কয়েক ঢোক পানি গিলে বোতলটা কফি টেবিলের উপর ফেলে রাখল রোদ। মন-মেজাজ তার ভয়ংকর খারাপ। সকালে তুচ্ছ একটা কারণে শুভ্রর সাথে ভয়াবহ এক ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলেছে। ঝগড়া হওয়ার পর থেকে দু’জনের কথাবার্তা বন্ধ। স্ত্রীর ব্যাপারে শুভ্র সদা সতর্ক। দোষ যারই হোক ঝগড়া করে কথাবার্তা বন্ধ করে বসে থাকার মতো পুরুষ সে না। মেয়ের থেকে বউয়ের প্রতি তার আহ্লাদ বেশি। সেই শুভ্র ঝগড়া করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে এমন ঘটনা রোদের জীবনে প্রথম। ঝগড়ার পর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে না, তা কেবল জীবনে নয় রোদের সমগ্র কল্পজগতেও প্রথম। রোদ চোখ-মুখ অন্ধকার করে বিছানায় গিয়ে বসল। দুশ্চিন্তায় অভিমানে এবার তার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের দুঃখে ব্যস্ত থেকে মেয়ের কথা প্রায় ভুলেই বসেছিল রোদ। দেওয়াল ঘড়ির ঘন্টায় সম্বিত ফিরে মেয়ের খোঁজ করল। দেখা গেল, শুভ্রতা তার ছোট্ট ছোট্ট হাতে মায়ের ফেলে আসা বোতলের ছিপি আটকানোর চেষ্টা করছে। কাজটা সে করছে খুব গম্ভীর মুখে। যেন তার কাঁধে পার্লামেন্টের খুব গুরুত্বপূর্ণ বাজেট পাশের দায়িত্ব পড়েছে। শুভ্রতা বোতলের ক্যাপ লাগিয়ে বোতলটা যথাস্থানে রাখল। সোফার এলোমেলো কুশনগুলো ইন অর্ডার রাখার চেষ্টা করল। রোদ একটু আগের মন খারাপ ভুলে মুগ্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। এসব কাজ সে শিখিয়েছে তার বাবার থেকে। মেয়েটা দেখতে হয়েছে বাবার মতো। কাজও করে একইরকম। টিপটপ, গোছানো। বাবাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করায় তার আগ্রহের শেষ নেই। রোদের ধারণা, মেয়েটা বড় হয়ে বাবার মতোই হৃদয়ের সমস্তটা দিয়ে ভালোবাসতে শিখবে। কিন্তু বাবার মতো বিধ্বংসী রাগটা সে আয়ত্ত্ব করতে পারেনি। বাবা-মা দু’জনেই আগ্নেয়গিরি আর মেয়েটি হয়েছে টলটলে নদীর মতো শান্ত। এতো সরল! এই সরল মেয়েটা এই কঠিন পৃথিবীতে কীভাবে টিকবে কে জানে ? কে তাকে আগলে রাখবে তার বাবার মতো করে? রোদ উঠে গিয়ে মেয়েকে আচমকা কোলে তোলে নিলো। তুলতুলে গালে গাঢ় চুমু দিয়ে প্রাণ ভরে মেয়ের গায়ের ঘ্রাণ নিলো। আদুরে কণ্ঠে বলল,
‘ আমার সোনা বাচ্চা!’
