#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
জীবন থেকে চলে গেছে আরও একটি বছর৷ তটিনী-রুদ্র, ইরাবতী-মাহিদ, রুপান্তর-মিনহাজ সুইজারল্যান্ডে হানিমুনের টিকেট কেটেছে। এইমুহূর্তে তিন দম্পতি প্লেনে চড়ে বসেছে।
মাহিদ ও ইরাবতীর এক হওয়াটা ছিল অবিশ্বাস্য। দুজনের যখন বিয়ে হলো তখন তটিনী বিস্ময় নিয়ে বলেছিল, ‘মিরাক্কেলটা ঘটলো কিভাবে?
কিন্তু উত্তরটা সে পায়নি। তবে মনে মনে সেই ব্যক্তিটার জন্য অসংখ্য দোয়া করেছে যে এই মিরাক্কেল টা ঘটাতে সাহায্য করেছে মাহিদকে।
ইরাবতী মাহিদের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। মাহিদ ইরাবতীর হাতের মুঠোয় নিজের হাত নিয়ে প্লেনের জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে ব্যস্ত। তন্মধ্যে ইরাবতী চোখ খুলে প্রশ্ন ছুড়লো।
‘সেই ব্যক্তিটার কথা কিন্তু জানালে না।’
‘কোন ব্যক্তি?’
‘তিনি যিনি আমাদের সম্পর্কের একটি পরিণতি করতে তোমাকে সাহায্য করেছিলেন। কে সে মাহিদ?’
মাহিদ হাসলো। গালের টুলে অসম্ভব সুন্দর লাগলো সেই হাসি।
‘তাকে তুমি চেনো ইরাবতী। আমি যখন কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন আমার মাথাতে হুট করে সেই ব্যক্তিটির নাম এসেছিল। আমি এর আগে তার সাথে তেমন করে মিশিনি। এক দু’বার হাই হ্যালো হয়েছিল হয়তো ইশানের জন্য। কিন্তু সেই অপরিচিত ব্যক্তিটিই যে আমার বিপদের সময় শুভাকাঙ্ক্ষী হবে সেটা আমি ভাবতেও পারিনি।’
ইরাবতীর কন্ঠে কৌতূহল, ‘ কে সে?’
‘রুদ্র ইরফান।’
‘রুদ্র ভাই!
ইরাবতীর সামনের সিটে বসা তটিনী ও রুদ্র। রুদ্রের কানে ইয়ারফোন গুঁজা। তটিনী পেছনের সবকথা শুনেছে। নিজের এতোদিনের কৌতুহল কমলো তার। তার হঠাৎ করেই মনে হলো তার মানুষটা ম্যাজিক জানে। হি ইজ এ ম্যাজিশিয়ান!
তটিনী আবেগে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরলো। রুদ্র ইয়ারফোন খুলে তটিণী-কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। তটিনী এহেন প্রশ্রয়ে নেচে উঠলো। রুদ্রের সাথে একেবারে মিশে যেতে চাইলো। কিন্তু হায় সিট বেল্টের জন্য পারলো না। রুদ্র সেটা বুঝতে পেরে হাসলো। তটিণী-র মাথা নিজের কাঁধে রেখে এক হাত দিয়ে কাঁধ জড়িয়ে ধরলো।
‘এভাবে থাকো, নাহলে ঘাড় ব্যথা করবে। ফ্লাইট পরেই বুকে লেপ্টে থাকার অফুরন্ত সময় পাবে।’
তটিনী বাচ্চাদের মতো ফেইস করে তাকালো। রুদ্রের গাল টিপে ধরে বলল, ‘আপনি এতো কিউট কেন রুদ্র ভাই?’
রুদ্র চোখ রাঙিয়ে তাকালো, ‘কোন জন্মের ভাই হই তোমার?’
তটিনী জিহ্ব কাটলো। দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘স্যরি।’
রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তুমি আমাকে এক্ষুনি ফটাফট দুই তিনটে চুমু খাবে। ফাস্ট!
তটিনী কথা বাড়ালো না। রুদ্রের গালে কপালে থুতনিতে ফটাফট চুমু খেলো। রুদ্র মন খারাপ করে বলল, ‘ঠোঁট কি দোষ করেছে?’
