#অবন্তিকা_তৃপ্তি
সকালটা কোনোরকমে মুখে রুটি গুঁজেই অদিতি বেরিয়ে এসেছে হোস্টেল থেকে। আজ সিটি আছে একটা। সারারাত জ্বরের ঘরে তেমন একটা পড়তে পড়েনি, যেটুকু পড়েছে সেটুকুই মস্তিষ্কে নিয়েই বেরিয়েছে। অদিতির চোখ-মুখ ক্লান্তি-দূর্বলতায় রীতিমত ভেঙ্গে আসছে। মাথাটাও ঘুরাচ্ছে ক্রমশ। ও হেঁটেই যায় প্রতিদিন অনেকটা পথ। আজও হাঁটছে, মলিন চোখ-মুখে চেয়ে আছে রাজ্যের অসুস্থতা। হঠাৎ কল এলো অদিতির ফোনে। বাটন ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দেখে, ওপাশে মা। অদিতি হাঁটতে হাঁটতে কলটা রিসিভ করলো,সালাম করলো।
ওপাশে ফাহিমা বললেন-
‘ও মা, ভালো আছিস তুই? জ্বরটা কমেছে তোর?’
অদিতি দুর্বল গলায় হাসল! মায়ের এমন আহ্লাদি গলা শুনে গলে পরে গেল একদম, উত্তর দিল- ‘আগের চেয়ে একটু ভালো আছি,মা।’
মিথ্যে কথা। এই যে অদিতি মাথা ঘুরছে,এক্ষুনি যেন লুটিয়ে পড়বে। তবুও কি হাসিমুখে মিথ্যে বলে যাচ্ছে গতকাল থেকে ফাহিমাকে।ওপাশ থেকে ফাহিমার চিন্তা তাতেও কমে না। তিনি কিছুটা চিন্তিত গলায় বললে-‘তোর গলা তো শুকনো লাগছে রে। আর এত আওয়াজ, কোথায় তুই?’
‘আমি রাস্তায় মা,ভার্সিটি যাচ্ছি।’— অদিতি হাঁটছে ফুটপাথ ধরে।
‘এত জ্বরেও ভার্সিটি যাওয়া লাগে?-‘ ফাহিমার কপাল কুঁচকে গেল চিন্তায়।
অদিতি বলল-‘ টেস্ট আছে মা। যাওয়াটা দরকার।’
‘কিন্তু -‘ ওপাশে ফাহিমা আর কিছু বলতে না দিয়ে তোফাজ্জল ফোন কেড়ে নিলেন। অদিতি সেটা বুঝতে পেরে তাড়াহুড়ো করে সালাম করলো। তোফাজ্জল জিজ্ঞেস করল-
‘জ্বর যেহেতু কমে নি, তাহলে এত পড়াশোনা নিয়ে আদিক্ষেতা কেন দেখাচ্ছো? হোস্টেলে শুয়ে থাকবে,তা না করে এখন রাস্তায় জ্বর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে, না?’
