রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৩৩
#লেখিকা- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
____________________
সকালটা সুন্দর। চারদিকে মেঘ মাখানো হালকা আলো। বিছানার পাশের জানালাটা খোলা, গোলাপী রঙের পর্দাটা অল্প অল্প কাঁপছে। ঘরের কোণের টেবিলটাতে বসে এসাইনমেন্টের পাতায় মুখ ডুবিয়ে আছে আপু। আমি সচেতন চোখে এদিক-ওদিক তাকালাম। দরজার কাছে আম্মুকে দেখতে পেয়ে আবারও আগের মতোই পড়ে রইলাম। কয়েকমাস যাবৎ খুব বাজে একটা অভ্যাস হয়েছে। নয়টা/সাড়ে নয়টার আগে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আজও করছে না। আমাদের রুমে কোনো ঘড়ি নেই।
এখন সকাল কয়টা বাজে তার সঠিক খবরটাও আমার জানা নেই। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে এখনও নয়টা বাজে নি। এ বাড়িতে ঘড়ির প্রয়োজন আমার বিশেষ একটা হয় না। তবে, সময় জানার একটা বিশেষ পদ্ধতি অবশ্য আমার আছে। ‘বিশেষ’ ট্যাগ লাগানো বিষয়গুলোর বিশেষ বিশেষ নাম থাকতে হয়। বিশেষ বিষয়ের বিশেষ নাম থাকবে এটাই নিয়ম। তবে, আমার পদ্ধতিটির বিশেষ কোনো নাম নেই। তার নামটা খুব সাধারণ —- ” দি ন্যাচারালিস্টিক এলার্ম”।
এই এলার্ম, নিয়ম করে রোজ ৮ টা থেকে বাজতে শুরু করে। আমি ওঠে না বসা পর্যন্ত বাজতেই থাকে। এই এলার্ম সিস্টেমের একমাত্র অধিপতি হলেন, আমার মা। সে যায় হোক, কিছুক্ষণ ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকার পরও যখন আম্মুর এলার্ম সিস্টেমটা বেজে উঠলো না তখন বাধ্য হয়েই চোখ মেলে তাকালাম। আপুর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
—” এই আপু? কয়টা বাজে?”
আপু আমার দিকে একবার তাকিয়েই ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালো। ব্যস্ত গলায় বললো,
—” ন’টা বত্রিশ।”
ন’টা বত্রিশ! এতো বেলা হয়ে গেছে? আম্মুর এলার্মটা কি আজ তবে ঘড়ি দেখতে ভুলে গেছে ? আশ্চর্য! আম্মুর এলার্ম তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে করতেই বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। সারা বাড়ি ইলিশে শুঁটকির গন্ধে মউ মউ করছে। ইলিশ মাছের গন্ধ শুকতে শুকতেই হঠাৎ চাটনির কথা মনে পড়লো। ভুনা খিচুড়ির সাথে ঝাল ঝাল চাটনি….আহা! ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে রান্না ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মুর মেজাজ বুঝার জন্য হালকা গলায় ডাকলাম,
—” আম্মু!”
আম্মু জবাব দিলেন না। আম্মুর নিশ্চুপতা মানেই ভয়ানক রাগ। তবুও সাহস করে বললাম,
—” আম্মু? চাটনি বানাও না প্লিজ। একদম ঝাল ঝাল চাটনি।”
এবারও জবাব এলো না। আমি একটু ঘাড় নুইয়ে আম্মুর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। আম্মু আগের মতোই থমথমে মুখে রান্নার কাজ সারতে লাগলেন। আমার পাশে থাকা নুনের বাটিটা হাত বাড়িয়ে নিলেন ঠিক তবুও আমাকে দেখলেন না। হয়তো দেখার চেষ্টাই করলেন না। এমন একটা ভাব করলেন যেন এই দুনিয়াতে ‘রোদেলা’ নামক কোনো বস্তুর কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। আমি নিজের চেষ্টা জারি রাখতে আবারও বললাম,
—” আম্মু? ও আম্মু?”
