শারীরিক সম্পর্ক কিভাবে করতে হয়
বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি অনুযায়ী নারীর সাথে পুরুষের ডেট :
ফঁরাসী:
১ম দিন – আলিঙ্গন ও চুমু
২য় দিন – যৌন সম্পর্ক
৩য় দিন – আবার যৌন সম্পর্ক
ইতালিয়ান:
১ম দিন – যৌন সম্পর্ক
২য় দিন – আবার যৌন সম্পর্ক
#ইংল্যান্ড:
১ম দিন – রেস্তোরাঁর খাওয়া ও চুমু
২য় দিন – চুমু ও আলিঙ্গন
৩য় দিন – চুমু, আলিঙ্গন ও ধুমপান
৪র্থ দিন – বারবার যৌন সম্পর্ক
আমেরিকান:
১ম দিন – দেখা ও ঘোরাঘুরি
২য় দিন – আলিঙ্গন
৩য় দিন – উষ্ণ আলিঙ্গন
৪র্থ দিন – চুমু
৫ম দিন – গাঢ় চুমু
৬ষ্ঠ দিন – যৌন সম্পর্ক
বাঙ্গালী:
১ম দিন – চা
২য় দিন – চা ও বিস্কুট
৩য় দিন – আলাদা দেখা করার প্রস্তাব
৪র্থ দিন – রাজি
৫ম দিন – কেনাকাটা
৬ষ্ঠ দিন – রেস্তোরাঁয় খাওয়া এবং আবার কেনাকাটা
৭ম দিন – আবার রেস্তোরাঁয় খাওয়া, সাথে মেয়ের ৩ ক্ষুধার্ত বান্ধবী
৮ম দিন – চুমু খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা শেষে শুধু আলিঙ্গন
৯ম দিন – আবার চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ
১০ম দিন – চুমু সফল
১১তম দিন – গাঢ় চুমু
১২তম দিন – যৌন সম্পর্ক করতে গিয়ে ব্যর্থ
১৩তম দিন – আবার যৌন সম্পর্ক করতে গিয়ে ব্যর্থ
১৪তম দিন – কথা বলা বন্ধ
১৫তম দিন – ছেলের দুঃখ প্রকাশ
১৬তম দিন – আলিঙ্গন ও গাঢ় চুমু
১৭তম দিন – যৌন সম্পর্ক করতে গিয়ে আবারও ব্যর্থ
১৮তম দিন – জোর করে যৌন সম্পর্ক
১৯তম দিন – ধর্ষণ মামলা
#Collected_Post
২০তম দিন – কারাগার
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প
– জ্বীনটা প্রতিদিন আমার ব্লাউজ খোলে।
– কি বলিস।
– অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। আমিও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর নিশ্চিত হয়ে গেছি।
– ব্লাউজ খোলে কি করে সে?
– জানিনা। তবে আমার বুকে আমি স্পষ্ট কারো ছোয়া পাই।
– যেমন?
– মনে হয় কেও আমার স্তন ভোগ করে নিচ্ছে।
– কোনো কবিরাজ দেখাস নি?
– না। তোকেই বললাম আমি। পরশু আমার গায়ে হলুদ। তার পরেরদিন বিয়ে। স্বামীর কাছে কিভাবে মুখ দেখাবো আমি। বা উনার কাছে আমি কিভাবে শেয়ার করবো সেটাই ভাবছি।
– তোর ফ্যামিলিকে জানাতে পারিস।
– আবার কি ঝামেলা হয় সেই ভয়ে জানাচ্ছিনা। তুই তো জানিস,রিয়াজকে আমি গত ৫ বছর যাবত ভালোবেসে এসেছি। ভাগ্য আমার সহায়ক হয়েছে বলে ওর সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। এখন বিয়ের আগে এসব নিয়ে মাতামাতি হলে,যদি বিয়ে ভেঙ্গে যায়?
– কিন্তু তোর মনে হচ্ছেনা? যে তুই রিয়াজকে ঠকাচ্ছিস?
– জানিনা। কিন্তু রিয়াজকে ছাড়া আমার বেচে থাকারও ইচ্ছে নেই।
– যা ভালো বুঝিস। যাইহোক, আমি যাচ্ছি রে। কলেজে তোর সাথে আমার এইটাই শেষ দেখা। বিয়ের পর তো আর আসবিনা। একেবারে তোর গায়ে হলুদে আসবো।
– হুম।
ধনিয়াপাড়ার মেয়ে তাজকিয়া। গত ২ মাস ধরেই রাতের বেলা অস্বস্তি অশান্তি সহ্য করে আসছে। কোনো এক জ্বীন তার ব্রা খোলে প্রতিদিন অশ্লীলতায় মেতে উঠে। তাজকিয়া অনুভব করতে পারে। কিন্তু চোখে দেখেনা। বিষয়টা সবাইকে বলবে,সেই মুখটাও নেই। বিয়ে ভাঙ্গার ভয়ে সে,আত্মগোপন করে রেখেছে সব। কিন্তু এই রিয়াজ কে?
তাজকিয়াদের বাসার পাশেই রিয়াজদের বাসা। পাশাপাশি থাকায়,প্রতিদিন তাদের দেখাটা হয়ে যেতো। রিয়াজ প্রতিদিন ছাদে ব্যায়াম করার জন্য আসতো,আর তাজকিয়া চা খাওয়ার বাহানা ধরে ছাদে এসে রিয়াজকে দেখতো। এই ঘটনা গত ৫ বছর ধরেই ঘটে আসছে। রিয়াজকে কয়েকবার তাজকিয়া চিঠি পাঠায়। তবে ঝামেলা এক জায়গায়,রিয়াজ কখনো চিঠি হাতে পায়নি। সব চিঠি রিয়াজের ছোট ভাই রাজু তার মায়ের কাছে দিতো। রিয়াজের মা ব্যাপারটা তাজকিয়ার মায়ের কাছে শেয়ার করে। আর ফ্যামিলিগত ভাবেই ওদের বিয়ে ঠিক হয়। সব ঠিকঠাক হয়ে আসছিলো,কিন্তু গত ২ মাস ধরে, তাজকিয়ার সাথেই অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে আসছে। শিরোনাম এইটুকুই ছিলো,চলুন এইবার পরের ঘটনা জেনে আসি।
কলেজ থেকে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাসায় ফিরছিলো তাজকিয়া। কড়া রৌদের প্রভাবে কপাল বেয়ে ঘাম প্রভাবিত হচ্ছে। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। তাজকিয়ার মন শুধু এই জ্বীনের ব্যাপার নিয়ে। কি হবে তার সাথে,বা কি হতে যাচ্ছে। কয়দিন পরেই তার বিয়ে। না চায় সে বিয়ে ভাঙ্গুক,আর না চায় রিয়াজকে ঠকাতে। করনীয় কাজটা তার সাধ্যের বাহিরে। বলতে গেলে,সমাধান খোজে পাচ্ছিলোনা সে।
বাসায় ফিরে ব্যাগটা টেবিলে রাখে তাজকিয়া। ওর মা এসে বলল,
– কিরে,এতো দেরি হলো কেন? তোকে বলেছিলাম আজ তোর বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবো। আগে আসা উচিৎ ছিলো না?
– সরি মা।মনে ছিলো না। আমি গোসল সেরে আসছি।
কথা না বাড়িয়ে তাজকিয়া সোজা রুমে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের চেহারাটা দেখে নিজেই কান্না করতে লাগলো। তখনি জানালায় একটা খটখট শব্দ হয়। তাজকিয়া ভয়ে আঁতকে উঠে। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে কেও নেই,তবে একটা গোঙ্গানির শব্দ আসছে। তাজকিয়া জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভয় পেতে লাগলো, জ্বীনটা দিনেও এসে যায়নি তো?
ভাবনার মাঝে হটাৎ তাজকিয়া খেয়াল করে,ব্যালকনিতে কেও ধপাস করে পড়েছে। যা দেখে তাজকিয়ার চোখ কপালে উঠার অবস্থা। রিয়াজ জানালা বেয়ে ওর রুমে প্রবেশ করেছে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তাজকিয়া। হটাৎ রিয়াজ কেন এখানে। আর এমন কিছু তাজকিয়া সত্যিই আশা করেনি। বলতে গেলে তার অবিশ্বাস হচ্ছিলো।
রিয়াজ দৌড়ে এসে তাজকিয়াকে কোলে নেয়। এরপর বিছানায় ফেলে দিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। রিয়াজের প্রথম স্পর্শ, প্রথম নিশ্বাসের তাপ,প্রথম গায়ের গন্ধ পেয়ে তাজকিয়া যেখানে উত্তেজিত হবার কথা। সেখানে সে হতভাগ হয়ে তাকিয়ে আছে। রিয়াজের হটাৎ কি হলো। রিয়াজ তাজকিয়ার কানে কানে বলতে লাগলো,
-কেমন দিলাম আমার সুন্দরী বউ। এরকম সারপ্রাইজ নিশ্চয়ই আশা করো নি।
– আগে উপর থেকে নামো।
– নামবো না। যা বলার এখানেই বলো।
– তুমি এইভাবে কেনো এসেছো। কেও দেখে ফেললে?
– কি হবে?
– কি হবে জানো না? খারাপ বলবে সবাই। বিয়ের আগেই?
– তাতে বিয়ে ভাঙ্গবে? ভাঙ্গতে দাও। রিয়াজের সাথে তোর বিয়ে আমি হতে দিবো না।
হুট করে লাফিয়ে উঠে তাজকিয়া। রুমের কোথাও রিয়াজ নেই। তাজকিয়া তার বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে,আবারো ব্রা খোলা। এইবার আর বোঝতে বাকি নেই,ওটা জ্বীন ছিলো।
তাজকিয়া আবার ফুপিয়ে কাদতে থাকে। এইবার যেনো তার মনে হচ্ছে,রিয়াজকে সে সব সময়ের জন্য হারাবে। তখনি দরজার বাহির থেকে তাজকিয়ার মা বলতে লাগলো,” কিরে, রেডি হস নাই? আমরা সবাই অপেক্ষা করতেছি”। তাজকিয়ার আম্মুর ডাকে তাজকিয়া বলল,” আসছি মা”।
অসহায় তাজকিয়ার দিন এইভাবেই কাটতে থাকে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সে মার্কেটে যায়। কত স্বপ্ন ছিলো বিয়ের কেনাকাটা অনেক অনন্দের সাথে করবে। সেখানে মন মরা হয়ে আছে তাজকিয়া। সময় যত ঘনিয়ে আসছে,তাজকিয়ার ভয়টা তত বেশি বাড়তে থাকে। হয়রানির মাঝেই মার্কেটিং শেষ করে বাসায় ফিরে সে। রাত ১০ টা বাজে। তাজকিয়া জানে,একটু পরেই সে জ্বীন আসবে। আবার তার অশালীন তান্ডব চালাবে। প্রতিদিনের মতো আজও তার পুরো শরীর ব্যাথা হয়ে যাবে।ভয়ে ঘুমাচ্ছে না তাজকিয়া। বিছানায় বসে অনমনা হয়ে ভাবছে। সে এক গভীর ভাবনা।
কিছুক্ষণ বাদেই তাজকিয়ার চোখ ঝাপসা হতে লাগলো। তাজকিয়া হাপিয়ে উঠে। বোঝতে বাকি নেই,জ্বীনটা চলে এসেছে। তাজকিয়া দরজার দিকে এগিয়ে আসতে চায়। সে পালাতে চায়। আর সহ্য হয়না এই অশরীরীর অত্যাচার। কিন্তু চোখ ঝাপসা হওয়ায় তাজকিয়া দরজা খোজে পাচ্ছেনা। হেলে ঢুলে পড়ে যাচ্ছে সে। হাতটা এগিয়ে দিয়ে,অন্ধের মতো দরজার সন্ধানে আছে তাজকিয়া। এরই মাঝে হুট করে ফ্লোরে পড়ে যায় সে। চোখ ঝাপসা হলেও, পুরো হুশ আছে তার। তখনি তাজকিয়া অনুভব করে তার পিঠের নিছে কেও হাত ঢুকায়। তাজকিয়া চটপট করতে থাকে। অদৃশ্য হাতটি তাজকিয়াকে তুলে কোলে নেয়। এরপর বিছানার দিকে নিয়ে ফেলে দেয় তাকে। তাজকিয়া ঝাপসা চোখ নিয়ে চটপট করছে আর চারপাশে দেখার চেষ্টায় আছে। এবং সেই মুহূর্তে তাজকিয়ার চোখে নতুন কোনো ঘটনা আটকে যায়। অনেক লম্বা কিছু একটা তাজকিয়ার পায়ের পাশে দাড়ানো। পুরো শরীর কুচকুচে কালো৷ তার দেহ অনেক মোটা,কিন্তু মাথাটা একদম ছোট। ঝাপসা চোখে এর চেয়ে ভালো আইডিয়া করতে পারেনি তাজকিয়া। যা দেখেছে,তার পরেই জ্ঞান হারায় সে।
রৌদের আলো মুখে পড়তেই লাফিয়ে উঠে তাজকিয়া। অনেক ঘাবড়ে আছে সে। তড়িঘড়ি করে বিছানায় বসে পড়ে। নিছের দিকে তাকিয়ে দেখে,আজও শরীরে জামা নেই। গেঞ্জি বিছানায়,সাথে ব্রা টাও। ভেঙ্গে পড়ে সে। এইভাবে আর নিতে পারছেনা । কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা। ক্লান্ত মস্তিষ্ক নিয়ে আবার শুয়ে পড়ে সে।
কাল তাজকিয়ার গায়ে হলুদ। বাসায় মেহমান ভরপুর। বাসার চারপাশে আলোকসজ্জা আর বিয়ের স্টেইজ তৈরি হচ্ছে। পাশের বিল্ডিং রিয়াজদেরও সেম অবস্থা। ব্যালকনিতে দাড়িয়ে সব দেখছে তাজকিয়া। এই দিনটার জন্য সে গত ৫ বছর অপেক্ষা করে আসছে। আজ সেই দিন চলেই এলো। কিন্তু খুশিটা আর রইলো না। মন খারাপের দেশে ঢুবে থাকে সে। তাজকিয়া কনফিউজড হয়ে আছে। বিয়ের পর রিয়াজের রুপ ধারণ করে সেই জ্বীন এসে না সহবাস করে ফেলে।আবার বিয়ের পিড়িতে রিয়াজের বদলে সেই জ্বীন যদি কবুল বলে? জ্বীনটা ইচ্ছে করলে অনেক আগেই সহবাস করতে পারতো,কিন্তু করেনি। কেনো করেনি তা হয়তো তাজকিয়ার কাছে একটা রহস্যের গোলকধাঁধা। তবে যেকোনো মুহূর্তে যা কিছু হতে পারে। জ্বীন তো হুমকি দিয়েই গেলো,রিয়াজের সাথে বিয়ে হতে দিবেনা। তাজকিয়ার মাথায় কিছু ঢুকছেনা। ভাবতে না পেরে সে ব্যালকনি থেকে নিজের রুমে চলে আসে।
মেহমানদের সময় দিতে দিতে দিনটা চলে যায়। তাজকিয়া সিদ্ধান্ত নেয়,রিয়াজকে বিষয়টা বলে দিবে। যদিও বিয়ের আগে ওদের ফোনালাপ করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু রিয়াজ নিজেই নিষেধ করছিলো। কেনো করেছে সে জানে। এই মুহূর্তে তাজকিয়ার মনে হতে লাগলো,রিয়াজের সাথে ব্যাপারটা বলা খুব জরুরি। সে রিয়াজকে ঠকাতে চায় না। বিয়ের আগে ছেড়ে চলে গেলে,হয়তো মানিয়ে নিতে পারবে।কিন্তু বিয়ের পর ছেড়ে দিলে তাজকিয়ার সাথে,তার ফ্যামিলিও ভেঙ্গে পড়বে।অবশেষে তাজকিয়া ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেয়,আজ সে রিয়াজকে বিষয়টা বলবেই।
সন্ধ্যা করে সে বাসার বাহিরে আসে। রিয়াজের ছোট ভাইকে বলে,রিয়াজকে যেনো নিছে আসতে বলে।রাজু রিয়াজের কাছে না গিয়ে,সোজা রিয়াজের মাকে বিষয়টা বলে। রিয়াজের মা রিয়াজের রুমে গিয়ে রিয়াজকে বলে। রাজু এমনি। ছোট মানুষ। তাছাড়া, সে যাই কিছু হোক,সবার আগে তার আম্মুকে বলবে। এবং পরে অন্য কাওকে বলার প্রয়োজন মনে করেনা। এদিকে তাজকিয়া বাসার নিছে দাঁড়িয়ে আছে। হটাৎ তাজকিয়ার ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শ।পিছনে তাকিয়ে তাজকিয়া দেখতে পায় রিয়াজ চলে এসেছে। তাজকিয়া রিয়াজকে হুট করে জড়িয়ে ধরে। রিয়াজ তাজকিয়াকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে। এমন আতংকিত দেখাচ্ছে কেন?