তটিনী শার্টের উপরেই রুদ্রের বুকে চুমু খেলো। হেসে বলল, ‘সেটা ফ্লাইট শেষ হওয়ার পর দিবো। এখন দিলে দুর্বল হয়ে যাবেন আপনি স্যার।’
রুদ্র চোখ বড়বড় করে তাকালো, ‘আমাকে তোমার এতো দূর্বল মনে হয়? লিসেন তুমি যদি আমার সামনে পোশাক বিহীন ও দাড়িয়ে থাকো তবুও আমি সহজে দূর্বল হবো না।’
-ওহ আচ্ছা তাই নাকি?
-অফকোর্স!’
তটিনী রুদ্রের ঠোঁটে ফটাফট চুমু দিতে লাগলো। রুদ্র থরথর করে ঘামতে লাগলো। হাত দিয়ে তটিণী-র ঠোঁট চেপে ধরে বলল, ‘থামো এবার।’
তটিনী নাক ফুলিয়ে বলল, ‘কেন থামবো? আপনি না দূর্বল হোন না?’
‘তুমি এখন প্লেনে বসে ঝগড়া করবে?’
তটিনী মুখ ফুলিয়ে সরে গেলো। রুদ্র নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘যা পরীক্ষা নেওয়ার প্লেন থেকে নেমে নিবে। তখন মানা করবো না। তবুও মুখ গোমড়া করে রেখো না। হাসো?
তটিনী দাঁত কেলিয়ে হাসলো। রুদ্র সেটা দেখে নিজেও হেসে ঠোঁট ভুলিয়ে নিলো তটিণী-র কপালে।’
*
রুপান্তর ও মিনহাজ বসেছে ইরাবতীদের সোজাসুজি সিটে। রুপান্তর ও মিনহাজ একে অপরের সাথে ঝগড়া করেছে। তাদের ঝগড়ার বিষয় হলো সুইজারল্যান্ড হানিমুনে আসা৷ মিনহাজকে ছুটি নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। রীতিমতো দ্বিগুণ পরিশ্রম করে সে ছুটি ম্যানেজ করেছে। একজন ইন্টার্নিশিপ ডাক্তার সে। ছুটি পাওয়াটা কষ্টকর। তার উপর ইন্টার্নির শেষ পর্যায়ে সে। কিন্তু তার মহারানীর জিদের জন্য ছুটি নিতেই হলো। সেজন্য দুজনের এয়ারপোর্টে আসার আগে ঝগড়া করেছে। মিনহাজ সেই কখন থেকে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু রুপান্তর টু শব্দ টাও করছে না। সে প্রতিজ্ঞা করেছে আজ মিনহাজ চিৎকার করে মরে গেলেও সে কথা বলবে না।
মিনহাজ অনেক খুঁজে রুপান্তরের মনোযোগ পাওয়ার পথ পেলো। সে কেশে রুপান্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘আচ্ছা তোমার আমাদের বিয়ের কথা মনে আছে? ওইযে আমি তুমি তটিনী বাজে গলিতে ঢুকে পড়েছিলাম? তারপর আমাদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো। মনে পড়ে? তারপর পুলিশের থেকে বাঁচতে তোমাকে বিয়ে করতে হয়েছি..
রুপান্তর উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘রুদ্র ভাই এসে আমাকে তোমাকে ও তটিনীকে ছাড়িয়ে এনেছেন। কিন্তু বিয়ের শর্তে। ওখানে তোমার আমার বিয়ে হলো। তারপর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। ভাগ্যিস সেদিন রুদ্র ভাই এসেছিলেন। নাহলে তো আমাদের সহজে ছাড়তই না ওরা।
মিনহাজ হাসলো, ‘আর রাগ আছে?’
রুপান্তর মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘তোমার উপর আমি কখনো রাগ করি না, অভিমান করেছিলাম।’
কতোটুকু?
রুপান্তর হাসলো, ‘খুবই সামান্য।’
মিনহাজ ভাবুক স্বরে বলল, ‘আচ্ছা তুমি একটা জিনিস খেয়াল করেছো?
কি?’
তোমার আমার, মাহিদ ইরাবতী সবারই কিন্তু বিয়েটা রুদ্র ভাইয়ের বদৌলতে হয়েছে। এটা কি কুইন্সড্যান্স?
