ফুপুর সংসারে আমি একটা অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মত। বিষয়টা স্বাভাবিক একে তো ফুপু যৌথ পরিবারের বউ এসবের মধ্যে সেই পরিবারে আমার থাকাটা ফুপুর জন্য বাড়তি একটা ঝামেলার মত। অবশ্য ফুপু নিজেই সেই ঝামেলাটা মাথা পেতে নিয়েছেন।
আমার নিজের পরিবার না থাকায় ফুপু আমাকে উনার পরিবারের অংশ বানিয়ে নেন। এজন্য কম কথা শুনতে হয়নি উনাকে। মুখ বুজে সহ্য করেছেন। না করেও উপায় নেই। এসব কথা সহ্য না করতে পারলে আমাকে এতিমখানায় রাখতে হবে আর সেটা ফুপু কখনো করতে পারবেন না।
সন্তান জন্মদানের সময় আমার মা মারা যান। মায়ের শোকে বাবা এর দুবছর পর পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। আমি তখনো খুব ছোট। বাবা মা পালিয়ে বিয়ে করেন। সেই থেকে নানাবাড়ির সাথে মায়ের কোন সম্পর্ক নেই আমাদের। মাও কোনদিন যোগাযোগ করেনি। জানি না মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন কিনা!
সেই তখন থেকে একটা মেয়ের জন্য আশ্রয় হয়ে দাঁড়ান এই ফুপু।
মা মারা যাওয়ার পর যতদিন বাবা ভালো ছিলেন ততদিন ফুপু বাড়িতে এসে আমাদের দেখাশুনা করে গেছেন।
কিন্তু বাবার অসুস্থতার পর আমাকে আর একা ঘরে রাখার সাহস হয়নি উনার।
আমি তখন ৬/৭ বছরের বালিকা।
বাবার চিকিৎসা করানোর মত অবস্থা ফুপুর ছিল না। তবুও একটা সরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন।
ফুপুর যৌথ পরিবারের পারিবারিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল না। ফুপা কম আয় করলেও বাকিদের আয়ে মোটামুটি চলে যেত উনাদের।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে আমিও উনাদের উপর বোঝার মত। ফুপুর জা’য়েরাও আমাকে সেখানে সহজ ভাবে মেনে নেন নি। এক কথায় সেখানে ফুপু ছাড়া ভাঙ্গা কুলার মত আমার অবস্থা।
তার উপর ফুপু আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন উনার ছেলেমেয়ের সাথে।
সেটা নিয়ে নানা কথা উঠে। খাওয়ানোর সামর্থ্যই নেই সেখানে পড়াশোনা বিলাসিতা এরকম কত কথা শুনতে হত ফুপুকে।
ছোট থেকে যখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলাম তখন ভাবতাম শুধু মাত্র আমার জন্য ফুপুকে এত কথা শুনতে হচ্ছে! যার কেউ নেই তাকে তোমার কাছে নিয়ে নাও না কেন আল্লাহ।
তখন থেকেই ফুপুকে নিজের মায়ের চেয়ে কোন অংশে কম দেখি না। বাবাকেও দেখতে যেতাম।
তবে ফুপু এমন হলেও উনার ছেলেমেয়েরা কেন জানি আমাকে মেনে নিতে পারত না। একমাত্র রূপা ছাড়া। রূপা আমার ছোট।
সোনালি আপু স্কুল থেকে কিছু আনলে সেটা উনার ভাইবোনদের নিয়ে ভাগাভাগি করে খেতেন সেখানে আমার ভাগ হয়নি। তবে সেটা নিয়ে কখনো আফসোস হয় না আমার। এইটুকু আশ্রয়ই আমার জন্য অনেক।
ওদের সব কাজ আমি করে দিতাম সাথে রান্নাঘরের টুকটাক কাজ সহ।
পড়াশোনা নিজে নিজে ই করতাম। স্কুলে যতটুকু বুঝে আসতাম ততটুকু মাথায় রেখে বাকি পড়াটা শেষ করতাম।
ফুপা যে আমার উপর খুব সন্তুষ্ট তাও না। উনি ফুপুকে খুব ভালোবাসেন ফুপুর যেকোন ন্যায় সঙ্গত কথার সহযোগীতা করেন। শুধু এইটুকু কারণে তিনি আমাকে কিছু বলতে পারেন না।
তবে মাঝে মাঝে বলেন
নিজের ই তিন/চারটা মেয়ে তার উপর অন্যের ফরজ কাজ নিজের কাঁধে পড়লে সেটা সামলাব কী করে?
ফুপু শুধু বলতেন
তোমাকে কিছু করতে হবে না। নিজের মেয়েদের ব্যবস্থা করে রাখো।
এভাবে দিন চলতে লাগল। ক্লাস ফাইভে এসে যখন আমি বৃত্তি পাই সবাই অবাক হয়ে যায়।
অথচ ঘরে আমার সাথে যারা পড়ে তারা টিচারের কাছে পড়েও তেমন ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি আর আমি একা পড়ে এত!
সেদিন আমি আমার ফুপুর চোখে আমাকে নিয়ে গর্ব আর আনন্দের হাসির বদলে সুখের অশ্রু দেখেছি।
এই প্রথম হয়ত ফুপুকে দেখে বুঝেছিলাম মা’য়েদের খুশি চোখের জলে প্রকাশ পায়।
তিনি আমাকে এমন ভাবে ডান হাত দিয়ে বুকে আগলে ধরেছিলেন যেন মনে মনে বলছিলেন আমি এই মেয়েটাকে আপন করে ভুল করিনি।
এরপর থেকে দেখলাম ফুপা আমার প্রতি অনেকটা স্নেহ সূলভ আচরণ করতে লাগলেন।
মাঝে মাঝে দুটো পেন্সিল দুটো কলম জ্যামিতি বক্স এগুলো এনে দিতেন।
ফুপুও সেগুলো দেখে ভীষণ খুশি। শুধু খুশি না আমার বোনেরা মানে ফুপুর মেয়েরা। রূপা সে দলে না।
মাধ্যমিকে পড়ছি সংসারে অনেক টানাপোড়ন। উনার নিজেদের সন্তানদেরই পড়াতে পারছেন না সেখানে আমি!