– আমি আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি। দয়া করে পুরো কথাটা মন দিয়ে শুনুন।
– হুম বলো?
– আপনি প্রমিজ করেন,শুনার পর আমাকে ছেড়ে যাবেন না।
– বলো তো আগে।
এরপর তাজকিয়া প্রথম থেকে শেষ অব্দি সব বলে।
– ওও আচ্ছা। জ্বীনটাকে কখনো দেখেছো?
– না। ঝাপসা চোখে তার কালো রঙটাই দেখেছি।
– দেখো তো? এমন কিনা?
এ বলেই রিয়াজ তার চেহারা বদলে ফেলে।তাজকিয়া অশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে। লাল লাল দুইটা চোখ আর কালো চেহারাটা আর সামনে। পিছন থেকেই রিয়াজ তাজকিয়াকে ডাক দেয়। তাজকিয়া পিছনে তাকিয়ে দেখে রিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়ে তাজকিয়া রিয়াজের কাছে যেতে যেতে রিয়াজ অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার তাজকিয়া অবাক হয়ে যায়। এগুলোর কোনোটাই রিয়াজ নয়। সব এই জ্বীনের ধোকা মাত্র। তখনি রিয়াজদের বাসার দরজায় তাজকিয়া রিয়াজকে দেখতে পায়। তাজকিয়া আর সহ্য করতে না পেরে,দৌড়ে তার বাসায় চলে আসে। সবাই তাজকিয়ার এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে তাকিয়ে আছে। তাজকিয়া সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। এদিকে রিয়াজ তাজকিয়ার পিছু পিছু তাদের বাসায় আসে। রিয়াজকে দেখে,তাজকিয়ার বাসার মেহমানরাও অবাক হয়ে যায়। রিয়াজ তাজকিয়ার আম্মুকে জিজ্ঞেস করলো,
– তাজকিয়া কোথায়।
– সে দৌড়ে এসে তার রুমে চলে গেলো।
– রুমটা কোনদিকে।
– উপর তলার বাম পাশেরটা।
রিয়াজ দৌড়ে তাজকিয়ার রুমের দরজায় যায়। এরপর দরজা ধাক্কাতে ধাক্কতে তাজকিয়াকে ডাকে। তাজকিয়া দরজা খোলেনা। ভিতরে সে ভীতুর মতো বসে কান্না করছে। রিয়াজ তাজকিয়াকে ডেকে যাচ্ছে। তাজকিয়া বিশ্বাস করতে পারছেনা যে,এইটা রিয়াজ। হয়তো এইটাও কোনো জ্বীন। রিয়াজের প্রতিটা ডাকে তাজকিয়া আরো জোরে কান্না করতে লাগলো।
চলবে…..?
গল্প- #জ্বীন রহস্য পর্ব ১
লেখক- #রিয়াজ_রাজ
সকল পর্বের লিংক একসাথে
https://kobitor.com/category/uponas/jin/
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প ২
মাঝরাতে পানি খেতে উঠে নিজের স্বামীকে মেজো ভাবীর ঘর থেকে বের হতে দেখে চমকে উঠলো রাহেলা। মেজো ভাইয়া ৩ দিন হলো ঢাকায়। এখন ভাবি একা ঘরে। তার স্বামী এত রাতে মেজো ভাবীর ঘরে কী করতে গিয়েছিল বুঝতে কিছু বাকি থাকে না তার।
এই ঘরের দিকে স্বামীকে আসতে দেখেই দরজা বিজিয়ে দিয়ে বিছানায় উঠে ঘুমানোর অভিনয় করলো রাহেলা। তার স্বামী দরজা ঠেলে সন্তর্পণে হেটে এসে বিছানায় তার পাশে শুয়ে পড়লো। রাহেলা এই বাড়ির মেয়ে। তার স্বামী ঘরজামাই। রাহেলা জানে কোনো রকমের কুৎসা রটলেই তাকে সহ তার স্বামীকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিবে ভাইয়েরা। তাই এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলে না রাহেলা।
পরের দিন সারাদিন মুখ কালো করে রাখলেও তার স্বামী আমজাদকে এই বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করে না সে। তারপরের রাতে রাহেলা আর কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। তার বিশ্বাস তার মেজভাই যতদিন শহরে আছে প্রতি রাতেই বোধহয় তার স্বামী মেজো ভাবীর ঘরে গেছে। তার বিশ্বাসকে সত্যি প্রমাণিত করতেই যেন ধীরে ধীরে আমজাদ রাহেলার পাশ থেকে গড়িয়ে মেঝেতে নামল। এরপর পা টিপে টিপে ঘরের দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। রাত এখন কয়টা হবে। ১টা – ২টা।
আমজাদ কোনো কাজ না জোগাড় করতে পারায় ভাইদের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে তারা দুজন। রাহেলা আমজাদের এই অর্থ উপার্জনের অক্ষমতাটাই পুষিয়ে দেয় সারাদিন গাধার মতো বাড়ির কাজ করে। সারাদিন কাজ করায় শরীর এতই ক্লান্ত হয় যে সারারাত মরার মত ঘুমায় রাহেলা। কয়বার আমজাদ লাথি মেরেও রাহেলার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। তাই রাতে যে রাহেলা জেগে থাকতে পারে এমন কোনো ভয়ই তার ছিল না বলা যায়। তা না হলে স্ত্রীকে বিছানায় রেখে কোনো পুরুষের পক্ষে পড়ো নারীর সঙ্গে গভীর রাতে ঘন্টা কাটিয়ে আসা সম্ভব না।
আমজাদ চলে যেতেই। বালিশে মুখ গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো রাহেলা। সে তার স্বামীকে কত ভালবাসে। কিনা করে সারাদিন তাকে একটু আরামে রাখার জন্য, বড় ভাইদের কটু কথা থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য। আর সেই নাকি এমন বিশ্বাস-ঘাতকতা করল তার সাথে! আর মেজ ভাবিও যে এমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে তা তার চিন্তার বাইরে ছিল।
পরের দুই রাত অনেক চেষ্টা করেও জেগে থাকতে পারলো না রাহেলা। সারাদিনের কাজের ধকলে এতই ক্লান্ত থাকতো যে মাঝরাত পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে জেগে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
তারপরে যখন মেজোভাই চলে এলো তখন থেকে রাহেলা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। তারও কয়েকদিন পর এক রাতে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে রাহেলা। অনেক ধাক্কাধাক্কি করে তাকে উঠালো তার স্বামী আমজাদ। ঘুম জড়ানো ক্লান্ত কণ্ঠে রাহেলা বলল :
কী হইছে ? এত রাইতে ডাকেন কেন ?
লাইটটা একটু জ্বালাও তো রাহু।
সারাদিন কাম কইরা কুল পাইনা। উনি আছেন ফুর্তিতে। এখন ঘুমান।
আরে রাহু ! লাইট জ্বালাও না! দেখ কী দেই ।
বিরক্ত হয়েই বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালালো রাহেলা। তারপর চকিতে এসে বসল। আমজাদ তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক জোড়া চুড়ি বের করলো।
আরেকটু কাছে আসো। পড়ায়া দেই।
চুড়িগুলো দেখেই চিনলো রাহেলা এগুলো স্বর্ণের। আর এর মালিক যে মেজো ভাবি ছাড়া আর কেউ না তাও সে ভালো করে জানে। সে ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে বলল:
এগুলা তো মেজো ভাবীর। তুমি পাইলা কই ?
আরে ভয় পাইয়োনা, চুরি করি নাই। মেজো ভাবি আমারে দিছে।
বলো কী ! সে কেন দেবে ?
তোমারে একটা কথা কই? কই কই কইরাও এতদিন কইতে পারি নাই শরমে। ভাবছিলাম তুমি আমারে ভুল বুঝবা। কিন্তু তোমারে আমি কী কিছু গোপন করি বলো! ভুল বুইঝো না বউ। মেজো ভাই এইবার ঢাকায় যাওয়ার পর কয়রাত আমি মেজো ভাবীর ঘরে গেছিলাম।
এবার রাহেলার বুকটা কেঁপে উঠলো। এটাতো সে জানে। স্বামীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়েও সে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু এমন কথা নিজ থেকে আমজাদ কেন বলছে। কেন তাকে লজ্জ্বা দিচ্ছে। আমজাদ আবার বললো :
মেজ ভাই ঢাকা যাওয়ার পরে মেজ ভাবীর কয় রাত খুব জ্বর হইছিল । কিন্তু তার সেবা করার মতো কেউ ছিল না। তাই ভাবি কইল , দেখ আমজাদ তোরে আমি ভাইয়ের মতোই দেখি। আমার সারাদিন ভালো লাগে খালি একটু দুর্বলতা থাকে। কিন্তু রাত হইলেই জ্বর বাড়ে। তুই কী রাইতে আইসা আমার মাথায় একটু পানি ঢালতে পারবি ?
রাহেলা অবাক হয়ে বলল , আমারে কইতে পারতো। ছোট ভাবি , বড় ভাবি আছে। তোমারে কইলো কেন ? আমারে সারাদিনে জ্বরের কথা একবারও কইল না।
আমজাদ মুখটাকে মলিন করে বলল, দেখলা! সব আমার কপালের দোষ। আমি জানতাম তুমি আমারে সন্দেহ করবা। আমি কী আর মাইনষের বিশ্বাস পাওয়ার যোগ্য ?
রাহেলা এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল , নাগো আমি ঐটা বলি নাই। আমি তোমারে বিশ্বাস করুম নাতো কারে করুম কউ। তুমি ছাড়া আমার আর কেডা আছে ? তুমি আমারে ঠকাইবা ফিরিশতা আইসা কইলেও বিশ্বাস করুম না।
এই না হইলে আমার বউ! শুনো। ভাবীরে কইলাম রাহেলারে পাঠায়া দিব নে। ভাবি কইলো। আহা! বেচারি সংসারটার লাইগা কাজ কইরা সারাদিন মরতাছে তারে আবার রাইতে ত্যক্ত করা কেন ? রাহেলা জানে যে আমি তোমারে ভাই মানি। তুমিই আইসো। রাহেলা কিছুই মনে করবে না জানলেও। ওর মন এত নষ্ট না। তবুও আমি তোমারে কিছু কই নাই ডরে। তাছাড়া বুঝইতো পরের বাড়িতে থাকি। বেশি তর্ক মানায় না। কিন্তু তোমারে কইতে লজ্জা লাগলো বইলা চুপিচুপিই ভাবীর ঘরে ৩ রাত গেছিলাম। পানি না দিলে কী তখন জ্বর ছাড়তো?