আম্মু এবার ধমকে উঠলেন। হাজারো ক্ষোভ নিয়ে বললেন,
—” একদম আম্মু আম্মু করবি না। আমার একটা কথা শুনিস কোনোদিন? যা মন চায় তাই করিস। এখন আবার আম্মু কিসের? কোনো আম্মু নাই। খবরদার আমায় আম্মু ডাকবি না।”
আমি অসহায় চোখে তাকালাম। আম্মুকে ডিসট্রেক্ট করার সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা। আমার এই প্রচেষ্টাটাও মাঠে মারা গেলো, আম্মু পাত্তা দিলেন না। ব্যর্থ আমি, অসহায় মন নিয়ে বসে রইলাম সোফায়। কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে থেকে ওঠে দাঁড়াতেই টি-টেবিলে রাখা আম্মুর ফোনটা বেজে উঠলো। আম্মু তখন কড়াইয়ে খুন্তি নাড়তে ব্যস্ত। একবার উঁকি দিয়ে ফোন স্ক্রিনে নামটা দেখে নিয়েই ঝটপট তুলে নিলাম ফোন।
—” মামানি আচার খাবো।”
—” কে রোদু?”
—“হু।”
—” কিসের আচার খাবি?”
—” আমড়ার আচার।”
—” আচ্ছা, করে দিবো।”
—” করে দেবে কি? আমি আজই খাবো।”
—” আচ্ছা। তাহলে চলে আয় বাসায়। তোর মামুকে আমড়া আনতে পাঠাচ্ছি।”
মুহূর্তেই খুশি হয়ে উঠলাম আমি। ফিসফিস করে বললাম,
—” মামানি? আম্মু তো এখন যেতে দিবে না। তুমি বলো না প্লিজ।”
মামানি হাসলেন। আদুরে গলায় বললেন,
—” বেশ তো। তোর মাকে ফোনটা দে আর তুই ঝটপট রেডি হয়ে যা।”
___________________
মামানি চুলোয় আমড়া সিদ্ধ চড়িয়েছেন। আমি এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছি। পর্দার ফাঁক দিয়ে বারান্দায় লাগানো গোলাপের গাছ চোখে পড়ছে। গাছে গাঢ় রঙের একটা ফুলও ফুটেছে। সেদিকে চোখ রেখেই বিরবির করে বলে উঠলাম আমি,
—” ভাল্লাগছে না কিছু। সবই কেমন একঘেয়ে লাগছে মামানি।”
আমার কথায় চোখ তোলে তাকালেন মামানি। একবার ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন,
—” টিভি দেখ ভালো লাগবে। নয়তো শুভ্রর রুম থেকে কোনো উপন্যাস টুপন্যাসের বই এনে পড়। তোর তো বইয়ের প্রতি খুব নেশা।”
মামানির প্রস্তাবটা খুব একটা খারাপ লাগলো না আমার। পা টিপে টিপে শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। রুমের দরজাটা খোলায় ছিলো কিন্তু ভেতরটা আবছা অন্ধকার। রুমে ঢুকে আলো জ্বেলে দিতেই বিছানায় উপুর হয়ে ঘুমিয়ে থাকা শুভ্র ভাইকে চোখে পড়লো। আমি চুপচাপ বুকসেল্ফ ঘেটে বই দেখতে লাগলাম। পছন্দ মতো বই নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করে এক-দু পাতা উল্টে-পাল্টে দেখছিলাম। এমন সময় ঘুম জড়ানো কন্ঠ ভেসে এলো,
—” এই? এখানে কি করিস তুই?”
