(ইরাবতীর আগমন)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
রমজান শেষে ঈদ আবারও কড়া নাড়ছে দরজায়। সেই দু’বছর আগে ঈদ পালন করেছে একসাথে তারা। আবারও এখন থেকে একসাথে পালন করতে পারবে বলে তটিণী-র খুশির অন্ত নেই৷ ঈদের শপিংয়ের সাথে সাথে বিয়ের শপিং ও কমপ্লিট৷ ঈদ পরপরই তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে। আজ চাঁদ রাত। ছাঁদে গোল হয়ে বসেছে সবাই। রুদ্র তটিণী-র হাতে মেহেদি পড়িয়ে দিচ্ছে সযত্নে। বিয়ে ও ঈদ একসাথে কাটাবে কাছের সব আত্মীয় ইতিমধ্যেই বাড়িতে উপস্থিত। ছাঁদে পা ফেলার জায়গা ও অবশিষ্ট নেই। মেহেদী আর্টিস্টরা মেহেদী পড়াতে ব্যস্ত। তটিনী সবার প্রথমে রুদ্রের হাত থেকে মেহেদি পড়ে নিচ্ছে। রুদ্র সুন্দর করে নিজের নাম আর্ট করে দিয়েছে। তটিনী চাঁদের মতো হাসলো। রুদ্র মুচকি হেসে বলল, ‘আমার চাঁদকে আকাশের চাঁদের মতো সুন্দর লাগছে।’
তটিনী লজ্জা পেলো। আলগোছে রুদ্রের কাঁধে মাথা রাখলো। রুদ্র কপালে ঠোঁট ভুলিয়ে নিলো সবার আড়ালে। তটিণী-র মেহেদী পড়া হাত নিজের হাতের উপর রাখলো। কিছু মনে পড়তেই পকেট হাতড়ে বের করলো কিছু। তটিনী তাকিয়ে দেখলো বেলীফুলের মালা। কিছুটা শুকনো। রুদ্র হেসে বলল, ‘বিকালে কিনেছিলাম, পকেটই রয়ে গেছে এতোক্ষণ।’
তটিণী-র এলোমেলো চুলের এলোমেলো কোপা তে রুদ্র সযত্নে মালা পড়িয়ে দিলো। তটিণী-র মাথা পুনরায় নিজের কাঁধে ফেলে হাতের উপর হাত রেখে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। ছাঁদে সবাই মেহেদী পড়তে ব্যস্ত। তাদের দিকে বিশেষ কেউ খেয়াল করছে না। আর করলেও কিছু হবে না। সবই তাদের কাজিন মহল। বড় কেউ নেই।
তটিণী-র মায়ের দূরসম্পর্কের এক বোন রয়েছে। তিনিও উপস্থিত আছেন এই বাড়িতে। সেই মহিলার এক ছেলে ও এক মেয়ে। বয়সে তটিণী-র থেকে তিন বছরের বড়। মেয়েটির নাম ইরাবতী আফনান। তটিনীদের কানে ইদানিং খবর আসে মেয়েটি কোনো এক হিন্দুধর্মের ছেলের সাথে সম্পর্কে রয়েছে। সেই ছেলেটি ইরাবতীর ভাই ইয়াশ আফনানের ভার্সিটির বন্ধু ছিলো। বর্তমানে ভালো পর্যায়ের চাকরি করছে। এই যে এখনো ইরাবতীকে ছাঁদের এক কোণে মুঠোফোন কানে ধরে ফিসফিস করতে দেখা যাচ্ছে। ওপর পাশের ব্যক্তিটি তার ভাইয়ের বন্ধু মাহেন্দ্র চক্রবর্তী ছাড়া কেউ নয়। তটিনী একশো ভাগ নিশ্চিত এ বিষয়ে।
রুদ্র তটিনীকে ভাবনা থেকে বের করলো। বলল, ‘কি এতো ভাবছো?’
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ভালোবাসায় কি ধর্ম প্রাধান্য পায় রুদ্র?’
রুদ্র জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো,
‘একদমই না। ধরো তুমি রাস্তায় একটা পথশিশুকে ভালোবেসে খাবার দিলে। সেটা দিতে কখনোই ধর্ম দেখতে হবে না।’
‘আমি এই ভালোবাসার কথা বলিনি গো।’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তাহলে?’
