ঋণ পর্ব ১
আজ আমার জীবনের একটা গোপন ঘটনা বলবো। ঘটনাটা ঘটেছে আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে এই ‘ঝিলমিল কাবাব ঘরে’। মূল ঘটনাটা বলার আগে আমার অতীতের কথা একটু বলা প্রয়োজন তাহলে ঘটনাটা বুঝতে সুবিধা হবে।
আমি ছিলাম গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের বড় সন্তান। আমার ছোট আরো তিন ভাইবোন। আমার বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন হঠাৎ একদিন আমার আব্বা দুই দিনের জ্বরে মারা যান। আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে আমরা ভীষণ আর্থিক অনটনে পড়ে গেলাম। আমি পড়ালেখা বন্ধ করে একটা কারখানায় কাজ নিলাম। আমার স্কুলের শিক্ষকরা আম্মাকে এসে বললেন, ‘আসিফের মত একটি ছেলের পড়ালেখা বন্ধ করা যাবে না। আমরা ওর পড়ালেখার ভাড় নিলাম।’
আম্মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ওর আব্বারও বড় শখ ছিলো ছেলেরে এমএ পাশ করাবে। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে তা হলো না।’
শিক্ষকরা বললেন, ‘ আপনি চিন্তা করবেন না। ও বাবার ইচ্ছা পূরণ করবে।’
‘কিন্তু আমার সংসার চলবে কেমনে?’
শিক্ষকরা বললেন, ‘আমরা আপনাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিবো। সেটা দিয়ে আপনি আয় করবেন। তাছাড়া যতদিন আসিফ নিজে কিছু না করবে আমরা আপনাকে প্রতিমাসে কিছু টাকাও দিবো’।
আমার স্যারদের সহায়তায় আমি আবার কলেজে ফিরে এলাম। আমাদের সংসারটাও খেয়ে পরে চলতে পারলো।
আমি কলেজ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। প্রথম বছর থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি শুরু করলাম। টিউশনি করে নিজে চলতাম, বাড়ীতে টাকা পাঠাতাম। এভাবে অনার্স শেষ করলাম। কিন্তু ফলাফল খুব ভালো করতে পারলাম না। কোনরকম টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাশ পেলাম। মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। বিভিন্ন জায়গায় চাকরীর চেষ্টা শুরু করলাম, পাশাপাশি টিউশনি চলতে থাকলো।
একদিন একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘গৃহ শিক্ষক চাই’ বিজ্ঞপ্তি দেখে সেই বাসায় গেলাম। বাসাটি মিরপুরে। ভেবেছিলাম এটি কোন এপার্টমেন্ট হবে। কিন্তু বাসার সামনে এসে দেখলাম পুরনো একটি দোতলা বাড়ি। এই বাড়ির ছেলেটিকে পড়ানোর জন্য আমাকে গৃহ শিক্ষক রাখা হলো। ছেলেটির নাম সিয়াম। ও পন্চম শ্রেণীতে পড়ে। আমি সাধারণত এত ছোট ক্লাশের ছাত্র পড়াই না কিন্তু বেতনের পরিমাণ বড় অংকের হওয়ায় আমি রাজী হয়ে গেলাম। আমি সপ্তাহে চারদিন সন্ধ্যায় সিয়ামকে পড়াই।
সন্ধ্যায় যখন সিয়ামদের বাসায় ঢুকি তখন চারিদিকে একদম নিরব থাকে। বাইরের গেটে কোন দারোয়ান নেই। গেটটা ভিতর থেকে তালা দেয়া থাকে। গেটের পাশে কলিং বেলের সুইচ আছে। কলিং বেল বাজালে ভিতর থেকে কেউ চাবি নিয়ে যেয়ে দরজা খুলে দেয়। বেশীরভাগ সময় সিয়ামই যেয়ে তালা খুলে দেয়। মাঝে মাঝে সিয়ামের আম্মাও খুলেন। একদিন ওর বড় বোন গেটটা খুলে দিয়েছিলো। ওর বাবাকে অবশ্য কখনো দেখিনি। চাকরীর জন্য প্রথমদিন এসেও সিয়ামের আম্মার সাথেই কথা বলেছিলাম। তবে দু’একদিন পড়ানোর সময় অন্য ঘরে বেশ ভারী গলার আওয়াজ পাই। সেসব দিনে সিয়াম বেশ চুপচাপ থাকে, পড়ার বাইরে একটি কথাও বলে না। আমি যদি বলি, ‘How was the day?’ ও মুখের উপরে আঙ্গুল দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘আজকে আব্বু বাসায়। আজকে কোন কথা বলা যাবে না’।
সিয়ামের আম্মা দেখতে খুব সুন্দর। আমি বয়স আন্দাজ করতে পারতাম না। হয়তো পয়ত্রিশ বা চল্লিশ হবে। সালোয়ার কামিজ পরেন, হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় না তার দুটি ছেলেমেয়ে আছে। দেখলে মনে হয় কলেজ পড়ুয়া কোন মেয়ে। সিয়ামের বোনটা সেই তুলনায় দেখতে সাধারণ। আমি গত তিন মাসে মাত্র একদিনই দেখেছি। গায়ের রঙটা ফর্সা হলেও মায়ের মত সুন্দর মুখের গড়নটি পায়নি। আমার অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। ছাত্র পড়াই, বেতন পাই। ব্যাস এতটুকুই। তবে মাঝে মাঝে বেশ সুস্বাদু নাস্তা দিতো। একদিন ফুলকপির রোস্ট আর লাচ্ছা পরাটা দিলো। সিয়াম খুব আগ্রহ নিয়ে বললো, ‘এগুলি আপু রান্না করেছে।’
আমি নির্লিপ্তভাবে বললাম, ‘তাই?’
