রুপকথা পর্ব ১৩
নিহাল জলদি কাপড় পাল্টে নিচে নামলো। লবিতেই কিছু বান্ধবীদের সাথে সোফায় বসে গল্প করছিল মাহিয়া। নিহাল কে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে হেসে দিল মনে মনে। ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে লেখাটা ও পড়েছে। নিহালের চোখ মাহিয়ার ওপর পরতেই সোজা হয়ে সামনে ফিরে বসলো মাহিয়া। নিহালকে ইগনোর করার ভান করে বান্ধবীদের সাথে আরও বেশী গল্প জুড়ে দিল । নিহাল ওর কাছেই যাচ্ছিলো কিন্তু মাঝপথেই আটকে দিল বন্ধুরা।
-এই নিহাল কই ছিলি তুই? সবাই চলে আসছে সেই কখন। আমাদের কোস্টার রেডি, চল্।
সবাই লবি দিয়ে বের হয়ে সামনে রাখা সাদা কোস্টারটায় একে একে উঠতে লাগলো। প্ল্যান হলো মেরিন ড্রাইভ ধরে হিমছড়ি, ইনানি বিচ হয়ে দুপুরে মারমেড ক্যাফেতে লাঞ্চ করে ফেরত আসা।
মাহিয়া তো আগেই উঠে যেয়ে জানালার পাশে বসে পড়েছিল। বাসটা ছাড়ার মুহূর্তে বাকি ছেলেদের সাথে নিহালও উঠলো। মাহিয়ার পাশে যেয়ে বসলো ও। আর বসার সাথে সাথেই একেবারে আচমকা মাহিয়ার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে নিল। না, এইবার কোনো জড়তা অথবা লজ্জাবোধ নিয়ে না, একদম অধিকার খাটিয়ে কাজটা করলো নিহাল। মাহিয়া নিহালের চেহারায় সেই কনফিডেন্সটা দেখে, হেসে আর কিছু বললো না।
গান, ঠাট্টার মাঝেই পথ পার হচ্ছিলো বাকিদের তবে মাহিয়া আর নিহাল যেন অন্য এক জগতের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। একে অপরকে ছাড়া আর কারও উপস্থিতি জরুরী ছিল না ওদের কাছে। নিজেদের মাঝেই হারিয়ে গিয়েছিল তারা। এই জন্যই বোধহয় হিমছড়িতে এসে যখন বাসটা থামলো, সবচাইতে বেশী ব্রেকের ঝাকি এই দুইজনই খেলো। একে অপরের দশা দেখে হেসে ফেললো ওরা।
বাস থেকে নেমে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো যে এখানে যে যার মতোন ইচ্ছে ঘুরতে পারে কারণ সাতাইশ জনের একসাথে করে ঘোরার অবস্থা এইখানে নেই। এক ঘন্টা পরে সবাই কোস্টারের কাছে চলে আসলেই হবে। এরপরে শুরু হলো ঘোরাঘুরি। অনেকেই একা চলে গেল তো কেউ কেউ ছোট গ্রুপ বানিয়ে ফেললো নিজেদের মধ্যে। নিহাল আর মাহিয়াকে জিজ্ঞেস করাতে প্রায় একসাথেই বলে উঠলো ওরা যে একাই ঘুরবে। তাই ওদেরকে আর কেউ ঘাটালো না।
পুরা হিমছড়ির প্রত্যেকটা স্পট মাহিয়া আর নিহাল একে অপরের হাতে হাত রেখে ঘুরলো, তা সেটা নিচের হিমছড়ি ঝর্ণাই হোক অথবা হোক সেই পাহাড়ের চূড়া। নিজেদের একান্তে পার করা মুহূর্তের স্মৃতিগুলো প্রকৃতির এই মনোরম পরিবেশের সাথে ওরা ধরে রাখলো ফোনে।
দেড় ঘন্টা পরে চললো ওরা ইনানি বিচের পথে। সেখানের পরিবেশ টা হিমছড়ি থেকে সম্পূর্ণই উল্টা। পুরা খোলা প্রান্তরে সবাই একসাথে থাকায় নিজেদের মাঝে সময় দিতে পারলো না দুজন। তবে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে অনেক মজার একটা সময় কাটলো ওদের।
ইনানী থেকে ফেরার পথে মাহিয়া আর নিহাল বাসের মাঝামাঝি স্থানে সিট পেয়েছিল ফলে আশপাশের সবার গল্প, আড্ডার মাঝে বাধ্য হচ্ছিলো উপস্থিত থাকতে। মাহিয়া কিছুটা মজা পেলেও, নিহালের চেহারায় ছিল স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। তাই মারমেড ক্যাফেতে লাঞ্চ সেরে যখন কক্সবাজারের পথে রওনা দিয়েছিল ওরা, নিহাল উঠে দেখে মাহিয়া সবার শেষ থেকে দ্বিতীয় রো তে জায়গা রেখেছে ওদের জন্য। মাহিয়া যে নিহালের বিরক্তিটা বুঝতে পেরেছে তা জেনে অনেক শান্তি লাগলো নিহালের। তারপরেও একটু খেপানোর জন্য মাহিয়াকে বললো ও,
– এতো পেছনে বসছো কেনো?
