#রোগী কথন
পর্ব ৮৩
#খেলিছ_এ_বিশ্ব_লয়ে
এক.
ষোল সতেরো বছরের একটি টলটলে মেয়ে নিয়ে তার মা এসেছেন। মনটা বিষন্ন। কি সমস্যা জিজ্ঞেস করতেই উওর পেলাম, মেয়ের তো মাসিক হয় না ম্যাডাম। কোনো দিনই হয় নাই। ওর সমসাময়িক সব বান্ধবীদের হয়েছে। ওর ছোটো বোনেরও হয়েছে। দুশ্চিন্তায় আমার তো ঘুম হারাম। কথা কয়টি এক দমে বলে থামলেন তিনি। কন্ঠ ডুবে যাওয়া মানুষের।
আস্বস্ত করলাম মা মেয়ে দুজনকেই। আরো কিছু হিস্ট্রি নিয়ে, প্রাইভেসি মেইনটেইন করে পরীক্ষা করলাম। দেখা গেলো শরীরের আর সব ঠিকঠাক। উচ্চতা, গ্রোথ, ব্রেস্ট, পিউবিক হেয়ার, এক্সিলারী হেয়ার সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল ক্যারেক্টারিস্টিকস সব। একজন পরিপূর্ণ নারী শরীরের যা যা থাকার দরকার সব আছে। কিন্তু একটা জিনিস নাই। বলেন তো কি নাই? জ্বি হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, জরায়ু নাই। তাই মাসিক ও নাই।
দুই.
নতুন বিবাহিত এক দম্পতি এসেছেন। হাতে মেহেদীর রং উৎসবের আমেজ ছড়াচ্ছে কিন্তু মনে তা রিফ্লেক্ট করছে না। কারণ হিসাবে জানলাম। তারা ইন্টিমেট রিলেশন যেতে পারছে না। মাসিকও হয় না। কখনো নাকি হয়নি। তবে মাসে মাসে তলপেটে ব্যাথা হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেলো, সব ঠিকঠাক। জরায়ুও ঠিক আছে কিন্তু…
জ্বি হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, মাসিক হওয়ার পথ নাই। মানে তৈরিই হয় নি। যে পথ তৈরি হয় নি সে পথে গমন করবে কি করে? মাসিকই বা আসবে কি করে?
অবাক লাগছে, নাহ্? এমনও হয়! জ্বি হয়। প্রতি পাঁচ হাজারে একজন। কম কিন্তু নয়।
কোনো এমন হয়?
একজাক্ট কারণ জানা যায় না। তবে মেয়ে শিশুর জননাঙ্গ মানে জরায়ু, যোনিপথ মুলারিয়ান ডাক্ট নামক একটি জিনিস থেকে তৈরি হয়। ভ্রুন অবস্থায় কোনো কারনে এই মুলারিয়ান ডাক্ট ডেভেলপমেন্ট হতে না পারলে জরায়ু তৈরি হয় না। আবার কখনো জরায়ু তৈরি হলেও যোনিপথ তৈরি হয় না। হলেও অসম্পূর্ণ থাকে কিংবা পর্দা দ্বারা বন্ধ থাকে।
যার জরায়ু নাই তার মাসিক হবে না, বাচ্চা হবে না এটা তো স্বাভাবিক। তবে যার জরায়ু আছে কিন্তু যোনিপথ নেই তার সমস্যা আরো বেশি। মাসে মাসে মাসিক হয় কিন্তু বাইরে আসতে পারে না। ফলে ভিতরে জমা হয়ে নানা রকম সমস্যা করে। পেটে ব্যাথা, প্রসাব বন্ধ হয়ে যাওয়া, এন্ডোমেট্রিওসিস নামক একধরনের জটিল রোগের সৃষ্টি করা। আরো কতো কি! এসব ঝামেলা থেকে বাঁচতে অনেক সময় জরায়ুকে ফেলে দিতে হয়। বেঁচে থাকতে কত কী যে করা লাগে!