নিজের কাছেই খারাপ লাগা শুরু হয়।
আমি অনেক দিন স্কুলে যাই না।
স্কুল থেকে খবর আসে। আমাকে ডেকে নিয়ে বলা হয় স্কুলে যাওয়ার কথা।
আমি আমার সবকিছু বললাম। উনারা বলেন আমার কোন খরচ লাগবে না। আমি যে বৃত্তি পেয়েছি সেখান থেকে সব খরচ বহন করবে সরকার ক্লাস এইট অব্দি।
ফুপু কথাগুলো শুনে অনেক খুশি হোন আর মন খুলে দোআ করেন।
উনাদের পরিবারের অবস্থা অন্যরকম হতে লাগল।
যৌথ পরিবারে ভাঙ্গনের সুর দেখা দিল।
একে তো ফুপা খুব একটা আয় নেই একটা ছোট্ট দোকান ছাড়া। সেটাও খুব একটা চলে না।
পরিবারের এমন অবস্থা দেখে আমার কেমন জানি খারাপ লাগা শুরু হল।
পড়াশোনায় মন নেই।
ক্লাস এইটের ১ম পরীক্ষা বেশ একটা ভালো হয়নি। সেদিন ফুপুর সাথে তরকারি কাটছিলাম। সোনালি আপু হাসতে হাসতে ঘরে এসে বলে
দেখো মা তোমার আদরের নয়নার রেজাল্ট দেখো অঙ্কে ফেল করেছে।
আমি খাতাটা হাতে নিয়ে কান্না করে দিলাম।
সেদিন আমাকে নিয়ে অনেক হাসাহাসি করল সবাই। শুধু ফুপু আর আরো একজন ছাড়া।
ফুপু বললেন,
এভাবে আমাকে নিচু করতে পারলি!
ক্লাসে যতটুকু পড়ি তা দিয়ে বাকিটা শেষ করতে পারি না একা।
ঠিক তখনি সন্ধ্যায় আসিফ ভাই এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। ফুপু আর এই মানুষটা হাসেনি।
আসিফ ভাই ফুপুর বড় জা’য়ের ছেলে। দেখতে যেমন ভালো তেমনি কথাবার্তাও অমায়িক।
বেশ অনেকদিন আমাকে এভাবে বাকি সাবজেক্ট গুলোতে সাহায্য করতে লাগলেন।
উনার সহায়তায় আমি আবারো ক্লাস এইটে বৃত্তি পাই।
সেদিন আরেকবার ফুপু সবার মুখের উপর তালা লাগিয়ে দেন।
তখন আমি সদ্য কিশোরী। এই ঘর আর ঘরের পরিস্থিতির বাইরে কখনো কোন চিন্তা কিংবা কল্পনার জগৎ ছিল না আমার।
তবে আমার রেজাল্টে আসিফ ভাইয়ের মুখে হাসি দেখে আমার কেমন জানি অন্যরকম ভালো লাগা শুরু হল।
আমি জানতাম না সেই ভালো লাগাটা আসলে কি!
তবে তাঁকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগত। নতুন অন্যরকম স্বপ্নে বিভোর হতে লাগলাম আনমনে। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেই চিন্তা আমার মাথায় নেই।
এমনকি আমার অবস্থান কোথায় সেটাতেও খেয়াল নেই।
অন্যদিকে পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। ফুপু সহ উনার জা’য়েরা আলাদা হয়ে গেলেন। অনেক দিনের পুরনো সংসার যেখানে হাজার স্মৃতির সমাহার তা কদিনের মধ্যে চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেল চোখের পলকে।
সবাই যে যার মত নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছেন।
আসিফ ভাইকে খুব একটা দেখা যেত না।
বিকেলে টিউশন পড়িয়ে সন্ধ্যায় ঘরে আসতেন।
মাঝে মাঝে ফুপুর রুমে আসতেন।
কিভাবে সংসারটা আবার আগের মত করা যায় সেটা জানতে।
–একবার সংসারে ভাঙ্গন ধরলে সেটা আর আটকে রাখা যায় না বাবা। নদীর পাড় যখন পানিতে বিলীন হতে থাকে তখন কি কেউ সেটা আটকাতে পারে? পারে না বিলীন হয়েই যায় আর বিলীন হয়ে যাওয়া অংশ আর ফিরে পাওয়া যায় না। সংসার ধর্মটাও একদম নদীর মত বাবা।
আমি চা নিয়ে আসিফ ভাইকে চা দিলাম।
উনি চা হাতে নিতে নিতে বললেন
এই হয়ত শেষ চা খাওয়ার আজ নয়না।
কাল চলে যাব চাচি ভার্সিটি খুলে যাবে।
আর শুনেছো হয়ত বাবা মা সবাই শহরে বাসা নিচ্ছে।
ফুপু কথাগুলো শুনে চোখের জল মুছলেন। কাউকে ধরে রাখার সামর্থ্য নেই আমার বাবা। তোমার চাচাকেও জানো তুমি! সবাই সবার মত ভালো থাকুক। শুধু
বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে সেই আশায় উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করি। জানো তো বাবা তোমার চাচার অবস্থা!
আমি কথাগুলো শুনছিলাম ঠিক তবে কান্না করছিলাম কেন সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
না পরিবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে সবার যার যার মত সব গুছিয়ে নিচ্ছে সেটা তো আমি জানি!