হঠাৎ এমন ধমকে চমকে উঠে বিছানার দিকে ফিরে তাকালাম। উনি ঘুম মাখা আধো চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকাতেই বললেন,
—” যা। রুম থেকে যা। তোকে না বলেছি? যখন তখন রুমে আসবি না।”
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
—” আশ্চর্য! আমি কি আপনাকে চিমটি দিয়েছি নাকি? আমি এখানে বই নিতে এসেছি। আপনি আপনার মতো ঘুমোন না।”
উনি এবার সোজা হয়ে শুলেন। কাঁথাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
—” বই নেওয়া তো শেষ হয়েছে? এবার যা।”
আমি বই হাতেই হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালাম। ভ্রু উঁচিয়ে বললাম,
—” যাবো না। আমি এখানেই বই পড়বো। আপনার ঘুম আপনি ঘুমোন না। আমি কি আপনাকে ডিস্টার্ব করেছি? একটা কথাও তো বলছি না। তাহলে সমস্যা কোথায়?”
—” অনেক সমস্যা। প্রথম সমস্যা লাইট জ্বালিয়ে রেখেছিস। আর মুখ্য সমস্যাটা হলো, তোর পায়ের নুপুরের শব্দ আর গায়ের গন্ধে আমার ঘুম আসবে না। তুই যা এখান থেকে। রাতে ঘুম হয় নি…ঘুমোতে দে।”
হাতের বইটা সেল্ফের উপরে রেখে ভ্রু কুঁচকালাম আমি। বিরক্তি নিয়ে বললাম,
—” আজিব! রাতে আপনার ঘুম হয়েছে কি হয় নি সেটা নিতান্তই আপনার সমস্যা? আপনার রাতে ঘুম হয় নি বলে সারা দুনিয়া অন্ধকার করে রাত বানিয়ে ফেলবেন? দিনে ঘুমোতে হলে আলোতেই ঘুমোতে হবে। আর তারসাথে আমার নুপুরের শব্দও শুনতে হবে।”
শুভ্র ভাই বিরক্ত চোখে তাকালেন,
—” এই তুই বের হ তো। আমার রুম আমি অন্ধকার করি নাকি আলোকিত করি সেটা নিতান্তই আমার ব্যাপার। দরকার হলে আমার রুমকে আমি পাতালপুর বানিয়ে ফেলবো, তাতে তোর কি? তুই বের হ।”
—” বললাম তো যাবো না। আমি এখানেই বই পড়বো। ব্যস!”
শুভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে থেকে কাঁথা দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লেন। আমি আগের মতোই রুমময় ঘুরে ঘুরে বই পড়তে লাগলাম। আধাঘন্টা পর আমাকে ডাকতে ডাকতে রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন মামানি। আমি তাকাতেই বললেন,
—” আচার হয়ে গেছে আয়।”
আমি দাঁত বের করে হেসে বললাম,
—” মামানি? আচারের বাটি কি এখানে আনা যায় না? এখানে বেশ হাওয়া আসে। চলো না এখানে বসে খাই আর গল্প করি। প্লিজ…”
মামানি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,
—” আচ্ছা। ঠিক আছে।”
কিছুক্ষণের মাঝেই মামানি আচার নিয়ে রুমে এলেন। মামানি বিছানার এক কোণায় আর আমি চেয়ার টেনে পাশে বসে গল্পে মন দিলাম। মামানি আর আমার গল্পের মাঝপথেই বিরক্তি নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
—” আম্মু? যাবা রুম থেকে? কি সব আজাইরা গল্প শুরু করে দিয়েছো। এই বাসায় কি গল্প করার জন্য আর কোনো রুম নাই? ঘুমোতে দাও তো…যাও।”
মামানি ভ্রু কুঁচকালেন। আচারের প্লেটটা পাশে রেখে ফুঁসে ওঠে বললেন,
—” এতোক্ষণ তো তোর কোনো সমস্যা হচ্ছিলো না। আমি এসে বসতেই তোর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে গেলো?”