অনেকদিন টিউশনি করে আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ছাত্রের বোনের ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখানো যাবে না। তাই আমি চুপচাপ খাচ্ছি। আমাকে নিরব দেখে সিয়াম নিজেই আগ্রহ নিয়ে বললো,
‘আব্বু বেঁচে থাকতে আপু অনেক মজার মজার খাবার বানাতো।এখন আর বানায় না। এখনতো আপু আর কিছুই করে না।’
আমি একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার আব্বু বেঁচে নেই? তাহলে উনি কে যাকে তুমি আব্বু বলো?’
সিয়াম বিষন্নভাবে বললো, ‘উনি আমার সৎ বাবা। দুই বছর আগে আমার আব্বু ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে। আমার আম্মু গত বছর এই আব্বুকে বিয়ে করেছে।’
সিয়ামের মুখে তীব্র কষ্টের ছায়া দেখে আমি মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেলাম কিন্তু মুখে কোন কথা বললাম না। ওদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আগ্রহ দেখানো আমার সাজে না। সিয়াম নিজে থেকেই বলতে লাগলো, ‘আগে আমরা উত্তরায় থাকতাম। ভাড়া বাসায়। এটা আমার সৎ আব্বার বাসা।’
আমি দ্রুত খাওয়া শেষ করে সিয়ামকে বললাম, ‘ঠিক আছে সিয়াম, এখন তোমার অংক বইটি বের করো; আগামীকাল তোমার ক্লাশ টেস্ট।’
একদিন সিয়ামকে পড়ানো শেষ করে বের হবো দেখি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অসময়ের বৃষ্টি। আমি কোন ছাতা সঙ্গে আনিনি। এখান থেকে বের হয়ে বাসস্টপে যেতে আমি একদম ভিজে যাবো। এরপরে আমার আরো একটা টিউশনি আছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিলাম এমন সময় সিয়ামের বোনটা বের হলো। আমার দিকে একটা ছাতা এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘কালকে ফেরত নিয়ে এসেন।’ আমি লক্ষ্য করলাম মেয়েটার একটি হাত একটু ছোট এবং চিকন। আমরা গ্রামের মানুষ এ ধরনের হাতের মানুষকে বলি ‘নুলা’। আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম, চোখ দুটি ভীষণ কষ্টে ভরা। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। মনে হয় বাড়ীতে আর কেউ নেই। আমি ছাতাটি হাতে নিয়ে দ্রুত রাস্তায় চলে এলাম।
পরের দিন কি মনে করে আমি নিজেই সিয়ামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার বোন কি পড়ে?’ সিয়াম বললো, ‘আপু এখন কিছুই পড়ে না। আগে কলেজে পড়তো। আব্বু পড়া বন্ধ করে দিয়েছে।’ আমি নিজের কৌতুহল দমন করতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার আম্মু কিছু বলেন না?’ সিয়ামের চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। মাথা নীচু করে বললো, ‘ আম্মু কিছু বললে আব্বু আম্মুকে খুব মারে।’ আমি হতবাক হয়ে গেলাম। সিয়ামের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। আমি ওর মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিলাম। ও পড়ায় আর মন দিতে পারলো না। আমিও জোর করলাম না। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসাও করলাম না। এর কয়েকদিন পরে একদিন পড়া শেষে সিয়াম গেট বন্ধ করতে এসে আমাকে একটা ছোট খাম দিলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কি?’
‘আমি জানি না’
‘তুমি জানো না? তাহলে আমাকে দিচ্ছ কেন?’
‘ আপু আপনাকে দিতে বলেছে।’
আমি খামটা দ্রুত পকেটে রেখে দিয়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে এলাম। কিছুদূর এসে খামটি খুললাম। খামের ভিতরে চারজনের একটি হাস্যজ্জল ছবি। ছবির পিছনে লিখা আব্বু, আম্মু, সামিরা এবং সিয়াম। আমি বুঝতে পারলাম সিয়ামের বোনের নাম সামিরা আর এটি ওর আব্বুর সাথে তোলা ছবি। ছবিটার সাথে একটা চিঠি। আমি চিঠিটি পড়ার খুব আগ্রহ বোধ করলাম যদিও সিয়ামের বোনের প্রতি সহানুভূতি ছাড়া আমার আর কোন আবেগ তৈরী হয়নি। তারপরেও একটি মেয়ের চিঠি অবজ্ঞা করার মত বয়স আমার তখন ছিলো না। চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরলাম। সাদা একটা কাগজে শুধু একটি বাক্য লিখা, “আমাকে বাঁচান”। আমার কৌতুহল, উৎসাহ সব নিমিষে উড়ে গেলো। মনে হলো এ আমি কোন বিপদে পড়লাম। আমি দরিদ্র পরিবারের ছেলে। আমার দিকে আমার মা এবং ভাই বোনেরা তাকিয়ে আছে। আমি একটা চাকরীর জন্য প্রাণপন চেষ্টা করছি। ভাই বোনদের পড়ালেখা করাতে হবে, বোনদের বিয়ে দিতে হবে। সামিরার মত একটি মেয়েকে কোন বিপদ থেকেই বাঁচানোর ক্ষমতা আমার নেই।
চলবে………..