কষ্টটা আমার অন্য জায়গায় হচ্ছিল।
কিরকম একটা কষ্ট! ঠিক আসিফ ভাইকে নিয়ে যেমন এক অন্যরকম ভালো লাগা ছিল ঠিক সেটার বিপরীত এই কষ্টটা!
একটা ১৫/১৬ বছরের মেয়ের কাছে এই বিচ্ছেদের কষ্টটা হয়ত নতুন ছিল।
মনটা খুব ভার হয়ে আসছিল। যেন কেউ একজনে আর দেখতে না পাওয়ার কষ্টটা আস্তে আস্তে আমার সর্বস্বকে ঘিরে ফেলছিল।
রাতে ঘুম হয়নি। পরদিন সকালেই ঠিক করলাম আসিফ ভাইকে বলে দিব যা হবার হোক।
যে মেয়েটা কোনদিন কারো কাছে কিছু চাওয়ার সাহস করেনি এমনকি হাড়ি থেকে এক টুকরো মাছের আবদার করেনি! সে আজ একটা আস্তো মানুষকে চেয়ে বসবে! আমি ওতশত ভাবতে পারছিলাম না।
আরো ২/৩ ঘন্টা পর আসিফ ভাই চলে যাবে। আর গ্রামে আসবে না!
এটা ভাবতে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। এই বয়সে মেয়েদের নাকি একটু বেশি আবেগ থাকে।
আমি অনেক লজ্জা আর সঙ্কুচ নিয়ে আসিফ ভাইয়ের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। তখন একবার মাথায় আসলো এই মানুষটাকে চাওয়ার মত আমার কি এমন সামর্থ্য আছে…
তারপর ভাবলাম একবার বলে দেই নিজের কথাগুলো।
অন্তত বলে দিয়ে স্বাধিন হয়ে রই নিজের কাছে। বলতে না পারার এই যন্ত্রনা থাকবে না!
আসিফ ভাই আমাকে দেখে ভেতরে ডাকলেন। অনেকগুলো নতুন খাতা কলম আর কিছু বই দিলেন সামনের এসএসসি পরিক্ষায় কাজে আসবে বলে।
আমি তখনো কাঁপতেছি..
আমার মাথা নিচু দেখে জিজ্ঞেস করলেন আজ কি হল আমার?
আমি মাথা নিচু রেখেই বললাম
অনেক কিছু হয়েছে। খাতা আর বইগুলো একপাশে রেখে বললাম..
আসিফ ভাইয়া আপনাকে আমার ভালো লাগে! অনেক ভালো লাগে। না ঠিক সেটা না। আমি আবার চোখ বন্ধ করে বললাম
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি!’
এই কথা বলার ঠিক দুই সেকেন্ড পর আমার গালে খুব জোরে চড় বসলো।
আমি ভাবতে ই পারিনি আমার পছন্দের মানুষটা আমার উপর হাত তুলতে পারে।
চলবে…
পরিণীতা
ফাবিহা ফেরদৌস
পরিণীতা [২য় পর্ব ]
ফাবিহা ফেরদৌস
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’
কথাটা বলার দুই সেকেন্ড পর আমার গালে খুব জোরে একটা চড় বসলো ! ভাবতে পারছিলাম না আমার পছন্দের মানুষটা গায়ে হাত তুলতে পারে।
আমি মাথা নিচু রেখে চোখের জল ফেলছিলাম। মুখ উপরে তোলার সাহস হচ্ছে না। দেখছিলাম আমার চোখের জল কিভাবে মাটি স্পর্শ করছে।
তারপরও কাঁপতে কাঁপতে চোখ খুলে চেয়ে দেখি চাচি দাঁড়িয়ে। মানে ফুপুর জা আসিফ ভাইয়ের মা। মূলত উনি আমাকে চড়টা মেরেছেন।
আসিফ ভাই কিছুটা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এই মুহূর্তের ঘটনাটি কী ঘটে গেল সেটাই হয়ত ভাবছেন।
একে তো আমি এসব বলেছি পরপরই আবার চাচি সেসব পেছন থেকে শুনতে পেয়ে এরকম ভাবে একটা ঘটনা ঘটে যাবে বুঝে উঠতে পারিনি কেউ।
আবেগে যা বলার তা বলে দিয়েছি ঠিক কিন্তু এই মুহূর্তে লজ্জায় আমার মাটি ভেদ করে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
চাচি চড়টা মেরে চুপ থাকেননি মোটেও।
আসিফ ভাইকে পাওয়ার মত কি আছে আমার? না একটা ঘর পরিবার আছে নিজের না আছে ওতটা রূপ।
রূপ বলতে আমি ওতটা খারাপও নই কিন্তু এই মুহূর্তে চাচির কাছে আমি একমাত্র কুৎসিত মেয়ে। তবে একটা সমস্যা আছে আমার। অবশ্য আমি সেটাকে সমস্যা মনে করি না। অন্যরা বলে ‘ আমি খাটো’। অনেকটা খাটো।
আমার মা কিংবা বাবা কেউই খাটো না কিন্তু আমি খাটো। যাই হোক সেটা উপরওয়ালার দেওয়া আমার তো এতে হাত নেই। আর খাটো না হয়ে লম্বা হলেই কি আসিফ ভাইকে পেতাম! না, পেতাম না মনে হয়। আমার সেই যোগ্যতা নেই।
আমি সব শুনছিলাম। আবার মনে মনে অনুশোচনা হচ্ছিল কেন বলতে গেলাম। যতটুকু পছন্দ করতো সবাই সেটাও আজ নিজের ভুলে হারালাম হয়ত।
আমি আর কিছু না বলে আসিফ ভাইয়ের রুম থেকে চলে আসলাম।
আসার সময় পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হয়নি। দেখতে পারিনি আসিফ ভাই তাকিয়ে আছে কিনা আমার দিকে।
শুধু ভাবছিলাম কোনদিন এই মানুষটাকে দেখতে পারব কিনা জানি না আর সে আমাকে মনে রাখার মত যে সম্ভাবনাটুকু ছিল আজ সেটুকুও হারালাম বোধ হয়।
ঘটনাটা ফুপুর কানে যেতে বেশি সময় লাগেনি। ফুপু আমাকে মারতে গিয়েও মারতে পারলেন না। মারার আগে হাত কেঁপে উঠলো চোখ দুটো লাল হয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। হয়ত ভাবছেন বাপ মা ছাড়া মেয়ে অভাগী যাকে কিনা তিনিই আশ্রয় দিয়েছেন বড় করেছেন। তার উপর প্রথম বার হাত তুলতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নিলেন।
– লজ্জা করল না আমার সম্মানের কথা মনে পড়লো না। এমনিতে জা’য়েরা আমাকে বিভিন্ন কথার খোটায় জ্বালিয়ে মারেন তার উপর আজ এসব। ভাবতে পারছিস আমি ওদের সামনে কোন মুখে যাব। বাইরে না হোক এই বাড়ির বাকি সব বউয়েরা তো এই ব্যাপারে জানবে। আমার মুখটা এভাবে উজ্জ্বল করতে পারলি!
