রুপকথা পর্ব ৬
নিহালের বাসায় আসতে বিকাল হয়ে গেল। দরজা খুলে দিল কাজের মেয়ে। ডাইনিং টেবিলেই মা আর মাহিয়া বসে গল্প করছে দেখে ওদের কাছে এগিয়ে গেল নিহাল।
-আব্বা, কেমন ছিল অফিস?
-এইতো আম্মু। মিটিংটা আজ শেষ হয়েছে বলে শান্তি লাগছে। থ্যাংকস ফর দা সাজেশন মা। তোমার আইডিয়া গুলোই আজ ডিসকাস করলাম। দা বোর্ড সিম্ড হ্যাপি।
-গুড ফর ইউ দেন। এখন আয় একসাথে বিকালের নাস্তা করি।
-আম্মু একটু ফ্রেস হয়ে আসি। মাহিয়া পড়াশোনার কি অবস্থা? মিডের প্রিপারেশন কতদূর?
– চলছে। একটা একটা করে শেষ করছি।
– হমম। আচ্ছা আমি রুম থেকে আসছি।
এই বলে নিহাল রুমে চলে গেল। মাহিয়ার আজ প্রথমবার নিহালের একটা জেসচার খুব মনে ধরেছে। কেন যেন নিহালের ফুল পাঠানোটা ভালো লেগেছে ওর। এর আগেও জিনিসপত্র অর্ডার দিয়ে নিহাল মাহিয়ার প্রতি কেয়ার জাতালেও আজকের বিষয়টা প্রথমবার মাহিয়াকে অল্প হলেও ইম্প্রেস করেছে। তাই নিহালের সাথে আজ কথা বলতে জড়তাবোধ না বরং কেমন যেন একটু লজ্জা লাগছে ওর।
অনেক্ষণ পার হয়েও যখন নিহাল ডাইনিং রুমে আসলো না তখন আয়েশা বললেন,
-মাহিয়া, আম্মু নিহাল মনে হয় বেশ টায়ার্ড। এক কাজ করি, ওর নাস্তাটা বুয়ার হাতে রুমেই পাঠিয়ে দেই। তুমি রুমে যাও। একসাথে নাস্তা করো তোমরা।
– কিন্তু মা আপনার সাথে তো আপনার ঔষধগুলো নিয়ে বসার কথা আমার। কোনটা কখন খাবেন সেটা না ঠিক করে দিব?
-আরে সময় চলে যাচ্ছে নাকি? সেই কাজ সন্ধ্যায় করা যাবে, এখন নিহালের কাছেই যাও।
মাহিয়া আর কথা বাড়ালো না। আয়েশা টেবিল থেকে উঠে চলে যাওয়ার পর ও নিজের রুমে চলে আসলো। নিহাল মাত্র ড্রেসিং রুম থেকে বের হয়েছে। মাহিয়া ঢোকার পরপরই ওদের নাস্তা নিয়ে আসলো বুয়া। সেন্টার টেবিলে রেখে দরজা বন্ধ করে চলে গেল ও।
মাহিয়া আর নিহাল একই সাথেই চা নিল। নিহাল খুব স্বাভাবিক ভাবেই অফিস আর ভার্সিটির এদিক ওদিককার কথা বলছিল মাহিয়ার সাথে। মাহিয়াও শুনছিল তবে ওর মনে চলছিল অন্যকিছু। নিহালকে ফুলগুলোর জন্য ধন্যবাদ দিতে চাচ্ছে কিন্তু কিভাবে বলবে তাই বুঝে উঠতে পারছিল না ও। নিহালও এই ব্যাপারে কোনো কথা উঠাচ্ছিলোনা তাই ফ্লোর পাচ্ছিলো না মাহিয়া।
এক পর্যায়ে চা আর নাস্তা করা শেষ হয়ে যাওয়ায় পড়াশোনার কথা বলে উঠে পড়লো নিহাল। মাহিয়া তখনো কিছু বলতে পারলো না।
এইদিকে অফিস থেকে এসে রুমে ঢুকেই ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফুলের তোড়াটা দেখেছিল নিহাল। যাক, তাহলে মাহিয়া পেয়েছে ফুলগুলো। নিহাল মনে করেছিল, ফুলগুলো পেয়ে হয়তোবা মাহিয়া ওকে একটা কল করবে। কিন্তু ওর ফোন না আসায় একটু শংসয়ে ছিল নিহাল। এখন এসে বুঝলো যে ফুলগুলো ঠিক মানুষের হাতেই পরেছে। তবে মাহিয়ার থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে একটু হতাশ হয়েছিল ও। আড়াই মাস গড়িয়ে যাচ্ছে ওদের বিয়ের। মাহিয়াকে এখন অনেকটা স্বাভাবিক দেখালেও এখনো ওদের মাঝে অনেক ব্যবধান রয়ে গেছে, বুঝতে পারে নিহাল। এই ফুলগুলোকি সেই ব্যবধানের একটুকুও মিটাতে পারেনি তাহলে?