অকস্মাৎ মায়ের আদর পেয়ে বড় বড় সরল চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল শুভ্রতা। মেয়েকে এতো মিষ্টি করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়ের কচি গলার কাছে গাঢ় করে চুমু খেয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
‘ ওরে আমার রসগোল্লা।’
চোখের সামনে মায়ের ঝলমলে মুখ আর টপাটপ আদর পেয়ে খুশি হয়ে গেল শুভ্রতা। ঠোঁটে অনাবিল হাসি নিয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল। রোদ মুগ্ধ হয়ে মেয়ের হাসি মুখের দিকে চেয়ে রইল। সবাই বলে শুভ্রতা হাসলে তাকে তার মতো দেখায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার রোদ এই হাসিতেও শুভ্রর ছায়াই খুঁজে পায়। শুভ্রতা হাসলেই মনে হয়, ওই তো শুভ্র হাসছে। কী প্রাণখোলা সে হাসি! রোদ মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরে কপালে চুমু খেল। বাবার থেকে সে অনেককিছুই পেয়েছে। চিরায়ত বাঙালি মায়ের মতো রোদেরও হঠাৎ এক হাস্যকর চিন্তা মাথায় এলো, মেয়েটা চেহারা, স্বভাবে এতো বাবা বাবা হলো। পড়াশোনা আর ধৈর্য্যে বাবার মতো হলেই রক্ষা। তার নিজের মতো হলে মেয়ের এবং মেয়ের মায়ের দু’জনের কপালেই দুঃখ আসন্ন। রোদের কেন যেন মনে হয়, মেয়েটা তার মতোই ঢেঁড়শ হবে। মায়ের থেকে অভিমানের ফুল কোর্স একেবারে ফটোকপি করে নিয়ে জন্মেছে সে। আর জেদ! বাপরে বাপ! মেয়ের জেদ দেখে শুভ্র আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে, ‘আরে! ও তো একদম তোমার মতো!’ যেন মেয়ের মায়ের মতো জেদ হয়েছে তাতে সে খুবই গর্বিত। আপনমনেই হেসে ফেলল রোদ। মেয়েকে নিয়ে বিছানায় চলে এসে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ শুভ্রতা এখন ঘুমু যাবে। বাবা কী শিখিয়েছে? দেরি করে ঘুমোনো ইজ ব্যাড ম্যানারস্।’
শুভ্রতা মায়ের কথা শুনে চট করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। একটু পর চোখ পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করল মা করছে কী? রোদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল,
‘ উম! দুষ্টুমি হচ্ছে? আম্মুর সাথে দুষ্টুমি হচ্ছে?’
মায়ের প্রশ্রয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল শুভ্রতা। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে ভাবুক হয়ে গেল মুখ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মায়ের দিকে বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে শুধাল,
‘ বাবা কোতায়?’
মেয়ের প্রশ্নে রোদের হুট করেই সকালের ঝগড়ার কথা মনে পড়ল। ধীরে ধীরে উড়ে এলো অভিমানের মেঘ। মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ বাবা নেই।’
‘ বাবা নেই’, কথাটা বোধহয় শুভ্রতার ভাবনায় আঘাত করল। অবুঝ সরলতায় শুধাল,
‘ বাবা কখন আসবে?’
বাইরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। রোদ একটু উদ্বেগ, একটু অভিমান, একটু অস্থিরতা মিলিয়ে আনমনা হয়ে চেয়ে রইল বাইরের অন্ধকারে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ বাবা আসবে না। তুমি ঘুমাও।’
শুভ্রতা ঘুমাল না। আবার নতুন কোনো প্রশ্ন করে মাকে বিরক্তও করল না। চুপ করে মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে রইল। অভিমানের ধকল সামলাতে দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে এক সময় চোখ বন্ধ করল রোদ। মায়ের চোখ বন্ধ দেখে চট করে উঠে বসল শুভ্রতা। শিয়রের পাশে রাখা মায়ের ফোন নিয়ে সে খুঁজতে লাগল বাবার ফটো। নাম সে পড়তে পারে না কিন্তু কল লগে বাবার হাসিমুখের ছবিটা দেখে ঠিক চিনে ফেলতে পারে এটা বাবা। সে বাবার ছবি খুঁজে খুঁজে বাবাকে ফোন করল। ফোনটা বিছানায় রাখা। সে বিছানায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে, বাবা কী আসলেই আছে এর মধ্যে? একসময় বাবা কথা বলল। ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
‘ হ্যালো?’
শুভ্রতা খুশিতে ঝুমঝুম করে বলল,
‘ বাবা!’
