রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৪৩
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
‘সপ্তাহ’ —– এই চার বর্ণের ছোট্ট শব্দটা উচ্চারণ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কিন্তু, এই সপ্তাহের মাঝে লুকিয়ে থাকা ছাপ্পান্নটি প্রহর পাড়ি দিতে শুধু যে বেগ পেতে হয় তা নয়, ভয়ানক এক যুদ্ধে নামতে হয়। সেই যুদ্ধটা হয় কখনো মনের সাথে মস্তিষ্কের তো কখনো মনের সাথে চামড়ায় ঢাকা এই শরীরটার। আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধটা কিন্তু করতেই হয়। নির্ঘুম রাত, খাবারের প্লেট এমনকি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দুগুলোর সাথেও চলে বিষাক্ত মুহূর্তগুলোর নির্মম যুদ্ধ। আমিও যুদ্ধ করেছি।
এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা দিয়েই পাড় করেছি আস্ত একটা সপ্তাহ। ‘পড়ছি’ বাহানায় ঘন্টার পর ঘন্টা শান্ত, নিথর বসে থেকেছি। সারাদিন দরজা বন্ধ রেখে, ব্যস্ততার নামে দুঃখ লুকিয়েছি। কাঁথা দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ঘুমের নামে নির্ঘুম রাত পার করেছি। ‘পড়াশোনা নিয়ে ডিপ্রেশড’ বাহানা দিয়ে সকালের খাবার দুপুরে আর দুপুরের খাবার মধ্যরাতের রুটিনে ফেলে রেখেছি। তবুও হেরে যাই নি। কারো সামনে এক বিন্দু কাঁদি নি, হা-হুতাশ করি নি। কিন্তু, আমার এই হেরে না যাওয়াটা বেশিদিন টিকলো না। যেখানে আমার তীব্র ভয়, তীব্র অস্বস্তি সেখানেই বিশাল এক ভুল করে ফেলল রাফিয়া।
রাফিয়ার ‘ভেঙে যাবে যাবে’ সম্পর্কটা তখনও ভাঙে নি। কোনো একটা উপায়ে সম্পর্কটা আবারও জোড়া লেগে গিয়েছে। শুধু জোড়া লেগেও ক্ষান্ত হয় নি। আগামী এক-দুই মাসের জন্য কাটা-ছেঁড়া সম্পর্কের হায়াতটাও বেড়ে গিয়েছে। কিভাবে বেড়েছে, কে জানে? জানালার শিকে পা তুলে বিছানায় বেশ আরাম করে শুয়ে ছিলাম আমি। মুখের সামনে একটা বই নিয়ে গম্ভীর মুখভঙ্গিতে তাকিয়ে আছি। এমন সময় রাফিয়া এলো। বিছানা থেকে আমার ফোনটা তুলে নিয়ে বলল,
—-” ব্যালেন্স আছে?”
আমি বই থেকে চোখ তুলে তাকালাম। ভ্রু বাঁকিয়ে বললাম,
—-” না। নেই।”
রাফিয়ার মুখটা চুপসে এলো। বিছানায় বসে আমার ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,
—-” সিফাতের সাথে কথা বলতে বলতে ফোন অফ হয়ে গিয়েছে। মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট কথা চলছিল, বুঝলি?”
আমি জবাব দিলাম না। বিরক্ত চোখে বইয়ের পাতায় মুখ ডুবালাম। রাফিয়া কিছুক্ষণ একা একা বকবক করে হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলো। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
—-” রোদু? শুভ্র ভাই হোয়াইটস্ অ্যাপে আছেন। উনাকে টাকা পাঠাতে বলি?”
আমি অসচেতন গলায় বললাম,
—-” হু।”
—-” কত টাকা পাঠাতে বলব? ত্রিশ?”
আমি এবার চোখ তুলে তাকালাম। কপাল কুঁচকে বললাম,
—-” কি?”
—-” শুভ্র ভাইকে ব্যালেন্স দিতে বলি তোর ফোনে, ত্রিশ টাকা।”
আমি চোখ বড়বড় করে বললাম,
—-” অসম্ভব। তুই উনাকে কখনোই ম্যাসেজ করবি না। আমার ফোন থেকে তো ভুল করেও না।”
রাফিয়া বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। অসহায় মুখে বলল,
—-” খুব ইম্পোর্টেন্ট, প্লিজ রোদু।”
বইটা পাশে রেখে উঠে বসতে বসতে বললাম,
—-” কোনো প্লিজ ফ্লিজ চলবে না। দরকার হলে অন্য কাউকে বল তবু শুভ্র ভাইকে না।”
—-” আর কাকে বলবো? আলিফ ভাই, অদুদ ভাই আমার ভাই সব কয়টা ফাজিল। আমি বলতে বলতে মরে গেলেও টাকা সেন্ড করবে না। কিন্তু শুভ্র ভাই ওমন না। আর তুই সেজে ম্যাসেজ দিলে মুহূর্তেই দিয়ে দেবে। তোকে খোঁচা মারার জন্য হলেও দেবে।”
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,
—-” একদম না রাফিয়া। উনার কাছে টাকা চাইব আর আমি! ছি…! তুই আমার ফোন দে বলছি।”
আমাকে বিছানা থেকে নামতে দেখেই তাড়াহুড়ো করে টাইপ করতে লাগল রাফিয়া। আমি দৌঁড়ে গিয়ে ওর হাত থেকে ফোন নিতে নিলেই দৌঁড়ে বিছানার উপর উঠে গেলো সে। বেশ কিছুক্ষণ ছুটোছুটির পর বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল রাফিয়া। দাঁত কেলিয়ে বলল,
—-” ম্যাসেজ সীন হয়ে গিয়েছে। আহা! আহা!”
