জলমানবী
পর্ব -১
…………..
বিয়ের রাতে শীলার হাতে আংটি পরাতে গিয়ে আমি চমকে গিয়েছিলাম।এত ঠান্ডা হাত একজন মানুষের হয় কেমন করে?এর আরও পরে আমি বুঝতে পেরেছি শীলার শরীর বরফের মত ঠান্ডা।আমি শীলার কাছাকাছি কোন ভাবেই যেতে পারছিলাম না।স্বামী স্ত্রীর একান্ত সান্নিধ্য ও সম্পর্কের সময়গুলোতে ওর বরফ শরীর আমাকে অস্বস্তিতে ভরিয়ে তুলত।যেন মৃত মানুষের শরীর।বরফের মত ঠান্ডা ও শক্ত।আমি ছিটকে দূরে সরে যেতাম।অশরীরী মনে হত সবকিছু।শীলা ওর ব্যর্থতা মেনে নিয়ে চুপ করে থাকতো।আমি কারও সাথে এ বিষয়ে আলোচনাও করতে পারছিলাম না লজ্জায়।অল্প কদিনের বিয়ে, কাকে,কিভাবে কি জিজ্ঞেস করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।বিয়ের পর দুলাভাইদের সাথে দেখা হলেই টিপ্পনি কাটতো, ইঙ্গিতপূর্ন বাক্যবাণে বিদ্ধ হতাম আর আমি ক্রমশ ডুবে যেতাম উত্তরহীন প্রশ্নে।
শীলা খুব শান্ত ও গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে।খুব বেশি কথা বলেনা ।অথচ ওকে যখন বিয়ের পাত্রী হিসেবে আমার সেজোখালা নির্বাচন করে তখন খুব মিশুক মেয়ে ,দারুন গান গায় এই বিশেষণে বিশেষায়িত হয়ে সে আমার হবু বউ হিসেবে সিলেক্ট হয়।আমি নিজেই কোনদিন নিজের জন্য কোন শার্ট পছন্দ করে কিনতে পারিনি।বই ছিল আমার প্রথম ও শেষ প্রেমিকা তাই বউ পছন্দ করা আমার দ্বারা হচ্ছেনা সেটা সবাই বুঝে গিয়েছিল।তাই মা খালারাই দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে দিলেন।হ্যা প্রেমিক মন তো একটা ছিলই।কেউ একজন জীবনে আসবে,আমার সবকিছুকে মায়া মমতা ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে এসব কতকিছু ভাবতাম।তাই শীলাকে পেয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম ।
তারপরেও আমি শীলাকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম।দুজন বন্ধু যদি পাশাপাশি থাকতে পারে আমি পারবনা কেন?কিন্তু শীলা আমার বন্ধু পর্যন্ত হতে চাইলো না।সে ঠিকমতো কথাও বলতে চাইতো না আমার সাথে।সে শুধু ভাবলেশহীন নীরবশ্রোতা ।
সাতদিন বিয়ের নানা আচার অনুষ্ঠান শেষ হলে শীলাদের বাবার বাসায় গেলাম।বিয়ের সময় বরযাত্রী হয়ে ওদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও কোন এক অজানা কারণে বিয়েটা ঢাকাতেই হুটহাট করে হয়।
গ্রামের মধ্যে কি বিশাল ওদের বাড়ি।কি নেই।এ যেন স্বপ্নে দেখা কল্পলোকের আবাস।আমার সব চাইতে ভালো লেগে গেল পুকুর ঘাট।এরা পুকুরঘাঁট বলে আদতে এটা দীঘি।কি স্বচ্ছ ও গভীর জল।
শান বাঁধানো পুকুরঘাঁটে শীলাকে নিয়ে বসে আছি।এই প্রথম আমি শীলাকে খুব উৎফুল্ল দেখলাম।থেমে থেমে কত গল্প করে যাচ্ছিল।কিভাবে এই পুকুরঘাঁটে সাঁতার কাটা শিখলো,এমনকি জাল ফেলে মাছও ধরে ফেলতে পারতো সে।আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম ওর গল্প।আর ভাবতে লাগলাম হয়তো বাবার বাড়ি এসেছে এজন্য ও আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।আমার শীলা কে নতুন করে ভাল লাগতে শুরু করলো।