নিহালের গম্ভীর আওয়াজে একটু হকচকিয়ে গেল মাহিয়া। ও মনে করেছিল এই জায়গা দেখে নিহাল খুশি হবে। তাহলে…? কনফিউস্ড হয়ে বললো ও,
– মানে?
– মানে এতো পেছনে বসলে তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে না। আবার গাড়ির বাম্পিংও হবে। আমাদের মনে হয় সামনে বসা উচিত।
মাহিয়া কোনো কথাই বললো না আর। এক মুহূর্ত নিহালের চেহারার দিকে করুণ আর অভিমান মিশ্রিত একটা দৃষ্টি দিয়ে যেই না ওখান থেকে উঠে বের হতে যাবে ওমনেই ওর পাশে বসে রাস্তা ব্লক করে দিল নিহাল। মাহিয়া তখনো নিজের সিটের সামনে দাড়িয়েই ছিল। নিহালের চাঁপা হাসি দেখে বুঝতে পারলো যে এতোক্ষণ ওকে খেপানো হচ্ছিল। ওর দিকে রাগান্বিত ভাব দেখিয়ে সিটে বসে মাহিয়া জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলো ।
হঠাৎ হাল্কা একটা শিহরণ অনুভব করলো পিঠে মাহিয়া । শিহরণটা থেমে গেল। ঝট করে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো নিহালকে। সে হাত গুটিয়ে বসে আছে। ভুরু কুছকে গেল মাহিয়ার। হয়তোবা মনের ভুল ভেবে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলো ও।
আবার সেই শিহরণ। সয়ংক্রিয়ভাবে পিঠ সোজা হয়ে গেল মাহিয়ার। আবার থেমে গেছে ছোয়াটা। এবার পুরোপুরি পাশ ফিরল ও। ধমকের সুরে তাকালো নিহালের দিকে।
– এই, কি শুরু করসো তুমি হ্যা?
-কি হলো?
-কি হলো মানে? আমাকে এভাবে টাচ্ করছো ক্যান পিঠে?
– কিভাবে টাচ্ করছি? এভাবে? নাকি এভাবে?
এই বলতে বলতে নিহাল মাহিয়ার পিঠের নানান জায়গা ছুতে ছুতে এক পর্যায়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। মাহিয়ার রাগ একদম গলে গেল নিহালের দুষ্টুমিতে। হাসতে শুরু করলো ও।
হোটেলে এসে নিজ নিজ রুমে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে উঠলো সবাই। তবে যেহেতু বিকাল পরে গেছে আর আজ ওদের শেষ সন্ধ্যা এখানে, তাই মিনহাজ সবাইকে বলে দিল রুমে আধা ঘন্টার বেশী দেরী না করতে। নাহলে বিচের সানসেট মিস করবে ওরা।
মাহিয়া এতোক্ষণ মজাতেই ছিল নিহালকে নিয়ে, কারণ আশপাশে বন্ধুরা ওদের ঘিরে ছিল। কিন্তু নিজেদের ফ্লোরে ওঠার পরে হাত পা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো ওর। নিহাল ওকে এখন একা পেয়ে কি করবে? চিন্তা করতেই ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়লো ও। যদি এখনি কাছে আসে? মানে এভাবেই আসবে? ও কি করবে তখন? কি করা উচিত আসলে? দাড়িয়ে থাকবে পুতুলের মতন নাকি নিজেও একটু আগাবে?