গল্পঃ ঋণ
কলমেঃ কাজী আজমিরী
বনানী, ঢাকা।
ঋণ (পর্ব-২)
আমি দুদিন সিয়ামকে পড়াতে গেলাম না। মোবাইলটা সুইচ অফ করে রাখলাম। এ মাসে সিয়াম ছাড়া আমার আর কোন টিউশনি নেই। এ টাকাটা আমার খুব দরকার। ছোট বোনটা এইচএসসি দিবে। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। প্রাইভেট স্যারের কাছে পড়তে হয়। আমি টাকা না পাঠালে স্যারের বেতন দিতে পারবে না। এসব আগ পাছ ভেবে আমি সিয়ামদের বাসায় গেলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম সিয়ামের বোনের ব্যাপারে কঠোর হবো, কোন কিছুই প্রশ্রয় দিবো না।
আমাকে দেখে সিয়াম কিছুই বললো না। যেন গত দুইদিন আমার না আসাটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। সিয়াম মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, আমার হঠাৎ কি হলো আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার বোনের হাতে কি হয়েছিলো?’
‘কিছু হয়নি। জন্ম থেকেই আপুর হাত এমন।’
‘তোমরা এখানে কেন থাকো? তোমার দাদা দাদী নেই?’
আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি আমার নিজের কথায়। আমি কেন যে এসব জানতে চাচ্ছি আমি বুঝতে পারছি না। সিয়াম বললো, ‘দাদা দাদী বেঁচে নেই। চাচারা আমাদের বাড়ীতে থাকতে দেয় না। মামারাও উনাদের বাড়ীতে না যেতে বলেছে।’
আমার মনে আরো অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। নিজেকে খুব কষ্টে সংবরণ করলাম। পড়তে পড়তে হঠাৎ খুব বৃষ্টি নামলো। আজও আমার ব্যাগে ছাতা নেই। তবে পড়া শেষ করে আজ আর আমি অপেক্ষা করলাম না, গেটের দিকে হাঁটা ধরলাম। হঠাৎ পিছনে একটা মেয়ের গলা শুনতে পেলাম, ‘একটু দাঁড়ান প্লিজ’। আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি সামিরা দৌড়ে এসেছে। আমি ভাবলাম ও হয়তো আমাকে ছাতাটা দিতে এসেছে কিন্তু না। ও কাছে এসেই আমার দুই পা জড়িয়ে ধরলো, ‘আমাকে বাঁচান। গত এক মাস ধরে লোকটা রাতে আমার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। আমি বড় বিপদে আছি। আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচান।’
আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্ববল হয়ে গেলাম। আমি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘কোন লোকটা?’
সামিরা আমার পায়ের উপরে পড়ে থেকেই বললো, ‘আমরা এখন যাকে আব্বু বলে ডাকি’।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ও কাঁদছে আর বলছে, ‘আমি কিভাবে ঐ লোকটার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবো? আমাকে কোথাও যেতে দেয় না। আমি ঘরে বন্দী।’
আমি যন্ত্রচালিতভাবে বললাম, ‘আপনার আম্মু?’
‘আম্মুকে জানিয়ে কোন লাভ নেই। আম্মুও খুব অসহায়। আম্মু কিছুই করতে পারবে না। আম্মুকে উনি উনার বিভিন্ন পার্টিতে নিয়ে কাজ আদায়ে কাজে লাগায়। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় আম্মু পার্টিতে যায়। অনেক রাতে ফিরে পাগলের মত ঘুমায়।’
আমি যেন স্হির হয়ে গেলাম। মেয়েটিকে কি বলবো আমি বুঝতে পারছি না। যদিও মেয়েটির ভয়াবহ বিপদের বিষয়টা আমাকে স্পর্শ করছে কিন্তু আমি যে নিরুপায়। আমাকে নিরব দেখে সামিরাই বললো, ‘প্লিজ আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান।’
আমি ওর এই কথাটায় যেন বাস্তবে ফিরে এলাম। আমি বললাম, ‘আপনাকে নিয়ে যাওয়ার কোন জায়গা আমার নাই। আপনি চাইলে আমি আপনাকে আপনার কোন আত্মীয়ের বাসায় দিয়ে আসতে পারি।’
এ কথা শুনে সামিরা আরো জোড়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘তেমন কেউ যদি থাকতো আমি অনেক আগেই চলে যেতাম।’
বৃষ্টির তোড় বাড়তে লাগলো। আমি গেটের দিকে তাকালাম। একটা খালি রিক্সা যাচ্ছে। আমি হাত উঁচু করে রিক্সাটা ডাকলাম। ওর হাত থেকে পা ছাড়িয়ে রিক্সায় যেয়ে উঠলাম। সামিরাও আমার পাশে যেয়ে বসলো। আমি ‘না’ বলতে পারলাম না। রিক্সাটা সামনে টান দেয়ার আগে বাড়ীটার দিকে তাকালাম দেখলাম সিয়াম দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর হাত নেড়ে আপুকে বিদায় দিচ্ছে। রিক্সাওয়ালা হুটটা তুলে দিয়ে প্লাস্টিকের পর্দা টেনে দিয়ে রিক্সা সামনের দিকে টান দিয়ে বললো, ‘কই যাইবেন স্যার?’ আমি জানি না সামিরাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকি। সেখানে কোন মেয়েকে নিয়ে যাওয়া যায় না। কোন আত্মীয় বা বন্ধু কারো কাছেই ওকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