অদিতি কি বলবে? তোফাজ্জল ঘুরেফিরে পুরো ব্যাপারটা অন্য দিকে টেনে নিচ্ছেন। অদিতি নিচু গলায় বলল- ‘টেস্ট দেওয়া টা দরকার আব্বা।’
তোফাজ্জল হাসেন, তাচ্ছিল্য করে বললেন-‘ওসব বুঝি আমি। আমি যা বলে দিয়েছি মনে আছে তো? ভার্সিটিতে পড়াশোনাটাই যেন করো, বেলাল্লাপনায় জড়িয়ে যেও না আবার। বাপের মুখটা তো এখনও উঁচু আছে, সেটায় আবার চুনকালি দিয়ে বসো না যেমন। ঢাকার পোলাপান ভালো না, ভেবে চিন্তে থেকো।’
আবারও একই কথা, একই খোচা। অদিতি ছোট করে শ্বাস ফেলে, উত্তর দিল—‘ ঠিকাছে, জড়াবো না।’
‘মেয়েটা অসুস্থ গো, এখুনি এসব কি বলো? ফোনটা আমাকে দাও।’ ওপাশ ফাহিমা মেয়ের অস্বস্তির কথা ভেবে ফোন কেড়ে নিলেন তোফাজ্জলের থেকে। ফাহিমা আরও কিছুক্ষণ অদিতির সঙ্গে কথা বলে তারপর কল কাটলেন।
অদিতি ফোনটা কেটে আবার ব্যাগে রাখলো। আকাশের দিকে একবার চেয়ে তাচ্ছিল্য ভরা হাসলো। আকাশটা যেন আজও বিদ্রুপ করছে অদিতিকে। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে- ‘তোর জীবনে আমি একমাত্র শত্রু নই, আরও আছে। আরও আসবে। সবে তো শুরু।’
অদিতি মাথাটা নামালো। পরপর আবারও পা চালালো ভার্সিটির দিকে।
অদিতি কোনরকমে পরীক্ষার দিতে বসল। পরীক্ষা দেওয়া শেষ করে বেরিয়ে এসে দেখে বাইরে সবাই একজোট হতে হাসাহাসি করছে। অদিতি কিছুটা এগিয় গিয়ে আবার কি মনে করে দাঁড়িয়ে রইল। তানিয়া নামের মেয়ে হেসে হেসে হাতে থাকা চিরকুট দেখিয়ে বলল-
‘দেখ লাভ লেটার। ভেতরে কি লেখা জানিস?’
বাকিরা উৎসুক চোখে তাকাল। অদিতি দেখছে সবাইকে। হুমা বলল-
‘কি লেখা রে?’
তানিয়া ফিসফিস করে ওদের কিছু বলল। ওর কথা শুনে বাকিরা অবাক হয়ে তানিয়ার দিকে তাকাল, পরপর অট্টহাসিতে একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পরলো। অদিতি ওদের দেখল, ছেলে-মেয়ে কি অবলীলায় মিশছে। অথচ অদিতি ছেলে দেখলেই আঁতকে উঠে দশ হাত দূরে সরে যায়। অদিতি ছোট করে শ্বাস ফেলে চলে এলো সেখান থেক। ওর আপাতত কোন ফ্রেন্ড নেই। কদিন হয়েছে এসেছে এখানে। তেমন একটা বন্ধু পাতানো হয়নি করো সঙ্গে। টুকটাক কথা-টথা হয়েছে মেয়ে ব্যাচমেটের সঙ্গে। কেউ যেচে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে এলে, দুদিন পর নিজেরাই চলে যায় অদিতির সীমারেখার মস্ত বড় লাইন দেখে। অদিতি হাসে; একাকী লাইফ ও এর আগেও কাটিয়েছে। তবে এখানে এসে সবার এত বন্ধু-বান্ধব দেখে ওরও ইচ্ছে হয় কারো সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করতে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনা অদিতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে, অদিতিও জড়তায় এগিয়ে যায়না; এভাবেই চলছে।
অদিতি এখন হোস্টেলে যাবে আবার। শরীর ভালো লাগছে না, আবারও চারপাশ বারবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। জ্বরটা আবার বোধহয় ফিরছে। অদিতি ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি ছেটালো। আয়নায় যখন নিজের দুর্বল ভেজা মুখটা দেখল,ও যেন দেখলো ওর পেছনে ধ্রুব দাঁড়িয়ে। হাতে টিস্যু, ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট। অদিতি চমকে উঠে পেছনে তাকাল। কেউ নেই, ভ্রম ছিলো ওটা অদিতির। অদিতি ঢোক গিললো। চোখে-মুখে আবারও কয়েক ঝাপটা পানি দিয়ে ওরনায় কোণা দিয়ে মুখটা মুছে ভেজা চুলে ক্লাচার বেধে নিলো আবারও। তারপর ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে।