রাহেলার চোখ ভিজে উঠে। আহা! তার এই স্বামীকে আর ভাবীকেই নাকি সে ভুল বুঝেছে। কি নোংরা চিন্তাই না করেছে সেই রাতে তার স্বামীকে ভাবীর ঘর থেকে বের হতে দেখে। লজ্জ্বায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে রাহেলার। সে সিদ্ধান্ত নেয় তার সহজ-সরল এই স্বামীকে আর কোনোদিন সন্দেহ করবে না সে। আমজাদ বললো :
আমি সেবা-শুসুস্রা করাতেইতো ভাবি সুস্থ হইয়া গেল। তাইতো খুশি হইয়া দিল এই চুড়ি জোড়া , কইল রাহেলারে দিও। তবে দিনের বেলা এইটা পইরো না , রাহু। বুঝইতো পরের ঘরে থাকি পাঁচ লোকে পাঁচ কথা কইবো।
রাহেলার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা স্বামীর জন্য উৎলে পড়ে যেন। ঘরের আলো নিভিয়ে স্বামীর সঙ্গে মিশে যায় সে।
এই বাড়ির সবচেয়ে অবস্থাপন্ন বলা যায় মেজো ভাই ফরিদকে। তার স্ত্রীও অবস্থা-সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। ফরিদ মিয়ার বড় চালের আড়তের ব্যবসা। গ্রামের দিকে হলেও ফরিদের ঘরটা দেখার মতো। ইট-সিমেন্টের দেয়াল আর টিনের দো-চালা। তার ডানপাশে দুটো ইটের তৈরি ছাপড়া ঘরে থাকে ছোট ভাই বাদল আর বড় ভাই জলিল। তাদের দুটো ঘরের মুখোমুখি উঠান পেরিয়ে একটা টিন আর বাঁশের তৈরি ঘর। এখানেই রাহেলা আর আমজাদের সংসার। রাহেলা খুব চিকন আর কালো হওয়াতে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তিন ভাই অনেক খুঁজেও কোনো পাত্র পায় না। শেষ-মেষ এক ভবঘুরে , ভাদাইমা গোছের এই আমজাদকে ঘর জামাই হিসেবে আনে। ভেবেছিল টুকটাক কিছু কাজে তাকে লাগাবে । কিন্তু সে পুরোই অকর্মা।
সেই দিনের প্রায় ১ মাস পর বাড়িতে বিরাট উৎসবের মতো আয়োজন হলো। রাহেলার ছোট ভাইয়ের ২টা আর বড় ভাইয়ের ৩ টা সন্তান হলেও মেজো ভাই বিয়ের ৪ বছর পরেও সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি। মেজো ভাই আরেকটা বিয়ে করবেন কিনা এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছিলেন। যে স্ত্রী তাকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারবে। মেজো বউকে তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হতো। ঠিক এই সময়েই আনন্দ সংবাদটা পেল সবাই। মেজো বউ অন্তঃসত্ত্বা। মেজো ভাইয়া আর ভাবীর আনন্দ দেখে কে! এই উপলক্ষেই এই উৎসব আয়োজন।
রাহেলা যখন আনন্দের সাথে আমজাদকে এই খবরটা দিল তখন সে সামান্য একটু মুচকি হেসে বলল ভালোইতো। শুনছিলাম কোন ফকিরের কাছ থেকে পানি পড়া নিছে । ফকিরটা কামেল।
আশায় রাহেলার চোখও জ্বলজ্বল করে ওঠে। বিয়ের ৫ বছর হলো সেওতো সন্তানের সুখ পায়নি। সেও কী যাবে নাকি সেই ফকিরের কাছে । কোথায় থাকে সে ?
তার সপ্তাহ খানেক পর এক সন্ধ্যায় একটা চাদরে পেঁচিয়ে কিছু জিনিস নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে রাহেলা আমজাদকে। সে কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় চাদরের ভেতর কী? আমজাদ ফিসফিস করে বলে , দরজা বন্ধ করে আসো।
চকির ওপর চাদর নামিয়ে প্যাচ খুলতেই রাহেলার চোখ ছানা-বড়া হয়ে যায়। এত গহনা সে এক সাথে জীবনে কখনো দেখেনি। তার সাথে ওগুলো কী ? ৫০০ টাকার নোট না ! কতগুলো ওখানে ? রাহেলার বিস্ময় কাটতেই চাইল না। আমজাদ হাত ধরে তাকে বিছানায় বসালো। বললো :
মেজো ভাবী দিছে।
রাহেলা অবাক হয়ে বলল , শুধু জ্বরের সময় মাথায় পানি ঢেলে দেওয়ার লাইগা এত কিছু দিল ?
দূর বোকা! ভাবীরে ঐ ফকিরের পানি পড়াতো আমিই আইন্না দিলাম। তখনই নাকি ভাবি মনে মনে নিয়ত করছিল এইবার যদি সুখের মুখ দেখে তাইলে তার অর্ধেক গয়না আমাগো দিয়া দিবে। আমাগো আর দাসী-বান্দির মতো এই বাড়িতে থাকা লাগবে না। আমরা ঢাকা যামু। নতুন কইরা সংসার শুরু করমু।
রাহেলার বিস্ময় এখনো যাচ্ছে না। সত্যি ভাবি অর্ধেক দিয়া দিল ? মেজো ভাইয়ে জানে ?
দূর বোকা! সে কী তাইলে দিত ! তারে এসব জানানের কাজ নাই। কালকেই আমরা ঢাকা যামু। তোমার নতুন সংসার হইবো।
রাহেলা খুবই সহজ-সরল মেয়ে । জটিলতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক , জানা-শোনা নেই। মেজো ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার স্বামীর মেজো ভাবীর ঘরে যাওয়া , সামান্য এই কারণে ভাবীর এত গহনা দেওয়া , তার পরেই তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া, এই বাড়ি থেকে তাদের দূরে চলে যাওয়া এইসব এর মাঝে যে জটিলতা কিছু থাকতে পারে তা তার চিন্তা শক্তির বাইরে।
সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার নিজের একটা সংসার হবে , সেখানে সেই হবে পরিচালক। এই চিন্তার পুলকেই সে শিউরে ওঠে। সারারাত মন নাচতে থাকে।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্বামীকে তার পাশে না দেখে সে চমকায় না। ভাবে গেছে কোথাও আশেপাশে। ঘরের আলনার নিজের জামা-কাপড় , সব গহনা আর সারারাত ধরে নতুন সংসারের চিন্তায় ডুবে থাকা রেহানার স্বপ্নকে সাথে করে নিয়ে, রাতেই যে আমজাদ এই গ্রাম , জেলা আর তার থেকে অনেকদূরে চলে গেছে তা বুঝতে তার দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন পাথরের মূর্তির মতো এই দারিদ্র ঘরের চকিতে বসে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না। ……………………………….
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
আমজাদ যে রাহেলাকে , এই বাড়ি ফেলে আর কখনো এখানে ফিরবে না ভেবে একেবারে চলে গেছে তা বুঝতে বাড়ির বাকি সবারও পুরো দিনটা কেটে গেল। সবাই উত্তেজিত। শুধু বাড়ির মেজবৌ কে এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন কম মনে হলো। সে অন্য কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল। পাছে হারামজাদাটা যাওয়ার আগে সব ফাঁস করে দিয়ে যায়নিতো! রাহেলাকে , আমজাদের হঠাৎ এমন নিরুদ্দেশের কারণ অনেক জিজ্ঞেস করতেও যখন সে গয়নার কথা তুলল না তখন মেজবউ কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। যদিও তারমধ্যে থাকা আতঙ্ক ভাব তেমন গেলো না।
রাহেলা তখনো বিশ্বাস করতে পারেনি আমজাদ তাকে ফেলে , এই বাড়ি ছেড়ে সত্যি সত্যি চলে যেতে পারে। এতো অসম্ভব । তার এতো ভালোবাসা এত মায়া সব কী মূল্যহীন! তার বিচক্ষণ মেজো ভাই যখন এসে তাকে বলল , একটা গাট্টি নিয়ে বাজার থেকে ঢাকার বাসে তাকে যেতে দেখেছে কিছু লোক তখনও রাহেলার মনে ক্ষীণ বিশ্বাস ছিল তার এমন বুদ্ধিমান ভাইয়েরও হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। গেলই বা! হয়তো সে ঢাকায় গেছে বাড়িঘর ঠিক করতে । একদিন এসে তাকে নিয়ে যাবে। স্বামীর ক্ষতি হয় , সে যদি মামলা খায় এই ভয়ে গহনার কথা ভুল করেও উচ্চারণ করে না সে। এমন কী মেজো ভাবীর কাছেও না। ভাবে , হয়তো ভাবি গয়নাগুলো আমজাদকে দেয়নি । আমজাদ চুরি করে নিয়ে গেছে। ভাবি হয়তো এখনো টের পায়নি।
চুরি করলে তার জন্য ছাড়া আর কেনই বা আমজাদ চুরি করবে। এই গোটা দুনিয়ায় সে ছাড়া আর কে আছে আমজাদের? কে তার স্বামীকে এতটা ভালোবাসবে আর ! হোক না সে একটু কালো , চিকন। সন্তানের মুখ দেখাতে পারছে না। এই তুচ্ছ কিছু কারণে তাকে ফেলে যাবে আমজাদ ! এটা কিছুতেই হতে পারে না। সে মানুষ চিনতে ভুল করবে? আমজাদ ঘর-বাড়ি ঠিক করে আবার আসবেই তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে। সেখানে তার একটা সংসার হবে। নিজের রান্নাঘর , আলমারি থাকবে। সংসারী কী কী বাজার লাগবে তার লিস্ট সে করবে।
তার বাড়ির আর এলাকার কিছু মানুষেরও বিশ্বাস ছিল রাহেলার স্বামী ফিরে আসবে। তারা প্রায়ই রাহেলাকে আশ্বাস দিয়ে বলতো তার স্বামী ফিরে আসবে। ঢাকা শহরতো আর কম কথা না।আমজাদের সহায়-সম্বল সম্পর্কে সবার ধারণা ছিল। সেখানে সহায়-সম্ভবলহীন একজন মানুষ আর কয়দিন টিকবে। ঘরে ফিরে আসতেই হবে। এইসব কথা যারা বলতো রাহেলার নজরে এরা পৃথিবীর সেরা মানুষে রূপান্তরিত হলো। তাদের কথা শুনে তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করতো। পুরোনো স্বপ্ন আবার প্রাণ ফিরে পেত । আবার তার স্বামীর কাছে অনেক গয়না-টাকা আছে মনে হতেই বুকটা ধক করে উঠতো। যদি না ফেরে! মেজো ভাবিই তাকে বেশি আস্বস্ত করতো তার স্বামী আবার ফিরে আসবে বলে। মেজো ভাবীকে আগে থেকেই শ্রদ্ধা করতো সে। তা যেন ভালোবাসায় রূপান্তরিত হলো।
আগে বাড়ি-ঘরের কাজ করে যেটুকু সময় পেত স্বামী সেবা করে কাটিয়ে দিত। এখন সে সময়টুকু ঘরে বসে কাঁদে আর স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষা করে।
দিন যায় , সপ্তাহ যায় মাস যায়। এক বছর পেরিয়ে গেল। এখনো আশা ছাড়েনি রাহেলা। মাঝেমধ্যে স্বপ্নে আমজাদ নতুন শাড়ি , গয়না নিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। রাহেলার হাত ধরে চকিতে বসায়। অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ পকেট থেকে স্বর্ণের চুড়ি বের করে পরিয়ে দেয়।
খাবারে অনিয়ম , অগোছালো জীবন-যাপন, খাটনি রাহেলার চেহারা আরো খারাপ করে দিয়েছে। কিছু করেই সুখ পায় না সে। মেজো ভাবীর ছেলে হওয়ার পর বাড়িতে কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে। এখন রাহেলার কাজ কমে গেছে। সে বাচ্চার দেখাশোনা করে , ফিটার খাওয়ায়। ভাবীকে টুকটাক কাজ করে। এইতো। আগে তাও সারাদিন নানান কাজ করে ব্যস্ত থাকতো। এখন অবসর সময়ে শুধু আমজাদের কথা ভেবেই কাটায়। লোকটার না ফিরে আসার কোনো কারণ দেখে না সে ।
আরো এক বছর কেটে যায়। চেহারা মলিন, চিন্তিত থাকলেও এখন মেজো ভাবীর সঙ্গে থাকে সে। অনেকটাই নিয়মতান্ত্রিক জীবন। বরাদ্দ করা খাবার না খেলে নষ্ট হবে। এতেই ভাবীর বকা খেতে হবে। নিয়মিত খাওয়া , পরিশ্রম কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ফিরতে লাগলো রাহেলার। চেহারা আরো মায়া মায়া হলো। পাড়ার কিছু মেয়ে-বউ বলতে লাগলো , এইরকম চেহারা যদি আগে থাকতো তাহলে স্বামী কিছুতেই ফেলে যেত না।
মধ্যবয়স্ক স্ত্রী-হীনা কয়েকজন রাহেলার মেজো ভাইয়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাবও নিয়ে এসেছিল। তাদের সন্তানের দরকার নেই। আগের স্ত্রীর সন্তানদের দেখাশোনা , আর গৃহস্থ দেখাশোনা করলেই চলবে। ভাইদের শত অনুরোধ , রাগেও বিয়েতে রাজি হয়না রাহেলা। কেন হবে ? তার স্বামী কী মরে গেছে ? সে ঢাকায় গেছে। কই অনেকের স্বামীতো বিদেশ গিয়ে দশ-বারো বছর পরেও ফিরে আসে। সেই বউরা বুঝি এরমাঝে আবার বিয়ে করে ? তাহলে সে কেন করবে ? তার স্বামীও ফিরে আসবে।
সে এত সাহস পাচ্ছিল অবশ্য মেজো ভাবীর কারণেই। তার স্বামী চলে যাওয়ার পর থেকেই রাহেলা অনুভব করতে পারে তার মেজো ভাবি তার জন্য মায়া অনুভব করে। কেমন যেন একটা টান সৃষ্টি হলো দুজনের মাঝে যা আগে কখনো ছিল না। তার সংসারের দায়িত্ব রাহেলার কাঁধে তুলে দিয়ে নিজেই যেন রাহেলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। নাহলে রাহেলা কবে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতো।
এখন রাহেলার আনন্দ আর মায়ার আরেকটা উৎস হলো মেজো ভাইয়ের ছেলে মনু। ছেলেটা যে এত মায়াবী চেহারা নিয়ে জন্মেছে! একেবারে ছোট থেকে পালার কারণে মা আর ছেলের সম্পর্ক যেন গড়ে উঠেছে ছেলে আর ফুপুর মাঝে। রাহেলাকে পেলে আর কাউকে চায় না। শুধু ছোটবেলা থেকে পালার জন্য না । অন্য কী এক কারণেও যেন রাহেলা বাচ্চা এই ছেলেটার প্রতি একটা টান অনুভব করে। খুব আপন মনে হয় একে। মনের ভুলে মাঝেমধ্যে নিজের স্বামীর চেহারার সঙ্গে একে মিলাতেই নিজেকে মনে মনে গালি দিতে থাকে রাহেলা। তার মাথা কী খারাপ হয়ে গেছে ! কীসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করে সে।
আবার সেসব রাতের কথাও মনে পড়ে যে রাতে মেজো ভাবীর ঘর থেকে আমজাদকে বের হতে দেখে ছিল সে!