ফেরার পথে পুকুরঘাঁট ঘেষে শীলার দাদির কবর।শীলা কবরের সামনে এক ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
আমার শশুরবাড়ির সদস্য সংখ্যা বলতে আমার শশুর শাশুড়ি,শীলা আর ওর ছোট বোন কান্তা আর ওদের মামা থাকে।যদিও আসা অব্দি আমি মামা শশুরের দেখা একবার পেয়েছি।অত্যন্ত ব্যস্ত থাকেন তিনি।শশুরের ব্যবসা দেখভাল করেন সেটাই শুনলাম।
পাঁচদিনের ছুটি নিয়ে আসা আমার মোটামুটি দুদিন এ বাড়িতে ভালোই কেটে গেল।কান্তা মানে আমার শালীর সাথে বেশ খাতির হল আমার।এ বাড়িতে কথা বলার মত ওই একজনই তো আছে।সারাদিন আত্মীয় স্বজন জামাই দেখতে আসে আর আমি সালাম ও ইন্টারভিউ দিতে দিতে ক্লান্ত।
বিকেলে কান্তার সাথে বসে পুকুরঘাঁটে অযথাই ছিপ ফেলে মাছ ধরার নামে গল্প করছি। জামাই আসা উপলক্ষে পিঠা হচ্ছে সেখানে শীলা নাকি সেখানে বসে আছে।
“দুলা তুমি সাঁতার পারো?” কান্তার প্রশ্ন।
আমি পারিনা শুনে খুব হাসলো।সে নিজেও পারেনা সেটা ব্যাপার না।আমি বললাম,তুমি তো তোমার বোনের কাছ থেকে সাঁতার কাটা শিখতে পারতে।সে নাকি খুব ভালো সাঁতার কাটে, এক দুবার নাকি জাল ফেলে মাছও ধরে ফেলেছে?
কান্তা খুব অবাক হয়ে আমাকে বলল,বুবু সাঁতার কাটতে পারে এটা বুবু তোমাকে বলেছে?সত্যিই বলেছে ?কি আশ্চর্য!বুবু তো পানি ভীষন ভয় পায়।ও কোনদিন পুকুরে পা পর্যন্ত ডুবায় নি।এ বাড়ির মেয়েরা এ পুকুরে কোনদিন সাঁতার কাটেনা।এ পুকুর অভিশপ্ত।
একটা অজানা রাগ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগলো….
চলবে…….
জল মানবী
পর্ব – ২
……………….
রাতে শোবার আগে আমি শীলাকে জিজ্ঞেস করলাম,তুমি আমাকে কেন মিথ্যে বললে তুমি সাঁতার পারো?তুমি জাল ফেলে মাছ ধরতে পারো?কেন তুমি আমার সাথে এমন করছো?তোমার কি অন্য কোথাও পছন্দ ছিল?সেটা তুমি তোমার পরিবারকে বলতে পারতে।আমাকে শুধু শুধু ঠকাচ্ছ কেন?
শীলা বরাবরের মত নিশ্চুপ।আমি আর সহ্য করতে পারলাম না।টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেললাম।
শীলা কাঁদতে লাগলো।আমি বোকা বনে গেলাম।শীলা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো আমাকে কিছুটা সময় দিন।প্লিজ কিছুটা সময় দিন।
হতভম্ব আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।দেখলাম অত রাতে আমার শাশুড়ি আমার মামাশশুরকে ভাত বেড়ে খাওয়াচ্ছেন।তিনি গভীররাতে ব্যবসার হিসেব পত্র গুটিয়ে কেবল বাড়ি ফিরেছেন।তারাও আমাকে দেখলেন আমি হনহন করে হেঁটে চলে গেলাম।
মন খারাপ করে পুকুর ঘাটে বসে আছি।হঠাৎ কারও পায়ের শব্দে চমকে তাকালাম।দেখলাম আমার শাশুড়ি।বাবা তোমার মন খারাপ?শীলার সাথে কিছু হয়েছে কি?