ধ্রুব সবে প্রফেসরের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাতে একটা অভিযোগনামা। যা আজ ধ্রুবকে ডেকে নিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভার্সিটির রুলস-রেগুলেশন ভঙ্গ করার জন্যে, ধ্রুবর বাবাকেও কল করা হয়েছে। ধ্রুব তখন হেসেছে খুব। প্রফেসররা ধ্রুবর হাসি দেখে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে কল কেটে, ধ্রুবকে কটা কথা শুনিয়ে আবারও ছেড়ে দিয়েছেন। কি লাভ এই ছেলেকে কিছু বলে? সেই একই ঘাড়ত্যারা সারাজীবন থেকে যাবে। ওর বাপও একইভাবে দোষী, ছেলের ভুল-অশৃঙ্খলতা অদেখা করে যান সবসময়ই। পুরো ডিপার্টমেন্ট ধ্রুবর উপর বিরক্ত, একইসাথে বিরক্ত ওর বাবার প্রতিও।কিন্তু কি করবে? বহিষ্কারও করতে পারেন না। তাদের সেই সাহস নেই; তাই সহ্য করা লাগে।
ধ্রুব সোজা হেঁটে ওদের বটগাছের নিচে আড্ডাখানায় আসতেই, বইমন, রাজন, সুমন নামের এই থ্রি ইডিয়েটের দল ওকে ঘিরে ধরলো। ধ্রুব গিয়ে বটগাছের নিচে বসেছে। রাজন এগিয়ে এসে বলল-‘শুধুশুধু ভাইকে বারবার ডাকায় নিয়ে যায় ওই প্রফেসরগুলা; বেহুদা খাটনি। ভাই, আজ আপনারে কি ডোজ দিল?’
ধ্রুব তখন কোকাকোলার ক্যান মুখে দিস গিলছে, ও অন্যদিকে চেয়ে হাতের অভিযোগনামা বাড়িয়ে দিল রাজনের দিকে। রাজন অভিযোগনামা লুফে নিয়ে পড়া শুরু করলো, সুমনও সাথে আছে।
ইমন এগিয়ে গিয়ে ধ্রুবর পাশে বসলো। উদাসীন ধ্রুবকে কিছুক্ষণ দেখে তারপর আচমকা বলে উঠল- ‘ধ্রুব, তুই কি জানিস তুই নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু?’’
ধ্রুব আবারও বিশ্রী হাসল, গা ছাড়া ভাবে বলল- ‘জানি, এখন কি করব? নাচবো?’
ইমন হতাশ হলো ভীষণ। ও তবুও হাল ছাড়লো। চেষ্টা করলো ধ্রুবকে বোঝানোর; ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখল, বলল—‘তুই চাইলেই একবার নিজের লাইফকে গুছিয়ে নিতে পারিস কিন্তু। তুই নিজেও জানিস তুই অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। কিন্তু এসব মারামারি-ঝামেলা তে জড়িয়ে নিজের সব ট্যালেন্ট জলে ফেলছিস কেন, বল তো?’
‘মজা লাগে তাই।’ -ধ্রুব আবারও হাসে!
ইমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই ধ্রুব জীবনেও শুধরাবে না। ইমন আরও কিছু বলবে: তার আগেই হঠাৎ পাশ থেকে সুমন বলে উঠে-
‘ভাই, ওই দেখো ভাবি যাচ্ছে।’
সুমনের চেঁচানোতে সবাই সামনে তাকাল। হেলায় পড়ে ধ্রুবও তাকাল। যেন সুমনের ‘ভাবি’ হওয়ার অধিকার একমাত্র ওই নির্দিষ্ট মেয়েটারই, মেয়েটার নাম অবশ্যই অদিতিই হতে হবে।
ধ্রুব তাকাল, অদিতি যাচ্ছে। পা ফেলছে এলোমেলো, যেন এক্ষুনি পড়ে যাবে। মাথার সামনের বেবি চুল গুলো ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে,চাদর দিয়ে পেট অব্দি শরীর ঢাকা, যেন ভীষণ ঠান্ডা আজ। অথচ আজ তাপমাত্রা উগ্র ; ৪২ ডিগ্রি। এত গরমেও গায়ে একটা বিশাল-ভারী চাদর জড়ানো। চোখে-মুখে ভীষণ দুর্বলতা, অসুস্থ নাকি ও? ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেলল তাৎক্ষণিক! অসুস্থ? কি অসুখ হয়েছে ওর?