আবার সেই চুপিচুপি ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে , বড় হলে আমারে মা ডাকবি ? বল তো মা। মাআআআ……….।
না! তার মাথা কী খারাপ হয়ে যাচ্ছে! নিজেকে সামলায় সে।
এভাবে আরও দুই বছর কেটে যায়। রাহেলার ভালোবাসা এখন মনু আর তার স্বামীর মধ্যে দ্বিখণ্ডিত হলেও এখনো সে তার স্বামীকে ভুলতে পারেনি। আশায় আছে একদিন ফিরবে সে। সেদিনও মনুকে ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় যেতে সে প্রস্তুত। কষ্ট হবে , হোক একটু ।
মনু হাটতে পারে , মিষ্টি করে কথা বলতে পারে , পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখে। ছোট ভাই-ভাবি , বড় ভাই ভাবি তাদের সন্তান সবার চোখের মণি। আর মেজো ভাইতো তাকে ছাড়া জগৎটাই চিন্তা করতে পারে না। আর মা একমুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করেন না। তবুও যে ছেলেটা এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তাকে, যার হাত ছাড়া খাবার খায় না , যাকে না জড়িয়ে ধরলে তার ঘুম আসে না সেই ফুপু রাহেলা। ছোটরা ভালোবাসার প্রতিদান খুব ভালো করেই দিতে পারে ।
একদিন বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে একটা সি.এন.জি যাওয়ার শব্দ শুনে রাস্তায় বেরিয়ে আসে রাহেলা। দেখে উৎসুক দৃষ্টিতে সি.এন.জির দিকে আশেপাশের ঘর-বাড়ির অনেক মেয়েরাও তাকিয়ে আছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে। এদিকে সি.এন.জি দিয়ে যারা আশা-যাওয়া করে অধিকাংশই ঢাকার লোক। রাহেলা উৎসুক হয়ে পাশের বাড়ির কামালের মাকে জিজ্ঞেস করলো :
কে গেলো গো ভাবি ?
‘আরে , তুই ঘটনা শুনিস নি নাকি রাহু ? ‘ বলে হাসতে হাসতে রাহেলার দিকে এগিয়ে এলো।
আরে কয়বছর আগে মনে আছে , উত্তর পাড়ার বন্যার জামাই যে তারে ফেলে ঢাকায় চলে গেল ? আর ফিরে আসলো না। শুন , ছয়মাস আগে বাপ মরার পর লোক ধরে বন্যাও গেল ঢাকায়। গার্মেন্টসে চাকরি পেল। চাকরি করা নাকি খুব সোজা। মাস শেষে নগদ টাকা! তো একদিন রাস্তায় তার জামাইয়ের সাথে দেখা । আর কী চিনতে পাইরা কী যে বকুনি বন্যার । তারপরে জানা গেলো ঐখানে গিয়া আরেকটা বিয়া করছে। বন্যারে দেইখা আবার মনে ধরছে। তাই শুনছিলাম বন্যা ওর জামাইরে নিয়ে আজকে আইবো। চাচীত তাই কইল।
কথাটা শুনেই রাহেলার বুকের ধকপক বেড়ে গেল।সে ঘরে চলে এলো। এক ঘোরে চলে গেল যেন সে। অনেক বছর আগে জমা স্বামীর সঙ্গে সংসার করার
স্বপ্ন আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। লোকে বলে তার চেহারা নাকি আগের থেকে সুন্দর হয়েছে । আসলেই কী তাই ? আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হতাশ হলো সে।
বন্যার স্বামী অনেক বছর আগে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিল। আর বন্যা ছয়মাস আগে ঢাকায় যেতেই তার স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! তবে সে যে শুনেছিল ঢাকা শহর অনেক বড় , কোটি কোটি মানুষ থাকে। টিভিতেও তো ঢাকা শহর দেখেছে সে। এক লঞ্চঘাটে যত মানুষ তাদের পুরো গ্রামে তত মানুষ নেই।
তাহলে তার ভাইয়েরা যে বলতো ঢাকা শহরে হারিয়ে যাওয়া মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না সেটা পুরোপুরি ঠিক না। ভালোবাসা-টান থাকলে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সে মেজো ভাইয়ের কাছে এই কথা বলতেই ধমক খেল , ঢাকা শহর কী সহজ জিনিস পাইছিস ? এই জোচ্চোরটার লাইগা এখনো তুই আশায় বইসা আছস ? ওয় নাই। মনে কর মইরা গেছে।
উল্লেখ করা হয়নি এরমধ্যে অনেক আগেই মেজো ভাবি প্রকাশ করেছে তার ঘরের আলমারি থেকে অর্ধেক গয়না আর কিছু টাকা চুরি হয়েছে। কাজটা হয়তো আমজাদই করেছে। মেজো ভাইও এবার হঠাৎ আমজাদের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনের কারণটা বুঝলো। কিন্তু বোনের আর বাড়ির সম্মান যাতে নষ্ট না হয় তাই এই বাড়ির বাইরে কথাটা ছড়ায়নি।
ভাবীকে বলতেই সে হেসে উঠে বলল , কেনরে আমাদের মনু বুঝি আর তোকে ভালোবাসে না যে পুরোনো নাগরের জন্য ঢাকা যেতে হবে ?
রাহেলা বুঝতে পারে এরা কখনো তার স্বামীর কাছে তাকে যেতে দেবে না । যা করার তাকেই করতে হবে। এখন আলম মামাই ভরসা।
আলম মামার আরেকটা নাম দালাল। কয়েকটা পুলিশি কেসও খেয়েছে সে। শোনা যায় গ্রামের সহজ সরল মেয়েদের সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে শহরে নিয়ে গিয়ে দুষ্টু লোকেদের কাছে বিক্রি করে দেন। সেখানে তাদের নিয়ে নোংরা কাজ করানো হয়।
এই আলম মামাই পথে-ঘাটে রাহেলাকে দেখে রঙিন ঢাকার গল্প শুনাতো। সেখানে জীবন কত সহজ ? টাকা কামানো কত সহজ । সেখানে একবার কাজে ঢুকতে পারলে যে একজন কাজ করে গ্রামের পুরো গোষ্ঠীকে খাওয়াতে-পরাতে পারবে সেই কথা। কী নেই সেখানে। কেবল মাত্র বোকারাই এখন গ্রামে পড়ে থাকে ইত্যাদি।
আকার ইঙ্গিতে রাহেলাকে এটাও বলতে ছাড়েননি যে , তার স্বামীর মতো একটা লোককে কয়েকবার দেখেছেন বোধহয়। নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তবে ঢাকায় গিয়ে খুঁজলে পাওয়া অসম্ভব না। রাহেলা তখন কোনো ভরসা পায়নি। তাছাড়া আলম মামার দুর্নাম সম্পর্কে সবটাই তার জানা।
কিন্তু আজ যে কী হলো। সেই আলম মামা ছাড়া আর কারো উপর ভরসা করতে পারলো না সে। ঢাকার কিইবা জানে সে। আলম মামা প্রথমে তার কথা শুনে মুখ গম্ভীর করলেন । বললেন , ” এ আর কী ব্যাপার ! মামা বইলা ডাকো। প্রয়োজনে কাজে না লাগলে লাগবো আর কখন ? তো ভাইদের অনুমতি তো লাগবো।”
রাহেলা যখন শান্ত কণ্ঠে বলল, ভাই-ভাবি কাউকে জানিয়ে যাবে না সে। চুপিচুপি যাবে। তখন এই পঞ্চাশ উর্ধ লোকটার মুখ যে প্রশান্তিতে ভরে গেল তা মাটির দিকে তাকিয়ে থাকায় রাহেলা দেখতে পেল না। আলম মামা গম্ভীর, চাপা কণ্ঠে বললেন :
কবে যাবা?
আজ রাইতেই । পারবেন ?
পারুম না মানে। ভাগ্নি বিপদের সময় মামার কাছে আসবে নাতো কার কাছে যাবে। আমিতো আগেই বলছিলাম। মামা বইলা ডাক। দাঁড়াও।
এই বলেই ঘরে ঢুকে একটা পুরোপুরি কালো বোরখা আর হিজাব নিয়ে এসে রাহেলাকে দিল । বলল :
রাইত ১০ টায়। পুকুর পাড়ে আসবা।
খরচ ?
আহা! মামা বইলা ডাক , আবার খরচ !
পুরা দায়িত্ব আমার !
রাহেলা জামার ভেতরে বোরখা পেঁচিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির পথে যায়। মনে হাজার প্রশ্ন আর চিন্তা।…………………………………..
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
প্রথম শারীরিক সম্পর্কের গল্প
.
রাহেলা সন্ধ্যার পর থেকেই টুকটাক করে সবাইকে লুকিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছিল। ব্যাগে পরার জামা-কাপড় আর জমানো ১২ হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই নিল না। মেজো ভাইয়া সন্ধ্যায়ই বাড়িতে চলে আসে। ১০ টার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে ভাবিকে নিয়ে। মনু থাকে রাহেলার সাথে। সেও ৯টার বেশি জাগতে পারে না। দেখতে দেখতে ঘড়িতে ১০ টা বেজে গেল।
রাহেলা ভেবেছিল যাওয়ার আগে কিছুতেই মনুর প্রতি মায়া বাড়ানো চলবে না। তাহলে হয়তো আর যাওয়াই হবে না। কিন্তু বোরকা পরে , ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা মনুর দিকে তাকাতেই পুরো বুকটা বিষাদে ভরে উঠলো। বিছানায় উঠে মনুকে বুকের সাথে চেপে ধরে ফুপিয়ে উঠলো। মনু ঘুম জড়ানো চোখ জোড়া সামান্য একটু খুলল শুধু। আবার ঘুমিয়ে পড়লো। তাকে আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে। ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ভাইয়া-ভাবীর ঘর ভেতর থেকে দেয়া।
বাইরে একবার নজর দিয়ে দেখল ছোট ভাইয়া কিংবা বড় ভাইয়ের ঘরের কেউ বাইরে আছে কিনা। না , নেই। সন্তর্পণে গেইট খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো রাহেলা। হৃদ-স্পন্দন বেড়ে গেছে অনেক। এরপর নেমে পড়লো রাস্তায়। হেটে পুকুর পাড়ে যেতে পনেরো মিনিট লাগলো। কেউ নেই। চিন্তিত ভাবে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতেই এক সারি নারকেল গাছের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আলম মিয়া।
আসছ নাকি রাহেলা ?
জ্বী।
ভাইয়া-ভাবীরে বইলা আসলে ভালো হইতো না ? ঢাকা শহর , কমতো কথা না ! এতদূর যাইতেছ।
বললে , যাইতে দিবে না মামা । আপনে চলেন।
আলম মামা দাঁত বের করে হেসে বললেন , মামা বইলা ডাক , আর কী বলুম ! চলো।
এর আগে কখনো সি.এন.জি তে ওঠেনি রাহেলা। ওঠার প্রয়োজনই পড়েনি। আলম মামা আগে থেকেই সি.এন.জি ঠিক করে রেখেছিল। গ্রামের শেষ মাথা পর্যন্ত হেটে এসে এটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। যানে উঠেই দুটো পাঁচশ টাকার নোট আলম মামার দিকে এগিয়ে দিল রাহেলা। মামা জিহ্ব কেটে বলল:
মামা বইলা ডাক , আবার খরচের চিন্তা কেন ? বলছিনা সব খরচ আমি দিব।
রাহেলা জোর করেই আলম মামার পাঞ্জাবির পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিল। গাড়ি চলতে লাগলো। এত উত্তেজিত রাহেলা জীবনে হয়নি। এমন কী যে সন্ধ্যায় বুঝতে পারলো তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে সেদিনও নয়। এক অজানা , অচেনা শিহরণ। পুরো শরীর কাঁপছে। হাতের লোম খাড়া হয়ে গেছে।
বাজার বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সি.এন.জি তে আসলো। এখান থেকে বাসে উঠলো। রাহেলা ভয়ে ভয়ে ছিল পরিচিত কেউ বাসে তাকে দেখে ফেলে কিনা। অবশ্য বোরকা পরে থাকায় তাকে কেউই চিনতে পারবে না যদিনা তার এই মায়াবী চোখ-জোড়া পূর্বে ভালো করে খুঁটিয়ে না দেখে থাকে।
বাস চলতে শুরু করতেই গা টা গুলিয়ে উঠলো তার। আলম মামা বললেন , একটু অমন লাগবেই। বাইরের দিকে তাকায়া থাকো। একটু পর সব ঠিক হয়ে যাবে। জানলার পাশের সিটে বসেছে সে। পূর্ণিমা রাত। জোৎস্নার আলোতে রাস্তার পাশের সারি সারি ফসলের ক্ষেতের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো সে। আপন মনেই চোখ ভিজে উঠলো। এসব যে তার চেনা জগৎ , এসব ছেড়ে সে কোথায় যাচ্ছে। যে মরীচিকার খোঁজে যাচ্ছে সে কী আদো সেখানে আছে। খুঁজে পাবে কিভাবে , আর পেলেই যদি তাকে চিনতে না পারে। যদি দেখে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে সংসার করছে। তখন কী করবে রাহেলা। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।
ঘুম ভাঙলো আলম মামার ডাকে। চারদিকে এত ঝাঁক-ঝমক আলো । বড় রাস্তা , বড় বিল্ডিং, গভীর রাতেও রাস্তায় এত মানুষ দেখেও প্রথমে রাহেলার বিশ্বাস হলো না এটাই সে ঢাকা। সত্যিই সে ঢাকায় এসেছে। সব কিছু তার স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হতে লাগলো।
আলম মামার কাছ থেকে জানতে পারলো রাত ৪টা বাজে। এত রাতেও যে বাইরে মানুষ এইভাবে চলাচল করতে পারে তা তার ধারণায় ছিল না। বাস আসছে, থামছে, যাত্রী নামছে উঠছে। বাসস্ট্যান্ডে অনেক যাত্রী বসে অপেক্ষা করছে। আলম মামা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন :
কিরে শহর দেখলি ?