আমি সামিরার মুখের দিকে তাকালাম ও কোন সমাধান দিতে পারে কিনা সেজন্য। তাকিয়ে দেখলাম ও নিরবে কাঁদছে। আমি তাকানোমাত্র ওর কান্নার তোড় আরো বেড়ে গেলো। ঠিক তখনি বিদ্যুৎ চমকানির সাথে বিকট শব্দে বাজ পড়লো। রিক্সাওয়ালা রাস্তার একপাশে রিক্সা থামিয়ে ফেললো। বিরক্ত মুখে বললো, ‘বাজ পড়তেছে। আকাশের অবস্হা আরো খারাপ হইতেছে। আপনারা যাইবেন কই বলেন। আপনাদের নামায় দিয়ে গাড়ী গেরেজে তুলমু।’ আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। এর মধ্যে আরো একবার বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে বাজ পড়লো। বিদ্যুৎ-এর সেই আলোর চমকে হঠাৎ আমার একটি মুখই মনে পড়লো, আমার সকল ভরসার স্হল- আমার আম্মা। আমি রিক্সাওয়ালাকে অনুনয় করে বললাম, ‘ভাই, কষ্ট করে আমাদের একটু গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দাও।’
ভোররাতে বাড়ীতে যেয়ে পৌঁছালাম। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে এত গভীর রাতে আমাকে দেখে সবাই ভূত দেখার মত চমকে উঠলো। আমার ছোট ভাইটা দরজা খুলেছিলো। ও চিৎকার করে বললো, ‘ভাইজান, আপনি?’ ওর চিৎকারে সবাই দৌড়ে এলো। আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরতে যেয়ে আমার পিছনে সামিরাকে দেখে আঁতকে উঠলো, ‘তুই বিয়ে করছিস?’ তারপর আমি কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো। আম্মাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুখে পানির ছিটা দিচ্ছিলাম। সামিরা ঘরের দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ছাট ওর গায়ে লাগছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি ভিতরে আসুন। আমার আম্মা ভুল বুঝেছে। কিছু মনে করবেন না।’ আমার কথায় আমার তিন ভাইবোনই আমার দিকে ঘুরে তাকালো। ছোট বোন বলে উঠলো, ‘ভাইজান, আপনি বিয়ে করেন নাই?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘নারে। আম্মার অনুমতি ছাড়া আমি বিয়ে করবো তোরা এটা ভাবলি কিভাবে?’
বড় বোনটা বললো, ‘তাহলে উনি কে? এত রাতে এভাবে আপনার সঙ্গে এসেছে।’
‘উনি খুব বিপদে পড়েছে। তাই এসেছে। দুদিন পরেই চলে যাবে।’
আমার কথার সঙ্গে সঙ্গে সামিরা বলে উঠলো, ‘না না আমি যাবো না। আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না প্লিজ।’
ভাইবোনেরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। আম্মার জ্ঞান ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে। আমি আম্মার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ‘আম্মা, আমি বিয়ে করি নাই।’
আম্মা কেমন যেন অস্বাভাবিকভাবে মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা বাবা, ভালো ভালো। আমি বিয়ে দিয়ে দিবো।’ বলেই মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, ‘আসো মা, কাছে আসো’। সামিরা আমার আম্মার কাছে এগিয়ে গেলো। আম্মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। সামিরা আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আম্মা ওকে আদর করে কপালে চুমু দিয়ে বললো, ‘ আমি তোমাদের বিয়ে কালই দিয়ে দিবো।’ তারপর আমার ছোট ভাইর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোর বড় মামারে খবর দে।তোর ফুফুরেও আসতে ক।’
আম্মার এ সব আচরণ দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। আমি বলতে চাচ্ছি, ‘আম্মা, আপনি এসব কি বলছেন? ওর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই।’ কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোন স্বর বের হচ্ছে না। আমি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছি।
চলবে…….
গল্পঃ ঋণ
কলমেঃ কাজী আজমিরী
বনানী, ঢাকা।
ঋণ (পর্ব-৩)
দুপুরের মধ্যে মামা এবং ফুফু চলে এলো। মামা এসে প্রথমেই বললো, ‘আসিফের পড়া শেষ হইলো না এখনি বিয়ে দেওয়ার দরকার পড়লো কেন? ও পড়া শেষ করুক, চাকরী বাকরী করুক তারপর বিয়াটা দিও।’
আম্মা তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল। মামার মন্তব্যের উত্তরে সে বললো, ‘ বড় ভাইজান, শুভ কাজে দেরী করার দরকার নাই।’
মামা আমতা আমতা করতে লাগলো, ‘কার মাইয়া, বংশ পরিচয় কি এসব একটু খোঁজ খবর নেওন দরকার ছিলো।’
‘ এসব খবর নিয়া কি করবেন? আমার ছেলে মাইয়া পছন্দ করছে সেইটা আমি মাইনা নিছি।’
ফুফু এসে সামিরাকে দেখে কান্না শুরু করলো, ‘ভাবী, আমাগো বংশের প্রথম ছেলের সাথে একটা নুলা মাইয়ার বিয়া দিবেন?’