আমার নীরবতা দেখে তিনি বলে উঠলেন তুমি আমাকে বলতে পারো সব।আমি কিছুই মনে করবনা।
আমি হালকা হতে চাইছিলাম,উত্তর খুজছিলাম।তাই শাশুড়ি মাকে সব জানালাম।শুধু জানাতে পারলাম না শীলার শরীর বরফের মত ঠান্ডা থাকে সবসময়ই,আমি ওকে ছুঁতে পারিনা একদমই।লজ্জাবোধ থেকেই জানাতে পারলাম না।
জানলাম ,শীলার দাদির সাথে শীলার খুব আত্মিক সম্পর্ক ছিল।কেউ কাউকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতেন না।এই বাড়াবাড়ি দাদি নাতনির ভালোবাসা দেখে সবাই ঠাট্টা মস্করা করে বলতো তাহলে আর নাতনির বিয়ে দেয়া লাগবেনা। তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলতেন, কেউ যদি তারচেয়েও শীলাকে বেশি ভালোবাসতে পারে আর যদি সেটার প্রমান দিতে পারে তবেই তিনি শীলাকে ছাড়বেন তার আগে নয়।দাদি খুব ভালো সাঁতার জানতেন,পুকুরে অনেকক্ষন ডুব দিয়ে থাকতে পারতেন,অসম্ভব কর্মঠ সেই মহিলা জাল ফেলে মাছও ধরতেন।এই পুকুরে তিনি কারনে অকারণে সাঁতার কেটে বেড়াতেন।একবার পানিতে নামলে তাকে তোলা যেতনা।অথচ তার মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে।লাশ তোলা হলে কপালে আঘাতের চিন্হ আর পায়ে জড়ানো ছিল জলজ লতাপাতা।ধারণা করা হয় তিনি পুকুর ঘাটে পিছলে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ও গড়িয়ে পুকুরে পড়ে যান আর পায়ে লতাপাতা জড়িয়ে গেলে আর উঠতে পারেননি।
দাদির লাশের অদূরে শীলা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।সবাই ধারণা করেছে ফজরের নামাজের ওযু করতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা হয়েছে আর শীলাই দাদির লাশ প্রথমে দেখতে পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।দাদির মৃত্যুতে শীলা অসুস্থ হয়ে পড়ে।তার কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়।অনেকদিন লেগেছিল এই ট্রমা কাটতে। সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও, এরপর থেকে শীলা কখনও একা থাকতে চাইতো না,বাড়ির মেয়েদের কাউকে না কাউকে ঘেষে থাকতো,ভয় পেত।এমনি হাসিখুশি উচ্ছল হলেও সন্ধ্যার পর সে কখনোই পুকুরঘাঁটে যেতে চাইতো না
এই ঘটনার পর থেকে আমার শশুর আব্বা এই পুকুরে মেয়েদের নামতে নিষেধ করে দেন।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।আমার শাশুড়ি মা বলে উঠলেন,তোমাকে আরেকটা কথা বলা হয়নি বাবা।তোমাদের বিয়ের দিন পনেরো আগে খুব ভোরে ঠিক একইভাবে শীলাকে আমরা পানি থেকে উদ্ধার করি।ওর পায়েও লতাপাতা জড়ানো ছিল।আমরা ভেবেছিলাম ও মরে গেছে,মরে গিয়ে পানিতে ভেসে উঠছে ঠিক ওর দাদির মতন।কিন্তু না, ও বেঁচে ছিল।পানিতে ভেসে ছিল অথচ ও সাঁতার জানেনা।
