প্রেমে যদি পড়তেই হয়, তবে গরু-ভেড়া-ছাগলের প্রেমে পড়ুন। একমাত্র ঢিশ খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো রিস্ক নাই, ছ্যাঁকা খাওয়ার সম্ভাবনা জিরো। এরা কখনো আপনাকে হতাশ করবে না। ওদিকে মানুষ প্রেম নিয়ে খুব লুকোচুরি খেলে। প্রেম থার্মোমিটার থাকলে মেপে মেপে মানুষের বিয়ে দেওয়া যেত। লাইলি বলে মজনুকে ভালবাসে, কিন্তু মন থাকে ফরহাদের দিকে। আরও খারাপ দিক হলো সন্দেহ করতে করতে জীবন শেষ, ভালবাসবেটা কখন? বাংলা সিনেমার মতো শেষে মরার আগে বউ তার সত্তর বছরের জামাইয়ের হাত ধরে বলে- ওগো আরেকটা বিয়ে করে সুখী হও; অনুমুতি দিলাম। [আ..আ.. ঢ্যাং..! না..]
ভালবাসা মানে পাঁচ পার্সেন্ট সোহাগ, পাঁচ পার্সেন্ট ঝগড়াঝাটি, দশ পার্সেন্ট বাজার করা আর আশি পার্সেন্ট সন্দেহ।
.
রাত সাড়ে বারোটার দিকে নিচে নেমে এসে ছাগলের দুধের ডিব্বার সিল খুলে আধা গ্লাস মাইক্রোতে গরমে দিলাম। আজকে ছাগলের দুধ কিনছি ফিফটি পার্সেন্ট ছাড়ে। জিনিসটা চাখা দরকার। খুব নাকি পুষ্টি। কালকের বানানো গিন্নির চিজ পাস্তা বাটিতে নিয়ে গরম করে বাইরের ঘরে হাঁটা ধরি।
.
ফ্রিজটার ভেতরটা দেখতে খুব ভালো লাগছে।
গত সপ্তাহে তিন দিন কারেন্ট না থাকার পর বেশ কিছু জিনিস পচে গিয়েছিল। ওসব ফেলে নতুন করে গুছিয়েছে গিন্নি। অর্ধেক জিনিসই কাজের ছিল না। আসলে উপলক্ষ ছাড়া গুছানো হয় না। কেউ বেড়াতে আসার কথা থাকলে তবেই মানুষ ঘর গোছানো শুরু করে। এমনিতে ভাগাড়ের চাইতেও খারাপ অবস্থায় রাখে। ওদিকে মেহমান এসে দেখে চকচকে ফাইভ ষ্টার হোটেল। বলে- ভাবি, আপনার ঘর কি সুন্দর গুছানো, আর আমার বাসা.. ছিঃ ছিঃ।
তখন আমার এমন হাসি লাগে..
.
.
ছাগল জাতিকে শুধু যে ভালোবাসি; তা নয়। গর্বও করি।
এর প্রধান কারণ তারা খাবার-দাবার নিয়ে বেশি বাছ-বিচার করে না। আর তাদের সিনার সাথে সাদা ধবধবে কচকচে বেলি ফুলের সুবাসে ভরপুর চর্বির যে স্বাদ ভাই রে ভাই.. ভাতের সাথে পাতলা মসুরের ডাল দিয়ে চর্বি চিবানোর মতো মধুর কিছু এ জগতে শুধু একটাই দেখছিলাম; সেটা হলো মহিলা গরুর ওলনের চর্বি। উফফ! এ চর্বি খাওয়ার পারফেক্ট সময় হলো মাংস ভালমতো কষিয়ে পানি ঢালার ঠিক আগ মুহূর্তে হাঁড়ি থেকে তুলে নেওয়া। এর মধ্যে দেখবেন সুতার আঁশের মতো মিহি চর্বি থাকে। জামদানি শাড়ি বুননের মতো নিখুঁতভাবে স্তরে স্তরে সাজানো। কি ফ্লেভার মাইরি! মাসকালাইয়ের ডালের ঝাল খিঁচুড়ির সাথে ওলনের চর্বি ছিঁড়ে খেতে খেতে নাকের পানি চোখের পানি এক করার মতো আনন্দের কিছু এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। একেই বলে আনন্দের কান্না। ওদিকে এক মানুষ আরেক মানুষের কাছে বাঁশ খেয়ে শোকে-দুঃখে চোখের পানি ফেলে।
মানুষ এতো বোকা!
.
আগুন ধরা ঝাল খিঁচুড়ির সাথে আরেকটা জিনিস জমে ভালো; তা হলো গরুর পাছার সলিড খসখসে কষানো মাংস। প্রচুর বাটা আদা-রসুনে কষানো ঝোলে চুবিয়ে নিয়ে খাওয়া; যেমন সিঙ্গারা সসে চুবিয়ে খাওয়া হয়। কাটাকুটি করবার সময় ভুলে কসাইরা একদম পাতলা সাত চারা খেলার গুটির মতো সাইজ করে ফেলে। এই চাকতি গোশ যদি আপনি পুকুরের পানিতে ভূমির সমান্তরালে জোরে ছুঁড়ে মারেন, দেখবেন পানির সারফেসে পনেরো বিশটা ড্রপ খেয়ে অন্য পাড়ে উঠে গেছে! এই গোশ আরও জমে চালের আটার রুটির সাথে গরম ঝোল দিয়ে। আগেও অনেকবার বলছি, মাংস কষানোর পর রান্না স্টপ করে দেবেন। তখন পাবেন চূড়ান্ত ফ্লেভার। মশলা থেকে বের হওয়া তেল যে কেমন মুক্তোর মতো জ্বল জ্বল করে গো!