হঠাৎ নিজের এমন চিন্তায় নিজেই ভীষণ বিরক্ত হয়ে গেল ধ্রুব,মুখ দিয়ে নিজের জন্যে একটা বিশ্রী গা/লি বের হয়ে এলো ধ্রুবর। অসুস্থ হওয়া কোনো বড় কিছু না, মানুষ মাত্রই অসুস্থ হয়। এটা স্বাভাবিক, সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটছে। ধ্রুবর অযথা কাউকে নিয়ে মাথা ঘামনো উচিত না; কোনো ছাপোষা গ্রামের মেয়েকে নিয়ে তো নয়ই।
ও চোখ সরিয়ে ফেলল অদিতির থেকে। দেখবে না আর ওই মেয়েকে, নাহলে কালু জাদু করে ফেলবে ধ্রুবকে, বলা যায়না। আজকাল এসবই হচ্ছে।
এতক্ষন ধ্রুবর মনে যা চলছে, সেটাই পাশ থেকে রাজন বলে ফেলল-‘ভাই, ভাবি মনে হয় অসুখ, দেখো না চোখ-মুখের বেহাল দশা। কিন্তু এই অসুখ নিয়ে ভার্সিটি ক্যান আসছেন? পড়াশোনা নিয়ে এত তেল ক্যান ভাই উনার? কই আপনার তো এত তেল কোনোদিন দেখলাম না।’
ধ্রুব আবার তাকাতে চাইল অদিতির দিকে,আরেকবার দেখতে চাইলো ওই গোলগাল নিষ্পাপ-ভয়ভয় চেহারাটা। কিন্তু তাকাল না, নিজেই নিজেকে অ/পমান করলো মনেমনে,বিশ্রী কয়েকটা গা/লি দিয়ে দমিয়ে ফেলল।
কিন্তু আচমকা পাশ থেকে সুমন চেঁচিয়ে উঠল-
‘ভাই ভাবি কপাল চেপে দুলতেসে,পরে যাবে নাকি?’
ধ্রুব শুনলো।অথচ এবারেও তাকাল না। চুপ করে বসে ক্যান থেকে কোকাকলা গিলছে। ওর মুখভর্তি কোক, কিন্তু গিলতে পারছে না। নিঃশ্বাস আটকে গেছে বোধ হচ্ছে।
‘আরে আরে ভাবি পরে গেছে তো।’ বলে সুমন আঁতকে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ধ্রুব সঙ্গেসঙ্গে এবার তাকাল। অদিতি রাস্তার মধ্যে পরে গেছে মাথা ঘুরে। আশেপাশে তেমন একটা লোক না থাকায়, অদিতিকে কেউ ধরতে পারেনি। কজন একটা মেয়েকে রাস্তায় পরে থাকতে দেখে এগিয়ে এসেছে। অদিতিকে ঘিরে রেখেছে কজন ছাত্র-ছাত্রী।
ধ্রুব আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। ইমন পাশ থেকে ধ্রুবকে এত অশান্ত হতে দেখে কাঁধে হাত রাখলো আলতো করে, ধ্রুব আগাবে কি আগাবে না ভাবতে লাগল। পরে ভাবলো, দরকার কি? আছেই তো মানুষ, ধরেছে ওকে। ওর সেখানে যাওয়ার কোনও দরকার নেই। দরকার ছাড়া ধ্রুব ইয়ামিন কি কোনো কাজ করে কখনো? ধ্রুব ইগো দেখিয়ে আবার বসে গেল নিজের জায়গায়। বসে আবারও কোকের ক্যান মুখে লাগালো।
কোক খেতে খেতে তীক্ষ্ম চোখে পরখ করতে লাগলো, অদূরে অদিতিকে ঘিরে হতে থাকা দৃশ্য। পাশ থেকে হতবম্ব চোখে সুমন, রাজন, ইমন ধ্রুবকে দেখে যাচ্ছে। ইমন নিজের বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল- ‘তুই ওখানে যাবি না ধ্রুব?’’