আমি চমকে উঠলাম।আমার চমকে উঠা দেখে আমার শাশুড়ি বলে উঠলেন,বাবা মেয়েটা আমার খুব দুরন্ত,হাসিখুশি ছিল কিন্তু ওই ঘটনার পর কেমন চুপচাপ হয়ে গেলো।আমরা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছি,কিছু বলতে পারেনা।ভয় পেয়েছিল মনে হয়।নানান লোকে নানান কথা বলবে আর যদি বিয়ে ভেঙে যায়।গ্রামদেশ এলাকা ,মেয়ের আংটি পড়া হয়ে গেছে এজন্য আমরা ঢাকায় বিয়ের ব্যবস্থা করলাম।এরপর তো বিয়েই হয়ে গেল।বাবা,মা,বোন নিজের জগৎ ছেড়ে নতুন জায়গা।একটু শিখে পড়ে নিতে কষ্ট তো হবেই।তুমি ওকে ভুল বুঝিও না বাবা।
আমি কাউকেই ভুল বুঝছিনা,আমি শুধু এটুকু বুঝতে পারছি কোথাও একটা রহস্য আছে,জট আছে।আমাকেই সেটা খুলতে হবে।
ঘরে এসে দেখলাম শীলা নেই।খুঁজতে গিয়ে দেখি কান্তার ঘরে ঘুমুচ্ছে।কি নিষ্পাপ একটা মুখ।কি বাজে একটা ব্যবহার করলাম ওর সাথে।আমার নিজের উপরেই মেজাজ খারাপ হল।থাক বোনের সাথে ঘুমুচ্ছে ঘুমাক।আর একদিন পর তো চলেই যাবে সবাইকে ছেড়ে।আমি নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।
সকালে নাস্তা খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।হঠাৎ হৈ হট্টগোলে সবাই চমকে উঠলাম।হৈ হট্টগোল আসছে পুকুর পাড় থেকে।আমরা ছুটে গেলাম।এরকম ভয়াবহ দৃশ্য আমি আমার জীবদ্দশায় দেখব কখনোই ভাবিনি।পুকুর লাশ ভেসে উঠছে,পায়ে লতাপাতা জড়ানো লাশ।আমার শাশুড়ি “ও আল্লাগো” বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।
চলবে ……..
জলমানবী
শেষ পর্ব
…………..
লাশ তোলার পর দেখা গেল সেটা আমার একমাত্র মামা শশুরের লাশ।কেন কীভাবে তিনি পুকুরে ডুবে গেলেন কেউ জানেনা,দেখেও নি।তিনি কখনো পুকুরে নামতেন না।কিন্তু গভীর রাতে সিগারেট খেতে এ জায়গাটায় আসতেন সেটা সবাই জানে।পুত্রসম একমাত্র ভাইকে হারিয়ে আমার শাশুড়ি বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন।
শিলা আরও প্রচন্ড বরফ শরীর নিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।একটা কথাও বলছে না।
আমার সারাদিন গেল শশুরের সাথে পুলিশি ঝামেলা মেটাতে।শশুর প্রতিপত্তিশীল হওয়ায় খুব একটা বেগ পেতে হলনা।সাধারণ দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া গেল।তখনই আমি জানলাম তিনি আমার শাশুড়ির নিজের ভাই না,খুব ছোটবেলায় আমার নানা শশুর তাকে দত্তক নিয়েছিলেন কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষ এটা জানে।খুব অল্প দিনের ব্যবধানে আমার নানা শশুর ও নানি শাশুড়ির মৃত্যু হলে তিনি আমার শশুরবাড়িতে চলে আসেন।
সন্ধ্যায় দাফন ও জানাজা শেষে ফিরে এলাম।শীলাকে নিয়ে আমার ঢাকায় ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে গেল।আমি সিদ্ধান্ত নিলাম শীলাকে রেখে ঢাকায় ফিরে যাব।
সারাদিনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা শেষে ক্লান্ত আমি ঘুমিয়ে গেলাম।ঘুম ভাঙলো গভীর রাতে।পাশে তাকিয়ে দেখি শীলা নেই।রাত সাড়ে তিনটা বাজে।আমি ভয় পেয়ে গেলাম।যা ঘটছে এ বাড়িতে এরপর কোন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিনা আমি।শীলার কিছু হল নাতো?