—” আশ্চর্য! আমি কি বলেছি যে ওকে রেখে তুমি একা চলে যাও? আমি দু’জনকে মিন করেই বলেছি। দরকার হলে পুচকিকে বাইরে বসিয়ে রেখে তুমি একা এখানে আমার পাশে বসে থাকো। কিন্তু দু’জন একসাথে বসে কান খেয়ো না প্লিজ।”
—” আমি এখন তোর কান খাওয়ার মানুষ হয়ে গেলাম? এই ছেলেকে পেটে ধরছি আমি? আজ আমার একটা মেয়ে থাকলে এই দিন দেখতে হতো না।”
মামানির কথায় শুভ্র ভাই চরম বিরক্ত। চোখ মুখ কুঁচকে ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে পাশের বালিশটা মাথায় চেপে রাগী গলায় বললেন,
—” করো গল্প। মহিলা মানুষ মানেই আপদ। ‘ক’ বললে কোলকাতা বুঝাটা এদের জন্মগত স্বভাব। রিডিকিউলাস।”
মামানি কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। আমার দিকে তাকিয়ে উৎসাহ নিয়ে বললেন,
—” ওকে ছাড়। রুহিকে যে দেখতে এসেছিলো ওই ছেলেকে দেখেছিস তুই? দেখতে কেমন রে?”
আমি আচারের টুকরো মুখে দিতে দিতে বললাম,
—” আমি কি করে দেখবো? বাসার কেউই তো দেখে নি। ঘটক বললো ছেলে নাকি লম্বা। দুধের মতো ফর্সা হেনতেন। আমার তো ভাল্লাগে নাই। ছেলে জিরাফের মতো লম্বা আর ফর্সা হলেই হয় নাকি? ফর্সা ছেলেদের বলদ বলদ লাগে। তার থেকে শ্যামা ছেলেদেরই মিষ্টি লাগে। তাই না মামানি?”
—” হ্যাঁ। নুরজাহানের ছেলে নাহিদ কিন্তু শ্যামা। তবু নাঈমের থেকে নাহিদকে সুন্দর লাগে। কি মিষ্টি চেহারা। ফর্সা হলেই….”
এটুকুই বলেই থেমে গেলেন মামানি। আমিও নিশ্বাস বন্ধ করে আচার চিবুতে লাগলাম। ততক্ষনে শুভ্র ভাই বিছানায় ওঠে বসেছেন। শুভ্র ভাইকে উঠতে দেখেই মামানি ‘অনেক কাজ আছে’ এই বাহানা দিয়ে ওঠে গেলেন। শুভ্র ভাই চেঁচিয়ে ওঠে বললেন,
—” কোথায় যাও? দাঁড়াও… নিজের ছেলের নামে বসে বসে নিন্দা করছো আম্মু? আনবিলিভেবল। ফর্সাতে এতো সমস্যা হলে ফর্সা ছেলে বিয়েটা কেন করেছিলে। আম্মু? আরে…”
আমি এবার ওঠে দাঁড়ালাম। আচারের বাটিটা হাতে নিয়ে কোনো রকম দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। সাথে সাথে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন উনি,
—” আরেকদিন যদি মুখে নাহিদের গুণগান শুনেছি তো দুটোকেই নাহিদের বাসায় দিয়ে আসবো। অসহ্য!”
আমি বিরবির করে বললাম,
—” নাহিদ ভাইয়াদের বাসাটা যথেষ্ট সুন্দর। আমার বা মামানির কারো কোনো সমস্যা নেই।”
—” এই? কি বললি তুই?”
উনার কথাটা শেষ হওয়ারার আগেই দৌঁড়ে রুমের সীমানা পাড় করলাম আমি। রান্না ঘরে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। মামানি আমার দিকে ফিরে তাকাতেই দু’জনে দমফাঁটা হাসিতে ফেঁটে পড়লাম। হাসিটা কোনোরকম থামিয়ে বলে উঠলেন মামানি,
—” অনেকদিন পর এভাবে হাসলাম রোদু। আজ থেকে যা না মা। গিয়ে গোসল করে নে।”
—” কি যে বলো না মামানি। আমি কি জামা-কাপড় এনেছি যে গোসল করবো? তাছাড়া, আজ যেতে হবে নয়তো আম্মু বকবে খুব।”
—” তোকে এতো পাক্নামো কে করতে বলেছে? আমি তোর আম্মুকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি। আর গোসল করে আমার শাড়ি পড় আজ। আমার আগের ব্লাউজগুলো ঠিক হয়ে যাবে তোর। আমি আজ তোকে আমার ইচ্ছে মতো সাজাবো। তুই আমার মেয়ে হলে রোজ সাজিয়ে দিতাম। যা…”
—” কিন্তু মামানি….”