হ , মামা ।
এখন বাসে উঠুম। বাসের লাইগা কিছুক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকা লাগবো।
আবার ! তুমি না কইলা এইটাই ঢাকা।
বাপরে! ঢাকার আবার মা-বাপ আছে নাকি ! বিরাট বড় শহর। এক মাস লাগবো তোর ঘুইরা দেখতে।
ঠিকই বলছেন আলম মামা। ছোট জায়গা হলে কোটি কোটি মানুষ থাকে কী করে! সে আলম মিয়াকে প্রশ্ন করলো :
আমরা যামু কই ?
তোমার জামাইরে খুঁজতে যা যা করা লাগে সব করমু। মামা বইলা ডাকছ একবার ! এমন এক জায়গায় যাব যেখানে এই শহরের সব মাইনষের লিস্ট আছে। ছবি দেইখা চিনবা না আমজাদরে ?
জ্বী।
ওই জায়গায় কিছু মেয়ে লোকের সাথে তোমার এক হপ্তা থাকা লাগবো। আমি এরমধ্যে তদবির কইরা লিস্ট জোগাড় করুম এই শহরের সবার। তারপর তোমারে সোজা আমজাদের কাছে নিয়া যাব।
রাহেলার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। সে জানে আলম মামার খারাপ স্বভাবের কথা। অনেকগুলো মেয়েলোক একসঙ্গে থেকে নোংরা কাজ করে এগুলো নিয়ে গ্রামের মেয়েদের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছিল। তবুও সে মামার সঙ্গে এসেছে এই ভরসায় যে তার চেহারা , খারাপ। তারমত একটা মেয়েকে কে কিনবে আর বেচবে ? আর তার মনে তীব্র বিশ্বাস ছিল শহরে আসলেই আমজাদের সঙ্গে তার দেখা হবে।
এই প্রথম আলম মামাকে ভয় করতে লাগলো রাহেলার। সে সংকোচের সঙ্গে বলল :
মামা , পিশাব চাপছে।
মামা বইলা ডাক! সরম কিসের ? চলো।
এটা কোনো অজুহাত ছিল না। সত্যিই সংকোচের কারণে এতক্ষণ কথাটা বলতে পারেনি রাহেলা। বাসস্টপের পাশের লেডিস টয়লেট দেখিয়ে আলম মিয়া তাকে বলল , তুমি নিশ্চিন্তে যাও। আমি ঐযে চায়ের দোকান ঐখানে বইসা থাকবো।
রাহেলা টয়লেটে ঢুকে গেল। মোটামুটি বিশ-মিনিট সময় লাগালো বের হতে। বের হতেই ছোট্ট চায়ের স্টলের সামনে পুলিশের পোশাক পরা দুজন লোককে দেখে তার বুকের পানি শুকিয়ে গেল। আরো হতভম্ব হয়ে গেল আলম মামার হাতে হাতকড়া পরানো দেখে । তার পুরো শরীর যদিও কাঁপছে তবুও ওইদিকে তাকিয়ে থাকলো রাহেলা। সে বোকা হলেও আলম মিয়া যে তার দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারায় তাকে বিপদের ইঙ্গিত দিলেন এবং তাকে পালিয়ে যেতে বললেন তা সে বুঝতে পারলো।
রাহেলা এবার চোখে অন্ধকার দেখছে। আলম মামাকে পুলিশ ধরলো কেন । নিজের বিপদ সে আঁচ করতে পারলো। তবে কী পরিবার ছেড়ে পালিয়ে এ শহরে এলে পুলিশ ধরে ? তারা কী করে জানে। কে পালিয়ে এসেছে আর কে ইচ্ছায় !
উদ্ভ্রান্তের মতো হাটতে থাকে রাহেলা। কোথায় যাচ্ছে , কোনদিকে যাচ্ছে কিছুই খেয়াল নেই তার। শুধু বুঝছে ওই পোশাকের লোকদের থেকে যত দূরে সরে যেতে পারে তত মঙ্গল। আলম মামা যতই খারাপ হোক না কেন , এতক্ষন ধরে একটা সাহস পাচ্ছিল রাহেলা। অন্তত কী করতে হবে , কী করবে এই চিন্তা মাথায় আসছিল না। যা করার আলম মামাই করবেন। এবার নতুন শহরে পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে গেল সে।
প্রায় ১ ঘন্টা হাটলো সে। তার মুখ , শরীর বোরকার আবরণে ঢাকা। এরমধ্যেই সূর্য উঠতে শুরু করেছে। মানুষ জনের আনা-গোনা , গাড়ি , রিক্সার সংখ্যা বেড়ে গেল। অদ্ভুত বিষয় হলো রাহেলার সাথে কেউ অস্বাভাবিক আচরণ করছে না , বা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে না। এতেই যেন সে শান্তি পেল। বেলা বাড়তে থাকলে এত লোকজন , এত মানুষ একসঙ্গে সে আগে দেখেনি। আরো কিছুটা সময় কাটালো সে হেঁটে হেঁটে। ভয় কেটে তার চোখে এখন কৌতূহল। আলম মিয়া কিংবা তার স্বামীকে নিয়েও চিন্তা নেই। শুধু কৌতূহলী দৃষ্টি চারপাশের পরিবেশ আর মানুষদের পর্যবেক্ষণ করছে। এর মধ্যেই চায়ের দোকান , কিছু খাবার হোটেল খুলতে শুরু করেছে।
রাহেলা শুনেছিল ঢাকা শহরে নারী-পুরুষ একসঙ্গে বসে হোটেলে খাবার খায়। প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করলো সে। একটা হোটেলে ঢুকে পড়লো। এত সকালে ভিড় জমেনি। পরোটা আর মাংসের জল দিয়ে নাস্তা করার পরই অনুধাবন করলো রাহেলা , সে খুব ক্লান্ত এবং এই শহরে তার থাকার কোনো জায়গা নেই। কেন জানে না আলম মামার হাত থেকে ছুটে ভয়ের পাশাপাশি সামান্য তৃপ্তিও অনুভব করেছিল সে।
একটু লোক বাড়তেই সে বিল মিটিয়ে , কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আবার রাস্তায় হাঁটা ধরল। বোরখা পরা মানুষ খুব কমই দেখল রাহেলা। বেশির ভাগই , সালোয়ার-কামিজ , শাড়ি , কাপড় পরা। ছেলে-মেয়ে পাল্লা দিয়ে বাসে উঠছে। জিন্স পরা কিছু মেয়ের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল সে।
আবার হাঁটা ধরল। ক্লান্তি ফিরে আসতেই আলম মামাকে পুলিশ কোথায় নিয়ে গেল , সে একা এখন কী করবে , আমজাদ ইবা এই শহরের কোথায় থাকে। এই চিন্তা আবার ভর করলো মাথায় । আচ্ছা , সে যদি কাউকে বলে তাহলে সে কী আবার তাকে গ্রামে যাওয়ার বাসে তুলে দিবে ? কিংবা তার স্বামীকে খুঁজে দিবে ? এই শহরের সব মানুষের লিস্ট যেখানে থাকে সেখানে নিয়ে গেলেও চলবে। নাকি বাড়ির পথ ধরবে! কিন্তু কোন মুখে আমজাদকে না নিয়ে আবার বাড়ি যাবে। আশেপাশে এবার চিরচেনা সেই আমজাদের মুখ হঠাৎ দেখতে পাওয়ার আশায় তাকাতে তাকাতে এগোল সে।
বেলা বেড়ে যায়। করা রোদে বেশিক্ষন হাটতে পারে না সে। আসলেই শহরটা অনেক বড় আর অনেক মানুষের। অনেক বড় বড় দালান আর গাড়ির। এক জায়গায় অনেক গুলো মানুষকে কোদাল, পাতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেল রাহেলা। সেদিকেই এগিয়ে গেল সে, কারন তাদের অধিকাংশই লুঙ্গি-শার্ট , গেঞ্জি পরিহিত। আমজাদকে তো এইরকম পোশাকে দেখেই সে অব্যস্ত। যদিও কারো মুখের মাঝেই আমজাদকে খুঁজে পেল না সে।
একসময় দুপুর শেষ হয়ে যায় । এরমধ্যে খাবার দোকান খুঁজে খাবার , পাবলিক টয়লেট খুঁজে প্রয়োজনীয় কাজ সাড়া করে ফেলেছে রাহেলা। ক্লান্ত হলেই জায়গা পেয়ে ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেয়। আস্তে আস্তে তার মনের ভয় কেটে যেতে থাকে শহর নিয়ে। সেখানে জায়গা নেয় রোমাঞ্চ। নতুন অদ্ভুত এক জগৎকে দেখে সে বিস্মিত। যতটা ভয়ঙ্কর আর অনিরাপদ ভেবেছিল জায়গাটাকে ততটা লাগলো না। সাহস বেড়ে গেল তার। আত্মবিশ্বাস জন্মালো আমজাদের দেখা সে পাবেই।
সাহস করে একটা বাসে উঠে বসলো। বাস চলার পর হেলপার যখন ভাড়া চাইতে এলো তখন পাশের সিটের মেয়েটাকে অনুকরণ করে ২০ টাকা নোট তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। হেলপার, কোথায় নামবেন , জানতে চাইলে জানলা দিয়ে বাইরের ছুটন্ত মানুষ , গাছ , দোকানের দিকে চেয়ে নীরবতা পালন করে সে। একটা সময় অনেক গুলো গাছের সারির পাশে স্টপে বাস থামতেই পাশের সিটের মেয়েটা দরজার দিকে এগিয়ে যায়। রাহেলাও মেয়েটাকে অনুসরণ করে নেমে পড়ে। মেয়েটা যেদিকে যায় সে তার উল্টোদিকে হাটা শুরু করে।
রাস্তা ধরে হাঁটার পর যে সে পার্কের ভেতর চলে এসেছে তা তার জানার কথা না। বিকেলের শেষ মুহূর্তে এত সুন্দর ছায়াঘেরা জায়গা দেখে কিছুটা প্রশান্তি পেল যেন সে। একটা বেঞ্চে বসে আশেপাশের মানুষদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স।
জোড়ায় জোড়ায় ছেলে-মেয়ে বসে গল্প করছে , হাঁটছে , ফেরিওয়ালারা পানি-কোক , ভুট্টাভাজা, ঝালমুড়ি বিক্রি করছে। কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা , তার বয়সী মেয়ে , বাচ্চাদেরও লক্ষ করলো সে।
আরেকটু ঘুরে ঘুরে একটা গাছকে ঘিরে থাকা গোল সিমেন্টের বসার জায়গায় বসলো সে। একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এই শহরের রাত কীরকম তা সম্পর্কে ধারনা নেই রাহেলার। এখন শুধু ইচ্ছা করছে একটা ঘরে ফিরে যাওয়ার। ফিরেই আর কিছু না , বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া। কিন্তু , হায় , ঘর! এ শহরে তার কিছু নেই , কেউ নেই। এখন হঠাৎ করে যদি আমজাদ এসে তার সামনে দাঁড়াতো আর বলতো :
তুমি দেখি ভারী বোকা মেয়ে ! ঢাকায় আসবা , আমারে জানায়া আসবা না! ইসসস! সারাদিন একলা একলা ঘুইরা বেড়াইছ শহর ? তুমি ! ফিরিশতা আইসা কইলেও বিশ্বাস যামু না। তোমার যেই বুদ্ধি! চলো চলো , অনেক নাটক হইছে এখন বাড়িতে আসো। তোমার লাইগাইতো সংসারটা এতদিন ধইরা ঘুচাইলাম। এখন দায়িত্ব নিবা। চলো চলো, উঠো না কেন ?
ভাবতেই পুলকে শরীর শিউরে ওঠে রাহেলার। আহা, স্বপ! সন্ধ্যা নেম এলো। …………………………………….
.
১৮+ রোমান্টিক উপন্যাস
.