তার থেকে বরং ঘর থেকে…..
না। শেষ কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না ফুপু। এই ঘর ছেড়ে যাবই বা কোথায়! ছোট থেকে লালনপালন করা মেয়েটার উপর এতটুকু মায়া তো জন্মে গেছে উনার।
আমি ঘরের এক কোণায় বসে কান্না করছিলাম। চোখ মুছতে মুছতে বললাম এইবারের মত মাফ করে দাও ফুপু। তোমায় ছুঁয়ে শপথ করছি এসবে আর কখনো পা বাড়াবো না।
শেষ বারের মত ক্ষমা চাইছি জানো তো তুমি ছাড়া কেউ নেই আমার। আর সেই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে!
ফুপু অনেক কোমল মনের মানুষ। কাছে টেনে নিয়ে বললেন আর যেন এমন ভুল না হয়। তাহলে ফুপুকেও চিরদিনের মত হারাবো।
আমি তখন ১৫/১৬ বছরের আবেগী বালিকা রূপ পাল্টে একজন পূর্ণ বয়স্কা নারীর রূপ ধারণ করলাম। মনে মনে নিজেকে দৃঢ় তৈরি করে নিতে লাগলাম। কখনো ফুপুর সম্মানে আঘাত দিব না।
মাকে আঘাত করার সাহস যেন না হয় আমার তার জন্য যদি সবকিছু ভুলতে হয় সেটাই করবো।
তখনি সোনালি আপু স্বর্না আপু এসে দাঁড়ালো।
বলেছিলাম মা এত আদর করো না। দেখলে তো! এজন্যই আমার নয়নাকে পছন্দ না। স্বর্না আপু কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
যা হবার হয়ে গেছে। আর এমন ভুল হবে না ওর। যে যার কাজে যাও পড়াশোনা থাকলে কর গিয়ে।
এরপরে দু দিনের মধ্যেই আসিফ ভাইয়ের পরিবার চলে গেল। বাকিরা যে যার মত দূরত্ব বাড়িয়ে দিল। তবে ফুপুর ঘরের সীমানা অতিক্রম করে বাইরে যাওয়ার সাহস আমার হয়নি। ঘর থেকে শুধু পুকুর ঘাট অব্দি যেতাম আবার সোজা মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকতাম।
এর মাঝে আসলো সোনালি আপুর বিয়ের প্রস্তাব। সবকিছু ভালোই। ফুপা ফুপুর ইচ্ছা বিয়েটা দিয়ে দেওয়ার।
কিন্তু বিয়ের খরচ আসবে কোথা থেকে যেখানে নিত্যদিন খেয়ে বাঁচাটাই কঠিন হয়ে গেছে। ফুপার ভাইয়েরা অল্প অল্প সাহায্য করলেন আর ফুপা নিজের দোকানটা বন্ধক রেখে টাকা ধার নিলেন।
কিন্তু এই দোকানটাই ছিলো একমাত্র চলার সম্বল অল্প হোক তারপরও। কিন্তু আর কোন উপায় নেই।
সোনালি আর স্বর্ণা আপু আমার থেকে বয়সে বড়। রূপা আর শুভা আমার ছোট। শুভা তো একদম ছোট। এইতো ছয় বছরে পা দিল সবে।
যাই হোক সোনালি আপুর বিয়ে হয়ে গেল। এর ২ বছর পর স্বর্না আপুর বিয়ে হল।
দোকান ছাড়িয়ে আনা তো দূরের কথা উল্টো সেটা যার কাছে বন্ধক রেখেছিলেন।
সে দখল করে নিল। স্বর্না আপুর বিয়েতে ফুপা উনার ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। ভাই এখন টাকা ফেরত না পেয়ে ভিটে ছেড়ে দেওয়ার দাবি করছেন।
মানুষ কতটা নির্মম হয় টাকার দেখা পেয়ে গেলে।
ফুপা নিরীহ টাইপের মানুষ। এখন এই অবস্থা হলে বাকিদের কিভাবে দেখাশোনা করবেন সেই চিন্তায় রাতদিন কাটে।
এদিকে ততদিনে আমি এসএসসি পাশ করে ফেলেছি। আর খুব ভালো ভাবে পাশ করেছি। স্কুলে আমি রেজাল্টের দিক দিয়ে প্রথম।
এত চিন্তার মাঝেও যেন আমার এই রেজাল্টটুকু উনাদের মুখে হাসি ফুটালো।
ফুপা দোকান ছেড়ে দেওয়ার পর নদীতে মাছ ধরতেন নৌকা চালাতেন।
তাও সবসময় পারতেন না শরীর ভালো থাকে না।
আমি বেশ কয়টা টিউশনি জোগাড় করে নিলাম। ঘরের টুকটাক কাজের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলাম।
একবারো মনে হয়নি আমি এই পরিবারের বাইরের কেউ।
স্কুলে টিচারদের সহযোগীতায় একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম।
ফুপা ফুপু কেউই আর পড়ালেখায় বাঁধা দিলেন না।
বিবাহিত সোনালি আর স্বর্না আপুর টুকটাক শখের আবদার গুলো আমিই আড়ালে পূরণ করার চেষ্টা করতাম।