—“কোনো কিন্তু নয়, চল।”
অগত্যা মামানির কথাতেই রাজি হতে হলো আমায়। একটা গোলাপী-সাদা সিল্ক শাড়ি পড়িয়ে ইচ্ছে মতো সাজালেন। মামানির মুখে প্রশান্তির হাসি। সাজানো শেষ হলে দু’জনেই খেতে বসলাম। মামানি জোর করেই প্লেট তুলে নিয়ে বললেন,
—” চল তোকে খাইয়ে দিবো।”
আমি ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললাম,
—” কি দরকার? দাও আমি খাচ্ছি। আমাকে খাইয়ে দিলে তুমি কখন খাবে? আর শুভ্র ভাই আর মামু কোথায়?”
—” ওদের আর খাওয়া! একেক জন একেক সময় খাবে। তুই হা কর তো।”
—” তাহলে চলো সোফায় বসে খাই। টিভি দেখবো।”
—” আচ্ছা চল।”
আমরা সোফায় গিয়ে বসার কিছুক্ষণের মাথায় ডোরবেল বাজলো। মামানি গলা উঁচিয়ে শুভ্র ভাইকে ডাকলেন,
—” এই শুভ্র? বাবা দরজাটা খোল একটু।”
শুভ্র ভাই সাথে সাথেই উত্তর দিলেন,
—” ইচ্ছে করছে না।”
মামানি ফুঁসে ওঠে বললেন,
—” শুনো ছেলের কথা। দরজা খুলবি এতে ইচ্ছে করা না করার প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে? বাপ ছেলে দু’জনেই জ্বালিয়ে খেলো আমায়।”
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
—” আমি খুলছি মামানি।”
ধীর পায়ে গিয়ে দরজাটা খুলতেই ভেতরে এলেন দু’জন মহিলা আর একটি আমার বয়সী মেয়ে। এদের মধ্যে একটা মহিলাকে হয়তো এক আধবার দেখেছিলাম আমি। মহিলাগুলো আমাকে উপর-নিচ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করে মামনির দিকে তাকালেন। মামানি ভাতের প্লেটটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। স্মিত হাস্যে বললেন,
—” আরে ভাবি? কেমন আছেন? এখান থেকে চলে যাওয়ার পর তো আর খোঁজ-খবরই নেন না। এটা আপনার বোন সেলিনা আপা না?”
উনাদের মধ্যে একজন মহিলা বললেন,
—” হ্যাঁ ভাবি। আসলে, আসবো আসবো করেই সময় করে উঠতে পারি না।”
মামানি হেসে বললেন,
—” সময় কি আর হয়? করে নিতে হয়। বসুন ভাবি।”
উনারা বসলেন। আমিও দরজাটা বন্ধ করে মামানির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাথে সাথে পাশে বসা মহিলাটি বলে উঠলেন,
—” আপনার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন নাকি ভাবি? ছেলের বউ এটা? ভালোই তো দেখতে। কিন্তু আপনার ছেলে না সাদা ফর্সা? বউ আরেকটু ফর্সা হলে ভালো হতো। হাইটও একটু কম মনে হচ্ছে। প্রেমের বিয়ে নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ? আজকাল তো ছেলেমেয়েরা প্রেম করেই বেশি বিয়ে করছে।”
মামানি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকালেন। আমার মেজাজটা তখন চড়কগাছ। মামানি আমার হাত টেনে পাশে বসিয়ে বললেন,
—” তাড়াতাড়ি ‘হা’ কর জলদি শেষ কর এটুকু।”
আমি মৃদু গলায় বললাম,
—“আর খাবো না মামানি। প্লিজ।”
—” ছেলের বউকে বেশ আদরে রেখেছেন ভাবি। এখন বুড়ো বয়সে দেখলেই হলো।”
আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মহিলাটার চুলগুলো টেনে বলি, আমি যে মামানি ডাকছি শুনছিস না? শাশুড়িকে কেউ মামানি ডাকে? আমার ভাবনার মাঝেই হেসে উত্তর দিলেন মামানি,
—” এটা আমার ননদের মেয়ে ভাবি।”
মহিলাটি বিস্মিত হয়ে বললেন,
—” এটা আপনার ছেলের বউ না?”