সন্ধ্যার হালকা অন্ধকার তখন নামতে শুরু করেছে। রাহেলা সেখানেই গম্ভীর হয়ে বসে নিজের চিন্তার জগতে বসে আছে। এমন সময় তার পাশে এসে বসলো একটা ছেলে। বয়স ৭-৮ বছর। পরনে ময়লা প্যান্ট , খালি গা। একটা পলিথিনের প্যাকেটে কোণ আকৃতির অনেকগুলো বাদামের পুটলা। রাহেলার দিকে এক পলক তাকিয়েই ছেলেটা পলিথিন পাশে রেখে মাটির দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।
ছেলেটাকে দেখে সারাদিনে এই প্রথম মনুর কথা মনে পড়লো। মনু কী করছে ? তাকে ছাড়া আজ ঘুমাবে কী করে। ভাইয়া-ভাবি গ্রামের লোক তার বাড়ি থেকে পালানোর কথা জানার পর তাকে নিয়ে কী আলোচনা করছে জানার লোভ হয় তার। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে রাহেলা বলল :
কী নাম গো তোমার ?
ছেলেটা একবার তার দিকে তাকালেও কোনো কথা বলল না। আবার চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল। রাহেলার এই প্রথম মনে হলো তার যে মুখ ঢাকা! তাকে যদি আমজাদ দেখেও চীনবে কী করে। সে আমজাদকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে প্রকাশ করতেই যে ভুলে গিয়েছিল এই ভেবে নিজের ওপর ক্ষোভ হলো। মুখের আবরণটা সরিয়ে আবার ছেলেটার দিকে তাকালো সে।
এ ধরনের ছেলেদের সাহসের কমতি নেই। এরা অপরিচিত মানুষ দেখলেই ঘাবড়ে যায় না। পথে থাকতে থাকতে নানা রকম মানুষ দেখে অবস্থ। বাদাম ফেরি করে বেড়ায়। অচেনা মানুষের সাথেই ব্যবসা। তবুও পুরো শরীর ঢাকা অপরিচিতা এই মহিলাটা যখন হঠাৎ তাকে নাম জিজ্ঞেস করলো তখন সন্ধ্যার এই পরিস্থিতির জন্য হোক সে একটু ভয় পেল।
কিন্তু পরক্ষণেই রাহেলা মুখোশ খুলতেই সন্ধ্যার ম্লান আলোয় অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। এত সুন্দর মায়াবী চেহারা , চোখ ছেলেটা এর আগে কখনই দেখেনি যেন। কেমন একটা মা মা চেহারা। তার মুখায়ব, তার চিন্তায় যে জটিলতার কোনো ছাপ নেই তা প্রকাশ করে। গ্রাম্য সরল নারী। ছেলেটা বিড়বিড় করে বলে :
রাব্বি।
তোমার বাপ-মা কী করে ?
ছেলেটা আবার চুপ করে গেল। রাহেলার মন খুব খারাপ হয়। এইটুকুন একটা ছেলে বাদাম বিক্রি করে খায়। আহা, পৃথিবীর সে কী বোঝে ! ব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় ছেলেটার দিকে।
নাও , কিছু কিনা খাইয়ো।
ছেলেটা এবার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই নোটটা সে চেনে এবং মূল্য জানে । তবুও কেমন যেন সংকোচে হাত বাড়াতে পারে না। রাহেলা সিমেন্টের সিঁড়িতে টাকাটা রেখে দিতেই উড়ে যেতে পারে ভেবে টাকাটা হাতে নিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহেলার দিকে। রাহেলা বলল :
তোমার বাড়িতে কে কে থাকো ?
বাপ আর মা।
মায় চিন্তা করে না , রাইত হইয়া যায় বাড়ি যাও না!
সৎ মা।
ওয়!
ছেলেটার সমস্ত দুঃখ যেন চোখের সামনে দেখতে পায় রাহেলা। ছেলেটা এবার অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে বলে :
আপনি বাইতে যাবেন , না ? কই ?
রাহেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সারাদিনে এই প্রথম কোনো একজন মানুষ পেল মন খুলে কথা বলার। সে তার জীবনের ইতিবৃত্ত সমস্ত ছেলেটার কাছে প্রকাশ করলো। আমজাদ , তার গ্রাম , আলম মামা , কেন শহরে আসা সব। সে ছোট্ট ছেলেটার কাছে এর কোনো সমাধান চায় না। সে যে কথা বলার জন্য একটা মনোযোগী শ্রোতা পেয়েছে এতেই সে আনন্দিত।
কোনো কারণ ছাড়াই বলা যায় না , রাহেলার চেহারা , আচরণ , সে ছোট হলেও তার ব্যক্তিত্বকে সম্মান করে যে তাকে রাহেলা সব কথা খুলে বলেছে সব মিলিয়ে প্রথম থেকেই এই অচেনা মহিলার জন্য একটা শ্রদ্ধা কাজ করলো রাব্বির মনে। নাহলে , কোথাকার কোন মহিলা বিপদে পড়েছে , রাতে থাকার জন্য জায়গা নেই এতে তারও চিন্তা হয় নাকি ! সে চলে গেলে মহিলাটি একা এখানে বসে থাকবে ! সারারাত ? রাব্বি বলল :
আপনে আমার লগে আসেন।
কই ?
রাব্বি আর কোনো কথা না বলে হাটতে শুরু করে। রাহেলা কয়েক সেকেণ্ড শুধু চিন্তা করে , তারপরেই ব্যাগ নিয়ে ছেলেটার পিছু নেয়। রাব্বি , মহিলাকে তার বাড়িতে নেবে না দুটি কারনে। এক. তাদের ঘরে পর্যাপ্ত জায়গা নেই, দুই তার বাপ-মা এই সহজ সরল মেয়েটাকে পেলে তার সর্বস্ব লুট করে তাকে পথে নামিয়ে দেবে। বোঝাই যায় মহিলাটির কাছে অনেক টাকা আছে। রাহেলাও কিছুটা আশার আলো দেখতে পেল যেন। রাতটা কাটানোর জন্য ভাগ্যই বুঝি এই ছেলেটার সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিয়েছে।
রাব্বি হাটছেতো হাটছেই। সে নিজেও জানে না কোথায় যাচ্ছে। শুধু জানে একে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। তার পক্ষে সম্ভব না। কার সাহায্য নেবে সে ? হঠাৎ ফয়সাল ভাইয়ের কথা স্মরণ হলো। তিনি এখানকার একটা কলেজে পড়ে আর এই জায়গার আশেপাশেই তার বাড়ি। পথশিশুদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ ভালো। সন্ধ্যায় পার্কের গেটের উল্টোদিকের রাস্তায় চায়ের আড্ডায় প্রায়ই বন্ধুদের সাথে বসেন তিনি।
গেট থেকে বেরিয়ে একটা জায়গায় অভিভাবকের সুরে রাহেলকে বসতে বলল রাব্বি। তারপর বড় রাস্তা পেরিয়ে একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল সে। প্রায় আধা-ঘন্টা বসে থাকলো রাহেলা। এরমধ্যেই অন্ধকার নেমে গেছে পুরোপুরি। কিন্তু শহরে অন্ধকারের বালাই নেই। ইলেকট্রিক লাইট জ্বেলে আলো দিয়ে ভরা চারদিক। রাহেলার একবার মনে হলে ছেলেটা আর আসবে না। তবে আশ্রয় পাওয়ার এই ক্ষীণ আশাটা সে ছাড়তে পারছে না ।
এমন সময় ছেলেটাকে একজন বড় মানুষ নিয়ে রাস্তা পার হয়ে আসতে দেখে সংকুচিত হয়ে গেল রাহেলা। মুখের খোলা মুখোশটা পরে নিল।
ফয়সাল এখানের একটা কলেজে অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ে। এই আড্ডার সময়ে কোন মহিলার জন্য তাকে ঢেকে আনায় রাব্বির ওপর সে বিরক্ত। কিন্তু না এসে উপায় ছিল না , রাব্বি নাছোড়-বান্দার মতো ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্ত করে মারছিল। মহিলাটির বিপদের সমস্ত কথা আগা-গোড়া কয়েক বার শোনায় তাকে। এই ধরণের স্বপ্ন নিয়ে শহরে আসা মহিলাদের প্রায়ই দেখা যায় বলা না গেলেও , এই ধরনের মহিলাদের দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্বামীর সন্ধানে একটা মেয়ের শহরে ছুটে আশাটা তাই অস্বাভাবিক লাগলো না ফয়সালের কাছে।
সে তবুও আরেকবার প্রশ্ন করে রাহেলার কাছ থেকে সব কথা জেনে নিল। এই পর্যন্তই ঠিক ছিল। হয়তো সে অচেনা একটা নারীর জন্য কিইবা করতে পারে ভেবে এখনই চলে যেতে পারতো। কিন্তু সে উৎসাহিত হয়ে মহিলাটির মুখ দেখতে চাইল।
রাহেলা সংকুচিত হয়ে মুখোশ ছড়াতেই রাহেলার মুখের দিকে মুগ্ধ নেত্রে তাকিয়ে রইলো এই ছেলেটাও। কালো বর্ণের চেহারায় এই মায়া , এই তীব্র মায়া ভরা চোখ , মুখায়ব নির্দেশ করছে রাহেলার জীবনের সরলতা। করুন মুখ দেখেই বোঝা যায় এটা কোনো ছল না , এই মেয়েটি আসলেই বিপদে পড়েছে। একে এই রাতে শহরের মাঝে ফেলে যেতে ইচ্ছা করলো না ফয়সালের। কিন্তু রাতে কোথায় রাখবে একে ? টুনু আপাদের বাসায়? এই অপরিচিতা মেয়েটিকে এই প্রথম কিছু সম্বোধন করে কথা বলল ফয়সাল :
আমার সাথে চলেন , আপা।
রাহেলা বুঝতে পারছে না ভাগ্য তাকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা হয়তো তাকে একটা আশ্রয় খুঁজে দেবে এই আশা মনে জাগলেও অজানা একটা ভয় তাকে গ্রাস করলো। আর কিছু করার নেই তাই রাব্বির মাথায়, মুখে হাত রেখে তাকে বিদায় দিয়ে ফয়সালের সাথে রাস্তা পার হলো।
রাহেলার আন্দাজ নেই। পনেরো-বিশ মিনিট এই নতুন লম্বা ছেলেটার সাথে অলিতে গলিতে হাটলো সে। তারপর একটা গেটের বাইরে রাহেলাকে দাঁড়াতে বলে গেটের ভেতরে ঢুকলো সে। দশ মিনিট পর হতাশ ভাবে বের হয়ে এলো। বলল :
আপা , চলেন । হাটতে অসুবিধা হচ্ছে নাতো?
রাহেলা না সূচক মাথা নাড়ায়। আবার হাটতে থাকে তারা। এমন করে হাটতে হাটতে আরো ৩টা বাড়িতে যায় ফয়সাল। প্রতিবারই হতাশ হয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে আসে। রাহেলা বুঝতে পারে তার মতো অপরিচিত একটা মেয়েকে কেউই থাকতে দিতে চায় না। নিজের বিপদে ছেলেটাকেও এভাবে বিপদে ফেলায় ভেতরে ভেতরে লজ্জ্বা পায় রাহেলা।
রাত প্রায় ৯ টার মতো বাজে। ছেলেটা বলে:
দেখেন আপা , আমি কী করবো নিজেও বুঝতেছি না। আমি একটা ম্যাসের মতো জায়গায় থাকি। এক রুমে ৩ বন্ধু , এটাচ বাথরুম আর রান্নাঘর। আমার বাকি ২ রুমম্যাট গ্রামে গেছে অবশ্য। আপনে চাইলে রাতে রান্নাঘরে থাকতে পারেন।
রাহেলা হ্যাঁ, সূচক মাথা নাড়ে। আর কিবা করার আছে তার! রাহেলাকে নিয়ে সে তার বাড়িতে উপস্থিত হলো।
এমনিতেই সারাদিনের এই অদ্ভুত ভ্রমন , হাটায় ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল রাহেলা। ঘরে ঢুকার পর ছেলেটার অনুরোধে আগে থেকেই রান্না করা ভাত-তরকারি খেল তারা দুজন। এবার শরীর যেন অবশ হয়ে এলো পুরোপুরি। দুই চোখে ঘুমের জন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। রান্নাঘরে কাঁথা বিছিয়ে বালিশ ফেলে শুতেই তাই ঘুমের জগতে যেতে সময় লাগলো না তার। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
গভীর রাতে তার পুরো শরীরের ওপর আরেকটা শক্ত শরীরের স্পর্শ অনুভব করতেই শিউরে উঠলো রাহেলা। বিহ্বলভাবে চোখ মেলতেই পাশের ঘরের ডিমলাইটের মৃদু আলোতে তার ওপরে চেপে বসা ছেলেটাকে চিনতে পারলো সে। মুখটা পরিচিত হলেও এই চেহারা সম্পূর্ণ নতুন লাগলো রাহেলার কাছে। সন্ধ্যার পর থেকে যে ছেলেটা তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরেছে , তাকে আপা বলে ডেকেছে সেই ছেলেটার দৃষ্টি এটা না। পৃথিবীর কোনো ভাই তার বোনের দিকে এভাবে তাকাতে পারে না , এই আচরণ করতে পারে না। রাহেলার দুনিয়া উল্টে গেল তার সঙ্গে কী হচ্ছে বুঝতে পেরে। তার ঘুম এখনো কাটেনি , স্বপ্ন নাকি এটা। শরীর এতই ক্লান্ত ছিল যে ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে সরিয়ে দিতে পারলো না। মুখ দিয়ে শব্দ করতে যাবে এক হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরলো ছেলেটা। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে ছেলেটা দিনে আপা বলে ডাকে সে রাতে এতটা হিংস্র হতে পারে। বড়বড় চোখ করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইলো সে। ছেলেটা ম্লান আলোতে তার দু-চোখ বেয়ে পড়া পানি দেখলই না বা দেখার সময়ও পেল না। এখনো তার সাথে এসব ঘটছে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। চিৎকার করার শক্তি নেই তার। আতঙ্কে জ্ঞান হারালো রাহেলা।
ছেলেটা চলে গেল যখন, তখন তার জ্ঞান ছিল। শরীর এত ক্লান্ত হওয়ার পরও বাকি রাত সে দুচোখ বন্ধ করতে পারলো না। চোখ বন্ধ করলেই ছেলেটার হিংস্র চেহারা তার চোখের সামনে ভাসে আর সে কেঁপে ওঠে। দরজা খুলে কেউ যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল টের পায় সে। এক অচেনা ছেলের সাথে এই বাড়িতে আশাটাই তার ভুল ছিল। একবিন্দু নড়ার শক্তিও তার নেই। একজন পুরুষের মানুষ আর পশু দুই রূপের সঙ্গে এই নারীর পূর্বে পরিচয় হওয়ার কথা না। বিষাদে পুরো মন রাতের মতোই আধার হয়ে গেল তার।
সকাল বেলা যখন সে উঠে জামা জড়িয়ে পাশের ঘরে গেল, দেখল কেউ নেই। সে বাথরুমে চলে গেল। নিজের শরীরের প্রতি এক ঘৃণা অনুভব করলো। এখনো ঘোরের মধ্যে কাটছে তার চিন্তা। এই চিন্তায় আমজাদ নেই , আছে শুধু নিজে। হাঁটছে , বসছে কেঁপে কেঁপে।
ফ্রেস হয়ে ঘরের বাইরে বেড়ল না রাহেলা। পাথরের মূর্তির মতো বিছানার ওপর বসে রইলো।
প্রায় দুপুরের দিকে ঘরে ফিরলো ফয়সাল নামের ছেলেটা। এসেই রাহেলার পায়ের কাছে হাটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো :
আমারে মাপ করে দেন , আপা! আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না নিজের ওপর। প্লিজ আপা। এইসব আশেপাশের লোকজন জানলে সব শেষ হয়ে যাবে আমার। আমি গরিব। আমার গ্রামে পরিবার পথে বসে যাবে । আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আপনে আমার বড় আপা, আমারে মাপ করে দেন।
রাহেলা বিহ্বল দৃষ্টিতে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই চেহারার সাথে সেই চেহারা কিছুতেই মেলাতে পারছে না। তার ভেতর কোনো প্রাণ নেই । তাই সে কোনো কথা বলতে পারলো না।
ছেলেটা যে তার পা চেপে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে ছেলেটাকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তার নেই। ছেলেটা আবার ফুপিয়ে উঠে বলল :
প্লিজ আপা! এইবারের মতো আমারে ক্ষমা করেন। আপনি যা বলবেন তাই আমি করবো। প্রয়োজনে আপনার স্বামীরে যেখান থিকা পারি খুঁজে এনে দিব। আপনারে কাজের ব্যবস্থা করে দিব। আপনি চাইলে গ্রামে পৌছাইয়া দিব। প্লিজ আমারে মাপ করেন!
