনছি। আমি তখন ছোট আমার খুব একটা সরণ আসে না।
রাশেদ কাকা প্রায়ই রহিমা খালাগো বাড়িত বেড়াইতে আইত। কাকলি বুবুর সাথে রাশেদ কাকার নাকি ভাব আছিল। কেও কিছু জানত না। কিন্তু একদিন হঠাৎ কইরা বুবুর শরীর খারাপ করলে ডাক্তর দেখায়। তখন সবাই জানবার পারে যে কাকলি বুবুর বাচ্চা হইব। সবাই নাকি অনেক মারছিল বুবু রে। পরে বুবু কইছিল বাচ্চার বাপ রাশেদ কাকা।
রহিমা খালা রাশেদ কাকার হাতে পায়ে ধরছিল। কি কান্দন কানছিল। কিন্তু কাকা অস্বীকার গেছিল। বুবু অনেক ভালা আছিল আপা, বুবু এই অপবাদ সহ্য করবার পারে নাই।
ঐ রাত্রেই বিষ খাইয়া পেটের বাচ্চা সহ মইরা গেছিল। এক মাত্র মাইয়ার শোক সইতে না পাইরা কয়দিন পর খালুও মইরা যায়।
কিছুদিনের মাইঝেই হাসিখুশি একটা সংসার ভাইঙ্গা তছনছ হয়া যায় রাশেদ কাকার লাইগা।
নীলিমা নিজের কান বিশ্বাস করতে পারছিল না। কি বলছে মেয়েটা এগুলো। সে নিজেও এবিউজের শিকার ছিল। একটা টক্সিক রিলেশন এ থেকে মানসিক ভেবে এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিল যে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল বহুবার। সেই মানসিক অবস্থা থেকে রাশেদ তাকে একটু একটু করে বের করে নিয়ে এসেছিল। এই মানুষটার এই রূপ থাকবে এত জঘন্য একটা অতীত থাকবে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি নীলিমা।
কি করে সম্ভব রাশেদের পক্ষে এরকম কাজ করা। মেনে নিতে পারছে না যেন নীলিমা। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। নিজের শরীরের ভার আর ধরে রাখতে পারছেনা। বসে পড়ল মাটিতে।
– আপা। কি হইল। কি হইল।
কোনমতে ক্লান্ত কন্ঠে মাথা তুলে তাকাল শেফালির দিকে নীলিমা।
– শেফালী, তোমরা সবাই আমাকে এই কথাটা জানাতে চাচ্ছিলে না কেন?
শেফালী এবার চুপ করে আছে।
– বল শেফালী। আমিও তো এই অন্যায় এর শিকার।
– আপনেরে কেও কিছু কইতে চায়নাই কারণ রহিমা খালা। রহিমা খালা আমগোরে দিয়া কসম কাটাইছে আমরা যেন এই কথা কাউরে না কই। উনি কাকলি বুবু, খালুর মরণের প্রতিশোধ নিবার লাইগা ঢাকা গেছে।
কথাটা শুনে পিলে চমকে উঠল নীলিমার। এবার দুয়ে দুয়ে চার হিসেবটা মিলে গেছে।
চলবে…………..