#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
মে মাসের প্রথম সন্ধ্যা। চারিদিকে প্রকৃতির তান্ডবে অন্ধকার বিরাজ করছে। কারেন্ট নেই বলে জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে রুদ্রদের বাড়িতে। তটিনী পড়ার ফাঁকে একবার মোবাইল চেক করে নিলো। রুদ্র কোনো মেসেজ দিলো কি না সেটা সে পড়ার ফাকে বার-বার চেক করছে। কিন্তু সে জানে রুদ্র কল করবে না এখন। পাক্কা পড়া শেষ হওয়ার পরই করবে। তটিনীকে বলে কয়ে পড়তে বসানো হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও বেচারির শান্তি নেই। পড়তে হবে মানে পড়তে হবেই। নাহলে রুদ্র পাইভেটের পথ ধরবে। যেটা তটিনী একদমই চায় না। রুপান্তর পাবলিকে পড়ার সুবাদে পড়াশোনা নিয়েই আপাতত ব্যস্ত। এদিকে মিনহাজ মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। সেজন্য বেচারার তো আরও দম ফেলার সময় নেই। ছুটি পেলে তিনজন ট্যুর দিবে না-হয়। সেরকমই পরিকল্পনা তাদের।
তটিনী যখন পড়ার পাট চুকিয়ে ফোন হাতে বসলো তখন রাত নয়টা। তখনও কারেন্ট আসেনি। বৃষ্টি কমলেও হাওয়া দিচ্ছে তীব্র বেগে। মোবাইল হাতে নিয়ে সে নিচে নামলো। খাবার টেবিলে ঈশানী সব গুছিয়ে রাখছেন। একটু পরই হয়তো সবাইকে খেতে ডাকতেন। তটিনী চেয়ার টেনে বসলো। ঈশানী চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘তোকে তো খাওয়ার জন্য সবসময়ই ডেকে আনতে হয়। আজ হঠাৎ নিজ থেকে চলে এসেছিস যে?’
তটিনী গোমড়া মুখ বলল, ‘এখন কি চলে যাবো? তোমার ডাকার অপেক্ষা করবো?’
ঈশানী চোখ দিয়ে শাসালেন, ‘বড্ড বেশি কথা ফুটেছে। চুপচাপ খেয়ে উঠ।’
তটিনী প্লেটে খাবার নিয়ে সবার আগেই খেতে বসে গেলো। খেয়ে দেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো আবারও। তার খাওয়ার পরই সবাই খেতে বসলো। তটিনী যখন কলের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো তখনই তার মোবাইল ফেন বিকট শব্দে বেজে উঠলো। রিসিভ করে সে কানে ধরে রীতিমতো চিৎকার করলো।
‘আপনার এখন কল দেওয়ার সময় হলো, আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলেন।’ এতোক্ষণ কল দিলেন না যে-ই না ঘুমিয়ে পড়লাম ওমনি আপনার কল দেওয়ার জন্য হাত নিসপিস করলো না?’
রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘তাহলে রেখে দেই?’
তটিনী ফুসফুস করল, ‘আপনার এতো বড় স্পর্ধা। আপনি কল রেখে৷ দিতে বলেন। নতুন কেউ জুটিয়ে নিয়েছেন নাকি আমি চলে আমার পরপরই?’
রুদ্র রেগে বলল, ‘নতুন কেউ জুটালে নিশ্চয়ই তোমাকে কল দিয়ে ডিস্টার্ব করতাম না?’
তটিনী দমে গেলো, ‘ঠিক আছে স্যরি, কি বলবেন বলুন।’
‘কি বলবো মানে?’ তোমার সাথে কি আমার বলাবলির সম্পর্ক?’
‘তাহলে কিসের সম্পর্ক?’
‘তুমি জানো না কিসের?’