এতো রাতে ফোনের ওপাশে মেয়ের কণ্ঠ শুনে অবাক হলো শুভ্র। বিস্ময় কাটিয়ে কণ্ঠে আদর ঢেলে শুধাল,
‘ কী ব্যাপার? আমার আম্মু এখনও ঘুমায়নি?’
শুভ্রতা সামনে ঝুঁকে বিছানার সাথে কানটাকে এক রকম লাগিয়ে ফেলে বাবার কথা শুনল। বলল,
‘ বাবা! বাবা তুমি আসো।’
তৎক্ষনাৎ শুভ্রর বুকের ভেতর একটা উষ্ণ ঢেউ খেলে গেল। সকালে রোদের সাথে ছোটখাটো একটা ঝগড়া হয়েছিল৷ ভেবেছিল, মহারাণীকে একটু জ্বালাতন করে শেষ রাতের দিকে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু মেয়ের এমন আহ্বানে ভেতরটা দ্রবীভূত হয়ে গেল। মনে হলো এই ছোট্ট শরীরটা এই মুহূর্তে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিনিময়ে সে অবলীলায় বাজি রেখে ফেলতে পারে পুরো পৃথিবী। এই তুলোর মতো মেয়েটিকে পৃথিবীতে আনার জন্য, তার কোলে তুলে দেওয়ার জন্য রোদ নামক জেদি রমণীটিকেও ক্ষমা করে দিতে পারে শত সহস্র বার। মেয়েকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা সংযত করে বলল,
‘ আমি আসছি আম্মু।’
শুভ্রতা বোধহয় দেরী সহ্য করতে প্রস্তুত না। সে রুষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘ তুমি তাইতাই আসো।’
শুভ্র হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষের হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল,
‘ বাবা তাইতাই চলে আসবে, মা। বাবা আসতে আসতে তুমি মাকে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে ফেলো তো আম্মু। গরম গরম চুমু্।’
রোদ চোখ বন্ধ রেখেই বাবা-মেয়ের আলাপ শুনল। মেয়ের বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ফোন করার মতো বুদ্ধি হয়েছে ভেবে সে একই সাথে মুগ্ধ ও বিস্মত হলো। চোখ খোলে মেয়েকে বিব্রত করতে ইচ্ছে হলো না বলে চুপ করে রইল। শুভ্রতা ফোন রেখে এবার মায়ের দিকে মনোযোগী হলো। মায়ের মাথার কাছে বসে টুপ করে চুমু খেয়ে ফেলল তার গালে। ঘুমন্ত মায়ের গালে আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুম পড়ানো ছড়া কাটার মতো টেনে টেনে বলার চেষ্টা করল,
‘ আম্মু ঘুম, আম্মু ঘুম।’
তারপর আবারও টপাটপ দুটো চুমু খেয়ে ফেলল মায়ের গালে। ছোট্ট হাতে মায়ের মাথায় আলতো চাপড় দিতে দিতে আবারও ছড়া কাটতে লাগল আপনমনে। যেন মাকে ঘুম পাড়ানোর গুরুদায়িত্বটা তার ছোট্ট কাঁধে নামিয়ে দিয়েছে কেউ। রোদের বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল অদ্ভুত এক আনন্দ আনন্দ ব্যথায়। চোখ ভরে এলো। চোখ বন্ধ রেখেই হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কাছে টেনে বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরল৷ এই পৃথিবীর প্রতি, শুভ্রর প্রতি সকল অভিমান যেন মেঘ হয়ে উড়ে গেল তক্ষুনি। তার আর কোনো দুঃখ নেই। কেউ যেন ফিসফিসিয়ে বলে গেল, যার এমন একটা মেয়ে আছে তার জীবনে দুঃখ, কষ্ট, অভিমান থাকতে নেই।
– নৌশিন আহমেদ রোদেলা
( মা দিবসে একটা মা মা লেখা পেলাম ডায়েরিতে।)