‘আম্মুর দূর সম্পর্কের বোন আছে না? তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ইয়াশ ও ইরাবতী। ইরাবতী আপু ইয়াশ ভাইয়ের ভার্সিটি জীবনের বন্ধু মাহেন্দ্র চক্রবর্তীকে ভালোবাসে। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ও রয়েছে। আপনি জানেন না?’
রুদ্র লম্বা শ্বাস ছাড়লো,
‘কানে তো অবশ্যই এসেছে। তবে সবাই তা মনে মনেই রেখেছে। যাদের মেয়ে তাদেরই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আমাদের না।’ তবে এই বিষয়ে ধর্ম অবশ্যই প্রাধান্য পাবে ঐশি। সেটা যদি হয় আমাদের ইসলাম তো সবার আগে তাকেই রাখতে হবে। তবে হ্যাঁ আমাদের ধর্মের অনেক মানুষই ভিন্ন ধর্মের মানুষকে বিয়ে করে থাকেন। সেটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। সে কিভাবে সেটা হ্যান্ডেল করে বিয়ে করবে সেটাও তার ব্যাপার। তবে এসবে কিন্তু অনেক সাফার করতে হয়। পরিবার এক সময় মেনে নিলেও সমাজ ছাড় দেয় না।’
‘তবে কি ইরাবতী ও মাহেন্দ্রের ভবিষ্যতে বিচ্ছেদ রয়েছে?’
রুদ্র হাসলো,
‘সেটা তো আমি তুমি আগে থেকে বলতে পারবো না। ভাগ্য কখন কাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে কেউ জানে না। তবে সব সম্পর্কে যেমন বিচ্ছেদ হয় তেমনি পূর্ণতা ও পায়। যেমন তোমার আমার নামহীন মৌন সম্পর্ক পূর্ণতা পেলো। বুঝেছো?’
তটিনী মাথা নাড়ালো। তখনই তাদের দিকে ইরাবতীকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। সে এসে রুদ্রের পাশে বসেছে। তটিনী ও রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাচ ফর ইচ আদার ব্রো। তোমাদের দুজনকে দারুণ মানিয়েছে।’
রুদ্র হাসলো, ‘থ্যাংক ইউ ডেয়ার।’
তটিনী ইরাবতীর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। ইরাবতী তটিণী-র হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি তালুতে নাম লিখে বসে আছো। এসো আমি তোমাকে মেহেদী পড়িয়ে দেই?’
রুদ্র উঠে দাঁড়ালো, ‘তোমরা মেহেদী দাও, আমি নিচ থেকে ঘুরে আসছি।’
রুদ্র চলে যেতেই ইরাবতী তটিণী-র হাতে মেহেদি পড়িয়ে দিতে লাগলো। তটিনী তখনো ইরাবতীর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ইরাবতী সেটা খেয়াল করে বলল, ‘কি দেখছো এভাবে?’
‘তুমি কিভাবে সমাজ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসলে আপু?’
তটিনী মুখ ফসকে বলে ফেললো। ইরাবতীর হাত থেমে গেলো। তটিনী থমথমে গলায় বলল, ‘স্যরি আপু, আমি এটা বলতে চাইনি।’
ইরাবতী চমৎকার করে হাসলো। নিজের মুঠোফোন গেঁটে বের করলো সুদর্শন এক দেবতার মতো পুরুষের ছবি। তটিণী-র দিকে স্কিন ধরে বলল, ‘দেখো তো। কেমন?’
তটিনীর বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। এতো সুন্দর কোনো পুরুষ হয়? এই ছেলেটিকে কি মায়াবতা বলা উচিত? নাকি রুপবতা?’ এবার তটিনী বুঝতে পারলো। কেন ইরাবতী সবার বিরুদ্ধে গিয়ে এই এক ছেলেই ভালোবেসে চলেছে। এমন ছেলেকে কোন মেয়েই রিজেক্ট করবে? যদি ছেলেটা নিজ থেকেই প্রপোজ করে? তটিনী শুনেছে মাহেন্দ্র নিজ থেকে ইরাবতীকে প্রপোজ করেছিল। সব মেয়ের রাতের ঘুম হারাম করে দেওয়া পুরুষের মধ্যে ইরাবতী নিজেকে আটকে গেছিল। সেজন্য হয়তো প্রপোজাল রিজেক্ট করতে পারেনি। সুযোগ হাত ছাড়া না করে কাজে লাগিয়ে ফেললো।
ইরাবতী স্কিন অফ করে বলল, ‘কেমন দেখলে? আমার সাথে মানাবে তো?’