আম্মা মুখ শক্ত করে বললো, ‘বানু, থামোতো। এইসব আজেবাজে কথা বলবা না। আমার আসিফ যদি এরচেয়েও খারাপ মাইয়া আনতো আমি তারেই মাথায় তুইলা নিতাম।’
ফুফু আর কথা বাড়ালো না।
আম্মার আচরণে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। আম্মা ধরেই নিয়েছে সামিরাকে আমি ভালোবাসি এবং ওর বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো তাই ও আমার সাথে পালিয়ে চলে এসেছে। আমি বুঝতে পারছি যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না, আম্মার ভুল ধারণাটাও ভাঙ্গিয়ে দেয়া উচিত কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারছি না। আমার সারা জীবনে আম্মাকে এত খুশী হতে খুব কম দেখেছি। সেই খুশী দেখে আমি যন্ত্রচালিত পুতুল হয়ে গেছি, যে যা বলছে তাই করছি। আম্মার খুশী দেখে আমার ছোট ভাই বোনেরাও আনন্দে মেতে উঠেছে। ছোট ভাইটা দায়িত্ব নিয়ে সব আয়োজন করছে। বোনেরা এরই মধ্যে হলুদ বেটে সামিরার মুখে হাতে লাগিয়ে গোসল করানোর আয়োজন করছে। আমি অবাক হয়ে সামিরাকেও দেখছি। সে একেবারে নিশ্চুপ। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো সত্যি কথাটা সবাইকে বলবে, আমার মত সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটা ছেলের সাথে হুট করে বিয়েটা আটকাবে। কিন্তু ও তেমন কিছুই করছে না। বরং ওকে বেশ খুশী খুশী মনে হচ্ছে। আম্মা এবং বোনেরা যা বলছে ও তাই করছে।
সন্ধ্যার দিকে আম্মা তার বিয়ের লাল রঙের শাড়ীটা বের করলো। সেটা সামিরার সামনে এনে বললো, ‘মা, আমার ইচ্ছা এই শাড়ীডা আমার আসিফের বৌরে দিবো।’ সামিরা খুশী হয়ে দুহাত বাড়িয়ে শাড়ীটা নিলো। আমার বোনেরা সামিরাকে লাল শাড়ীটা পরিয়ে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার ছোটভাই বিয়ের কাজী ডেকে এনেছে। তার আগে আমার সেই শিক্ষকদেরও খবর দিয়ে আনা হয়েছে যাদের কারণে আমি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পেরেছি। শিক্ষকরাও আমার বিয়ের বিষয়টাতে বেশী খুশী হতে পারলেন না। কিন্তু আম্মার পূর্ণ সম্মতি দেখে তেমন কোন মন্তব্য করলেন না। দুজন শিক্ষক বিয়ের সাক্ষী হলেন। আমার মামা হলেন সামিরার অভিভাবক। সামিরার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে অতিথীরা বিদায় নিলেন। আমাকে আমার বোনেরা আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিলো। বিছানার উপরে মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে সামিরা বসে আছে। আমি তখনো ভাবতে পারছি না আমি একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি এবং সেই মেয়েটি আমার সামনে বসে আছে। সামিরা খাট থেকে নেমে এসে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। আমি ওকে দু’হাত দিয়ে ধরে দাঁড় করালাম। দেখলাম ওর দুচোখ ভরা পানি। আমি বললাম, ‘আমার এই কঠিন জীবনের সাথে তোমার ভাগ্য জড়িয়ে ফেললে। আমি জানি না আমাদের ভবিষ্যতে কি আছে।’ সামিরা আমার মুখে হাত দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘এমন কথা বলবেন না, আমাদের বিয়েটা হয়েছে আপনার আম্মার ইচ্ছায়। তার দোয়া আমাদের সাথে আছে। আমাদের সামনে ভালো কিছুই হবে।’
‘আম্মা বিয়েটা দিয়েছেন সম্পূর্ণ একটা ভুল ধারণার উপরে দাঁড়িয়ে। সত্যিটা জানলে কি হতো জানি না।’
সামিরা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো, ‘কি আর হতো? আমাকে হয়তো ফিরে যেতে হতো সেই নরকে।’