রাতে মায়ের আর নাবিলের সাথে ডিনারে বসে গল্প হলো খুব। তারপর যে যার মতন রুমে চলে গেল শুতে। নিহাল রুমে এসে বারান্দায় যেয়ে দাড়ালো। এই সময়টায় ওদের সামনের পার্কটা খুব চুপচাপ থাকে। এই নিরবতা নিহালের খুব পছন্দ।
নিচে একটা রিকশা দেখছিল নিহাল। একদম নতুন। রাস্তার আলোতে টিনের কাজগুলো জ্বলজ্বল করছে।
-নিহাল,
ঘুরে তাকালো নিহাল। মাহিয়া পেছনে দাড়ানো। ধীর পায়ে কাছে এসে নিহালের পাশে দাড়ালো ও। নিহাল খুব আশ্চর্য হলেও কিছু বললো না। প্রথমবার মাহিয়া আজ ওর সাথে এই বারান্দায় দাড়িয়েছে এবং দেখে মনে হচ্ছে গল্পই করতে এসেছে। মনে মনে খুশি হলো ও।
-কি দেখ নিচে?
-হমম?
-না মানে, পেছন থেকে দেখলাম উপুর হয়ে নিচে কিছু দেখছিলা তুমি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
-ও আচ্ছা। নিচে একটা রিকশা ছিল। একদম নতুন। পুরা চকচক করছিলো। তাই দেখছিলাম আর কি। তা তোমার খবর বলো।
তাকালো নিহালের দিকে মাহিয়া,
-এই তো চলছে সব কিছু। ফ্যাক্টরির কাজ কেমন চলছে তোমার? মিটিং কেমন হলো আজকেরটা?
নিহাল আবার একটু অবাক হলো। ফ্যাক্টরি, মিটিং এইসবের গল্প অলরেডি খাবার টেবিলে মায়ের সাথে হয়েছে নিহালের। মাহিয়াও পাশেই বসা ছিল। সব শুনেছে ও। তাহলে আবার কেন জিজ্ঞেস করছে?
ওওওওও, ম্যাডাম মনে হয় অন্য কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। তাই এদিক ওদিকের কথা ঘোরাচ্ছে।
নিহাল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু দুষ্টুমির মুড নিয়ে আসলো,
– ভালোই চলছে সব। মিটিং নিয়ে আম্মুর সাথে কথা গুলো তো শুনেছোই। সবার সামনেইতো সব বললাম। তবে হ্যা, একটা কথা বলা হয়নি ওখানে।
-কি সেটা?