মামানি মৃদু হাসলেন। ঠিক তখনই রুম থেকে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে এদিকে তাকালেন। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
—” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?”
আগের মহিলাটিই হাসি হাসি মুখ নিয়ে সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
—” সেই চার-পাঁচ বছর আগে দেখেছিলাম। আগের থেকে স্বাথ্যবান হয়ে গেছো দেখছি।”
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
—” ভার্সিটি বন্ধ তো… বাসায় থাকি। টিউশনি করানোর ঝামেলা নেই। তাই আরকি…”
মহিলাটি বেশ আয়েশ করে বসলেন। হাসিমুখে বললেন,
—” আপনার ছেলে কিন্তু মাশাআল্লাহ অনেক ভদ্র ভাবি। আমার মেয়েটাও এমন। আমার মেয়েটার কথা মনে আছে তো? দুটো পয়েন্টের জন্য ভার্সিটিতে চান্স হলো না। একটার পর একটা বিয়ের ঘর আসছে। সুন্দরী মেয়ে থাকলে যা ঝামেলা হয় আরকি৷ তারওপর ভদ্র। আমাদের পিংকিও তো অনেক ভদ্র। আমার মেয়েটাও খুব ভদ্র। বাসা থেকেই বের হয় না। কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে গেলেই ভয়ে কাঁপে দু’জনেই।”
মামানি কিছু বলবেন তার আগেই ইনোসেন্ট মুখ নিয়ে পাশের মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়লেন শুভ্র ভাই,
—” কেমন আছো পিংকি?”
মেয়েটা লাজুক হাসি দিয়ে বললো,
—” ভালো আছি ভাইয়া।”
—” কাল তো তোমাকে পার্কের একটু এইপাশে গলির মোড়ে দেখলাম। শাহিন ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়েছিলে।”
সাথে সাথেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো মেয়েটির। মহিলা দুটো গোল গোল চোখে পিংকির দিকে তাকালেন। তাদের দৃষ্টি দেখেই বুঝা যাচ্ছে, শাহিন নামে কাউকে চেনে না তারা। শুভ্র ভাই আগের মতোই ইনোসেন্ট চেহারা নিয়ে বললেন,
—” করোণাকালীন সময়ে ওভাবে ঘুরাফেরা করা উচিত নয়। আর বাইকে তো একেবারেই না। রিস্ক থাকে তো খুব। এখন তো বড় হয়েছো….সচেতন হতে হবে তো নাকি?”
শুভ্র ভাইয়ের কথায় দমফাটা হাসিতে ফেঁটে পড়তে ইচ্ছে করলেও চুপচাপ মুখ চেপে বসে রইলাম। মানুষকে কিভাবে, কতভাবে অপমান এবং বাঁশ দেওয়া যায় তা হয়তো উনার থেকে শেখা উচিত। পিংকি মেয়েটা পাংগু মুখে বসে রইলো। শুভ্র ভাই মৃদু হেসে বললো,
—” রোদ? আম্মু আন্টিদের সাথে গল্প করছে তুই একটু খেতে দে আমায়।”
আমি চুপচাপ ওঠে গেলাম। মহিলাটি মৃদু স্বরে বললেন,
—” আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে এমনই হয়। বউকে ‘তুই’ করে ডাকাটা কেমন শুনায়?”