চিকিৎসাঃ- সমস্যা যতো গভীর হোক না কেনো
সহমর্মিতা সহকারে কাউন্সিলিং করা জরুরি। যার যে সমস্যা সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়।
যার জরায়ু নাই, তাকে বলতে কষ্ট হয় তবুও বলতে হয় মাসিক হবে না, বাচ্চা হবে না। তবে দাম্পত্য জীবন মেইনটেইন করতে পারবে যদি চায়। ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি নামক একধরনের অপারেশনের মাধ্যমে পথ তৈরি করা যায়। যদিও ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। জটিলতা আছে অনেক। তবে যার পর্দা দিয়ে পথ বন্ধ, তার ক্ষেত্রে পর্দা রিমুভ করে দিলেই ঝামেলা শেষ।
উন্নত বিশ্বে জরায়ু প্রতিস্থাপনও করা যায়। তবে খুব ব্যয় বহুল। প্রয়োজনে সারোগেসীর মাধ্যমে বাচ্চা নিতে পারে। সারোগেসি হচ্ছে অন্যের জরায়ু ভাড়া নিয়ে বাচ্চা জন্মদানের একটি পদ্ধতি। এখানে স্বামীর শুক্রাণু আর স্ত্রীর ডিম্বাণু মিলিয়ে আইভিএফ পদ্ধতিতে (টেস্টটিউব) ভ্রুন তৈরি করে সারোগেট মায়ের জরায়ুতে বড় করা হয়। কোনো কোনো দেশে অনেকে শরীর ঠিক রাখার জন্য সারোগেসি পদ্ধতিতে বাচ্চা নেয়। অথচ যার জরায়ু নেই তার জন্য এই পদ্ধতি সর্বাধিক সমীচীন মনে করি।
টপিকটা অনেক বিস্তৃত এবং আরো অনেক লেখার আছে। আমি সেদিকে গেলাম না। পাঠক বোর হবেন। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন যে হতে পারে, হয় সে ব্যপারে একটু ধারণা দেওয়া।
পাঠক, এখন বলেন কেমন বোধ করছেন? চেহারা, গায়ের রঙ একটু উনিশ-বিশ হলে কত কষ্ট পাই আমরা। অথচ দেখেন এই পৃথিবীতেই আমাদের মতো আরেকজন কতো বড় সমস্যা নিয়ে আছেন। যে সমস্যায় তার কোনো হাতই নেই। আমাদের একটু বেঁটে হলে চলেনা। একটু স্হূল হলে ঘুম হারাম। একটু মেলানিন বেশি হলো কি হলো না, অস্থির হয়ে যাই। ঘষামাজার পাশাপাশি পরতের পর পরত আটা ময়দা সুজি তো আছেই। অথচ এদের কথা চিন্তা করেন। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে না?
যারা এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাদেরকে শুধু একটা কথাই বলবো, শুধুমাত্র খাওয়া, পরা, সন্তান জন্মদানের জন্য মানব জন্ম এটা আমি বিশ্বাস করি না। নিশ্চয় এরচেয়ে বড়ো কিছু আছে। পড়াশোনা করে সাবলম্বি হোন। নিজের দায়িত্ব নিজে নিন। এমন কাউকে জীবন সঙ্গী করুন যার বাচ্চার দরকার নেই। পরিবার, দেশ, সমাজের জন্য বাঁচুন। প্রাণভরে বাঁচুন। যে ব্যপারের জন্য আপনি দায়ী নন, সে ব্যপারে মন খারাপ করবেন না। বরং সীমাবদ্ধতাটাকে শক্তিতে পরিনত করুন। এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন খায়, ঘুমায়, বাচ্চা জন্ম দেয় এবং একসময় মরে যায়। তাদেরকে কে মনে রাখে বলুন? এমন কিছু করুন যাতে পৃথিবী আনন্দ নিয়ে মনে রাখে।
©Sabikun Nahar
#Lady_in_Red