– আজকে দুপুরে এই বাসার কাউকে আমি ফুল পাঠিয়েছিলাম। সেই ফ্লাওয়ার্স গুলো রিসিভ করার কনফারমেশন কলটার জন্য অনেক্ষণ অফিসে ওয়েট করেছি আমি বাট কলটা পাইনি।
মাহিয়া ঝট করে নিহালের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। ওর চোখের দুষ্টুমি দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো আবার। নিহাল আবার শুরু করলো কথা,
– কলটা না আসাতেই বুঝতে পেরেছি যে ফুলগুলো তোমার পছন্দ হয়নি। যাইহোক এরপর থেকে খেয়াল রাখবো যে তোমার অপছন্দের কিছু না দিতে।
নিহাল আড়চোখে মাহিয়ার এক্সপ্রেশন দেখার চেষ্টা করছিল। ওর মাথা এখনো নিচু তবে ও হাসছে। একটুপর মাহিয়া মাথা ওঠাতেই চোখ সরিয়ে ফেললো নিহাল।
-সরি তোমাকে কল করিনি আমি। আমার ফুলগুলো খুব পছন্দ হয়েছে। একচুয়ালি দে আর মাই ফেভারিট। যখন ওগুলো ডেলিভারি দেওয়া হলো তখন বেশ অবাক হয়েছিলাম আমি। পরে চিন্তা করলাম ফোনে না, সামনাসামনি তোমাকে থ্যাঙ্কস জানাবো।
থ্যাঙ্কস ফর দা ফ্লাওয়ারস্।
-ইউ আর ওয়েলকাম।
-কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না। তুমি কিভাবে জানলে যে আমার এই ফুলগুলোই ভালো লাগে?
মাহিয়ার প্রশ্নে হেসে দিল নিহাল,
– মনে আছে, আমাদের বিয়ের পর পর নামিরা আপুর সাথে একবার ডিনারে গেলাম আমরা তখন বনানীতে আপু ফুলের দোকানে থেমেছিল বাসার জন্য কিছু ফুল কিনতে? তখন তুমিই তো চুজ করে দিয়েছিলে ফুলগুলো। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম কেমন ফুল তোমার ভালো লাগে।
মাহিয়া হতবাক হয়ে শুনছিল নিহালের কথাগুলো। এতদিন আগের এত ছোট্ট একটা ঘটনাও এই মানুষটা মনে রেখেছে! কিভাবে পারে ও?
এরপরে একটা দুইটা করে গল্প জমলো তাদের মাঝে। মাহিয়া আর নিহাল, বিয়ের পর সেই রাতে প্রথম একে অপরের সামনে কোনো জড়তা ছাড়া হেসেছিল। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছিল ওরা। ইনফ্যাক্ট সেই রাতের পর থেকে একটু একটু করে ওদের মাঝের ইতস্ততবোধটা কাটতে লাগলো। বিশেষ করে মাহিয়া, নিহালের সাথে আগের চাইতে অনেকটা ইসি হয়ে গিয়েছিল।
দেখতে দেখতে মিডটার্মও শেষ হলো। রেগুলার ক্লাসেস শুরু হলো আবার।
বিয়ের সময় মাহিয়া ওর বান্ধবীদের বলে দিয়েছিল যেন ভার্সিটিতে আলাদা করে কেউ ওর আর নিহালের বিয়ের ব্যাপারে কথা না তোলে। আসলে সেই সময় মাহিয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না কাউকে কিছু জানানোর। আর দুইজন দুই ডিপার্টমেন্টের হওয়ায় ভার্সিটির ভেতর দেখা সাক্ষাতও হতো কম। তাই নতুন করে কেউ জানতেও পারেনি।
একদিন মাহিয়া ক্লাসে জলদি যাওয়ার তালে নিজের মোবাইল গাড়িতে ফেলেই চলে গিয়েছিল। যেয়ে দেখে টিচার এখনও আসেইনি। ক্লাসেই বসে সবাই গল্প করছে। তনুর পাশে বসে মাহিয়াও গল্প করা শুরু করলো। হঠাৎ খেয়াল করলো ওরা, ক্লাসটা হাল্কা চুপচাপ হয়ে এসেছে। ম্যাম ঢুকেছে ভেবে সামনে তাকাতেই নিহালকে দেখতে পেল মাহিয়া। নিহাল দরজা দিয়ে শুধু মাথা ঢুকিয়ে এদিক ওদিক কাকে যেন খুজছে আর ক্লাসে বসা সবাই নির্বাক স্রোতা হয়ে দেখছে ওকে।
মাহিয়া আঁচ করলো ওকেই খুজছে নিহাল তাই ও উঠে সামনে গেল নিহালের কাছে। নিহাল ওকে দেখেই রুমের দরজায় দাড়ালো।
– হ্যালো ম্যাডাম। সব নিয়ে এসেছেন গাড়ি থেকে?