.
খিঁচুড়িও অবশ্য ফ্রিজে ছিল, কাবাবও। থাক, বেশি বেশি হয়ে যাবে। কম খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত। কয়েকদিন কারেন্ট না থাকায় দুই প্যাকেট; অর্থাৎ আড়াই লিটার দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে রাখতাম যাতে নষ্ট না হয়। ফলে রং হয়ে গেছে হালকা গোলাপি। মালাই চা বানানোর জন্য পারফেক্ট। তবে আমার ভাগ্য আজ খুব ভালো, প্রায় দুই মিলিমিটার পুরুত্বের সর জমে আছে। আমি তর্জনী আর বুড়া আঙ্গুল দিয়ে চিমটি কেটে উপরে টেনে তুলতেই পুরো সর উঠে আসলো মাছধরা জালের মতো। ওটা পিরিচের উপর রেখে আধা চামচ চিনি ছিটিয়ে আয়েশ করে টিভির সামনে বসি। এটা হলো দুনিয়ার বেস্ট ডেজার্ট।
.
গরুর প্রেমে পড়ার আরেকটা কারণ হলো এদের মায়াকাড়া, ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ। বিশেষ করে পোয়াতি গাভীর চোখ। রবীন্দ্রনাথ মনে হয় গাভীর চোখ দেখেই লিখেছিলেন-
“বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল
সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না॥”…
.
ছাগদুগ্ধ মগে চুমুক লাগিয়ে কিছুক্ষন মুখের মধ্যে রেখে স্বাদ অনুভব করার চেষ্টা করি। যেভাবে চা ফ্যাক্টরিতে লিকার টেস্ট করা হয়। ভালো; যদিও একটু পাঠা পাঠা ফ্লেভার আছে। আসলে পশু পাখির গায়ের গন্ধ তার মাংসতে বা দুধে থাকবেই। যেমন গরুর বা মুরগির গায়ের গন্ধ মাংসতে পাওয়া যায়। সেরকম কবুতর, ভেড়া, হাঁস; এদের মাংসেও গায়ের গন্ধ তীব্রভাবে থাকে। ভেড়ার মাংসের বুনো বুনো গন্ধটা ইউনিক। এজন্যই টার্কিশরা এতো ভেড়া খায়।
.
টেবিলের ওপর রাখা আরেকটা মগ চেক করে দেখি বিত্ত রাতে ছাগলের দুধ চেয়ে আর খায়নি; হয়তো এক চুমুক দিয়ে রেখেছে। এটা আর না তুলি। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ফিনিশ করে ফেলি। খুব পুষ্টিকর। গান্ধী জি খেতেন।
.
.
বেশ কিছু বাসন জমে গেছে, ওগুলো ধুয়ে রাখাই ভালো। ধুতে গিয়ে দেখি ঠিক চুলার পাশে বাটিতে ঢাকনা দেওয়া রামেন নুডুলস। ভেতরে একটা সেদ্ধ ডিমও ভাসছে। এগুলো এখন ফ্রিজে ঢুকানো মানে আরেকটা বাক্স খুঁজে বের করো, যেটার ঢাকনা পাওয়া যাবে না। তখন আবার আরেকটা বক্সে ট্রান্সফার করে ফ্রিজ গুছিয়ে জায়গা করে ঠেলে ঢুকাও..!
ওসব ঝামেলা কে করতে যাবে? তাই জায়গামত চালান করে দিয়ে সময় বাঁচালাম।
.
এখন রাত প্রায় দেড়টা।
আজকের মতো ফিনিশিং দিতে ফ্রিজ খুলে চ্যাপমানের আইসক্রিমের ডিব্বা বের করি। এক আইসক্রিমের মধ্যে তিনটা স্বাদ দেওয়া স্তরে স্তরে; মধ্যেখানে ভ্যানিলা আর দুইপাশে চকলেট আর স্ট্রবেরী।
.
আইসক্রিম বাটিতে নিয়ে ছোট্ট চামুচে করে মুখে পুড়তে পুড়তে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি। গরুর দুধের ফ্রেশ ক্রিমের কি যে মিষ্টি একটা গন্ধ! সত্যি, মানুষ কোন দুঃখে যে মানুষের প্রেমে পড়ে আজাইরা সময় নষ্ট করে..
.
বিছানায় শুতেই দেখি গিন্নি হেডফোনে ‘গোলুস রেসিপি’ দেখে কেঁপে কেঁপে হাসছে। তারপর নিঃশব্দে নেমে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে! সর্বনাশ, রামেন নুডুলসের সন্ধানে না তো!
আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে মরার মতো পড়ে থাকি।
জাগা মানুষকে হাজার ঠেলেও জাগানো যাবে না..
.
.
.
জাভেদ ইকবাল