#তানিশা সুলতানা
বিয়ে হলো পবিত্র একটা বন্ধন। এই বন্ধন সারাজীবনের। পরিবারের দোয়া ছাড়া বাবার সম্মতি ছাড়া এই বাঁধনে আবদ্ধ হওয়া কি উচিত হবে? বড় ভুল হয়ে যাবে না?
অধরার মন টানছে না। প্রিয় মানুষটিকে বিয়ে করার একটা সুযোগ এসেছে সেটাও হাত ছাড়া করে দেবে? একদিকে পরিবার আরেকদিন ভালোবাসার মানুষ। কোথায় যাবে অধরা? কাকে বেছে নেবে?
কি করবে?
অধরার তেমন ভালো কোনো বন্ধু নেই যার সাথে মনের কথা শেয়ার করবে। বা যাকে মনের কথা খুলে বলবে।
এতোবড় পৃথিবীতে অধরা যে ভীষণ একা। ফ্রেশ হয়ে বসে বসে এসবই ভাবছিলো অধরা। তখনই আরিফ এক গাল হেসে অধরার রুমে ঢুকে পড়ে। বড় বড় দুটো টেডিবিয়ার অধরার বেডে রেখে অধরার পাশে বসে পড়ে। অধরা ভাবনায় এতোটাই বিভোর ছিলো যে তার উপস্থিতি টের পায় নি৷
আরিফ হাত রাখে অধরার কাঁধে। অধরা চমকে তাকায়। বাবাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে
“বাবা কখন আসলে?
আরিফ অধরার মাথাটা নিজের কাঁধের ওপর রাখে।
” এখুনি আসলাম। খেয়েছিস?
“মাত্র উঠলাম।
” ঠিক আছে দুজন এক সাথে খাবো।
মন খারাপ কেনো?
অধরা মলিন হেসে বলে
“বাবা আমাকে আরেকটা মা এনে দেবে? যাকে আমি মনের কথা গুলো বলতে পারবো।
আরিফ থমকে যায়। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শিউলির মুখটা। তাদের সম্পর্ক চলাকালীন সময়ের কিছু ঘটনা মনে পড়ে। ভালোবাসা ময় দিন, খুনসুটি, তাদের রাজকন্যা হওয়ার সময়।
সব কিছু ভাসতে থাকে চোখে। আরিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে
” তোমার ভাগ্য খারাপ সোনা। তোমার মতো এতো সুন্দর ফুলকে যে জন্ম দিয়েছে সেই ছেড়ে গেছে। অন্য কেউ আসলে তোমাকে আপন করবে না। আর আমিও পারবো না কাউকে আনতে। তোমার মাও আমি। বাবাও আমি।
অধরা বলার মতো কথা খুঁজে পায় না। বাবা তো ঠিকই বলেছে। ভাগ্য খারাপ তার। কেউ ভালোবাসবে না তাকে। সে অভাগা।
বেশ কিছুখন বাবা মেয়ে চুপচাপ সময়টাকে উপভোগ করে। মনের মধ্যে দুজনেরই অনেক কথা জমা আছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না।
“আমার খিধে পেয়েছে অধরা।
অধরা বাবার দিকে তাকায়। খিধে তারও পেয়েছে রাতে কিছু খায় নি বলে খিধেটা বেড়ে গিয়েছে
” চলো খেয়ে আসি।
অধরা আরিফের হাত ধরে খাবার খেতে যায়।
মুহিত বসে ছিলো। আজকে সে লাফাচ্ছে না। চুপচাপ বসে আছে খাবার সামনে নিয়ে। মিথি শরীফের পাশে বসে আছে। মাহমুদা চলে গেছে ভোরেই। মাহমুদাকে দিতে গেছে মাহিম।
খাওয়া শেষে মুহিত আর মিথি চলে যাবে।
অধরা আর আরিফ বসতেই সবাই খেতে শুরু করে। মুহিত এক পলকের জন্যও অধরার দিকে তাকায় নি। সে মাথা নিচু করে খাচ্ছে। অধরা কিছুটা অবাক হয়। এটা কি করে সম্ভব? এই ছেলে এতো ভালো হলো কি করে?