মাহিয়া ভুরু কুচকালো। তারপর নিজের বেঞ্চে রাখা ব্যাগ আর বই দেখলো।
– হ্যা সবই তো এনেছি। কেন?
নিহাল নিজের হাত সামনে এনে ফোনটা দেখালো।
-সো এটা কি অন্য কারও? আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমি রেখে দেই।
মাহিয়া নিজের মোবাইল দেখে হেসে দিল।
-ওহ্ এইটা? না এইটা আমারই সরি তাড়াহুড়ায় খেয়াল করিনি। থ্যাংস।
নিহাল হেসে ফোনটা দিয়ে দিল মাহিয়াকে। তারপর তনুকে একটা হায় দিয়ে চলে গেল। যাবার সময় বলতে ভুলে গেল না যে মাহিয়ার জন্য গাড়ির কাছে ওয়েট করবে ও।
যখন সিটে এসে বসলো মাহিয়া, তনু জানালো যে নিহালের সাথে যখন ও কথা বলছিল তখন ক্লাসের কিছু মেয়েরা বেশ আগ্রহ নিয়ে ওদের দিকে নাকি তাকিয়ে ছিল।
– ওইজে লিমা আছে না? ওর তো চোখই সরছিলনা তোদের থেকে।
-আচ্ছা বাদ দে তো এইসব।ওর ইচ্ছা হইসে ও দেখতেই পারে। ক্লাসে আসছি, ক্লাস কর্।
সেইদিন বেশী একটা পাত্তা না দিলেও পরে কয়েকবার একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে মাহিয়ার নজরে বিষয়টা পড়লো। একদিন ক্লাসের ব্রেকে সবাই ক্যান্টিনে গিয়েছিল। সেইদিন মনে হয় নিহালদেরও ক্লাসের ব্রেক একইসাথে পরেছে। তাই ওকেও পাওয়া গেল ক্যান্টিনে। মাহিয়া যখন কফি নিয়ে বসেছে তখন দেখলো নিহালকে। দুইজনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা আলতো হাসি দিয়ে নিজ নিজ বন্ধুদের মাঝেই আলাদা টেবিলে ব্যস্ত থাকলো। এর মধ্যেই মাহিয়া খেয়াল করলো লিমা নিহালদের টেবিলের দিকে যাচ্ছে। তনু পাশ দিয়ে টোকা দিল মাহিয়াকে,
-ওইযে দ্যাখ ম্যাডাম চললেন। নিহালের সাথেই কথা বলবে আই এ্যাম শিওর।
-কেন? অন্য কেউও তো ওর পরিচিত থাকতে পারে ওই টেবিলে।
-বেট লাগবি আমার সাথে মাহি? ও নিহালের সাথেই কথা বলতে যাচ্ছে।
মাহিয়া তনুর কনফিডেন্স দেখে আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ দেখতে লাগলো নিহালের টেবিলে যা হচ্ছে। একটু পর লিমা যেয়ে নিহালের সাথেই কথা জুড়ে দিল। তনু হেসে বললো,
-দেখলি? বলসিলাম না? আমি কোনো গেস করি নাই। কাহিনী আগের থেকেই জানি আমি। ছন্দা বললো, একদিন লাইব্রেরীতে নিহালের সাথে পরিচয় হয় লিমার। খুব নাকি গল্প করসে ও। আমিতো তখনই বুঝছি যে ম্যাডাম নিহালের পিছে লাগসে।
-তো এগুলা আমাকে আগে জানাস নাই কেন?