রুপান্তর হাসলো, ‘নাহ্৷ তবে পৃথিবীতে চমৎকার অনেক মানুষ রয়েছেন যাদের সবসময়ই অন্যের বিপদে পাশে পাওয়া যায়। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তারা কিভাবে যেন সবজায়গায় নিজের ভূমিকা রেখে ফেলে। রুদ্র ভাই হলেন তেমনই একজন মানুষ। এমন অসাধারণ একজন মানুষ আমার বেস্টফ্রেন্ডের বর সেটা ভাবতেই তো আমার কতো ভালো লাগে!
মিনহাজ রুপান্তরকে আলতো করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আকাশে অন্ধকার নেমে আসছে। এটা রুপান্তরের প্রথম প্লেনে উঠা হলেও সে কিভাবে যেন কোনো নার্ভাসনেস ছাড়াই বসে রয়েছে। মিনহাজ এর আগে অনেকবার উঠেছে ঢাকা টু সিলেট আসাযাওয়া করার জন্য। তবে মানতে হবে তার বউটা অনেক সাহসী। মিনহাজ আলগোছে রুপান্তরের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। তার মনে হলো রুপান্তরের জোরাজোরিতে না আসলে এই এতো সুন্দর মুহুর্ত গুলো মিস হয়ে যেতো।’
*
প্লেনের সব লাইট অন করা। তটিনী গুনগুন করে গান গাইছে৷ যা অস্পষ্ট হয়ে রুদ্রের কানে যাচ্ছে। রুদ্র হেসে বলল, ‘আরেকটু জুরে গাইতে পারো তো।’
তটিনী হাসলো, ‘আপনি শুনান না?’
রুদ্র তটিণী-র কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘কয়েকঘন্টা পর শুধু গান না তোমার কানে সারেগামাপা বাজবে। প্রস্তুত হও।’
তটিনী ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কিসের সারেগামাপা?’
রুদ্র নিরীহ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘সুইজারল্যান্ডের সেই বিছানা কাঁপাতে যাচ্ছি আমরা, ভুলে গেলে?’
রুদ্র চোখ মারতেই তটিনী লজ্জা পেলো। কি ফাজিল তার বরটা। তটিনী দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। রুদ্র মৃদু শব্দ করে হাসছে। তটিণী-র ভালো লাগছে। পাশের মানুষটা নিজের ভাবতেই আরও ভালো লাগছে।
তটিনী হাতের আঙুলর ফাঁক গলিয়ে রুদ্রকে দেখলো। তার হঠাৎ করেই মনে হলো রুদ্র ইরফান নামক এই পুরুষটি শুধুমাত্র একজনের বেলাতেই অসম্ভব দূর্বল হয়ে পড়ে, একটুতেই হার্ট হয়, একটুতেই রাগ করে। সেই শুধুমাত্র মানুষটা তটিনী নিজে। তটিণী-র সুখ সুখ অনুভুতি হলো। এমন চমৎকার মানুষ তার নিজের সেটা সে কল্পনা করেনি। ছোট থেকে রুদ্রকে কখনো সে চোখেই দেখেনি। কিন্তু কিভাবে যেনো হঠাৎ অনুভূতি জেগে গেলো। মানুষটা হঠাৎ করেই নিজের সাথে তাকে জড়িয়ে নিলো। তটিণী-র ভাবনার মধ্যেই নিজেকে সেই মানুষের সাথে মিশে যেতে দেখলো। মানুষটা তার কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে দিচ্ছে। তটিণী-র হঠাৎ করেই চিৎকার করতে ইচ্ছে করলো। চিৎকার করে সবাইকে জানাতে ইচ্ছে হলো, ‘তার পাশে বসা এই চমৎকার ছেলেটি শুধুই তার, একান্তই তার মানুষ, তার জীবনের একমাত্র ম্যাজিশিয়ান রুদ্র ইরফান!
(সমাপ্ত)
(সমাপ্ত বললেও সমাপ্ত না। রুদ্র ইরফান আমার কলমে সবসময়ই থাকবে। আমার তাকে অনেক পছন্দ। হুটহাট তাকে নিয়ে লিখে ফেলবো। দোয়া করবেন যাতে নতুন গল্প নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি। সমাপ্তি দেখে অনেকে মন খারাপ করবেন, কিন্তু সবকিছুরই বিরতি থাকে। রিলাক্স করেন আপনারা। রুদ্র ইরফান আবার আসবে, ইনশাআল্লাহ।)