আমি দৌড়ে পুকুর ঘাটে গেলাম।দেখি শীলা পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে আছে।যে মেয়ে কখনোই নাকি পুকুরে পা পর্যন্ত ডুবায় নি সে আজ এভাবে বসে আছে দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
শিলা আমার দিকে তাকিয়ে ফের পুকুরের দিকে মুখ করে বলল,এসেছেন?আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।আপনাকে অনেক কথা বলার আছে আমার।আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই,নেই আপনার হাতেও।
আমি চুপচাপ শীলার পাশে বসলাম।শীলা বলতে শুরু করলো,
বারো বছর আগের কথা।আমার বয়স তখন নয় আর কান্তার তিন।কান্তার খুব অসুখ হলো সেবার।তাই বাবা মা ঢাকায় গেছেন ডাক্তার দেখাতে। আমাকে নেননি।আমাকে নেয়ার দরকারও নেই কারন দাদি থাকলে আমার আর কাউকে লাগেনা।
গ্রামদেশে সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে যায়।তাই সব নিশ্চুপ হয়ে যায়।দাদি এশার নামাজ পড়বে বলে পুকুরেই ওযু সেরে বাসায় আসেন।জায়নামাজে দাঁড়ানোর পর দাদির মনে হয় চাবির গোছাটা তিনি পুকুরঘাঁটে ফেলে এসেছেন।মানা করা সত্ত্বেও আমি দাদিকে বললাম তুমি নামাজ পড়তে থাকো আমি চাবি নিয়ে আসি।কতক্ষন আর লাগবে।যাব আর আসব।
পুকুর ঘাটে যাওয়ার সাথে সাথে দমকা বাতাসে আমার হাতের কুপিটি নিভে গেল।অমাবস্যার ওই রাতে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটা লোমশ হাত আমাকে জাপটে ধরল।আমার মুখ চিপে ধরল ।আমি ভীষণ বাধা দিচ্ছিলাম।খুব খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই দাদি সেখানে উপস্থিত হন।দাদির সাথে সেই লোকটার খুব ধস্তাধস্তি হয়।দাদি পেরে উঠছিলেন না।দাদি শুধু চিৎকার করে বলছিলেন ,শিলু পালিয়ে যা, লুকিয়ে পড় কোথাও, জানোয়ারটা যেন তোকে খুঁজে না পায়।আমি ভয়ে পালিয়ে যাই।পুকুরের ওপারে জংলা জায়গায় লুকিয়ে পড়ি।অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও একটা ঝপাৎ করে শব্দ হলো পানিতে আমি দিব্যি শুনতে পেলাম। আমি বুঝতে পারলাম পুকুরের পানিতে ভারী কিছু একটা ছুড়ে ফেলা হয়েছে।
ভোরের দিকে আলো ফুটতে শুরু করলে আমি দৌড়ে এসে দেখি মাঝপুকুরে দাদির শাড়ি ভেসে উঠছে।দাদির লাশ ভেসে উঠেছে ….এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।
তুমি কি সেই লোকটাকে চিনতে পেরেছিলে?
-না।
-তাহলে বাড়ির কাউকে জানাও নি কেন?