কিকার্ড পাঞ্চ করে নিহাল পাশে সরে মাহিয়াকে ভেতরে যাওয়ার রাস্তা করে দিল। ঢুকেই সোজা ড্রেসিংটেবিলের সামনে চলে গেল মাহিয়া। চুড়ি আর দুল খুলতে খুলতেই আয়নায় আড়চোখে দেখে নিল নিহালকে। মনের ভেতর দোটানা যুদ্ধ চলছেই। একবার মনে হচ্ছে, বাঙালি বউ ও, নিহালের সামনে দাড়িয়ে বা বসে থাকাটাই ভালো। লজ্জা মেয়েদের অলংকার। সেটাই পরে থাকবে ও। পরক্ষণেই এই চিন্তা বাতিল করলো। আরে ও কি ১৯৬০ দশকের বউ নাকি? একুশ শতকের মেয়েরা নিজেরাও স্বামীর কাছে আগাতে পারে।
যখন মনের ভেতর এসব নিয়ে তোলপাড় চলছে তখন চোখ নিহালের দিকেই পরে ছিল মাহিয়ার। ওর একটু অবাক লাগলো দেখে যে ছেলেটা খুব স্বাভাবিক আচরণই করছে। সুটকেস থেকে নিজের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। বের হওয়ার পর মোবাইল নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। মাহিয়া নিজেও ইতিমধ্যে ফ্রেশ হয়ে এসেছে কিন্তু নিহালের কান্ড কারখানা মাথায় ঢুকছেনা ওর। মাহিয়ার কাছে আসার কোনো লক্ষণই নেই ওর। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল মাহিয়ার। লবির সেই নার্ভাসনেসটা চলে গেছে আর সেই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে বিরক্তি। মনে মনে গালমন্দ করলো নিহালকে ও,
– এহ! আসছে রোম্যান্স করতে! শুধু গাড়িতে আর ব্যালকনিতেই পারে সব। রুমে থাকলে কিছুই নাই। হুহ!
রাগ যে শুধু তখনি উঠলো মাহিয়ার তা না। এর থেকেও অনেক গুনে বেশী মেজাজ গরম হলো যখন ওরা আবার ঘুরতে বের হওয়ার সময় নিহাল মাহিয়াকে নিয়ে পুলের পাশের রেস্টুরেন্টে গেল চারটা টেবিল বুক করতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের জন্য। এই চারজন দম্পতির মধ্যে ওরা অন্তর্ভুক্ত না, এটা জেনে মেজাজ তীরিক্ষা হয়ে গেল মাহিয়ার।
– আমরা রাতে ডিনার কই করবো?
– আমরা? করে নিব কোথাও। রেস্টুরেন্টের অভাব আছে নাকি কক্সবাজারে? দেখি বাকিরা কই যায়।
এই বলে নিহাল সামনে চলে গিয়েছিল। কেন যেন সেইসময় রীতিমতো কান্না পাচ্ছিলো মাহিয়ার। নিহাল ওদের জন্য রোমান্টিক কিছু চিন্তা করেনি তা ও আগেই জানতো। তবে তাই বলে গতকাল থেকে তাদের মাঝে যা হচ্ছে, সেই অনুভব দিয়েও কি নতুন করে কিছু ভাবা যেত না? চারটা টেবিল তো বুক দিয়েছেই, আরেকটা বেশী দিলে কি ক্ষতি হতো ওর?