আমি দ্রুত হাতে ফোনটা নিজের কাছে নিলাম। উদ্বিগ্ন চোখে ম্যাসেজের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই ম্যাসেজ সীন করেছেন। রাগে-দুঃখে কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। রাফিয়াকে ধরে ঠাটিয়ে চড় বসাতে ইচ্ছে করছে। আমি শুভ্র ভাইকে আরেকটা ম্যাসেজ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব কি বলব না সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ফোনে ম্যাসেজ টুন বাজলো।
: 207: Account refilled TK 50……. ম্যাসেজটা দেখেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। রাফিয়া উনাকে ত্রিশ টাকা রিচার্জ করে দিতে বলেছেন আর উনি এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মিনিটের মধ্যে পঞ্চাশ টাকা রিচার্জ করে দিয়েছেন। বিষয়টা আমার আত্মসম্মানে তীব্র আঘাত হানলো। রাগে চোখদুটো টলমল করে উঠলো। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে তুমুল আক্রোশ নিয়ে রাফিয়ার দিকে তাকালাম। রাফিয়া প্রথমবারের মতো আমার চাহনী দেখে ভয় পেলো। ওর ঠোঁটে লেগে থাকা দুষ্টু হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে চোখে-মুখে একরাশ অস্বস্তি ভর করলো। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
—–” তুই হঠাৎ এমন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস কেন, রোদু? সিম্পল একটা ব্যাপার নিয়ে….”
আমি ফুঁসে উঠে বললাম,
—-” সিম্পল? কিসের সিম্পল? এটা তোর কাছে সিম্পল হলেও আমার কাছে নয়। তোকে আমি মানা করার পরও ম্যাসেজ কেন করলি উনাকে? তাও আবার আমার নাম করে? সব সময় এমন ছ্যাচড়ামো না করলে চলে না তোর?”
রাফিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল। আমি আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। রাফিয়াকে এভাবে বলাটা উচিত নয় নি। আর যায় হোক, বেড়াতে এসে কেউ এমন ধরনের কথার শিকার হতে চায় না। নিশ্চয় ভীষণ অপমানিত ফিল করছে মেয়েটা। আমি কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজা খুলতে খুলতে বললাম,
—-” মাথার ঠিক ছিলো না, সরি। মন খারাপ করিস না।”
রাফিয়া আমার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
—-” কই যাচ্ছিস?”
—-” ফেক্সিলোডের দোকানে।”
আমার কথায় থমকে দাঁড়াল রাফিয়া। আৎকে উঠে বলল,
—-” দোকানে মানে? রাত দশটা বাজে রোদ। এতো রাতে দোকানে!”
আম্মু টেবিল গোছাচ্ছিলেন। রাফিয়ার কথাটা কানে যেতেই ভ্রু কুঁচকালেন,
—-” কি হয়েছে?”