-মাকে বলেছিলাম।মা বিশ্বাস করেনি।বলেছে আমার কল্পনা।
আমি শীলাকে বললাম ,আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি শীলা।এবার ওঠো ,ঘরে চলো।পানিতে এভাবে বসে থাকা ঠিক না।
কঠিন স্বরে শীলা বলে উঠলো,না এই পানি থেকে উঠব না।আমার কথা শেষ হয়নি এখনও।
এবার আপনাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা বিষয় বলব।
আপনার আমার পান চিনি হওয়ার দুদিন পর রাতে আমার খুব দাদির কথা মনে পড়ছিল।দিনের বেলায় চুপচাপ পুকুরঘাঁটে বসে থাকলেও আমি রাতে কখনোই যেতাম না।গেলেও দলবল সহ যেতাম।কিন্তু কেন যেন সেদিন সাহস করে গেলাম।
আমি পুকুরঘাঁটে বসে আছি।হঠাৎ একটা লোমশ হাত আমাকে আবারও জাপটে ধরল বারো বছর আগেকার মতন।হিসহিস শব্দে বলে উঠলো,সেদিন ছাড়া পেয়েছিলি আজ পাবিনা।আমি খেয়াল করলাম পুকুরের পানিগুলো কি ভীষন ঢেউ আকারে আমাকে ছুঁতে আসছে কিন্তু অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠতে পারছে না।আমাকে ছোঁয়ার অদম্য চেষ্টায় পুরো পুকুরটা তোলপাড় হচ্ছিল ,যেন একবার ছুঁতে পারলে আমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে।
পুকুরের পাড় ঘেষে থাকা লতাপাতা দিয়ে আমার পা বেঁধে পুকুরে ফেলার আগ মুহূর্তে আমি শুধু একবার বলেছিলাম “ও দাদি তুমি কই?”
আমি পানিতে ডুবে যাচ্ছিলাম।কিন্তু না ,কেউ একজন আমাকে সারারাত ভাসিয়ে রাখলো।আমাকে বাঁচিয়ে রাখলো।
এরপর থেকে সে আমার শরীরে বসবাস করে।বরফ শীতল তার শরীর।
আমি খেয়াল করলাম পুকুরের পানির একটা বড় ঢেউ এসে শীলাকে একবার ছুঁয়ে দিয়ে গেল।যেন তার অস্তিত্ব জানিয়ে দিয়ে গেল।
শীলা,সেই মানুষটা কি তোমার মামা?
শীলা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলে উঠলো হ্যাঁ, বারো বছর আগে আমি তাকে চিনতে পারিনি।দাদি পেরেছিলেন তাই তাকে মরতে হয়েছিল।আর বারো বছর পর সে আমাকে মারতে চেয়েছিল যাতে তার নোংরা মুখোশ আমি খুলে দিতে না পারি।
একটু থেমে শীলা বলল,জলমানবী আমার সাথেই থাকে কিন্তু তার শক্তি ও সীমা ওই পুকুরেই।এর বাইরে সে কিছু করতে পারেনা।
গতকাল রাতে আমি মামাকে কৌশলে ডেকে নিয়ে আসি।তার শক্তির সাথে পারবনা বলে তার চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দিয়ে ধাক্কা মেরে পুকুরের শেষ সিঁড়ির নীচে ফেলে দেই।যেখানে পুকুরের ঢেউ এসে পড়ে।
আমি শীলার কথা শুনে চমকে উঠলাম।মামাকে তাহলে শীলা খুন করেছে।শীলা আমার চমকে উঠা দেখে বলে উঠল আমি মামাকে খুন করিনি।আমার দায়িত্ব ছিল ওই জানোয়ারটাকে পুকুরের পানির কাছাকাছি পর্যন্ত নিয়ে আসার।বাকিটা তিনিই করেছেন যিনি এই পুকুরে থাকেন।
স্তম্ভিত আমি শীলাকে জিজ্ঞেস করি ,শীলা দাদি ই কি তাহলে জলমানবী?
শিলা উত্তর দেয়না।
পুকুরের পানির উচ্চতা কেন জানি বাড়ছে ।শীলার পা ছড়িয়ে হাটুর নীচ অব্দি ডুবে যাচ্ছে পানিতে।
শীলা বলে উঠলো আজ উনি চলে যাবেন,আমিও চলে যাব তার সাথে।
বিশাল একটা ধাক্কা লাগলো আমার বুকে।আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন যাবে শীলা আমাকে ছেড়ে?
শীলা অস্ফুট স্বরে বলে উঠল ,আমি আপনার যোগ্য নেই আর!
আমি মরিয়া হয়ে শীলাকে জিজ্ঞেস করলাম ,সত্যি করে বলতো শীলা ওই জানোয়ার কি তোমাকে রেইপড করেছিল?