‘না তো জানিনা, আপনি জানিয়ে দিন রুদ্র ভাই।’
‘একদম ভাই বলব না। আমি তোমার মায়ের পেটের ভাই হই না।’
তটিনী ভড়কে গেলো, ‘আমি তো স্বভাবতই ভাই ডেকে ফেলেছি।’
‘সেটাও বলবে না, স্বভাব চেঞ্জ করো।’
তটিনী চিন্তিত স্বরে বলল, ‘আপনার মুড এতো হট কেন?’ আমার উপর চেঁচাচ্ছেন কেন? কি করেছি আমি?’
রুদ্র জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো, ‘আমার তোমাকে চাই ঐশি।’ এখনই এই মুহুর্তে, দিতে পারবে তোমাকে এখন?’
তটিনী হতভম্ব হয়ে কিছু সেকেন্ড চুপ থাকলো। তারপর বলল, ‘তো নিয়ে যান আবার। আমি তো এক পায়ে রাজি।’
রুদ্র অসহায় কন্ঠে শুধালো, ‘আমি এইবার আসলে আর তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবো না ঐশি। যেখানেই যাবো তুমি সঙ্গে যাবে। তোমাকে ছাড়া প্রতিটা দিন মৃত্যসম যন্ত্রণা দেয়। তুমি আমার বুকে লেপ্টে না থাকলে আমার দিন শুভ হয়না।’
তটিনী আবেগি কন্ঠে বলল, ‘আপনি ও না, দিলেন তো মুড নষ্ট করে। এবার আমি ঘুমাবে কিভাবে?’
রুদ্র আবদার করলো, ‘আজ সারারাত কথা বলি প্লিজ?’
তটিনী হাসলো, ‘আমার সবকিছুই আপনার কাছে গিয়ে থামে। আপনি আবদার করেছেন তা পূরণ করা অবশ্যই কর্তব্য।
তটিনী ও রুদ্রের বকবকানি চলতে থাকলো। এদিকে রুপান্তর একের পর এক কল করছে মিনহাজকে। বেচারা মিনহাজ তখন ফোন সাইলেন্টে রেখে পড়াশোনা করছে। ডাক্তার হওয়া তো সহজ নয়। সবসময়ই পড়াশোনার উপর থাকতে হয়। রুপান্তর একসময় ক্লান্ত হয়ে কল করা বন্ধ করে দিলো। তীব্র অভিমানে ফুপিয়ে উঠতে লাগলো বার-বার। তার কেন যেনো মনে হচ্ছে মিনহাজ অন্য কারো প্রতি ঝুঁকে গেছে। সেজন্য তাকে আগের মতো পাত্তা দিচ্ছে না। এমন যদি হয় তো সে মিনহাজকে খু ন করতে দুবার ভাববে না। তার হাসবেন্ড হয়ে কি না অন্য মেয়ের সাথে টাংকি মা র বে। কতবড় সাহস!
রুপান্তর রেগেমেগে মেসেজে টাইপ করলো,
‘কি রে চৌধুরীর পোলা? তোর এতো ভাব কিসের? কোন মাইয়ার পিছনে ঘুরোস? আমারে খেলনা পাইছত?’
মিনহাজ মেসেজটা সিন করলো রাত এগারোটার পর। তখন রুপান্তর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এতোগুলা কল ও এই মেসেজ দেখে সে বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেলো। রুপান্তর এই প্রথম এমন করেছে। নাহলে এতোদিন ফর্মালিটির মতোই তাদের কথাবার্তা হতো। যেরকম একটা বন্ধুর সাথে হয়। আজ রুপান্তর কিসের একটা অদৃশ্য দেয়াল যেনো ভেঙে দিলো। মিনহাজের নিজেকে এবার সত্যিই কারো স্বামী মনে হলো। মনে হলো তার একজন মানুষ রয়েছে যার সাথে তীব্র ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে কথা বলা উচিত।
সে একটানা কল দিতে শুরু করলো। তারপর মেসেজ করলো,
‘স্যরি গো ভুল হবে না আর। আমি এখন থেকে তোমাকে সময় দিবো প্রমিজ। আজকের মতো ক্ষমা করে দাও রুপ।’
ফোনের শব্দে রুপান্তরের ঘুম ছুটে গেছে। সে কল রিসিভ করে রেগে বলল, ‘কেডা তুই? এতো কল দিচ্ছিস কেন? মাইয়া গো মোবাইলে রাত্রে কল দেওয়া কোন ধরনের মেনার্স?’