তটিনী ইরাবতীর মুখশ্রীতে চোখ ভুলিয়ে বলল, ‘কেন যেনো মনে হচ্ছে এই মায়াবতা ছেলেটিকে শুধুমাত্র তোমার সাথেই মানাবে ইরাবতী আপু।’
‘তুমি নিশ্চয়ই ধর্ম নিয়ে ভাবছো?’
তটিনীর হ্যাঁ সূচক উত্তরে ইরাবতী চমৎকার করে হাসলো,
‘আমি কখনোই আমার ধর্ম ত্যাগ করবো না। সেও করবে না। কিন্তু আমরা কেউ কাউকে ছাড়তে পারবো না তটিনী। নিজ নিজ ধর্ম নিজ নিজ ভাবে পালন করবো। কিন্তু ভালোবাসাটা হবে দুজনার। আমাদের মতো পৃথিবীতে আরও অনেকে আছে। বিশেষ করে ভিনদেশে। সেখানে ধর্ম বর্ণ দেখে বিয়ে ভালোবাসা হয়না। তাদের যাদের ভালো লাগে তার সাথেই লিভ ইন এ চলে যায়। আমরা সেরকম কিছুতে যাবো না কখনোই। বিয়ে করবো অবশ্যই। তবে কখন কোথায় জানি না। আমাদের বিয়ে সমাজ মানবে না জানি। কিন্তু পরিবার মানবে কি না বুঝতে পারছি না। ইতিমধ্যে ভাইয়ের সাথে মাহেন্দ্রের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা নিজেদের ছাড়তে পারবো না। সেজন্য টিকে আছি।’
ইরাবতী ফের মেহেদী দিতে শুরু করলো। তটিণী প্রশ্ন করল, ‘ধরো তোমাদের বিচ্ছেদ হলো, তখন কি করবে?’
ইরাবতী চমৎকার করে হাসলো, ‘তার আমার বিচ্ছেদ হবে না তটিনী। আমি জানি সে আমার জন্যই জন্ম নিয়েছে!
তটিনী আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে এক পাগল প্রেমিকাকে দেখলো। কিরকম আত্মবিশ্বাস মেয়েটার। সমাজ পরিাবর সবার বিরুদ্ধে গিয়ে একটা ছেলেকে ভালোবেসে চলেছে।
‘তোমাদের রিলেশনের কতো বছর?’
‘আমাদের কোনো নামের সম্পর্ক নেই তটিনী। আমরা প্রেম করছি না।’
তটিনী অবাক হলো, ‘তবো?’
ইরাবতী তার সেই চমৎকার হাসি হাসলো,
‘আমরা এক অনুভুতিতে তলিয়ে গেছি তটিনী। যেখানে সবসময়ই অ-প্রেমের খেলা চলে। তাকে আমি কখনো ভালোবাসি বলিনি, সে কখনো আমাকে ভালোবাসি বলেনি। শুধু বলেছিল হাত ধরবে?’ এইটাই তার সেই বিখ্যাত প্রপোজ। তারপর কখনো ভালোবাসাবাসির কথা হয়নি। আমাদের সম্পর্কটা ভীষণ অন্যরকম তটিনী। তার সাথে আমার মাসেও দেখা হয় না অনেক সময়। আমরা কখনোই সময় ঠিক করে দেখা করিনি।
‘তবে?’
‘আমাদের দেখা হয়ে যায়। যেমনটা হয়ে গেছে অ-প্রেম।’
‘তোমরা কোনো রিলেশনে নেই?’
‘সবাই ভাবে আমরা রিলেশনে। কিন্তু আসলে আমরা কোনো রিলেশনে নেই। আমাদের মনের কথা একে অপরেকে বলা হয়নি। আমরা নিজ থেকে বুঝে নিয়ে এক নামহীন সম্পর্কে জড়িয়েছি। সেখানে কেউ কাউকে কোনো দায়বদ্ধতা দেখায় না। তবুও যেনো কতো দায় থেকে যায়।’
তটিণী আশ্চর্যরকম এক অ-প্রেমের কথা শুনে কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। এভাবেও ভালোবাসা যায়?’
(চলবে)