আমাদের বাসর রাতের প্রায় পুরো সময়টাই সামিরা চোখের পানি ফেললো। কেঁদে কেঁদে আমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা জানালো, বললো ওর শৈশবের কথা, ওর আম্মার কথা, সিয়ামের কথা, সবচেয়ে বেশী বললো ওর বাবার কথা। ওর আব্বা গাজীপুরে একটা গার্মেন্টসে কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতো। ভীষণ পরোপকারী একজন মানুষ ছিলো। কেউ যদি এসে বলতো তার মেয়ের বিয়ে দেয়ার টাকা নেই সে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতো এতে তার পরিবারের সারামাস চলবে কি চলবে না তা কখনো চিন্তা করতো না। একদিন অনেক রাতে গাজীপুর থেকে ফেরার পথে একটি মেয়েকে অনেকগুলি বখাটে ছেলের হাত থেকে বাঁচাতে যেয়ে খুব মার খেয়েছিলো, কিছুদিন হাসপাতালেও ভর্তি থাকতে হয়েছিলো তবু ঐ মেয়েটির কোন ক্ষতি তিনি হতে দেয়নি। সামিরার জন্মের পর থেকে সবাই যখন ওর এই হাত নিয়ে নানা কথা বলতো তখন ওর আব্বা বলতো, ‘এটা আল্লাহ্ র তরফ থেকে পাওয়া। এই মেয়েই একদিন আমাদের সবার সৌভাগ্য নিয়ে আসবে।’
আমি ভেবেছিলাম সামিরার আম্মা এবং সৎ বাবা থানা পুলিশ করবে। আমি এ নিয়ে ভীষণ আতঙ্কে ছিলাম। কিন্তু ৩/৪ দিন পার হওয়ার পরেও যখন পুলিশ এলো না তখন আমি আমার মোবাইল ফোনটা অন করলাম। দেখলাম সেখানেও কোন কল নেই। সামিরার কাছে বিষয়টা জানতে চাইলে ও বললো, ‘আম্মু হয়তো ফোন করতে চেয়েছে তাকে করতে দেয়া হয়নি আর ঐ লোকটা তো আমার মত একটা আপদ বিদায় করতে পারলেই বাঁচে।’
সামিরাকে বাড়ীতে রেখে আমি ঢাকায় এলাম। এই মুহূর্তে আমার কোন টিউশনি নেই। সামান্য কিছু জমানো টাকা দিয়ে চলছি। টিউশনির চেষ্টা করতে থাকলাম। এক সপ্তাহ পরে আবার বাড়ি গেলাম। সামিরা ঢাকায় আসতে চাইলো। আমি রাজী হলাম না কারণ ওকে ঢাকায় রাখার মত কোন জায়গা আমার নাই। ও আমাকে অনুরোধ করে বললো শুধু একদিনের জন্য ওকে ঢাকায় আনতে। আমি ওকে নিয়ে খুব ভোরের বাসে ঢাকা এলাম। ও আমাকে একজন ভদ্রলোকের বাসায় নিয়ে গেলো যিনি বেশ বিত্তবান এবং সেই সঙ্গে হৃদয়বান। তিনি আমাদের বেশ সমাদর করলেন। সামিরা আমার জন্য একটি কাজ ঠিক করে দেয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলো। লোকটি ওর অনুরোধটি মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তারপর কিছুক্ষণ নিরব থাকলেন। আমরাও চুপ করে বসে থাকলাম। একসময় তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার একটা বড় বিপদে সামিরার আব্বা আমাকে সাহায্য করেছিলেন। সেকারণেই আজ তোমাকে আমি একটা সুযোগ দিতে চাই। হাতিরঝিলে একটা দোকানের পজিশন নেয়া আছে। সেখানে তুমি একটা রেস্টুরেন্ট দিতে পারো। আপাতত আমাকে কোন টাকা দিতে হবে না। রেস্টুরেন্ট দাঁড় করাতে পারলে আমার পাওনা বুঝিয়ে দিবে।”
আমি এই প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাছাড়া এতবড় একটা কাজ করার মত মানসিক শক্তি বা আর্থিক সামর্থ কোনটাই আমার নেই। তাই আমি একটু সময় চেয়ে নিলাম। সেদিনই বিকালের বাসে বাড়ি ফিরে এলাম।
চলবে……
গল্পঃ ঋণ
কলমেঃ কাজী আজমিরী
বনানী, ঢাকা।
ঋণ (পর্ব-৪/শেষ পর্ব)
রাতে সামিরা আমার কাছে জানতে চাইলো আমি কবে কাজ শুরু করবো। আমি বললাম, অতো টাকা আমার কাছে নেই। ও তখন আমার হাতে এক সেট গহনা দিয়ে বললো, ‘এটা আমার আম্মুর বিয়ের গহনা। আপনি এটা বিক্রী করে কাজ শুরু করেন।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এই গয়না কোথায় পেলে?’
‘আম্মু একদিন আমাকে বলেছিলো আমার বিয়ের সময় এই গহনা আমাকে দিবে। আমি তাই আসার সময় এগুলি নিয়ে এসেছি।’
আমার তখন মনে পড়লো সামিরাদের বাড়ি থেকে আসার সময় ওর সাথে ছোট একটা ব্যাকপ্যাক দেখেছিলাম। আমি বললাম, ‘তোমার বাবার স্মৃতি এভাবে নষ্ঠ করে দিবে?’