মিনহাজ শব্দ করে হাসলো, ‘আমি তো অন্য মেয়েকে কল দেইনি। নিজের বউকে দিয়েছি। যেটা প্রত্যেকটা স্বামীর কর্তব্য ও অধিকার।’
রুপান্তর স্কিনে চোখ ভুলিয়ে নিলো, ‘তুই এতো রাত্রে কল দিচ্ছিস কেন? তোর কি বউ অন্য বেডার লগে পালিয়ে গেছে নাকি?’
মিনহাজ এবারও হাসলো, ‘তুমি সিলেটি ভাষা শিখে যাচ্ছো ধীরে ধীরে রুপ।’
রুপান্তর দাঁতে দাঁত চেপে হুংকার দিল, ‘ঐ চৌধুরী!
মিনহাজ থমকালো।
‘আবার ডাকো তো।’
রুপান্তর রেগেমেগে বলল, ‘ঐ চৌধুরী…!
মিনহাজ হেসে বলল, ‘এই ডাকটা এতো মনে ধরেছে। তুমি আমাকে এই নামেই ডেকো কেমন?’
রুপান্তর ফুসফুস করলো, ‘মজা হচ্ছে? আমি কি তোর লগে মজা করতাছি? আমি রেগে আছি বুঝতে পারছিস না?’
‘কি করলে রাগ কমবে?’
‘তুই এমন কেন? আমি তোর কেউ হই না? যেহেতু কেউ হই না তো তুই করে ডাকবি। বন্ধু ছাড়া আমি তোর কিছু হইনা।’
‘বউ হও তো। চৌধুরীর বউ তুমি।’
‘একদম আবেগ দেখাতে আসবি না। আমি যে কলের পর কল দিলাম তখন তোর আবেগ কই ছিল?’
‘স্যরি বউ ফোন সাইলেন্ট ছিলো।’ চৌধুরীর বউকে একশো একবার স্যরি।’
রুপান্তর একটু গললো, ‘এভাবে ডাকবি না খবরদার। আমি তোর কেউ হই না।’
‘তুমিই তো আমার সব রুপান্তর। আর ভুল হবে না তো। প্রথমবারের মতো ক্ষমা করে দাও।’
রুপান্তর আবেগি কন্ঠে বলল, ‘একদম ক্ষমা চাইবে না। আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করবো না।’
‘কেন?’
‘তুমি বরং ক্ষমা না চেয়ে তার পরিবর্তে আমাকে ভালোবাসো, দায় মিটিয়ে নাও নিজ থেকে।’
‘ঠিক আছে তাই হবে বেগম।’
তারপর সব নিশ্চুপ। মিনহাজ ডাকলো, ‘রুপ?’
রুপান্তর ‘হু’ বলল।
‘তুমি কার বউ বলো তো?’
‘চৌধুরীর।’
‘তুমি এতো আবেগি কবে থেকে হলে রুপ? আমি অবাক হয়ে হজম করতে পারছি না তো। বদহজম হতে পারে।’
রুপান্তর এবার হাসলো, ‘এখন তো এমন বলবেই। পটে গেছি না।’
মিনহাজ হেসে বলল, ‘তুমি পটবে কেন? তুমি তো পটোনি। আমি তোমাকে পটানের কোনো চেষ্টাই করিনি। যেখানে তুমি আমার সেখানে তোমাকে পটতে হবে কেন? তুমি তো আমারই রুপান্তর। চৌধুরীর বেগম তুমি।’
রুপান্তর বিস্মিত হলো, ‘তুমি এতো রোমান্টিক কেমনে? আমি তো তোমাকে হাবাগোবা মজনু ভাবতাম।’সবই ডাক্তারি পড়ার সাইট ইফেক্ট তাই না?’
মিনহাজ হাসলো, ‘প্রতিটি পুরুষই তার একান্ত মানুষের কাছে অন্যরকম হয় আমার বেগম।’
(চলবে)