রাফিয়া উত্তর দিলো না। আমি দৃঢ় গলায় বললাম,
—-” আমি ফেক্সিলোডের দোকানে যাব। দরকার আছে।”
—-” এতো রাতে কিসের দোকান? দিন দিন বুদ্ধিশুদ্ধি কমছে নাকি তোর? যা ঘরে যা।”
আমি আগের থেকেও দৃঢ় গলায় বললাম,
—-” আমি যাব।”
আমার দৃঢ় জবাবে হঠাৎই কোনো কথা খুঁজে পেলেন না আম্মু। আব্বু আর ভাইয়া এসে বুঝালো, কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত ভাইয়ার মতো কুঁড়ে মানুষটাও দোকানে গিয়ে লোড করে এনে দিতে রাজি হলো কিন্তু আমিও বদ্ধপরিকর, যাব মানে যাবই। ভাইয়াকে শুভ্র ভাইয়ের নাম্বারে টাকা পাঠাতে বললে কি একটা বিশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হবে! তার থেকে আমার যাওয়াটাই ভালো। ঘড়ির কাটা যখন সাড়ে দশটায় পৌঁছালো তখন ভাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে ফেক্সিলোডের দোকানে গেলাম। শুভ্র ভাইয়ের নাম্বারে পঞ্চাশ টাকা সেন্ড করেই ক্ষান্ত হলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উনাকে ম্যাসেজ পাঠালাম,
—-” আগের ম্যাসেজটা রাফিয়া ফাজলামো করে পাঠিয়ে ছিলো, সরি। আপনার ফোনে টাকাগুলো রিটার্ন করেছি।”
এক মিনিটের মাথায় ম্যাসেজ সীন হলো কিন্তু রিপ্লাই এলো না। দু’মিনিট পর ফোনে আবারও ম্যাসেজ টুন বাজলো। :207: Account refilled TK 100…… ম্যাসেজটা দেখেই মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা হলো আমার। এই কাজটা যে উনার তা আর বলার অপেক্ষা রাখলো না। মুহূর্তেই রাগে শরীরটা জ্বলে উঠলো আমার। বর্তমানে কলেজ, প্রাইভেট কিচ্ছু নেই তাই হাত খরচা নামক উপরি টাকাটাও নেই। শুভ্র ভাইয়ের সাথে এই খেলায় আমি জিততে পারব না। সম্ভবও নয়। আমি আবারও ম্যাসেজ পাঠালাম,
—-” সমস্যা কি? আবার টাকা পাঠালেন কেন আমার নাম্বারে? টাকা বেশি হয়ে গিয়েছে আপনার? টাকা বেশি হয়ে গেলে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে দেন, আমাকে নয়।”
সাথে সাথেই ম্যাসেজ সীন করলেন শুভ্র ভাই কিন্তু রিপ্লাই দিলেন না। আমি উনার রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম…. এক দুই তিন করে আধাঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত রিপ্লাইটা পেলাম না। রাগ লাগল, মেজাজ খারাপ হলো, এক সময় কান্নাও পেলো কিন্তু কোনো সমাধান মিললো না। নির্ঘুম রাতটার একটা সময় এসে মনে হলো, ‘ এই পৃথিবীতে শুভ্র ভাইয়ের আত্মীয় হয়ে জন্মানোটাই ছিলো আমার সবচেয়ে বড় ভুল। সবচেয়ে বড় পাপ। এর থেকে বড় ভুল আমার জন্য আর কিছু হতে পারে না।’ এই লোকটাকে আমি ভালোবাসি না আবার ঘৃণাও করতে পারি না। উনার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় কিন্তু জুতো ছুঁড়ে মারার ইচ্ছে বা সাহস জাগে না। উনার প্রতি আমার তীব্র শ্রদ্ধাবোধ কোনো কিছুর বিনিময়েই এক তিল পরিমাণ টলে না। উনার প্রতি আমার এই অবিচল শ্রদ্ধাবোধকে কেন্দ্র করেই উনাকে আমি নিজের মনেও গালি দিতে পারি না। একটাবারের জন্য ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতে পারি না। উনি আমার মাঝে এমন একটি শুভ্রকে বপন করেছেন যাকে আমি চাইলেও উপড়ে ফেলতে পারি না। সে নিজের মতো গম্ভীর মুখভঙ্গি নিয়ে বসে থাকে। আমাকে দেখে আর আকাশ- পাতাল ভাবে, আমার হাজার ধিক্কারেও মুখ ফেরায় না। কয়েক মুহূর্তের জন্যও না।
_____________________
সকালের খাবারটা শেষ করে মাত্রই বিছানায় এসে বসেছি আমি। বিছানায় রাখা এডমিশনের বইটা উল্টেপাল্টে দেখছি আর নানান কথা ভাবছি। এমন সময় ফোন বাজলো। এদিক-সেদিক খুঁজে কম্বলের নিচ থেকে ফোনটা বের করতে করতে কল কেটে গেলো। দু’মিনিট পর আবারও বাজলো। আমি অনিচ্ছাসত্বেও ফোন রিসিভ করে কানে নিলাম। ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় বলে উঠলেন মামানি,
—-” হ্যালো, রোদু বলছিস?”
—-” হ্যাঁ মামানি। কেমন আছো?”
—-” আমার কথা ছাড়। তোদের মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তো?”
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
—-” আমাদের মধ্যে মানে? কার কথা বলছ?”
—-” তুই খুব ভালো করে জানিস কার কথা বলছি। আমার ছেলের পাগলামোর মাত্রা দেখেই বুঝতে পারছি কিছু একটা ঘটেছে। শুভ্র আমায় কিছুই বলবে না। তুুুই বল, কাহিনী কি?”