‘নষ্ঠতো করবো না, একটা ভালো কাজে লাগাবো।’
‘তোমার আম্মু জানলে কষ্ট পাবেন।’
‘মনে হয় না। তিনি এখন ঐ লোকটার হাতের পুতুল।’
আমি সামিরার দেয়া গলার হার আর কানের দুল জোড়া বিক্রী করে হাতিরঝিলে ‘ঝিলমিল কাবাব ঘর’ দিলাম। প্রথম প্রথম খুব একটা লোক আসতো না তারপর আস্তে আস্তে লোক আসতে শুরু করলো। তবে সেই সংখ্যাও খুব বেশী না। রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি আর একজন যোগানদারের বেতন দিয়ে অল্প কিছু লাভ থাকে। দোকানের মালিক একদিন এসে দোকান দেখে গেছেন কিন্তু টাকা পয়সার কথা কিছু বলেননি। আমি ভেবে রেখেছি বিক্রী বাড়বে এবং আমি খুব তাড়াতাড়ি মালিককে টাকা পরিশোধ করতে শুরু করবো। কিন্তু আমার আশা পূরণ হলো না। দেখতে দেখতে প্রায় ছয় মাস চলে গেলো আমার রেস্টুরেন্ট তেমন জমে উঠলো না। দোকানের মালিক ফোন দিয়ে আমার কি অবস্হা জানতে চাইলেন। তারপর বললেন, মাসে মাসে কিছু টাকা দেয়া শুরু করতে পারবো কিনা? আমি বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এরমধ্যে সামিরাকে ঢাকা নিয়ে এসেছি। কালাচাঁনপুরে একটা রুম সাবলেট নিয়েছি। সামিরা গর্ভবতী, আমাদের ঘরে আসছে আমাদের প্রথম সন্তান। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। সব মিলিয়ে আমি বেশ পেরেশানির মধ্যেই আছি।
আমার কাবাব ঘরের পাশে একটা বড় রেস্টুরেন্ট আছে লোকজন সেটাতেই বেশী ভীড় করে। জলযানের লোকজন বাড়ি ফেরার আগে ওখানে চা নাস্তা খায়। অনেক রাত পর্যন্ত ওদের কাস্টমার থাকে। সেই তুলনায় আমার এখানে লোকই আসে না। আমার চিন্তিত মুখ দেখে সামিরা আমাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘এতো চিন্তা করবেন না। আমার বিশ্বাস আপনার রেস্টুরেন্ট খুব তাড়াতাড়ি জমে উঠবে।’ আমি ওর কথায় মনে মনে ভরসা খুঁজি।
রোজার মাসে ইফতারীর অফার দিলাম। প্রতি প্যাকেট ১০০ টাকা। প্যাকেটে কাবাব পরাটা ছাড়াও ছোলা, মুড়ি, খেজুর, জিলাপী ও একবোতল পানি দিলাম। রাস্তায় ভীষণ ট্রাফিক জ্যামে লোকজন সময়মত ঘরে ফিরতে পারে না। রাস্তায়ই ইফতারী করতে হয়। আমার এই প্যাকেট তাদের জন্য সুবিধা হবে। আমার কাবাব ঘরের পাশেই জলযানের ঘাট।জলযানের লোকজনেরও ইফতারীর প্যাকেট কিনতে দূরে যেতে হবে না। কিন্তু আমার সব হিসাবই ভুল হয়ে গেলো। তেমন সাড়া পেলাম না। প্রথম দুই এক রোজায় অনেক প্যাকেট অবিক্রিত রয়ে গেলো। তারপর প্যাকেটের সংখ্যা কমিয়ে দিলাম।
দশ রোজায় সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হলো। সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি পড়লো। সন্ধ্যার দিকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিলো। ইফতারির ঠিক আগ দিয়ে দশজন লোক একসাথে এসে আমার কাবাব ঘরে ঢুকলো। সবাই শার্ট প্যান্ট পরা মধ্য বয়স্ক লোক। দেখে মনে হচ্ছে অফিস থেকে ঘরে ফিরছে রাস্তায় ইফতারের সময় হয়ে গেছে তাই আমার রেস্টুরেন্টে এসেছে। কোনার দিকে একটি টেবিলে বসে ইফতারি দিতে বললো। সাহায্যকারী ছেলেটা পানি আর প্লেট দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি দৌড়ে গেলাম রান্না ঘরে; আর মাত্র তিন প্যাকেট ইফতারি আছে। আমি খুবই বিব্রত এবং দুঃখিত হলাম। আমাকে না দেখে লোকগুলির মধ্যে থেকে একজন জোড়ে হাঁক দিলো, ‘কই গেলা? আমাদের ইফতারি দাও। আজান হইতে আর বাকী নাই।’
আমি হাত কচলাতে কচলাতে উনাদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমার মুখটা মাটির দিকে অবনত। উনাদের একজন বললো, ‘কি ব্যাপার? তোমার কি হইলো? ইফতারি আনো।’
আমি মলিনভাবে বললাম, ‘ স্যার, তিন প্যাকেট ইফতারি আছে। আমাকে একটু সময় দিলে আমি বাকী ইফতারিগুলি বানায় দিতে পারবো।’
উনাদের সবার মুখে হাসির রেখা দেখতে পেলাম। একজন বললো, ‘এ জন্যই কি তুমি লজ্জা পাচ্ছো? লজ্জা পাওয়ার কি আছে আমরাতো তোমাকে বলে কয়ে আসিনি।’
অন্য আর একজন বললো, ‘তুমি ঐ তিন প্যাকেট ইফতারি আমাদের দাও। আমরা খেতে শুরু করি। বাকী সাত প্যাকেট তুমি বানাও। আমরা মাগরিব পড়ে এসে খাবো।’