বিকালে কলাতলী আর লাবণী পয়েন্টেই ঘোরাফেরা করলো সবাই। বন্ধুদের মাঝে মনের কষ্টটা সেই সময়ের জন্য ভুলে গেল মাহিয়া। একসাথে মিলে লাইভ ফিশএ গিয়ে স্কুইড, প্রণ সহ নানা রকম সামুদ্রিক মাছের ফ্রাই খেল ওরা। সন্ধ্যা আটটায় হোটেলে ফিরে আসলো সবাই। যেই চার দম্পতির জন্য ক্যান্ডেললাইট ডিনারের ব্যবস্থা হয়েছে তারা লবি থেকেই বিদায় নিল। ওদের চেহারায় খুশির ঝলক আর বাকিদের ওদেরকে খেপানোর দৃশ্যটা দেখে মনে মনে মাহিয়া কষ্টে শেষ। মাথা নিচু করে মনমরা হয়ে থাকলো ও।
নিহাল ছেলেদের সাথে দাড়িয়ে গল্প করছিল, তার মাঝেই এক ফাঁকে এসে মাহিয়ার হাতে কার্ড দিয়ে বললো,
– রুমে যেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। বিচে বালি টালি লেগে একাকার অবস্থা। এর মধ্যে আমরা একটু আলোচনা করি কোথায় ডিনার করবো, ওকে? আমি আসছি রুমে তুমি যাও।
মাহিয়া খুব কষ্ট নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। দিনের শুরু থেকে দুপুর পর্যন্ত কতো সুন্দর একটা সময় কাটছিল। মনের মাঝে আজ নিয়ে নানান স্বপ্নও কি দেখেনি মাহিয়া? তবে এখন যা দেখছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে এইবার আর কিছুই হবে না ওদের মাঝে।
এইসব সাত পাঁচ চিন্তা করতে করতেই কার্ড পাঞ্চ করে রুমের দরজা খুললো ও। তবে আলো জ্বলতেই বড়সর একটা ধাক্কা খেল মাহিয়া। ওর সামনে এক অবিশ্বাস্য ছবি দৃশ্যমান। রুমের এক কর্নারে, ঠিক বারান্দার উল্টা পাশে একটা টেবিল সেট করা হয়েছে। লাল সাদা কাপড় দিয়ে সাজানো টেবিলটা দুপাশে দুটি চেয়ার আর ঠিক মাঝখানে একটি মোমদানি। ভেতরে মোম আছে তবে এই মুহূর্তে নেভানো।
আসপাশে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। সেই গোলাপ খাটেও বিছানো। সাদা চাদরে টকটকে লাল গোলাপের পাপড়িগুলো যেন চেয়ে আছে মাহিয়ার দিকে। মাহিয়ার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ওর সামনে কি আছে। এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারলো নিহালের বিকালের আজিব আচরণের কারণ। লজ্জায় হেসে দিল মাহিয়া।
ইশ! ছেলেটাকে মনে মনে আনরোমান্টিকও মনে করেছে ও অথচ এসব করার মতন চিন্তা কখনো মাহিয়ার মাথা থেকেই আসে নাই। হঠাৎ মোবাইলে মেসেজ আসায় সেইদিকে মন দিল মাহিয়া।
নিহালের মেসেজ।
– আজ রাতে তোমাকে শাড়িতে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
মেসেজটা পড়ে চোখ মুখ লাল করে হেসে দিল মাহিয়া। ঢাকা থেকে আসার সময় নিহাল ওকে একটা শাড়ি নিয়ে আসতে বলেছিল। শাড়ি কেন লাগবে তা তখন না বুঝলেও কোনো প্রশ্ন করেনি মাহিয়া। মনে করেছিল হয়তো বন্ধুদের সবার সাথে কোনো পার্টি করবে তাই বলেছে নিহাল। এখন বুঝলো কেন এই শাড়ি আনতে বলা হয়েছিল ওকে। সুটকেস থেকে শাড়িটা বের করলো ও। নিজেকে ধন্যবাদ দিল এই শাড়িটা আনার জন্য। এর সাথে ম্যাচিং করা শাল এনেছিল ও। তবে এখন আর শালটা লাগবে না। এমনেই পরবে ও।
……………………………
এক ঘন্টা পর রুমের সামনে আসলো নিহাল। বেল বাজিয়ে অপেক্ষায় রইলো। ওর মনের অবস্থা তখন কেমন তা কাউকেই বোঝানো সম্ভব না। নিজেকেই কি বোঝাতে পারছে ও? মাহিয়ার জন্য স্পেশাল কিছু করতে চাচ্ছিলো ও। গতকাল থেকে অনেক নতুন কিছু হয়েছে ওদের মাঝে যা ওদের সম্পর্ককে এক নতুন গতী দিয়েছে। তাই আজ কক্সবাজারে থাকা ওদের শেষ রাতটাকে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখার একটা সামান্য চেষ্টা ও করতে চাচ্ছে। আচ্ছা মাহিয়ার রিএ্যাকশন কি ছিল রুমটা দেখে?