—-” কোনো কাহিনী নেই মামানি।”
মামানি চিন্তিত গলায় বলল,
—-” শুভ্রর কার্যকলাপ দেখে তো মনে হচ্ছে না যে কোনো কাহিনী নেই। সেদিন বাসায় এসে কোনো কথা নেই বার্তা নেই রুমের জিনিসপত্র ভেঙেছে। তারপর যখন মনে পড়েছে ওর বাবা অসুস্থ, বাসায় উচ্চশব্দ করা যাবে না তখন ভাঙচোর থামিয়ে থমথমে মুখ নিয়ে বসে থেকেছে। সেদিন আবার জ্বর শরীর নিয়ে কোন পুকুর থেকে সাঁতার টাতার কেটে এসেছে। রাগ উঠলে ছেলের মাথা ঠিক থাকে না। কারো কথা শুনে না। তবুও সাহস করে তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টাতে বললাম। কিন্তু ছেলের সেকি কান্ড! পোশাক না পাল্টিয়ে আরো দু’ঘন্টা ওয়াশরুমে শাওয়ার নিচে বসে থাকলো। রাগ দেখানোর জায়গা পাচ্ছে না বলে নিজের উপর ঢালছে। বল, এগুলো ভালো লাগে? কাল আবার কাঁচের ফুলদানিতে লাথি মেরে পা কেটে ফেলেছে। সকালে ওঠে দেখি ছেলের পায়ে ব্যান্ডেজ, চাদরে রক্ত লেগে আছে। অথচ আমাকে বলে নি পর্যন্ত। আমার এই রাগী ছেলেটাকে নিয়ে কি করি বল তো?”
আমি জবাব দিলাম না। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো একটি দীর্ঘশ্বাস। মামানি একটু থেমে আবারও বললেন,
—-” আজ সকালে ধরে-বেঁধে জিগ্যেস করেছি, কি হয়েছে? এইটুকু জিগ্যেস করেই যেন ফাঁদে পড়ে গিয়েছি আমি। ছেলে জোর গলায় বলে দিয়েছে, সে বিয়ে করতে চায় এবং বিয়ে করবে।”
মামানির কথায় চোখ বড় বড় হয়ে এলো আমার। নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু গলায় বললাম,
—-” বিয়ে করতে চাইছে তো বিয়ে করিয়ে দাও, ধরে রেখেছে কে?”
মামানি হতাশ গলায় বললেন,
—-” এটা বিয়ে করার সময় ওর? এখনও মাস্টার্সটাই শেষ হলো না। তবু, আজ বিকেলে যাব তোদের বাসায়। তোর মাকে বলে দেখবো কথাটা। কে জানে কেমন রিয়েকশন হবে তোর মায়ের।”
আমি আৎকে উঠে বললাম,
—-” আমার মাকে বলবে মানে? কি বলবে?”
—-” কি আবার? তোদের বিয়ের কথা।”
—-” মানে কি? কি সব বলছ মামানি? আমি এখনও বাচ্চা একটা মেয়ে। তাছাড়া, তুমি সিওর শুভ্র ভাই আমার কথা বুঝিয়েছেন?”
মামানি অবাক হয়ে বললেন,
—-” বুঝাবে কি রে? ও তো তোর কথায় বললো।”
—-” তোমার ছেলে পাগল হয়ে গিয়েছে মামানি। উনার সাথে তুমিও পাগল হয়ে যেও না প্লিজ। উনার কথায় মাকে কিছু বলবে না তুমি, কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাছাড়া, তোমার কথা মেনে নিয়ে উনার থেকে দূরে সরে এসেছি আমি। এখন এসব অদ্ভুত প্রস্তাবের প্রশ্নই আসে না।”
আমার কথায় বিস্মিত হলেন মামানি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
—-” নির্ঘাত আবারও ঝামেলা বাঁধিয়েছিস দু’জনে, আমি প্রথমেই ধারণা করেছিলাম। শোন, কেলেঙ্কারি হলেও কিছু করার নেই। তোর মাকে বলবি আজ বিকেলে তোকে দেখতে আসছে। শুভ্র ডিরেক্ট বলে দিয়েছে, আজ বিকেলের মধ্যে তোর মায়ের সাথে কথা না বললে সে বাসায় থাকবে না, চট্টগ্রাম চলে যাবে।”
আমি বিরক্ত আর উদ্বেগ নিয়ে বললাম,
—-” প্লিজ মামানি। এসব মজা ফজা ভাল্লাগছে না আমার। তুমি অবশ্যই আমাদের বাসায় আসবে না আর মাকে এই বিষয়ে কিছু বলবেও না।”
—-” শুভ্র মানবে না। জানিস তো ও কেমন….”
আমি রাগ নিয়ে বললাম,
—-” দাঁড়াও আমি আসছি তোমাদের বাসায়। তোমার ছেলের ঢং দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি আমি। উনাকে জাস্ট খুন করে ফেলবো আজ। সবকিছু উনার ইচ্ছেমতো হতে হবে কেন? এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? ফাজলামোর একটা লিমিট আছে।”
আমার কথার মাঝেই উৎসাহী গলায় বলে উঠলেন মামানি,
—-” শাড়ি পড়ে আসিস রোদু।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—-” কেন? শাড়ি পড়ব কেন?”