কিন্তু এর মাঝে একদিন এক মহাজন এসে বললেন বাড়ি ছেড়ে দিতে। ফুপার ভাই নাকি এই ঘরটা উনার কাছে বিক্রি করে গেছেন মারা যাওয়ার আগে।
ঘটনা শুনে আমার সবাই অবাক হয়ে রইলাম। কোন কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। ওই চাচির কাছে গিয়ে জানতে পারলাম ঘটনাটা সত্য।
তখন আর কিছু করার ছিল না। এমনকি টাকা পরিশোধ করার মত অবস্থা নেই আমাদের।
সবকিছু গুছিয়ে বাড়ি ছাড়তে হল।
একটা বাসা ভাড়া দেখলেন ফুপা। গ্রামে আর থাকা হল না। শহরের দিকে আমরা ৫ জন পা বাড়ালাম।
শহরে পা ফেলতেই কেমন জানি বুকটা ধক করে উঠল।
বেশ কয়েক বছর তো কেটে গেল সেই ঘটনার। তবুও মনে হয় জীবন্ত হয়ে আছে ওই সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত। মনের মাঝে দাগ কেটে আছে।
হ্যা, এই শহরে! এই শহরেই তো আসিফ ভাইয়েরা থাকে। কোথায় থাকে জানি না ঠিক তবে শহরে পা রাখতেই মনে হল আমি খুব কাছাকাছি আছি।
ওই ঘটনার পর থেকে আর কোন যোগাযোগ নেই উনাদের সাথে। নতুন বাসায় উঠতেই কাজে লেগে পড়লাম মন থেকে সব মুছে ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। যেদিকে আর ফিরে তাকাবো না বলে শপথ করেছিলাম সেদিকে কেন মন বার বার ডাকছে । হয়ত এই শহর নামক শব্দটার প্রভাবে।
আমি এইচএসসি পাশ করলাম। কলেজের ২য় মেধা স্থানে আমার নাম। আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া এত ঝড় ঝাপটার মধ্যেও এতটা সহায় হয়েছেন আমার।
টিউশনের পাশাপাশি একটা সরকারি এনজিও তে মাঠকর্মী হিসেবে যোগ দিলাম। ফুপা ফুপুর পারমিশন নিয়ে। ফুপা পারমিশন দিলেন ঠিক তবে একজন বাবা যেমন তার মেয়েকে সাবধানে থাকার উপদেশ দিয়ে দেন ঠিক তেমন। কথাগুলো শুনে কেমন জানি ভালো লাগছিলো।
মাঝে মাঝে নিজের বাবাকেও দেখতে যাই। ইদানিং প্রায় ঘন ঘন যাই। ফুপুকে বলে আবার না বলেও।
অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে আমি। মাঠকর্মী থেকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে আমার। তবে ফুপার শরীরটা ভালো না। উনার সব চিকিৎসার দায়িত্ব আমি নিলাম।
একজন লেখক ঠিকই বলেছিলেন
মেয়েদের কাছে জমানো কিছু টাকা থাকে।
এতদিনে অল্প অল্প করে লুকিয়ে যা জমিয়ে ছিলাম তা অনেকটা ফুপার চিকিৎসায় খরচ হয়ে যাচ্ছে।
তবে এতে আমার মোটেও আফসোস নেই। বরং দায়িত্ব নিতে পেরে অনেকটা ভালো লাগছিলো নিজের।
একদিন বাড়ির মালিক এসে বললেন ঘরটা বিক্রি করে দিবেন আমরা যেন অন্যঘর দেখি। উনার কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম অনেক কিছু।
তাই হুট করে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেল আমার কাছে বিক্রি করবেন!
আমি মাত্র অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ুয়া একটা মেয়ে! জায়গা কেনার মত খুব একটা সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু কি ভেবে বলে ফেললাম ঠিক জানি না। উনি বললেন তাড়াতারি শিওর হয়ে যেন বলি।
ফুপু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন এতগুলো টাকা আসবে কোথা থেকে?
আমি অভয় দিয়ে বললাম একটু ভরসা রাখো আমার উপর!
আমি দেরাজ খুলে টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়ানো দুল জোড়া দেখালাম। বেশ বড় না হলেও মাঝারি সাইজের দুল ভীষণ সুন্দর।
এটা মায়ের দুল। ফুপু আমাকে এক বছর আগে দিয়েছিলেন। এটা আমার আমানত উনার কাছে গচ্ছিত ছিল।
এই দুল জোড়া বিক্রি করে দিব।
ফুপু আমাকে মানা করলেন বললেন এটা শেষ স্মৃতি আমার মায়ের।
আমি তখন বললাম, হুম মায়ের স্মৃতি এক মায়ের স্মৃতি আরেক মা আর পরিবারকে একটু ভালো রাখতে এটা হাতছাড়া হয়ে গেলেও আমার মা কখনো নারাজ হবেন না আমি জানি!