ওল কি পছন্দ হয়েছে আইডিয়াটা! খুশিই তো হওয়ার কথা ওর বোধহয়। বিকালে অন্যদের জন্য টেবিল বুক করলেও নিজেদের জন্য নিহাল করে নাই দেখে বেশ কষ্ট পেয়েছিল মাহিয়া। ওর চেহারায় স্পষ্ট ছিল সেটা। দেখে মনে মনে হেসেছিল নিহাল। এখন নিশ্চয়ই বুঝবে কেন বুক করা হয়নি। এতোক্ষণ লাগছে কেন ওর খুলতে? আরেকবার বেল দিল নিহাল।
ওপাশ থেকে পায়ের শব্দ পেল ও। দরজাটা খুলে গেল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না নিহাল। দেখবে কেমনে? রুম তো অন্ধকার করে রাখা। মাস্টার সুইচ অফ করা। শুধু ফ্লোর লাইট টা জ্বলছে। ওয়াশরুমের পাশের ওয়ালে সুইচ আছে, হাতরে খুজে সেটাতেই চাপ দিয়ে আলো জ্বাললো ও।
রুমটা আলোকিত হতেই মনোরম একটা দৃশ্যের সাক্ষী হলো নিহাল। পুরো সাজ সজ্জার মাঝে ওদের ডিনার টেবিলের ওই পাশে বসা মাহিয়া। একটা মিষ্টি হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছে। অপরূপ সুন্দর লাগছে ওকে। শাড়ি পরেছে। সেজেছেও। চুল ছাড়া। চোখের একটা সাইড দিয়ে হাল্কা হয়ে ছড়িয়ে আছে সামনের চুলগুলো।
যেখানে আগে দাড়ানো ছিল, সেখানেই দাড়িয়ে রইলো নিহাল। নড়তে ভুলে গেছে পুরা। চোখের পলকও ফেলতে মনে নেই। এভাবে, এতো সুন্দর করে মাহিয়া যে ওর জন্য অপেক্ষা করবে তা ওর চিন্তার বাইরে। স্বপ্ন দেখছে না তো?
মাহিয়া বসে বসে দেখছিল নিহালের অবস্থা আর মিটি মিটি হাসছিল। ছেলেটার হকচকিয়ে যাওয়া ভাবটা দেখে বেশ মজা লাগছিল ওর। বোঝাই যাচ্ছে অনেক সার্প্রাইস্ড হয়েছে। যাক্! মাহিয়া তাহলে সার্থক। কিন্তু ও ওখানেই দাড়িয়ে আছে কেন?
যখন বুঝলো যে নিজের জায়গায় জমে গেছে নিহাল তখন উঠে হাল্কা পায়ে ওর কাছে আসলো মাহিয়া। নিহাল এখনও একই ভাবেই দেখছে ওকে। তবে এখন টেবিলের আড়াল থেকে বের হয়ে আসা সম্পূর্ণ মাহিয়ার ওপর চক্ষুস্থীর হলো ওর। নীল রং এর একটা অর্গ্যাঞ্জা শাড়ি পড়েছে মেয়েটা। আঁচলটা এক পালাতেই মেলে রেখেছে। হাফ হাতা ব্লাউজটার কারুকাজ টাও বেশ সুন্দর।
তার সাথে স্ট্রেট চুলগুলো খুলে রেখেছে ও। কোমরের নিচে ছেয়ে যাওয়া চুলগুলো আলোতে ঝলমল করছে । এই ঘন চুলের মাঝ দিয়েই আধো লুকানো আধো বের হয়ে থাকা ঝোলানো কানের দুলটা দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত স্টোনের কারণ সেটাও চকচক করছে। হাতে ভর্তি মেটালের চিকন চুড়ি ওর হাটার তালে ওপর নিচ দোল খাচ্ছে। নিহালের কাছে সেই মুহূর্তে সব মিলিয়ে অসম্ভব আবেদনময়ী লাগছিল মাহিয়াকে।
ওর সামনে এসে দাড়ালো মাহিয়া। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে নিজেই হাত বাড়ালো নিহালের হাতের দিকে। হাতে হাত রাখতেই নড়ে উঠলো নিহাল,
– ইউ আর লুকিং র্যাভিশিং!