উনার কথাটা কানে যেতেই আমার একটি কথায় মনে হলো। আর তা হলো, “মহিলাটি পাবনা ফেরত পাগল।” মামানি বললোই আমি তার ননদের মেয়ে তবু শুভ্রর বউ নামক কীড়া তার মাথা থেকে যায় নি। অদ্ভুত! মহিলার কথায় আমি বিরক্ত হলেও শুভ্র ভাই চরম রকম অবাক হলেন। খাবার টেবিলে বসে প্রথমেই বললেন,
—” এই? ওই মহিলা ওই কথাটা কেন বললো? তোকে আর আমাকে ইন্ডিকেট করেই তো বললো, না?”
আমি জবাব না দিয়ে চুপচাপ খাবার সার্ভ করতে লাগলাম। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—” মা কি তোকে বউ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নাকি রে? কি সাংঘাতিক ব্যাপার!”
আমি এবারও কিছু বললাম না। উনি প্লেটটা টেনে নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন,
—” শাড়ি পড়লে তোকে অনেকটাই তাই মনে হয়। ব্যাপারটা খারাপ না। শাড়িই পড়ে থাক। খুলিস না…”
আমি এবার বিরক্তি নিয়ে তাকালাম। উনি খেতে নিয়েও থেমে গিয়ে বললেন,
—” আম্মু খেয়েছে?”
আমি চেয়ারে হাত রেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
—” না খায় নি। “
—” আর তুই? খেয়েছিস? ও সরি…তুমি খেয়েছো?”
এটুকু বলে নিজেই হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে উঠলেন উনি। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
—” আশ্চর্য! এতো ঢং করছেন কেন?”
উনি হাসতে হাসতেই বললেন,
—” ঢং কই করলাম? ওই আন্টির কথামতো ট্রাই করছিলাম। আর দু-একবার ট্রাই করলে হাসতে হাসতেই মরে যাবো আমি।”
আমি রাগ নিয়ে বললাম,
—” আপনাকে কেউ ট্রাই করতে বলেছে? আজাইরা কাজে সবসময় হাজির। আর এভাবে হাসছেন কেন? একদম হাসবেন না। চুপচাপ খাবার খান নয়তো খাওয়া বন্ধ।”
উনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললেন,
—” আচ্ছা যা। হাসবো না আর। এবার সিরিয়াসলি জিগ্যেস করছি, তুমি খেয়েছো?”
এটুকু বলে আবারও উনি হাসিতে মেতে উঠলেন। উনার থেমে থেমে ঝংকার তোলা হাসির দিকে তাকিয়ে থেকে কটমট গলায় বললাম,
—” আপনি জাস্ট অসহ্য। আরেকবার হাসলে ডিরেক্ট খুন করে ফেলবো। হাসি থামান।”
উনি হাসি থামালেন না। উনার হাসির মাঝেই ফোন বাজলো। সেই ফোনের বাহানায় হলেও হাসিটা কমিয়ে ফোন রিসিভ করলেন। চাপা গলায় বললেন,
—” দোস্ত আজ নয় প্লিজ। আজ আমি বিজি। বের হতে পারবো না।”
ওপাশে কে বা কি বললো শুনা গেলো না। উনি আবারও জোর দিয়ে বললেন,
—” আরে শালা, বুঝিস না কেন। সিরিয়াসলি ব্যস্ত আছি নয়তো যেতাম। মেজাজ খারাপ করিস না। আরে তুই… আচ্ছা ঠিক আছে। আসছি বাট মাত্র একঘন্টা,ওকে? আচ্ছা রাখছি।”
উনি এবার কোনোরকম কথা না বলে খাবারে মনোযোগ দিলেন। আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি হুট করেই আমার হাত টেনে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
—” হা কর।”
প্রথম দফায় খানিকটা চমকে গেলেও পরবর্তীতে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। উনার হাতটা ছাড়িয়ে ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন উনি। প্লেটের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,
—” ‘হা’ না করলে ছাড়বো না। আগে হা কর তারপর ছাড়বো।”
আমি বিরক্তি নিয়ে উনার দিকে তাকালাম। তারপর হুট করেই মামুর রুমের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—” মামু! মামু তুমি খাবে না?”