শীলা কাঁদতে লাগলো।শীলার কান্নায় উত্তর খুজে পেলাম আমি।আমার আকাশ পাতাল এক হতে শুরু করলো।আমার সাথে তাল মিলিয়ে পুকুরের ঢেউগুলো যেন আরও বন্য হয়ে উঠলো।
সময় নেই…সময় নেই…ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে কিছুক্ষণ পর…সময় নেই আমার হাতে,সময় নেই শীলার হাতে…সময় নেই জলমানবীর হাতে।
আমি শীলাকে হারাতে চাইনা,জলমানবী শীলাকে হারাতে চায়না।শীলার তথাকথিত নোংরা শরীরটাকে যদি আমি ঘৃনা করি,তাই সে চায়না খুব নোংরা একটা পরিচয় নিয়ে শীলা আমার জীবনে থাকুক।সে নিয়ে যেতে চায় শীলাকে।
শীলা আমাদের দুজনের প্রবল ভালোবাসার মাঝখানে দাঁড়িয়ে।আজ একজনকেই জিততে হবে শীলাকে পাওয়ার জন্য।
“কেউ যদি তারচেয়েও শীলাকে বেশি ভালোবাসতে পারে আর যদি সেটার প্রমান দিতে পারে তবেই তিনি শীলাকে ছাড়বেন তার আগে নয়!!!”
আমার মনে পড়লো শাশুড়ির মায়ের বলা এই কথাটা।শীলার দাদি সবসময়ই বলতেন এই উক্তি।যেন খুঁজে পেলাম একটা সূত্র।শীলাকে বাঁচিয়ে রাখার,নিজের কাছে ফিরিয়ে আনার সূত্র।
শীলার কোমর অব্দি পানিতে ডুবে যাচ্ছে।আমি শীলাকে শক্ত করে আমার বুকে জড়িয়ে ধরলাম।প্রচন্ড বরফ ঠান্ডায় আমি জমে যাচ্ছি ।অসাড় হয়ে আসছে আমার প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।আমি জমে যাচ্ছি,দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার ।না আমি শীলাকে ছাড়ব না।হয় আজ আমি বরফ হব নয়তো আমার উষ্ণতায় শীলা উষ্ণ হবে।
প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে আমি অস্ফুট স্বরে বলতে শুরু করলাম,তোমার সাথে যা ঘটেছে তা নিছক দুর্ঘটনা।এতে তোমার কোন দোষ নেই।কোন পাপ নেই।
আমি তোমার অতীত জানিনা।জানতেও চাইনা।তুমি আমার বর্তমান আর তোমাকে নিয়েই আমি ভবিষ্যত গড়তে চাই।আমার মত করে কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবেনা।তুমি যদি চলে যাও আমিও তোমার সাথে চলে যাব।তোমাকে ছেড়ে আমি এই পৃথিবীতে একা হয়ে থাকতে পারবনা।আমার থেকে এরচেয়ে বেশি কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবেনা শীলা, কেউ না।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।উত্তাল পুকুরের ঢেউগুলো শান্ত হতে শুরু করেছে।আমার শীলা আমার বুকে মাথা রেখে একটু একটু করে উষ্ণ হতে শুরু করেছে।দুজনের উষ্ণতায় পুব আকাশ আলোকিত হতে শুরু করেছে যেন।শান্ত পুকুরটাতে কি যেন একটা ডুবে যাওয়ার শব্দ জোরে ভেসে এলো।কেউ একজন চলে গেলো,একা হয়ে।চিরতরে।
অল্প আলোয় সদ্য ঘুমন্ত শীলার মুখটা কি অসাধারণ স্নিগ্ধ লাগছে।আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম,আমি তোমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালবাসি শীলা।
সমাপ্ত
(জানিনা কেমন লাগলো।মতামত আশা করছি।আপনাদের মতামত আমার লেখালেখির প্রাণ।আপনারা ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন এই প্রার্থনা।শুভকামনা)
মিশা মালিহা মিমু
জুন ২০২১