—-” শাড়ি পড়লে তোকে সুন্দর দেখায়, তাই বললাম। দেখা গেল শুভ্র তোকে দেখেই রাগ ভুলে গেল।”
আমি তেঁতে উঠে বললাম,
—-” মামানি! তুমি মাঝে মাঝে তোমার ছেলের থেকেও অদ্ভুত সব কথা বলো। তোমার ধারণা আমি উনার রাগ ভুলাতে যাচ্ছি? কক্ষনো না। আমি তোমার ছেলেকে খুন করতে যাচ্ছি, খুন। সো, বি রেডি।”
কল কেটে ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি। বসার ঘর অতিক্রম করতে করতে রান্নাঘর উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
—-” আম্মু? আমি মামুর বাসায় যাচ্ছি। মামানি ফোন দিয়েছিলো। একটু পরেই ফিরে আসব।”
আমাদের বাসা থেকে শুভ্র ভাইদের বাসার দূরত্ব ১০/১৫ মিনিট। আমি উল্কার বেগে মামুর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। মামানি দরজাটা খুলতেই প্রথম প্রশ্নটা করলাম,
—-” তোমার ছেলে কই?”
মামানি দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে হাসলেন। বললেন,
—-” একদম রৌদ্রমূর্তি! তোকে দিয়েই হবে। আমার ছেলে রুমেই আছে, বেচারার জ্বর।”
আমি শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে যেতে যেতে বললাম,
—-” একদম বেচারা বলবে না। পুরো দুনিয়া বেচারা হয়ে গেলেও তোমার ছেলে বেচারা হতে পারে না।”
মামানি হাসলেন। আমি শুভ্র ভাইয়ের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। শুভ্র ভাই বিছানায় বসে ফোন ঘাটছিলেন। আমি দরজায় ধুমধাম শব্দ করে বললাম,
—-” আসতে পারি?”
শুভ্র ভাই চোখ তুলে তাকালেন। একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে তাকালেন। তারপর আবারও আমার মুখের দিকে তাকালেন কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। আমি আবারও বললাম,
—-” আসতে পারি?”
শুভ্র ভাই এবারও উত্তর দিলেন না। মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার। আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
—-” মামানি? দেখো তোমার ছেলে কেমন করছে।”
মামানি তাড়াহুড়ো করে এদিকে এসে অবাক হয়ে বললেন,
—-” তুই এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
এবার আমি শুভ্র ভাইয়ের ট্রিক ইউজ করে বললাম,
—-” তোমার ছেলে আমায় ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। বলছে, আমার মতো ফাউল মেয়ে তার ঘরে পা রাখলে তার ঘর নাকি অপবিত্র হয়ে যাবে।”
মামানি এবার চূড়ান্ত অবাক হলেন। বিস্ময় নিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালেন। বললেন,
—-” সত্যি? তুই এমনটা বলতে পারিস, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ গম্ভীর চোখে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কারো কথার জবাব না দিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলেন। মামানি আর আমি একে অপরের দিকে তাকালাম। মামানি ফিসফিস করে বললেন,
—-” ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে সুবিধার মনে হচ্ছে না। একটু বেশিই শান্ত লাগছে। একটু সাবধানে কথা বলিস, মা।”
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে গেলাম। সেইদিন মনে মনে করা ‘উনার ঘরে পা রাখবো না’ প্রতিজ্ঞাটা ভেস্তে গেলো। সরাসরি বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। তেজ নিয়ে বললাম,
—-” কি সমস্যা? এমন ভব ধরার কারণ কি?”
উনি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালেন। উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে নিতেই উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। উনার টি-শার্ট খামচে ধরে ধারালো গলায় বললাম,
—-” খবরদার নড়বেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবেন।”
উনি দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার নতুন ঢং দেখে মেজাজটা এবার চরমে উঠলো আমার। চড়া গলায় বললাম,
—-” কি সমস্যা? কথা বলছেন না কেন? নাকি প্রেমিকা ছাড়া অন্যকারো সাথে কথা বলতে মানা আছে? এতোই যখন প্রেমিকাভীতি তখন এসব ঢং এর মানে কি? ফ্রেন্ডদের কাছে গেয়ে বেড়াচ্ছেন তাসনিম আপনার প্রথম ভালোবাসা। তাসনিম ছাড়া আপনার এই পৃথিবীটা পৃথিবী না মঙ্গল গ্রহ, খুবই ভালো কথা। থাকুন আপনার তাসনিমকে নিয়ে, আমাকে খোঁচাচ্ছেন কেন?
আপনার বন্ধু এসে আমাকে অপমান করলো, আমার গায়ে থার্ড পার্সোনের তাকমা লাগিয়ে দিলো, আপনি আপনার সো কল্ড ফার্স্ট লাভের সামনে আমায় অপমান করলেন… এভ্রিথিং ইজ ফাইন। মেনে নিয়েছি আমি। সরে দাঁড়িয়েছি। তবু আপনার মন মানছে না। আমাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়াটা আপনার পোষাবে কেন? পোষাবে না তো। সত্যি করে বলুন তো, আমি একদিন শান্তিতে ঘুমালে আপনার শান্তি বিনষ্ট হয়ে যায়, তাই না?”