ধ্রুব উত্তর দিল না। ও তখনও ভ্রু কুঁচকে দেখে যাচ্ছে অদিতির চোখে-মুখে একটা মেয়ে পানি ছেটাচ্ছে।
ওদিকে কিছুটা শোরগোল লেগেছে। অদিতির জ্ঞ্যান আসছে না। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। একটা ছেলে এগিয়ে গেল, অদিতিকে পাজকোলে তুলবে সেজন্যে। এবার আর ধ্রুব নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারো না। কোক ভর্তি ক্যানটা ছুঁড়ে ফেলল দূরে, বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল অদিতির দিকে, ওর কাছে।
ধ্রুব আসছে দেখে ছেলেরা আপনাআপনি সরে গেল। সবাই ইতিমধ্যে ধ্রুব-অদিতির গুজবকেই সত্যি বলে জানে। ধ্রুবকে আসতে দেখে, মেয়েরাও সরে দাঁড়ালো। ধ্রুব গিয়ে অদিতির পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। বুক থেকে চাদর সরে গেছে ওর। ধ্রুব সেটা লক্ষ্য করে আড়চোখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের লক্ষ্য করল। যে মেয়ে সম্পূর্ণ গা ঢেকে রাখে ঢিলে সালওয়ার কামিজে, ওড়না পরে শালীন ভাবে। ওর এমন অবস্থা লোকে দেখছে, ভেবেই কেন যেন ধ্রুবর রাগ হলো ভীষণ। ও কড়া চোখে আশেপাশের মানুষের দিকে না চেয়েই বলে উঠল- ‘পাঁচ মিনিট জায়গা খালি করো, এভ্রিসিঙ্গেল ওয়ান।
সবাই ধ্রুবর শান্ত স্বরের কথা শোনে সুড়সুড় করে চলে গেল মুহূর্তেই। ধ্রুবর পাশে ততক্ষণে এসে দাঁড়াল ওর বন্ধুরা। ধ্রুব অদিতির চাদরের এক কোণা আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে ধরলো। ওর হাত কাপছে, শিভারিং হচ্ছে প্রচণ্ড। ধ্রুব অশৃঙ্খল হলেও আজ অব্দি মেয়ে স্পর্শ করেনি। ওর হাত বোধহয় এইজন্যেই কাপছে, নাকি অন্য কারণে?
র্
ধ্রুব ওর কাঁপা হাতটা দেখল, ঢোক গিললো! তারপর কাঁপা কাঁপা হাতেই অদিতির বুকে চাদর মেলে দিল। তারপর তাকাল অদিতির ফ্যাকাসে মুখটার দিকে। ইমন পাশ থেকে বলল-‘ওকে হাসপাতালে নিতে হবে ধ্রুব। দেখে মনেই হচ্ছে, অনেকদিন থেকে সিক।’
ধ্রুব তাকাল অদিতির দিকে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোলে নিবে? কেন নিবে? ধ্রুব ইয়ামিনের হাত কেন ওকে ছুঁবে? কেন ছুঁবে? কোন অধিকারে? ধ্রুব ইয়ামিন কে কাউকে অধিকার নিয়ে ছোঁয়ার? ও তো নোংরা একটা কিট স্রেফ! এই পৃথিবীর বোঝা ও! ও কেন ওই নিষ্পাপ মেয়েটাকে স্পর্শ করবে? ওর নোংরা হাতের স্পর্শ কেন মলিন করবে কোনো মেয়েকে?
