রাহাদ ভাইকে কখনো হাসতে দেখিনি। তিনি আমাদের সাথেই মেসে থাকেন। খুব গম্ভীর। একদিন বললেন, ‘রোহান, তোমার কাছে কিছু টাকা হবে? এক মাসের মধ্যেই ফেরৎ দিয়ে দেব।’
‘কত টাকা লাগবে ভাই?’
‘হাজার খানেক হলেই চলবে।’
আমি পকেট হাতড়ে দেখলাম। পকেটে দেড় হাজারের মতো টাকা আছে। তবুও বললাম, ‘এত টাকা তো নেই ভাই। বিশ টাকা আছে। আপনি চাইলে দিতে পারি।’
‘থাক। সব দিয়ে দিলে তুমি বিপদে পড়বে।’
টাকাগুলো চাইলেই দিয়ে দেওয়া যেত। তবে মেসে রাহাদ ভাইয়ের নামে একটি কথা সবাই জানে। সেটা হলো, তিনি এক মাসের জন্য টাকা ধার নেন। অথচ সেই টাকা ফিরিয়ে দিতে লেগে যায় বছরেরও বেশি। তবে প্রতিবারই তিনি পার পেয়ে যান। কারণ তার ব্যবহার ভালো। ছোটো সবাইকে তুমি করে ডাকেন। কখনো বড়ো গলায় কথা বলেন না। ছাত্র হিসেবেও ভালো। সেই সুবাদে খুব সহজে অনেকগুলো টিউশন পেয়ে গেছেন। টিউশন থেকে প্রতি মাসে সব মিলিয়ে পনেরো হাজারের মতো পেয়ে যান। তবুও তার অভাব ফুরোয় না। কারো না কারো কাছে ধার চাইতেই হয়।
একদিন টিউশন শেষ করে মেসের পথ ধরেছিলাম। চোখ পড়ল রাস্তার ওপাশের ফুটপাতে দ্রুত বেগে হেঁটে যাওয়া রাহাদ ভাইয়ের উপর। আমার একটু সন্দেহ হলো, এভাবে কোথায় যাচ্ছেন তিনি? এত তাড়াহুড়ো থাকলে রিকশা নিতে পারতেন! কৌতূহলের বশে পিছু নিলাম। কিন্তু পিছু নেওয়াটাই হয়তো ভুল হয়েছে। তিনি হাঁটছেন তো হাঁটছেন। থামবার নাম নেই। এতটা দূরে পথ কেউ পায়ে হেঁটে যায়?
হাঁটাহাঁটির অবসান হলো একটি হাসপাতালের সামনে এসে। রাহাদ ভাই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পাতলা শার্টের বুক পকেট থেকে টাকা বের করলেন। তারপর টাকাগুলো গুণলেন। দ্বিতীয় বার গুণা শেষ করে হাসপাতালের ভেতরে চলে গেলেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন সোজা ছয় তলায়। সেখানে রোগীর বেডে একজন বয়স্ক মহিলার পাশে রাহাদ ভাইকে বসে থাকতে দেখা গেল। নার্সের মাধ্যমে জানতে পারলাম সেই বয়স্ক মহিলা রাহাদ ভাইয়ের মা। তিনি বহুদিন যাবৎ অসুস্থ। রাহাদ ভাই মাঝে মাঝে এসে তাকে দেখে যান। শুনে খুব খারাপ লাগল। দু’বছর ধরে আছি মানুষটার সাথে। অথচ সে এতটা খারাপ পরিস্থিতিতে আছে, একবার বললও না!
রাহাদ ভাই যখন ফিরে এলেন, আমি দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। আড়াল থেকে তার অশ্রুভেজা চোখগুলো দেখে মায়া হলো। ঘৃণা হলো নিজের প্রতি। একটা মানুষ সামান্য সাহায্য চাইল। আর আমি তার অসুবিধার কথা না জেনেই তাকে ফিরিয়ে দিলাম!
রাহাদ ভাই ওষুধ কিনতে যখন ফার্মেসিতে গেলেন, তখন আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার তিনি আমাকে দেখে ফেললেও ক্ষতি নেই।
ওষুধ নিয়ে পকেটের টাকা তিনি আরো কয়েকবার গুণলেন। টাকা কম থাকায় ফার্মেসিতে কর্মরত একজনকে ওষুধ কমিয়ে দিতে বললেন। প্যাকেট হাতে নিয়ে ফিরে তাকাতেই আমি তার সামনে পড়ে গেলাম। তিনি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার কাছে কিছু টাকা হবে ভাই?’
গল্প : রাহাদ ভাই
মো. ইয়াছিন
Kobitor গল্প প্রেমিদের আস্থার জায়গা