রাহেলা তবুও কথা কথা বলে না। ছেলেটা এবার পকেট থেকে কয়টা পাঁচশ টাকার নোট বের করে রাহেলার পাশে রেখে বলল :
এই টাকা কয়টা রাখেন । লাগলে আরো দিব। আপনি চলে যান।
এবার রাহেলার হুস ফিরলো। চলে যান ! চলে যান! বিড়বিড় করে বলল সে। ফয়সাল ভয় পেয়ে গেল উদ্ভ্রান্তের মতো এই কন্ঠ আর দৃষ্টি শুনে। টাকার দিকে সে ফিরেও তাকালো না। তার এক সেট জামা বাথরুমে পড়ে রইলো। সে রান্নাঘর থেকে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। বোরকা পড়েনি সে। বোরকাও রান্না ঘরে পরে রইলো। চুল উস্কোখুস্ক। বিড়বিড় করে বলছে ” চলে যান ! চলে যান ! ” আর হেটে চলেছে ভয়ংকর এই শহরের একটি গলির রাস্তা দিয়ে। ……………………………
বাংলা প্রাপ্ত বয়স্কদের গল্প
.
যেই রাহেলা এই শহরের প্রতি ভয় কমিয়ে ধীরে ধীরে রোমাঞ্চ অনুভব করতে শুরু করেছিল সেই রাহেলাই এই শহরকে আগের চেয়ে দ্বিগুন ভয় পেয়ে এখন পালাতে চাইছে। সে কী করছে , কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু হাঁটছে। সবকিছু কেমন যেন বিষাদ-মাখা লাগছে । রাতের সেই ভয়ংকর স্মৃতি মোছার জন্য বারবার আমজাদের কথা মনে করতে চাইলেও পারলো না। এই মুহূর্তে খুব কাছের কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু কেউ নেই এখানে তার।
এটা , তার সাথে কী হয়ে গেল। সবাই যদি জেনে যায় এই ঘটনা তাহলে তার কী হবে। সে আমজাদকে মুখ দেখাবে কী করে! গ্রামে ফিরে গিয়ে ভাই-ভাবিকেই বা মুখ দেখাবে কী করে। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরছে। হুস নেই রাহেলার। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকালো। কত মুখ , ইস! একটা পরিচিত মুখ নেই।
সেই ছোট্ট ছেলে রাব্বির দেখা যদি সে পেত! সব রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে সে। চিনে গত সন্ধ্যার সেই জায়গায় যেতে পারবে না সে। বিপদের আশঙ্কা অনুভব করতে করতেই ধীরে ধীরে সজাগ হতে চাইল তার মস্তিস্ক। আবার ভয়াবহ স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই পালাতে চাইল এই জায়গা ছেড়ে যতদূর যাওয়া যায় ততদূরে।
হঠাৎ পেছন থেকে সেই পাষণ্ড ছেলের ডাক শুনে শিউরে উঠলো রাহেলা। পেছনে একবার তাকিয়েই আবার উদ্ভ্রান্তের মতো হাটতে লাগলো। ছেলেটা ছুটে তার দিকে আসছে। তারও ছুটে পালাতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এত মানুষের মাঝে তা করতে সঙ্কোচবোধ করছে। সে উন্মাদ হয়ে যায় নি। তার সুস্থ জ্ঞান আছে। ছেলেটা একেবারে তার কাছে চলে এলো। সে এখন কী করবে! চেঁচিয়ে লোকজনের সাহায্য চাইবে! ছেলেটার দিকে আবার তাকালো রাহেলা , ভয়ংকর মনে হচ্ছে না তো তাকে। কান্নাভেজা চোখ , করুণা প্রার্থনা করে এই মুখ।
ছেলেটার হাতে রাহেলার বোরকা। সে এতক্ষনে নিজের দিকে তাকালো। এত মানুষের মাঝখানে বোরকা ছাড়া এতক্ষন শুধু শাড়ি-কাপড় পরে হেঁটেছে ভাবতেই অস্বস্তি লাগলো। বোরকাটা নিয়ে , রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পরে নিল সে। আবার হাটতে লাগলো। ছেলেটাকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছে সে। ছেলেটা তার পিছু ছাড়ছে না।
আপা , প্লিজ আমারে মাপ করে দেন। আমি এই মুখ কাউরে দেখাতে পারবো না। আমি এই পাপের মূল্য দিতে যে কোনো কিছু করতে পারি। আপনার স্বামীরে আমি পুরো শহর হলেও খুঁজে বের করবো।
রাহেলা কোনো উত্তর দেয় না। হনহন করে হাটতে থাকে। অলি-গলি পেরিয়ে যায় । কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না। অন্তত এই নোংরা ছেলেটার থেকে দূরে যেতে চাইছে সে। ছেলেটার গতি না কমায় দুজনের দূরত্বও কমছে না। ছেলেটা তার স্বামীকে খুঁজে দেয়ার কথা বলতেই তার মনে ক্ষীণ আশার আবির্ভাব হলেও ছেলেটাকে সে আর বিশ্বাস করে না।
ছেলেটাকে তার পিছু নিতে না করার মতো শব্দও তার মুখ দিয়ে বেরোলো না। ঘৃণায় আড়ষ্ট হয়ে রইলো জিহ্বা। এইভাবে আরো অনেকক্ষণ হাটলো রাহেলা। একসময় বুঝতে পারলো তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই , কোনো আশা নেই। ছেলেটা তাকে একটা কাজ জোগাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। নিরাপদ থাকার জায়গার কথা শোনালো। ছেলেটার দিকে না ফিরে তাকিয়ে হাঁটছে আর হাঁটছে সে। মাথা চক্কর দিচ্ছে এবার, চারপাশ আধার আধার হয়ে এলো ক্লান্তিতে। রাহেলা এবার থামলো ছেলেটার দিকে তাকালো।
ছেলেটা রাহেলার ক্লান্ত চোখজোড়া দেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো। অনুধাবন করলো হার মেনে নিয়েছে রাহেলা। যেকোনো মুহূর্তে ঢলে পড়বে। তারপর একটা রিক্সা ডাকলো। রিকশাতে রাহেলাকে উঠতে সাহায্য করলো। রাহেলা জানে না তার সাথে কী হচ্ছে। ছেলেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে । তার শুধু কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। হয় মনু , নয় আমজাদ, নয় মেজভাবি। সেই পথশিশু রাব্বি হলেও হবে। কিন্তু এই পশুর থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছে সে। একটা নিরাপদ আশ্রয়। শরীরে শক্তি নেই যে! ক্লান্তি , অবসাদে তার পুরো শরীর আড়ষ্ট হয়ে এলো।
কতক্ষন মনে নেই রাহেলার। ছেলেটা বিড়বিড় করে পুরো পথে করুনস্বরে তাকে কী বললো তার কিছুই শুনতে পায়নি সে। রিক্সা থামলো একটা বড় বাড়ির গেটের সামনে । ছেলেটার সাথে বাড়ির গেট পেরোলো রাহেলা। রাহেলাকে এবারও মিনতির সুরে বলল :
আপা , আপনি আমাকে মাফ করে দেন। আমি জানি আপনি হয়তো কোনোদিন করবেন না। আমারে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে দেন। এখানে আপনি সবচেয়ে নিরাপদে থাকবেন। এদের ছেলের দেখাশোনার জন্য একটা লোক খুঁজছেন তারা। আপনে এই বাড়িতে কিছুদিন থাকেন , কাজ করেন। আমি আপনার স্বামীরে যেখান থিকা পারি খুঁজে আনবো।
তবুও নীরব রাহেলা। বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই অনেকটা ক্লান্তি দূর হয়ে গেল রাহেলার। বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চারদিকে তাকালো সে। এত সুন্দর আর বড় বাড়ি এতকাছ থেকে সে আগে কখনো দেখেনি। ফুলের বাগান , মাঠ , মাঠের ওপর ছাতার মতো চালের নিচে টেবিল চেয়ার ফেলা । একটা মৎসকন্যার পাথরের মূর্তির পাশ থেকে পানি ঝর্ণার মতো করে পড়ছে।
ছেলেটা বলল , সে এই বাড়িতে টিউশনি করায়। ঐ ছেলেটার দেখাশোনা করার জন্য একটা লোক খুঁজছে বাড়ির ম্যাডাম। ছেলেটা রাহেলাকে তার গ্রামের লোক বলে পরিচয় করিয়ে দিল ম্যাডামকে।
রাহেলা আভিজাত্য আর রূপে ঠাসা এই ম্যাডামের দিকে মুগ্ধ ভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকেই মাথা নিচু করে ফেলল। ম্যাডাম বলল :
মুখোশ সড়াও। কী নাম তোমার?
পুরো পথে ছেলেটার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। কন্ঠটা তাই আড়ষ্ট হয়ে ছিল। বিড়বিড় করে বলল :
রাহেলা।
ছেলেটা কিন্তু তার শহরে আসার পেছনের কারণ কিছুই লুকালো না । বলল কিভাবে স্বামীর খোঁজে গ্রামের এক লোককে ধরে একা শহরে এসে হারিয়ে গিয়েছিল। বাড়িয়ে বলল , সে মেয়েটাকে খুঁজে পায়। আপা বলেই ডাকে। তার গ্রামের মেয়ে যে তা চিনতে তার ভুল হয়নি।
রাহেলা কোনো কথা বলেনা চুপচাপ ঠায় দাঁড়িয়ে রয় । ম্যাডাম বিস্মিত হয়ে বলে :
আচ্ছা বোকা মেয়েতো তুমি ! এমন বোকামি কেউ করে ! ইচ্ছা করে এই শহরে এসে হারিয়ে গেলে কাউকে বুঝি খুঁজে পাওয়া যায় ? কি আশা নিয়ে এই ভরসা , বিশ্বাস পেলে তুমি? সেতো মনে হচ্ছে স্বেচ্ছায় তোমাকে ত্যাগ করেছে। তার ছবি আছে কোনো ?
ম্যাডামের কথাগুলোতে ঝাঁজ ছিল না । ছিল মায়া আর কৌতূহলতা। রাহেলা না সূচক মাথা নাড়লো। ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন ,
তবে ?
রাহেলার আর কিছু বলার নেই। মেয়েটি তার সাথে কথা বলতে সংকোচ বোধ করছে বুঝতে পেরে ম্যাডাম এবার ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন :
সে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে না কেন ?
কোন মুখে ফিরে যাবে বলছে। তাছাড়া সেখানে আপন কেউ নেই। মা-বাবা ভাই-বোন সবাই মৃত।
আন্দাজে বলল ফয়সাল। রাহেলা শুধু একবার তার দিকে চাইতেই চোখ নামিয়ে নিল। ম্যাডাম আবার বললো , এমন গোমড়া হয়ে থাকলে চলবে না। হাসিখুশি থাকতে হবে। আমি চাই আমার ছেলেটা হাসি-খুশি মানুষের সঙ্গে মিশুক।
রাহেলার সরল মুখায়ব দেখে তাকে প্রথমেই পছন্দ করে রেখেছিলাম গৃহকর্ত্রী। এবার বললেন , যাও ভেতরে । মন্টুর মা তোমাকে ঘর দেখিয়ে দেবে। ক্লান্ত মনে হচ্ছে। কিছু খেয়ে নিও। আমি মন্টুর মাকে বলে দিচ্ছি। মন্টুর মা?