আর এতে যা হবার হবে বাকিটা আমি মেনেজ করে নিব অফিস থেকে। তুমি শুধু বিশ্বাস রেখো আমার উপর।
ফুপু কেঁদে দিলেন। হটাৎ পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করলাম।
পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি উনার হাত আমার মাথার উপর।
পুরুষরা কাঁদে না ঠিক তবে অতি ভালোবাসায় পুরুষরা কান্না করে।
আমিও দেখেছি ফুপার এমন চোখ জোড়া।
মাথায় হাত রেখে বললেন
আমার ছেলে নেই বলে কখনো আফসোস ছিল না হয়ত বিধাতা তোকে আমাদের জীবনে পাঠিয়ে দিবেন বলে মনে এই সান্ত্বনা ছিল।
আমি শুধু দোয়া চাইলাম। মন থেকে একটু দোআ করো আমার জন্য।
ঘরটা খুব বেশি বড় না দুই রুমের একটা ঘর আর ছোট্ট একটা রান্না করার অংশ। তবুও নিজেদের বলে তো কিছু একটা হবে।
পরদিন অফিস থেকে তাড়াতারি চলে আসি।
বাড়ি ফিরে একটা বাচ্চাকে দরজার সামনে দেখতে পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। না তো আপুদের কারো ছেলে নয় তাহলে কে এলেন বাসায়।
ভেতরে ঢুকতেই আমার শরীরে অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেল।
শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেল বোধ হয়।
না মানুষটাকে চিনতে আমার ভুল হয়নি।
তবে সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি। রূপার কাছ থেকে জানলাম বাবাকে দেখতে এসেছেন আসিফ ভাই। আমি এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না।
কতদিন দেখি না মানুষটাকে! কতদিন!
ভাবতেই তাঁকে নিয়ে সব শূন্যতা ঘিরে ফেরলো আমাকে।
দেখার ইচ্ছে থাকলেও সামনে যাওয়ার সাহস নেই।সেই অতৃপ্তি নিয়ে টিউশনির নাম করে পাশে এক বান্ধবীর বাসায় চলে গেলাম। ঘরে থাকলে কখন কি করে বসি ঠিক নেই।
তবে বাচ্চাটা কার?
যাই হোক এত ভাবতে ইচ্ছে করছে না আমার। শরীরটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
দু ঘন্টা পর ঘরে আসি।
নিজের রুমে গিয়ে দেখতে পেলাম নতুন একটা বই।
বইটা খুলতেই একটা চিরকুট। কে লিখেছে তাঁর নামটা নিচে দেওয়া ‘আসিফ’।
আমার হাত কাঁপতে শুরু করল।
এটাও কি সম্ভব…!
চলবে
পরিণীতা [৩য়/ অন্তিম পর্ব ]
ফাবিহা ফেরদৌস
নতুন একটা বই। বইয়ের মধ্যে চিরকুট। চিরকুটটা কে লিখেছে সেটা নিচে দেওয়া আছে ‘আসিফ’!
নামটা দেখতেই শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে গেল। এটাও কি সম্ভব!
মাথায় ভীষণ যন্ত্রনা অনুভব করলাম। যা দেখছি তা সত্যি তো?
লেখা ছিল,
‘ অবেলায় ফোঁটা মুকুল মল্লিকা আজও আমার কাছে সে বড় পবিত্র পুষ্পের ন্যায়। তাঁর হৃদয়ের শুভ্রতায় আজ আমার গহীন হৃদয় আলোকিত। একটি বার আসবে শেষ বিকেলের শুভ্রতা নিয়ে খেয়া পাড়ে একটি বারের জন্য! কাল বিকেলে।’
লাইনগুলো বার বার পড়ছিলাম। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তাহলে কি আসিফ ভাই আমাকে পছন্দ করে। তাঁর কাছ থেকে তো কোনদিন সেরকম কোন আভাস পাইনি! নাকি সেরকম কোন সুযোগ মিলেনি উনার।
আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। বুকের গভীরে যে কাঁপন শুরু হল তা বলে বুঝানোর মত না। আমি চিরকুট হাতে নিয়ে বসে পড়লাম একদম ফ্যানের নিচে।
কোন দিকদিশা খুঁজে পাচ্ছি না।
সেই পুরনো আবেগ আমার প্রথম আর শেষ ভালো লাগার মানুষটাও যে আমাকে এভাবে এসে ধরা দিবে আমি যেন কল্পনাও করতে পারছি না।
একদিকে যেমন একটা ভালো লাগা কাজ করছিলো অন্যদিকে কেমন জানি আবার মনটা খঁচখচ করছিল।
কাল বিকেলে কি আমার যাওয়া উচিত? আর কেনই বা যাব। গেলে যদি আমি আবার সেখানে আটকা পড়ে যাই।
যদি নিজেকে সামলাতে না পারি! আমি তো জানি আমার ভালোবাসায় কোন ন্যায় অন্যায় ছিল না শুধুই ভালোবাসা ছিল। যার ফলে এখনো সেই মানুষটাকে নিয়ে আমার অনুভূতির কোন নড়চড় হয়নি। অন্য কারো প্রতি সেরকম কিছু অনুভব হয়নি আজ অব্দি।
ভীষণ দুটানায় পড়ে গেলাম। যাব নাকি যাব না। যাওয়াটা কি ঠিক হবে। পরিবার আর ফুপুর কথা মনে পড়লেই এক পা ও এগুতে চায় না। ফুপুকে দেওয়া কথা এভাবে ভেঙ্গে ফেলব।
তখনই ফুপু চা নিয়ে আসলেন। ফুপুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছিলো না।
পরদিন সকাল। অফিসের কোন কাজে মন বসছে না টুকটাক যা কাজ ছিল কোনরকম তা শেষ করে চেয়ারে মাথা দিয়ে চোখ বুজলাম। বার বার শুধু চিরকুটের লেখাটা সামনে ভাঁসছিলো।
কাজ শেষ করে বেড়িয়ে পড়লাম। সোজা বাড়িতে গিয়ে দেরাজ খুলে একটা শাড়ি বের করলাম। তখনই ফুপু আবার জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাচ্ছি। কোন উত্তর দিতে পারছি না কি উত্তর দিব? আর কেনই বা শাড়িটা বের করেছি? কোথায় যাব?