ধ্রুব ভাবছে। মনের এই হীনমন্যতায় কিছুক্ষণ পুড়লো ধ্রুব। ওর চোখে পরলো, অদিতির শ্বাস-প্রশ্বাস কমে আসছে: ধ্রুব হঠাৎ নিজের মনের বিবাদের সঙ্গে অন্যায় করলো, মনকে চমকে দিয়ে পাজকোলে তুলে নিল অদিতিকে।পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা থ্রি ইডিয়েট ধ্রুবকে দেখছে, হতবম্ব চোখে। ধ্রুব অদিতিকে পাজকোলে তুলে নিয়েই শুধু এটুকুই বলল-‘ইমন, উবার ডাক।’
ইমন সঙ্গেসঙ্গে পকেট থেকে ফোন বের করল। ধ্রুব এগিয়ে যাচ্ছে, দুহাতে পাজকোলে রেখেছে অদিতি হায়াতকে। ভার্সিটির রাস্তা ধরে এগুচ্ছে ও, সব ছাত্র-ছাত্রী বড়বড় চোখ করে ধ্রুবকে দেখছে। ধ্রুব ইয়ামিনের কোলে ওর গার্লফ্রেন্ড? ধ্রুব নির্বিকার এসবে।
রাফ এন্ড টাফ ধ্রুবকে এমন প্রেমিক রূপে দেখে কেউ কেউ ভিডিও করতে ফোন বের করতেই ধ্রুব এবার ভ্রু কুচকালো, পরপর ভয়াবহ এক গর্জন ছেড়ে বলল-
‘আজ একটা শা/লার ফোন হাতে উঠলে, এখানে গেঁড়ে রাখবো ওই শা/লাদের। মেয়েছেলে দেখবে না এই ধ্রুব।’
ধ্রুবর চিৎকারে কেঁপে উঠল সম্পূর্ণ জায়গাটা। সঙ্গেসঙ্গে সবাই ফোন রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ধ্রুব অদিতিকে কোলে নিয়েই এগুচ্ছে বড়বড় পেয়ে। উবার ততক্ষণে এসে গেছে। ধ্রুব অদিতিকে পেছনের সিটে শুইয়ে দিল। ইমন বলল-
‘তুই আয় ওর সঙ্গে। বাইকের চাবি দে,আমরা বাইকে আসছি।’
আবারও, কি করবে ধ্রুব? যাবে ওকে নিয়ে? কেন যাবে? কোন অধিকারে? ধ্রুব এত ভালো-মানুষী কেন করছে? ও তো খারাপ প্রাণী।
ধ্রুব তাকাল, দেখলো গাড়িতে আধশোয়া অজ্ঞান অদিতিকে। তারপর আর নিজের মনকে কিছুই ভাবার সুযোগ দিল না। নিজেই নিজের হীনমন্য মনের সঙ্গে বে/ইমানি করে পকেট থেকে বাইকের চাবি বের করে ইমনের হাতে দিল। ইমন বাইকের চাবি হাতে নিয়ে চোখ টিপে বলল—‘অল দ্য বেস্ট।’
ধ্রুব উত্তরে নিরব থাকলো। ওর চোখ তখনও অদিতির চোখে-মুখে ঘুরছে। থ্রি ইডিয়েট চলে গেল ধ্রুব-অদিতিকে একা রেখে। অদিতি জেগে থাকলে এসব দেখলে হয়তো আতঙ্ক সেখানেই মূর্ছা যেত। ও একটা ছেলের কোলে চেপে এতদূর এসেছে, ওরা একসঙ্গে গাড়িতে! ব্যাপারগুলো ভূতুরে অনুভূতি দিতো অদিতিকে। কিন্তু আপাতত ও এসব দেখছে না। অজ্ঞান অবস্থায় মেয়েটার আতঙ্ক-বিহীন চেহারাটা ভালো দেখাচ্ছে।
ধ্রুব একবার অদিতির দিকে চেয়ে দেখল। পরপর আবার গাড়ির দরজা লাগিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে উঠে বসলো। উবার ড্রাইভারকে পাশের হাসপাতালের অ্যাড্রেস দিতেই গাড়ি স্টার্ট হলো। ধ্রুব ওর বাম হাত জানালার বাইরে হেলান দিয়ে,হাতের আঙুল কপালে চেপে; চুপচাপ বসে রইল পুরোটা সময়।
#চলবে