উনি কপাল কুঁচকে তাকালেন। বললেন,
—–” আস্তে কথা বল পাশের ঘরে বাবা আছেন। আর যা বলবি স্পষ্ট বল। আমার ফ্রেন্ড তোকে অপমান করেছে, থার্ড পার্সোন, প্রথম ভালোবাসা এগুলোর মানে কি? কি বলতে চাইছিস তুই?”
আমি রাগে ফুঁসে ওঠে বললাম,
—-” কি বলছি মানে? আপনি বুঝতে পারছেন না? ন্যাকা সাজছেন? সাজবেনই না বা কেন? আজকাল নতুন প্রেমিকা যেহেতু জুটে গিয়েছে এসব ছোটখাটো ব্যাপার মনে থাকবে নাকি আপনার? আপনার তো রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেমিকার সাথে করা ফোনালাপের কথা মনে থাকবে। কিভাবে ক্রিকেট খেলার নাম করে প্রেমিকার সাথে পার্কে ঘুরে বেড়ানো যাবে, ফুসকা খাওয়া যাবে সেগুলো মনে থাকবে, তাই না?”
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
—-” আজাইরা কথা-বার্তা আমার সাথে করতে আসবি না। কিসের ফোনালাপ? কি সব বলছিস তুই?”
—-” ওহহো! এখনই ভুলে গিয়েছেন? সেদিন রাতের বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা কার সাথে কথা বলছিলেন আপনি? আর তাসনিম আপু আপনার ওয়াশরুমে কি করছিলো? আর পার্কে বসে ফুসকাটাই বা কে খাচ্ছিলো? আমাকে বলদ মনে হয় আপনার?”
আমার কথার মাঝেই শুভ্র ভাইয়ের ফোন বাজলো। স্ক্রিনে তাসনিম নামটা দেখেই জ্বলে উঠলাম আমি। শুভ্র ভাইয়ের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে কানে নিলাম,
—-” সমস্যাটা কি আপনার? ফোন দিচ্ছেন কেন? ছ্যাঁচড়ামোর যে একটা লিমিট থাকে, তা জানেন? ডাক্তার মানুষ হয়েও কার্টিসি শিখেন নি? কারো লাইফে জোরজবরদস্তি ঢুকে পড়াটা কেমন ভদ্রতা? বেয়াদব মহিলা!”
কথাটুকু বলেই ফোনটা ছুঁড়ে ফেললাম আমি। ফোনটা আমার থেকে দু-তিন হাত দূরে কার্পেটের ওপর গিয়ে পড়লো। ফোনটা ছুঁড়ে ফেলার পর বুঝতে পারলাম, রাগের মাথায় ব্যাপক বড় ভুল করে ফেলেছি। শুভ্র ভাইয়ের ফোনটা নির্ঘাত ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়েছে। এবার আর নিস্তার নেই। দুই-তিনটা চড় তো কনফার্ম। আমি মনে মনে চড় খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। শুভ্র ভাই দুঃখী দুঃখী গলায় বললেন,
—-” শিট! ফোনটা বোধ হয় গেছে। আশ্চর্য তো! এই বেয়াদব মেয়ে, ফোন ছুঁড়ে মারলি কেন? আমি রাগ হলে ফোন ছুঁড়ে মারি বলে কি তোরও মারতে হবে? আমাকে কপি করছিস, ফাজিল!”
আমি থমথমে গলায় বললাম,
—-” আপনাকে কপি করতে যাব কেন? রাগ লাগছিলো তাই ছুঁড়ে মেরেছি। ওই অসহ্যকর মেয়েটা আপনাকে কেন ফোন করেছে?”
শুভ্র ভাই ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালেন। ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
—-” রাগের মাথায় ছুঁড়ে ফেলেছিস বলে মাফ করে দিচ্ছি। শশুরের থেকে ফোনের টাকাটা যৌতুক নেবো, সমস্যা নাই। আর তাসনিম আমাকে কেন ফোন দিয়েছে সেটা তাকে জিগ্যেস করে জেনে নেওয়া যেতে পারে, জিগ্যেস করব?”
—-” আপনি ফাজলামো করছেন আমার সাথে?”
—-” না। করছি না। এতোক্ষণ তোকে ঠাটিয়ে কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু এখন আর মারতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, তোর গায়ে হাত তোলা আমার দ্বারা সম্ভব না। এমন কেন মনে হচ্ছে বল তো?”
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
—-” আপনার জ্বরটা হয়তো বাড়ছে।”
শুভ্র ভাই বিছানায় গিয়ে বসলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
—-” নুপুর খুলেছিস কেন?”
—-” আপনি খেলার নাম করে তাসনিম আপুর সাথে দেখা করতে কেন গিয়েছিলেন? সত্যটা বলে গেলে তো কেউ আটকাতো না। তাহলে এই লুকোচুরি কেন?”