তবুও খুব একটা পাত্তা দেয় না। নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
নিজের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করেই অধরা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। দোটানা মনটা বলে ওঠে “ভালোবাসা হারিয়ে গেলে আর কখনোই ফিরে পাবে না”
যেহেতু আজকে তার বিয়ে হবে। তাই সে শাড়ি পড়েছে। টকটকে লাল রংয়ের শাড়ি।
শাড়িটা মায়ের। যাওয়ার সময় সে গোটা কয়েক শাড়ি আর কয়েকটা গহনা ফেলে গেছে। বাদবাকি সবই নিয়ে গেছে। এমন কি আব্দুল্লাহর লকার থেকে কয়েক লাখ টাকাও নিয়ে গিয়েছিলো।
শাড়িটা গায়ে জড়াতেই মা মা একটা গন্ধ আসে নাকে। অধরার স্পষ্ট মনে আছে। তার আটতম জন্মদিনে এই শাড়িটাই পড়ে অধরার সাথে কেক কেটেছিলো তিনি। বাবা পড়েছিলো লাল পাঞ্জাবি । আর অধরা? টকটকে লাল ফ্রক। সেই ফটো এখনো আরিফের রুমের দেয়ালে টাঙানো।
“মানুষ চলে যায়। কিন্তু স্মৃতি গুলো কখনোই আমাদের পিছু ছাড়ে না”
মায়ের পাতলা কিছু গহনা পরে নেয়। একটুখানি সাজুগুজুও করে।
তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মনি জিজ্ঞেস করেছিলো “কোথায় যাচ্ছিস?”
অধরা বলেছে কলেজে।
শীলা গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে অধরাকে। কপালে চুমু দিয়েছে।
মমতা আড়াল থেকে প্রাণ ভরে দেখেছে। ইচ্ছে করছিলো বুকে জড়িয়ে একটু ভালোবাসা দিতে। কিন্তু পারে না। এতো বছর ধরে মেয়েটাকে চোখের বিষ ভেবে আসছে সে। সে জানে এতে অধরার দোষ নেই। তবুও সে অধরাকেই দোষ দেয়।
বাজারের পাশে একটা পার্কে অপেক্ষা করছে অধরা। এক ঘন্টা দুই ঘন্টা তিনঘন্টা। কিন্তু মাহিম আসার নাম নেই৷
কয়েকবার কল করেছে মাহিমকে। কিন্তু ফোন বন্ধ। এবার কান্না পাচ্ছে অধরার। বুঝে গেছে মাহিম আর আসবে। এভাবে ঠকালো তাকে?
ভালোবাসা ছিলো না একটুও। ইমোশন নিয়ে খেলেছে শুধু।
কান্না আটকাতে পারে না অধরা। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
শিশু পার্কে হওয়াতে আশেপাশে অনেক মানুষই ছিলো। অধরার কান্না দেখে তারা তাকিয়ে থাকে অধরার দিকে।
নরমাল পার্ক। দুই একটা খেলনা রাখা আর বসার জন্য কয়েকটা বেঞ্চ। গেইট নেই কোনো। তাই মানুষ যখন তখন যেখান দিয়ে খুশি ঢুকতে এবং বেরতে পারে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। ৬ ঘন্টা একটানা এখানে বসে আছে অধরা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। পরিপাটি করে খোপা করা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। হাতে থাকা ফোনটা অনেকখন যাবত বেজে চলেছে। স্কিনে বাবা নামটা জ্বল জ্বল করছে। কিন্তু ফোন তুলছে না অধরা।
বিকেল গড়িয়ে এবার সন্ধা হতে চলেছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে।
শিউলি পার্কের পাশের রাস্তা পরিষ্কার করছিলো। সে বিকেল থেকে কাজে লেগেছে। এসেছে পর থেকে অধরা এখানে বসে থাকতে দেখছে। ইচ্ছে করছে এগিয়ে যেতে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু পারছে না৷ তাকে দেখলে অধরা অবশ্যই নরম ব্যবহার করবে না। সুন্দর করে কথা বলবে না। মেয়েটার দুঃখ কমার বদলে বেড়ে যাবে।
মাগরিবের আজান দেওয়ার পরপরই অধরা ঢলে পড়ে যায় বেঞ্চে। একা একা না। তার সামনে দিয়ে একটা মহিলা হেঁটে যাওয়ার সময় কিছু একটা ফেলে তার ওপর। তারপর থেকে ঢুলছিলো সে। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পড়ে যায়।
মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই কেউ একজন তাকে পুরুষালী শক্ত হাত দিয়ে ধরে ফেলে। মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে।
“অধরা আমি এসেছি। চোখ খোলো
অধরা আধো আধো চোখ খুলতেই পরিচিত একটা মুখ দেখতে পায়। কিন্তু কিছু বলতে পারে না।
শিউলি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। তার মুখটা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। তার কাজ সম্পূর্ণ হয় নি। কি জবাব দেবে সে? এতোগুলো টাকা পাওয়ার কথা ছিলো তার। টাকা পাওয়া হলো না।
চলবে………………….
১০-শেষ পর্ব