নিহালের কমপ্লিমেন্টের জবাব একটা লাজুক প্রেমের হাসি দিয়ে দিল মাহিয়া যা নিহালের মনকে ছুয়ে গেল। ওর হাতটা চাপ দিয়ে ধরলো নিজের মাঝে। এরপর আস্তে আস্তে নিহালকে টেনে টেবিলের কাছে আনলো মাহিয়া।
এই প্রথম নিহালের চোখ মাহিয়ার থেকে সরে টেবিলের ওপর পড়লো,
– আরে খাবার দেখি পুরাই সেট? এগুলো কখন দিয়ে গেল? আমি তো বলেছিলাম আমার কল করার পর যেন সার্ভ করে।
একটা বিরত্বের হাসি দিয়ে বললো মাহিয়া,
– আমি অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। আরে অবাক হচ্ছো কেন? আজ বিকালে তুমি পুল ক্যাফে তে যেয়ে চারটা টেবিল বুক করলা না? তখন পাশে আমিও তো ছিলাম। রুমে এসে এই সেট আপ দেখেই গেস করলাম ওখান থেকেই এটারও অর্ডার দিয়ে রেখেছ তুমি। ফোন লাগালাম ওখানে, আমার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হলো। বাস্ আর কি! বললাম ওদের এসে সব সেট করে দিতে। পাঁচ মিনিট আগেই দিয়ে গেছে। এখনো ফুললি গরম আছে।
মাহিয়ার কথা গুলো মন দিয়ে শুনছিলো নিহাল। ওর কথা শেষ করার পর হেসে দিল,
– কি দরকার ছিল এতো কষ্ট করার তোমার? আমি এসে ম্যানেজারকে জাস্ট একটা ফোন দিলেই এনাফ ছিল।
নিহালের কথায় মাহিয়া চুপ মেরে গেল। ওর কিছুক্ষণ আগের উচ্ছাসিত হাসি এখন লাজুক ভাবে পরিণত হলো হঠাৎ করে।
– আমি আসলে… চাইনি যে… তুমি আসার পর… আমাদের কেউ ডিস্টার্ব করুক।
মাহিয়ার উত্তরে থমকে গেল নিহাল। এই মেয়েটা ওকে বার বার অবাক করে দিচ্ছে। ওকে ওর নিজের কাছেই বেকুব বানিয়ে দিচ্ছে। এই কথাটা ওর মাথায় আসেনি কেন? আসলেই ওর রুমে আসার পর ওয়েটার খাবার নিয়ে আসাটা অড লাগতো। ওদের এই মুহূর্তের মাঝে বাধা পড়তো একটা। বেকুব, গাধা কোথাকার!
– নিহাল? কি চিন্তা করো? চলো খেতে বসি নয়তো খাওয়া আসলেই ঠান্ডা হয়ে যাবে।
এই বলে মাহিয়া আরেক পাশের চেয়ারটায় যেই না বসার জন্য পা বাড়ালো, অমনি নিহাল ওর কনুই ধরে ঘুড়িয়ে নিল নিজের দিকে। আরেক হাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিল ওকে। এবার থমকানোর পালা মাহিয়ার। নিহালের চোখের ভাব বুঝতে সময় লাগলো না ওর। মাহিয়ার চেহারার একদম কাছে নিজের চেহারা নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো নিহাল,
– আজ আসলেই তুমি চাওনা কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করুক?
চোখ নামিয়ে ফেললো মাহিয়া। নিহাল নিজের আঙ্গুল ওর থুতনির নিচে রেখে চেহারাটা উঠিয়ে নিজের সামনে ধরলো। নিজেও নেমে আসলো মাহিয়ার কাছে। চোখ থেকে ওর ঠোটের দিকে তাকালো নিহাল। আস্তে করে নিজের ঠোট টা কাছে নিয়ে আসলো ও। একদম যখন কাছে এসেছে তখন হাত সামনে দিয়ে বাধা দিল মাহিয়া। লাজুক মুখেই বললো,
– খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।
চলবে…….