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
—-” আমি মোটেও তাসনিমের সাথে দেখা করতে যাই নি। তাছাড়া, আমি সব রেখে ওর সাথে দেখা করতে যাবই বা কেন? তোর মাথায় হঠাৎ এমন অদ্ভুত বিষয় কেন এলো, বল তো? আমি মাঠে ক্রিকেট খেলছিলাম, তাসনিম হয়তো ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো। আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকলো, আমি গেলাম। তারপর বলল, কিছু কথা আছে। পার্কে বসে বললে ভালো হয়। পার্ক আর মাঠ পাশাপাশি বলে মানা করার কোনো কারণও খুঁজে পেলাম না। পার্কে তো আর এমনি এমনি বসে থাকা যায় না। তাই ওকে জিগ্যেস করলাম ফুসকা খাবে কি না। ব্যস এটুকুই। আর তুই সেটাকে টেনেটুনে কত কি বানিয়ে ফেললি। এজন্যই বলে মেয়েদের ‘ক’ বললে কলকাতা বুঝে।”
আমি মুখ কালো করে বললাম,
—-” এটুকুই! তাহলে সেটা তখন কেন বললেন না?”
—-” তখন কখন? আমি তো আগে থেকেই জানি মহারাণী ক্ষেপে ঢোল হয়ে আছেন। তাকে ঘাটতে গেলেই বিপত্তি। পাব্লিক প্লেসে মানসম্মান কিছু থাকবে না।”
আমার রাগ ততক্ষণে নিভে এসেছে। আমি গুটি গুটি পায়ে শুভ্র ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলাম। মৃদু গলায় বললাম,
—-” সেদিন তাসনিম আপু আপনার ওয়াশরুমে কেন ছিলো? এই বাসায় কি আর কোনো ওয়াশরুম নেই?”
—-” আমরা তো কথা বলছিলাম রে বাবা।’
এটুকু বলে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন উনি। তারপর মৃদু গলায় বললেন,
—-” বাবা ভালো নেই রোদ। বাবার হাত-পা নাড়াচাড়া করতে সমস্যা হচ্ছে। স্টোকের পর অনেকেই প্যারালাইসড হয়ে যায়। আমি বাবাকে প্যারালাইসড অবস্থায় দেখতে চাই না। আম্মুকে তো জানিস? পুরাই বাচ্চাদের মতো বিহেভিয়ার আম্মুর। আম্মুকে এই নিয়ে কিছু বললে দেখা যেত বাবার টেনশনে আম্মুও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যেহেতু তাসনিম ডাক্তার তাই তাসনিমের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সারা বাড়ি তখন মেহমানে ভরপুর। কথা বলার জন্য আমার রুম ছাড়া আর কোনো জায়গার কথা মাথাতেই এলো না। তাই…”
এটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শুভ্র ভাই। আমার বুকে চিনচিনে একটা ব্যথা খেলে গেল। নিজেকে কি ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগলো আমার। শুভ্র ভাই হঠাৎই ফ্লোরে বসে পড়লেন। আমার হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে নিলেন। উনার গা গরম। শরীরটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। উনার তপ্ত হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম আমি। উনি বললেন,
—-” তুই এতো বাচ্চা কেন বল তো? আরেকটু বড় হলে কি হতো? একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা তো। এই এতো এতো সমস্যা, টেনশন আর নিজের মধ্যে আটকে রাখতে পারি না আমি। কাউকে বলতে ইচ্ছে করে। কোনো সমাধানের আশায় নয় শুধু নিজেকে হালকা করার জন্য হলেও বলতে ইচ্ছে করে। আম্মু নিজেই তো অসুস্থ, উনাকে এসব বলা যায় না। বাবাকে তো আরো বলা যায় না। আমার তো আর কেউ নেই। একটা নিজের মানুষ প্রয়োজন আমার। কবে বড় হবি তুই?”
আমি নরম গলায় বললাম,
—-” সরি।”
উনি হাসলেন। ফ্লোর থেকে উঠে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। চোখ দুটো বোজে নিয়ে বললেন,
—-” তুই যেদিন তাসনিমের সাথে কথা বলেছিলি সেদিনই শেষ। এরপর আর কখনও তাসনিমের সাথে ফোনে কথা হয় নি আমার।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—-” তাহলে সেদিন রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছিলেন?”
উনি চোখ মেলে তাকালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—-” কোনদিন রাতে?”
—-” ওইযে যেদিন তাসনিম আপু এখানে ডিনার করলেন সেদিন।”
শুভ্র ভাই ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—-” তুই আসলেই একটা বলদ। তোকে নিয়ম করে দিনে তিনবার চড়ানো উচিত। ওটা আমার স্টুডেন্ট ছিলো। যার জন্য চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম আমি। সে এডমিশনের জন্য আমার কাছেই পড়তে চায়। কিন্তু এটা আপাতত সম্ভব নয়, এসবই বুঝাচ্ছিলাম।”
আমি বিস্ময়ে ‘হা’ হয়ে বসে রইলাম। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফিচেল গলায় বললেন,
—-” খুব জ্বলছিল বুঝি? তোর এতো জ্বলাজ্বলির কারণ কি? আমার প্রেমে টেমে পড়ে যাস নি তো আবার?”