আমি দৌড়ে যেয়ে তিন প্যাকেট ইফতারি নিয়ে এলাম। মাগরিবের আজান শুরু হলো। উনারা ঐ তিন প্যাকেট ইফতারি ভাগাভাগি করে তৃপ্তি সহকারে খেলেন। খেতে খেতে বার বার শুকরিয়া করলেন। নিজেদের মধ্যে অন্য কথাও বলছিলেন। কথা শুনে মনে হলো তারা প্রত্যকে তাদের কোন অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। একজন তার অসমাপ্ত গল্পটা শেষ করলো, ‘আমার মেয়েকে সে সেদিন বাঁচিয়ে ছিলো। তাঁর সেই ঋণ শোধ করার সুযোগ যদি পেতাম!’ গল্পটা শেষ করে লোকটার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সবাই তাকে সান্ত্বনা দিলো। সবাই বলাবলি করলো, ‘আমরা সবাই যদি আমাদের ঋণগুলি শোধ করার সুযোগ পেতাম!’ আমি উনাদের কথাগুলি শুনছিলাম কিন্তু আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাদের খাওয়া শেষ হলো। খাওয়া শেষ করে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় একজন আমার হাতে ১০০০ টাকার একটি নোট দিলেন। আমি ৭০০ টাকা ফেরত দিতে গেলে উনারা সবাই প্রায় একসাথে হৈ হৈ করে উঠলো। একজন বললো, ‘আমাদের জন্য যে ইফতারি তৈরী হচ্ছে এটি তার দাম।’
আমি বললাম, ‘আপনারা ফিরে এসে খাওয়ার পরে দাম দিবেন।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘না তা হয় না। তুমি কোন বিশ্বাসে আমাদের জন্য এতগুলি ইফতারি বানাবে? টাকাটা রাখো।’
আমি টাকাটা ক্যাশ বাক্সে রেখে দিলাম। উনারা নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেন। বাবুর্চি ৭ প্যাকেট ইফতারি তৈরী করে ফেললো। আমি সেগুলি সাতটি প্লেটে সাজিয়ে টেবিলে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মাগরিব শেষ হলো, এশা শেষ হলো, তারাবি শেষ হলো কিন্তু আমার অপেক্ষা শেষ হলো না। উনারা সেই রাতে আর ফিরে এলো না।
সেই দশ জন অতিথী আর কোনদিনই ফিরে এলো না। কিন্তু সেই দিনের পর থেকে আশ্চর্য একটি ঘটনা ঘটলো। আমার কাবাব ঘরে কাস্টমারের উপচে পরা ভীড় শুরু হলো। আমার আয় রোজগার ব্যাপক হারে বাড়তে থাকলো। সেই সঙ্গে বাড়তে লাগলো আমার সম্পদ। গত পাঁচ বছরে আমি আরো দুটি রেস্টুরেন্ট করেছি, পুলিশ প্লাজাতে দোকান নিয়েছি, গ্রামের বাড়িতে আম্মাকে একটা পাকা বাড়ি করে দিয়েছি, নিকেতনে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছি যার একটি আমার শাশুড়ির জন্য। নিকেতনে থাকি আমি, সামিরা, আমাদের দুই সন্তান, সিয়াম এবং আমার শাশুড়ি। আপনাদের বলা হয়নি সামিরা ঢাকা এসে গোপনে তার আম্মা এবং ভাইর সাথে যোগাযোগ করা শুরু করে। আমার আর্থিক অবস্হার যখন উন্নতি হয় তখন আমরা তাদের দুজনকে ঐ পাষন্ড লোকটার হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। সামিরার আম্মা ঐ ভদ্রলোককে ডিভোর্স দিয়েছে। তবে সে খুব বেশী অসুস্হ হয়ে পড়েছে। সামিরা নিজ হাতে তার মায়ের সেবা যত্ন করে।
আমি অনেক সম্পদের মালিক হলেও এই ছোট্ট ঝিলমিল কাবাব ঘরটি কিন্তু ছেড়ে দেইনি। বরং মালিকের কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। মালিককে যখন এ প্রস্তাবটি দিলাম তিনি বলেছিলেন, ‘এ দোকানে তোমার আর কি প্রয়োজন?’
আমি বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, ‘চাচাজান, আপনি না চাইলে আমার কিছু করার নাই। কিন্তু আমি এ দোকানটা চাই। আপনি চাইলে আমি দ্বিগুন দাম দিবো।’
‘দ্বিগুন দামের দরকার নাই। তুমি আমাকে বাজার দরই দাও।’
সামিরাও এই দোকান কেনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলো না। ও বলেছিলো, ‘এ দোকানটা আপনি ছেড়ে দেন। এই কাবাব ঘরে এখন আপনি বসলে মানায় না।’ আমি সামিরার এ কথায় শুধু একটু হেসেছি কিন্তু কোন জবাব দিই নাই। আমি সেই দশজন অতিথীর কথা কাউকে বলিনি, সামিরাকেও না। আমার মনে এখনো আশা তারা ফিরে আসবে। প্রতি রোজায় আমি তাদের জন্য সাতটি ইফতার নিয়ে অপেক্ষা করি। আমার যে তাঁদের কাছে ঋণ রয়ে গেছে। সেই ঋণ শোধ করার একটা সুযোগ আমি চাই।
॥সমাপ্ত॥
গল্পঃ ঋণ
কলমেঃ কাজী আজমিরী
বনানী, ঢাকা।
ভালো লাগলে অবশ্যই আমার বাকি গল্পগুলো পড়বেন।
আপনারাই আমার লেখার অনুপ্রেরণা