‘মামু’ শব্দটা শুনেই হাতটা ছেড়ে খানিকটা সরে বসার চেষ্টা করলেন উনি। আমিও ঝটপট ওঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা তফাৎ এ গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আড়চোখে মামুর রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আমার চালাকিটা বুঝতে পেরেই হেসে ফেললেন। আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
—” খুব পেকে গেছো রোদপাখি।”
আমার ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক চিলতে গর্বমাখা হাসি। উনি আবারও খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
—” বাইরে এসেছিলাম তোকে ডাকতে। খেতে নয়। আমার রুমে যা। বেডসাইড টেবিলে একটা বক্স আছে।”
—” তো?”
—” তো তোর মাথা। বেশি কথা না বলে যা তো।”
আমি অলস ভঙ্গিতে উনার রুমের দিকে এগুলাম। ড্রয়িংরুমের সোফা থেকে এক পলকের জন্য আমার দিকে তাকালেন সেই মহিলা। আমি সেসব পাত্তা না দিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো সেই কাঙ্ক্ষিত বাক্স। একটি কাঁচের বাক্স। আমি আলতো হাতে বাক্সটা তুলে নিতেই বুঝতে পারলাম,
এটা একটা চুড়ির বাক্স। লাল, নীল, হলুদ আর কালো….চার রঙের কাঁচের চুড়িতে ভরে আছে বাক্সটা। আমি বাক্সটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। কিছু একটা নেই নেই মনে হচ্ছে। কিছুতে নেই। হঠাৎ ফ্লোরের ওপর পড়ে থাকা সবুজ কাগজের টুকরোর ওপর চোখ আটকে গেলো আমার। কাগজটা দেখেই হালকা হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটে। আনমনে এই চিরকুটটাকেই হয়তো খুঁজছিলাম আমি। উনার দেওয়া সব উপহারেই এমন একটা চিরকুট থাকা চাইই চাই। আমি নিচু হয়ে চিরকুটটা হাতে তুলে নিলাম। তাতে লেখা,
” এর আগের বারের সবকটা চুড়িই তুমি ভেঙে ফেলেছিলে, মনে আছে? চাইলে এবারও ভাঙতে পারো। তোমার তো আবার ভাঙাভাঙির অভ্যাসটা জন্মগত। তবে, ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগে না। একবার না ভাঙলে তো আর দ্বিতীয়বার কেনা যায় না। জানো? আমি প্রতিদিন উইশ করি তোমার ওই বাম পায়ের নুপুরটা যেন হারিয়ে যায়। কিন্তু আমার উইশটা পূরণ হচ্ছে না। নুপুরটা কিছুতেই হারাচ্ছে না। তিন তিনটা বছর ধরে এই একটা নুপুরই এভাবে আগলে রেখেছো কেন বলো তো? ইচ্ছে করেও তো হারিয়ে ফেলতে পারো। তাহলেই নতুন একটা পাওয়া যায়। তুমি বড্ড বোকা, সেই কাজটা তুমি কিছুতেই করবে না।
লাস্ট টাইম তোমার ঘুমের মধ্যে রাফিয়া নুপুরটা খুলে নিজের পায়ে পড়েছিলো বলে তোমার সেকি কান্না। আমি সেদিন হতবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। একটা নুপুরের জন্য একটা মানুষ এতোটা কাঁদতে পারে বুঝি? এখন আমার নিজের দেওয়া ওই নুপুরটার প্রতিও আমার মারাত্মক হিংসে হয়। মানুষটার চেয়ে নুপুরটাকে বেশি ভালোবাসাটা কিন্তু অন্যায় রোদপাখি। আর এই অন্যায় আমি মানতে নারাজ।”
চিরকুটটা পড়ে হেসে ফেললাম আমি। মন জুড়ে বয়ে গেলো অদ্ভুত এক পরিপূর্ণতাময় শিহরণ!
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/