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
—-” ছি! দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব হয়েছে নাকি যে আপনার প্রেমে পড়তে হবে? এসব দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন।”
উনি নিঃশব্দে হাসলেন। দুর্বল গলায় বললেন,
—-” এই তাসনিম নামক পোকাটা তোর মাথায় কিভাবে ঢুকলো বল তো? আরেকটু হলে তো আমার মতো ভার্জিন ছেলেকে তাসনিমের বাচ্চার বাপ হওয়ার অপবাদ লাগিয়ে দিতি। তোর জন্য কিছুই অসম্ভব নয়।”
আমি কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে তুষার ভাইয়ার কথাগুলো খুলে বললাম। কথাগুলো শোনার সাথে সাথেই উঠে বসলেন শুভ্র ভাই। গম্ভীর গলায় বললেন,
—-” ফোনটা তুলে দেখ তো ব্যবহারযোগ্য আছে কি না।”
আমি ধীর পায়ে গিয়ে ফোনটা উঠালাম। স্ক্রিনের এককোণা ফেটে যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষতি হয় নি। শুভ্র ভাই ফোনটা হাতে নিয়েই বাঁকা হাসলেন। কাউকে ফোন লাগাতে লাগাতে বলল,
—-” শশুরের যৌতুকের টাকা বেঁচে গেল দেখছি।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ততক্ষণে ওপাশের মানুষটি ফোন রিসিভ করেছে। শুভ্র ভাই ছোট্ট করে বললেন,
—-” তুই হলি জন্মগত বলদ। আমার সামনে আয় একবার তারপর তোর গার্লফ্রেন্ড তো দূরে থাক তোর মা তোকে চিনতে পারবে কিনা সেটাই ভাবনার বিষয়।আমার সংসার ভাসিয়ে দিয়ে শান্তিতে বসে আছিস ডাফার।”
এটুকু বলেই ফোন কাটলেন শুভ্র ভাই। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
—-” আমার নুপুর আমায় ফেরত দিন, আমি বাসায় যাব।”
শুভ্র ভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। নিষ্প্রভ গলায় বললেন,
—-” নুপুর তো তাসনিম নিয়ে নিয়েছে। ওর নাকি ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
আমি তেজ নিয়ে বললাম,
—-” আমার নুপুর তাসনিম আপু কেন নেবে?”
—-” তুই তো ওকেই দিয়েছিস। কেউ জোর করে দিলে নেবে না?”
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,
—-” ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আমি জানি নুপুর আপনার কাছেই আছে। দেন বলছি। নয়তো আমি মামানিকে বিচার দেব।”
শুভ্র ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন,
—-” আরে বাবা, থাকলে তো দেব। তোর নুপুর আমি নিয়ে কি করব? আমি কি নুপুর পরি?”
—-” আমি কিচ্ছু জানি না। আমার নুপুর আমার চাই মানে চাই।”
আমার কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন শুভ্র ভাই। পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
—-” আচ্ছা দেব। কিন্তু নুপুরের বদলে আমি কি পাব?”
আমি সন্দেহী গলায় বললাম,
—-” কি চাই আপনার?”
উনি নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে বললেন,
—-” আমি?”
আমি মাথাটা খানিকটা পিছিয়ে নিয়ে বললাম,
—-” হু।”
উনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললেন,
—-” বিশবার কানে ধরে উঠবস কর। প্রতিবার উঠবস করার সময় বলবি, রোদ পৃথিবীর নির্বোধ বালিকা। দি গ্রেট শুভ্রর উচিত রোদকে ক্ষমা করে দেওয়া।”
—-” কিহ! জীবনেও এমনটা করব না আমি।”
—-” তাহলে নুপুরের কথা ভুলে যা।”
আমি চোখ-মুখ ফুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই এক গোছা চুল টেনে ধরলেন। আমি ব্যথা পেয়ে আৎকে উঠলাম। শুভ্র ভাই আমার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালেন। চুলগুলোকে আরো একবার শক্ত হাতে টেনে দিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমি শিউরে উঠতেই আমার ডান গালে আচমকাই পর পর দুটো আলতো চুমু দিলেন শুভ্র ভাই। ফিসফিস করে বললেন,
—–” শুভ্র সরি। মেন্টাল প্রেশারে ছিলাম তো, মাথার ঠিক ছিলো না। রোদপাখি কি এখনও রেগে আছে?”
উনার এহেন কাজে চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো আমার। সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই সুযোগে নিচে বসে পায়ে নুপুর পরালেন উনি। নুপুর পরানো শেষ করে মেঝের উপরই বসে পড়লেন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফিচেল গলায় বললেন,
—-” দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আরো চাই?”
এতোক্ষণে টনক নড়লো আমার। আমি একমুহূর্ত দেরী না করে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলাম। মনের মাঝে একটা প্রশ্নই উদয় হলো, ছি! লোকটা এতো অসভ্য কেন?
#রোদবালিকা….
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/