আমি এই মুহূর্তে কি করছি তা নিজেও জানি না।
হঠাৎ মুখ ফসকে ফুপুকে মিথ্যা বলে দিলাম। বললাম এক বান্ধবীর আকদে যাচ্ছি বিয়ের অনুষ্টান পরে হবে আজ শুধু আংটি পড়ানো আর আকদ।
আমি এই মিথ্যা কথাগুলো কিভাবে নিজের মুখে একটানা বলে গেলাম তাও জানিনা।
মানুষের গোপন লুকানো মায়ার প্রতি যে গভীর টান থাকে তা হয়ত সবকিছু ভেদ করতে সক্ষম হয়।
বলার পর নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছিল। কেন এমন করলাম।
যাই হোক সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই নিয়েছি তাহলে শেষবারের মত যাই।
কলাপাতা রঙের শাড়ি কাঁচের চুড়ি চোখে হালকা একটু কাজল টেনে সাজলাম।
এই প্রথম কারো জন্য এভাবে নিজেকে সাঁজালাম। মেয়ে হয়েও কখনো এরকম সাধ আহ্লাদের প্রতি আমার ঝোক যায় নি।
আসলেই মেয়েরা তাঁর পছন্দের মানুষের জন্যই নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে।
ধীর পায়ে এগিয়ে এগুতে লাগলাম। কোন এক অদৃশ্য বলের আকর্ষণে যেন আমি ছুটতে লাগলাম। হৃদয় কম্পন বাড়তে লাগল। তবুও মানুষটাকে একটি বার দেখার নেশায় আমি এগিয়ে যাচ্ছি বার বার।
পৌঁছতে আমারই হয়ত ১০ মিনিট দেরি হয়ে গেল। আসিফ ভাই নদীর দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছেন। মানুষটার ছায়া দেখতেও যেন ভীষণ ভালো লাগছিল। যদি পারতাম সারাজীবন এই ছায়াটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে পারতাম। কিন্তু না চাইলেই সব হয় না।
চাইলেই সব পাওয়া যায় না এটাই জীবন ধর্ম হয়ত।
আসিফ ভাইয়ের সামনাসামনি গিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই যেন আমার ভয় লাগছিল। এত বছর পর উনার সামনে দাঁড়িয়ে তাও অনেক কিছু বদলে গেছে আগের মত নেই আর।
আমি মাথা নিচু করে থাকলেও বুঝতে পারছিলাম আসিফ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
— আমি তো জানতাম না এই মেয়েটা এত রূপবতী হয়ে গেছে আগের থেকেও। আমার অপেক্ষা তাহলে বিফল হয়নি।
— কিসের অপেক্ষা চোখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। অনেক দিন পর সেই চোখ জোড়া দেখতে পেলাম।
–জানো তুমি তো সেদিন তোমার কথা বলেই দিয়েছিলে। আমার যে কিছু বলার আছে সে সুযোগ টুকু পর্যন্ত পাইনি।
তোমার কিশোরী মন বলে হালকা করে নিয়েছিলে আমি পারিনি।
আমি আসলে তখনো বুঝতে পারিনি।
যখন তোমার থেকে দূরে গেলাম তখন বুঝলাম আমি কোথায় বাঁধা পড়ে গেছি।
মা বাবার চাপে তখন আমার বলার কিছু ছিল না।
পড়াশোনা শেষ করে দেশের বাইরে পারি জমাই। বাইরে যাওয়ার আগে গ্রামে গিয়েছিলাম তোমাদের পাইনি। ওইদিন রাতের ফ্লাইটে চলে যাই।
বাবা অসুস্থ মায়ের কথাই শেষ কথা। অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছি পারিনি। তাই সব বাদ দিয়ে পালিয়ে গেলাম।
— বাহ্ পালিয়ে গিয়ে বুঝি বাঁচা যায়। পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে পারলে আজ আমি এখান অব্দি আসতাম না।
— না পারিনি। পারিনি বলে হয়ত সেখানেও মন টিকে নি। জানো চোখের দেখায় ক্ষণিকের ভালো লাগা হয় কিন্তু মনের সাথে মন মিলে না। এক মনে আর কাউকে জায়গা দেওয়া যায় না। মেজো আপু ব্রেইন টিউমারে মারা যান গত বছর। দুলাভাই নতুন বিয়ে করে নিয়েছেন। উনি মারা যাওয়ার কদিন আগে দেশে আসি।
আপুর শেষ চিহ্ন টুকু আমার কাছে রেখে দিলাম। দেখলাম দুলাভাইও তেমন আপত্তি করলেন না। আমি কত অদ্ভুত তাই না! সায়মান এখন আমার ছেলের সমান।
— মেজো আপার জন্য খারাপ লাগছিল ঠিক তবে বাচ্চাটার কথা ক্লিয়ার হওয়ায় যেন বুকের উপর থেকে পাথর সরে গেল। আর যাই হোক প্রিয় মানুষটার পাশে অন্যকাউকে দেখার ক্ষমতা উপরওয়ালা কাউকে দেননি আমাকেও না।
তাতেই বা কি! ( মনে মনে বললাম।)
তা দেশে আসলেন যখন বিয়েটা করে নিতেন। আর কত একা থাকবেন। বয়স তো পেড়িয়ে যাচ্ছে।
–হুম তোমারও তো বিয়ের উপযুক্ত সময় । অবশ্য তোমার জন্য ছেলের অভাব হবে না। এরকম একটা মেয়ে সব ছেলে চায়।
— ছেলের অভাব হবে না বললেই কি একটা মেয়ের পছন্দ অপছন্দ থাকতে নেই! চাইলে কি কাউকে জীবনের সাথে জড়িয়ে নেওয়া যায়!