মাঝবয়সী এক মহিলা এসে রাহেলাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ফয়সাল ভয়ে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে জানে রাহেলা যদি এই ম্যাডামের কাছে একবার গত রাতের কথা প্রকাশ করে দেয় তাহলে নিশ্চিত তাকে জেলে মরতে হবে। তবুও সে এই বাড়িতেই তাকে আনলো। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। ম্যাডামের অনুরোধেও তাই বাড়ির ভেতর গেল না। নিজের বাড়ির পথে রওনা হলো।
শুরু হলো রাহেলার জীবন নতুন করে। সেই মানসিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে যদিও সময় লাগলো। কিন্তু ধীরে ধীরে এই বাড়ির সঙ্গে মানিয়ে নিল সে। এরা বড়লোক হলেও এদের ভেতর কোনো অহংকার নেই। স্যার, ম্যাডাম এমন কী যে ছেলেটার দেখাশোনা করার জন্য তাকে রাখা হলো তার প্রতি সবার আচরণে মুগ্ধ হলো সে। বাড়ির কর্তা লোকটাও কয়েকবার তার স্বামী প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। চেহারা গায়ের রং জেনে নিয়েছেন।
ফয়সাল নামের ছেলেটা রাহেলাকে এখানে এনে দেওয়ার কয়দিন পরই এই বাড়ির টিউশনি ছেড়ে দিল। বাড়ির কর্ত্রী খুব অবাক হলেও ছেলেটা স্বাভাবিক ভাবে বলেছিল জায়গা বদল করছে সে তাই এখানে এসে পড়ানো সম্ভব না। তারপরেও মাঝেমধ্যে রাহেলাকে দেখতে , তার খোঁজ খবর জানতে এই বাড়িতে আসতো ছেলেটা। রাহেলা যতটা সম্ভন দূরে সরে থাকতো। এমন কী ছেলেটা তার স্বামীকে নিয়ে কথা বললেও বিদঘুটে লাগতো , এক রকম অস্বস্তিতে ভুগতো। ভয়ার্ত এক স্মৃতির জন্ম দিয়েছে যে ছেলেটা তার ভেতর।
একদিন ফয়সাল তার এক আর্টিস্ট বন্ধুকে নিয়ে এলো। বাড়ির কর্ত্রীর কাছে বলল :
আমি , রাহেলা আপার স্বামীর একটা স্কেচ করাতে চাচ্ছি। দেখি চেহারা কেমন যদি জানতে পারি তবুও খুঁজে পাওয়ার একটা ক্ষীণ আশাতো থাকবে!
বাড়ির কর্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন ছেলেটার প্রতি আবারও ভালোবাসা অনুভব করলেন। একজন পরনারীর জন্য ছেলেটা যা করছে তা সত্যিই তাকে আনন্দ দেয়। হোক এক গ্রামের মেয়ে। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরও রাহেলার স্বামীকে খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে আছে ছেলেটা।
ফয়সালের আর্টিস্ট বন্ধু আধা ঘন্টা ধরে রাহেলার বর্ণনা অনুসারে একটা স্কেচ দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু রাহেলার পর্যবেক্ষণ বা বর্ণনা এতই কাঁচা যে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে উঠে যায় সে । ফয়সালকে জানায় এই কাজ তার দ্বারা হবে না। ফয়সালের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা না করে বাড়ি থেকে চলে যায়।
সময় কাটতে থাকে। রাহেলা আমজাদের কথা সব-সময় এখনো ভাবে। কিন্তু ২ মাস এখানে থেকে নতুন করে অনেক কিছুই উপলব্ধি করতে পারে সে। আমজাদকে খুঁজে পাওয়া যে খুব সহজ কাজ না, এই শহরের সব মানুষের লিস্ট বলে যে কিছু নেই , ঢাকা শহর যে কেবল একটা ছোট্ট জায়গা নয় এমন অনেক কিছু অনুধাবন করতে পারে সে। এই বাড়ির ম্যাডামের সঙ্গে খুব সামান্য কথা হলেও রাহেলা বুঝতে পারে তিনি খুব বুদ্ধিমান। প্রচুর পড়ালেখা জানা মেয়ে।
আলম মিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত খুটিয়ে জেনে নেয় রাহেলার কাছ থেকে ফরিদা বেগম। এবং সে যে নারী পাচারের দালাল ছিল এবং পুলিশ তাকে না ধরলে এতক্ষনে রাহেলার কী অবস্থা হতো তা অনুমান করতে বেশি মাথা খাটাতে হয় না তার। ভাগ্যিস ফয়সালের হাতে পড়েছিল , নইলে যে আর কী বিপদে পড়তো মেয়েটা। মানুষ যে এতটা বোকা , সহজ , সরল হতে পারে তা বিশ্বাসই করতে পারতেন না ফরিদা বেগম যদি না সামনাসামনি রাহেলাকে দেখতেন।
মেয়েটার জন্য একটা টান অনুভব করেন তিনি। চান কোনো একটা উপকার করতে। কিন্তু মেয়েটা তার স্বামী সম্পর্কে এমন কোনো তথ্যই জানে না যার মাধ্যমে তাকে খুঁজতে শুরু করবে সে। এমন কী এটাও নিশ্চিত না ঢাকাতেই আছে সে। ফয়সালেরও যে কী হলো তার ফোন বন্ধ। কিছুদিন যোগাযোগ রেখে রাহেলার স্বামীর অনুসন্ধানের তদবির করলেও অনেকদিন ধরে এই বাড়িতে আসে না সে। রাহেলা যে ফয়সালকে দেখে কেমন সংকুচিত হয়ে যায় তা তার নজরে পড়েছে। কিন্তু এরমধ্যে জটিল কিছু থাকতে পারে এমন চিন্তা তার মাথায় আসেনি। তার ৮ বছরের ছেলে সবুজও এই রাহেলাকে খুব পছন্দ করে। তার অনেক কথাই না শুনলেও রাহেলার কথা শোনে ।
তাই তিনি ভাবলেন , থাকুক মেয়েটা এখানে। যতদিন থাকতে চায়। তিনি বা তার স্বামী সারাদিন বাড়িতে থাকেন না। সবুজের দেখা-শোনাটাতো অনায়াসে করছে রাহেলা।
এভাবে আরো কয়েক মাস গেলো। এখন নিজের বাড়িই যেন হয়ে গেছে এটা রাহেলার। তার সঙ্গে কেউই এখানে কাজের লোকের মতো ব্যবহার করে না। সবুজের প্রতি আশ্চর্য এক রকম মায়াও জন্মে গেছে তার। মাঝেমধ্যে গ্রামের কথা , ভাইয়া-ভাবী মনুর কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া ম্যাডাম জানে গ্রামে তার আপন কেউ নেই। যদি জানে সে মিথ্যা কথা বলছে হয়তো তাড়িয়েও দিতে পারে।
ম্যাডাম তার গ্রাম , ফয়সালের বাড়ি কতদূর তাদের বাড়ি থেকে ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলতেই সে চুপসে যায়। এমন কোনো রাত নেই অবশ্য আমজাদকে তার মনে পড়ে না ।
আরো ৩ বছর পেরিয়ে যায়। এখন পাকাপোক্ত এই বাড়ির লোক রাহেলা। এই বাড়ি , সবুজ , স্যার – ম্যাডাম , মন্টুর মা , বাড়ির কেয়ার টেকার আবুল ভাই , দারোয়ান জামসেদ ভাই, মালি রজব চাচা এর বাইরে তার আর দুনিয়া নেই । তার মন এরমধ্যেই বিচরণ করে। খুব একটা বাড়ির বাইরে যাওয়া লাগে না তার।
মন্টুর মায়ের সঙ্গে যদিও বা একটু যায়। রাস্তায় হাঁটার সময় বুক ধকধক করে। আড়চোখে পরপুরুষের দিকে তাকায়। শুধু একটা পরিচিত মুখ দেখতে পাবে এই আশায়। আমজাদের মুখ ভর্তি হয়তো দাড়ি , হয়তো আরেকটু মোটা হয়েছে সে। রাহেলা যেমন আমজাদকে খুঁজছে । আমজাদও হয়তো তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ যদি চলতে চলতে কোনো একদিন আমজাদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যায় কী বলবে সে। ভাবতে থাকে। এখনো মাঝরাতে একটা সংসারের স্বপ্নে বিভর থাকে রাহেলা , জানে না আমজাদ কী করে জানবে সে এখানে আছে, তবুও আশায় থাকে খুঁজে খুঁজে একদিন হয়তো এখানে চলে আসবে আমজাদ , তাকে নিয়ে চলে যাবে নতুন ঘরে। যে বাড়ির কর্ত্রী হবে সে। মাসিক বাজারের লিস্ট করবে সে। সৃষ্টি কর্তার করুণায় হয়তো মনু কিংবা রাব্বি কিংবা এই সবুজের মতো ফুটফুটে একটা সন্তান হবে তার।
___________________________________________
গল্পটাকে এখানেই শেষ করে দেওয়া হলো। কিন্তু রাহেলার রাত-দিন কী এখানেই সমাপ্ত হবে ? না! সে আরো দীর্ঘদিন বাঁচবে। সে একটা আশ্রয় পেয়েছে এখন। এখন তার স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়। আমজাদকে দুনিয়ার আর কেউ না চিনলেও রাহেলা চেনে। আমজাদ বোকা , স্বপ্নবাজ , অকর্মা হতে পারে। কিন্তু জোচ্চোর না , বিশ্বাসঘাতক না। এই বিশ্বাস তার মনে না থাকলে এতদিন বেঁচে থাকতে পারতো না রাহেলা। বা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার মতো মনোবলও পেত না।
একবার ভেবেছিলাম রাহেলাকে আবার কিছু সময়ের জন্য গ্রামে পাঠাতে। ভাগ্যিস পাঠাইনি। এই দুঃখী , সরল মেয়েটার জীবনে দুঃখ আর বাড়িয়ে লাভ কী! তার স্বপ্ন -আশা এর খুন করার আমি কে? কিছু সত্য তার অগোচরেই থাক না! সে তার বাকি জীবনে আর গ্রামে ফিরে যায়নি। জানতে পারেনি তার জীবনের কঠিন সত্যটা।
সে যদি ফিরে যেত তাহলে দেখতো তার মেজো ভাইয়ের সাজানো গোছানো সংসারটি আর নেই। গ্রামের ধান ক্ষেতের আইলে ৭-৮ বছরের একটা ছেলের ছেড়া একটা নোংরা প্যান্ট আর খালি গা নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো, সব-সময় আতংক নিয়ে ছুটে চলা ছেলেটা যে তার সেই অর্ধেক ভালোবাসা পাওয়া মেজো ভাবীর ছেলে মনু তাও সে চিনতে পারতো না। যার মুখ দেখলেই এখন সবাই ” জারজ” “জারজ” বলে খেপিয়ে তোলে , তাড়িয়ে দেয়। মেজো ভাবি জেল-খানায়। মেজো ভাই ব্যবসা ছোট আর বড় ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে সারাদিন ঘরে বসে নেশা করে।
আমজাদ নিখোঁজ হওয়ার আগের দিনে মেজো ভাবি তার জীবনের সমস্ত গোপন কথা মেজো ভাবীর আপন বড় ভাইয়ের কাছে প্রকাশ করে । তার বড় ভাই তার ওপর রাগ করে না। বুঝতে পারে এছাড়া এই সংসারে টিকে থাকার আর কোনো পথ খোলা ছিল না। শুধু এখন তার বোন-জামাতা আর অন্য কেউ এই কথা না জানলেই হলো।
রাহেলার মতো আমজাদও যখন গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিল রাহেলা তার জন্য জীবনে কত কিছু করেছে। এই সুযোগ তাকে একটু সুখের মুখ দেখানোর। এই গয়না-টাকা আর রাহেলাকে নিয়ে কালই ঢাকায় চলে যাবে। এমন সময় বাড়ির বাইরে মেজ ভাবীর ডাক শুনে আমজাদ বাইরে বেরোয়। ভাবীর পেছন নিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে যায়। ভাবি তাকে দাঁড়াতে বলে কোথায় গেল ! এমন সময় মাথার পেছনে ভারী কিছু একটার আঘাত পায়। শেষবারের মতো দুনিয়াকে ঝাপসা দেখে। তার লাশের সাথে সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে আনা আমজাদের সমস্ত জামা-কাপড়ও পুঁতে ফেলা হয়। গয়না গুলোও পুঁতে ফেলা হয় তার সাথে। চারদিকে সেই লোক দিয়ে ছড়িয়ে দেয় ঢাকায় যাওয়ার গাড়িতে উঠতে দেখেছে আমজাদকে।
মেজো ভাবীর বড় ভাই যার সাহায্য নিয়ে কাজটি করেছিল সে অনেকদিন পর অন্য একটা মামলায় ধরা পড়ে তার পূর্বের এই অপরাধের কথা স্বীকার করে। সাথে সাথেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় পুরো গ্রামে।গ্রামের এমন কোনো মানুষ নেই সেদিন মাটিখুড়ে আমজাদের কঙ্কাল তোলার সাক্ষী হয়নি । ও ! শুধু একটি মেয়ে বাদে। সে তখন শহরের রাস্তা দিয়ে মন্টুর মা নামে পরিচিত এক মহিলার সাথে হাটতে হাটতে আড়চোখে পর-পুরুষের দিকে তাকিয়ে পরিচিত একটা মুখায়ব মেলানোর চেষ্টা করছিল।
• * * * সমাপ্ত * * *
লেখা: #Masud_Rana