— একদিন তো তুমি বলেছিলে আজ আমি বলছি আমি তোমাকে চাই। ধরবে আমার হাত? আমি দূরে গিয়ে পারিনি তোমার থেকে দূরে থাকতে বরং দূরত্ব আরো তোমার কাছে টেনে নিয়েছে আমাকে।
আসিফের শেষ কথাগুলো যেন আমাকে একদম নাড়া দিয়ে গেল। কোন মেয়ের কাছে এটাই হয়ত সর্বোচ্চ চাওয়া থাকে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে।
কিন্তু না আমি আর সেই ১৫/১৬ বছরের কিশোরী নই। এখন আমার পুরো একটা পরিবার আছে দায়িত্ব আছে আর সবশেষে আমার ফুপুর কাছে দেওয়া কথা!
আমি বললাম,
জানেন আগে বয়স কম ছিল। যখন যা কিছু মুখে আসত বলে দিতাম কি হবে না হবে ভাবতাম। আসলে তখন ভাববার এত বয়সও ছিল না।
কিন্তু এখন কোন কিছু বা কাউকে নিয়ে ভাবতে হলেও এর আগে দশবার ভাবি এটা নিয়ে ভাবা উচিত নাকি অনুচিত।
আমি নয়না মানুষটা ঠিক আগের মানুষটাই আছি। তবে পাল্টে গেছে ভেতর।
আগে আমি পরগাছার মত ছিলাম এখন আমার একটা পরিবার আছে।
শুধু মাত্র নিজের সুখের জন্য আপনার হাত ধরা আমার পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব না। হ্যা, ভালোবাসি আপনাকে আজও বাসি সেই আগের মতই।
তবে ভালোবাসলেই সবকিছু ছেড়ে ছুটে যেতে হবে এমন তো নয়।
বলেই মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
নিজের দুর্বলতা এখন আর কাউকে দেখাতে চাই না।
তখন খেয়াল করলাম এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। চোখগুলো অসম্ভব লাল হয়ে আছে।
আমার কিচ্ছু করার নেই। বিশ্বাস করুন কিচ্ছু করার নেই। আমি যাদেরকে আপন করে নিয়েছি তাদেরকে এভাবে ছেড়ে স্বার্থপর হতে পারি না।
আমি মা বাবা কি জিনিস কখনো বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝি। ফুপু ফুপা আমার সেই মা বাবা আমিও তাদের সন্তান সমতুল্য।
ভালো থাকবেন। আসি।
কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।
আমি জানি প্রিয়জনের দূরে চলে যাওয়াটা কত কষ্টের। ভেতরটা একদম ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তবুও আটকে রাখা কিংবা আগলে রাখা সম্ভব হয় না।
শুধু প্রার্থনা করি ভালো থেকো আর আমিও যেন সব সহ্য করার শক্তি পাই।
বাড়িতে গিয়েই দেখি সোনালি আপু স্বর্না আপু দুজনই এসেছে। সোনালি আপু পায়েস বানিয়ে এনেছেন আমার জন্য আলাদা করে বাটিতে রাখা। মনে পড়ল সেদিনের কথা যখন উনাদের খাবারে আমার ভাগ ছিল না। আর আজ সবার আগে উনি আমার ভাগটাই তুলে রেখেছেন এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে! আগে আপন করে না নিলেও এখন তো আপন। আজ আমার সব আছে বাবা আছে মা আছে বোনরা আছে।
উনারা আজ উনাদের বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। হ্যা এখন থেকে এটাই উনাদের বাবার বাড়ি আমিও চাই এমন হোক।
সোনালি আপু হটাৎ হাত ধরে কেঁদে ফেললেন।
আমি জড়িয়ে ধরে বললাম একটু নিজের বোনের মত ভালোবেসে আগলে রেখো আপু আর কিচ্ছু চাই না আমার।
এই তো বেশ আছি।
আমার সবকিছু নিয়ে।
কদিন পরে এক বিকেলে দরজার সামনে কেউ একজনকে দেখে থমকে গেলাম সবাই। মেজো চাচি! আসিফ ভাইয়ের মা। এত বছর পর!
কোন বাড়তি কথা না বলে ফুপুকে বললেন,
আমরা তো একই পরিবারের মানুষ আলাদা হয়েছি মাত্র। চাইলেই আবার একসাথে থাকতে পারি। আজ আমাকে ফিরিয়ে দিস না বোন।
আমার সামনে এসে বললেন আমার ছেলেকে ভালোবাসতে পারবি তো এরকম ভাবে সবসময়।
ফুপু আমার হাত ধরে অভয় দিলেন।
ভালোবাসাকে প্রত্যাখান করার ক্ষমতা কোন মেয়ের নেই।
আমি আজও নিরবে শুধু দু ফোঁটা চোখের জল ফেললাম।
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে। আসিফ একটা নীল রঙের শাড়ি আর চুড়ি এগিয়ে দিয়ে বললেন
‘ সারাজীবন সাঁজবে আমার জন্য।’
আমি ভাবছি উপরওয়ালা সব সুখ একসাথে দিয়ে দিয়েছেন আমাকে। কষ্টের পর আল্লাহ সুখ দেন নিশ্চয়ই।
আজ আমি সব পূর্ণে #_পরিণীতা।
সমাপ্ত।