-জানায় কি লাভ তোকে? কানে নিস এসব কথা? এর আগেও তোকে বলসি এই মেয়ের ইনটেনশন ভালো না। তারপরও তোর কোনো চেতবেত নাই।
-আমার চেতবেত থাকার কি আছে? নিহালের ব্যাপার নিহাল সামলাবে।
-আর ইউ সিরিয়াস মাহিয়া? তুই কি বলতেসিশ তুই নিজেও শুনতে পাস? তোর কোন কেয়ার থাকার কথা না যে কে তোর হাসবেন্ডের সাথে কি করছে? নাকি বাকিদের না বলতে গিয়ে তুই নিজেই ভুলে গেসিশ যে নিহাল তোর স্বামী হয়? ফর গুডনেস সেক গ্রো আপ।
তনুর রাগান্বিত কথাগুলো শুনে মাহিয়া চুপ মেরে গেল। কিছুক্ষণ তনুর দিকে চেয়ে থেকে আবার নিহালের টেবিলের দিকে তাকালো ও। লিমা এখনোও গল্প করছে নিহালের সাথে।
ক্লাস শেষে নিচে নেমে চত্বরে দাড়ালো মাহিয়া। নিহাল নামেনি এখনো। পেছনে দেখলো লিমা এসে দাড়িয়েছে ওর বান্ধবীদের সাথে। এর মধ্যেই নিহালও বের হলো ওর ক্লাস থেকে। মাহিয়াকে চত্বরে দেখে বাকি বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে ওর কাছে আসলো।
-ক্লাস ডান?
-হমম
-আর কোনো কাজ আছে?
-না।
-তাহলে চলো।
ওরা চলে যাওয়ার পথে পেছন থেকে লিমা বলে উঠলো,
– বাই নিহাল।
নিহালের পেছন ফিরে হাসিটা দেওয়াতে মাহিয়ার কেন যেন রাগ উঠলো খুব। মুখ গোমড়া করে রাখলো ও।
রাতে বাসায় ঢুকে প্রথমে ফ্রেশ হতে গেল মাহিয়া। ও যখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছিল তখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো নিহাল। আজ প্রথমবার নিহালের ওপর চোখ আটকালো মাহিয়ার। ভাল করে দেখতে মন চাইলো ছেলেটাকে। এই নিহালের প্রেমে মেয়েদের হাবুডুবু খেতে দেখেছে মাহিয়া। কিন্তু নিহালকে ওই নজরে কখনো দেখতে ইচ্ছে হয়নি ওর। তবে আজ কেন যেন নজরটা বদলাতে ইচ্ছা করছিল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত আয়নায় নিহালকে দেখলো একবার মাহিয়া। আসলেই বেশ হ্যান্ডসম ও।
এক কথায় বলা যায় রাজপুত্রর মতোন। মাথায় ঘন চুল পেছনে ছোট করে কাটা। স্কিনটোন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, হাল্কা ফর্শার ধাঁচেই পরে আসলে। পেটানো লম্বা শরীরে বাড়তি মেদ কোথাও নেই। কিন্তু আবার চিকনও না ও। কাধ ও বুক বেশ চওড়া। মাসালেরও কমতি নেই। তবে এইসব কিছু ওর ফিসিকাল এপিয়ারেন্সকে কম্প্লিমেন্ট করলেও, নিহালের সবচাইতে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা হলো ওর হাসি। একদম বাচ্চাদের মতন মনখোলা হয়ে হাসে ও। এই হাসি দেখেই তো আধা মেয়েরা পাগল।
মাহিয়ার কৌশলে তাকানোটা নিহালের চোখ কিন্তু এড়ালো না। মাহিয়া যে ওকে চেকআউট করছে সেটাও বুঝতে পারলো ও। কারণ ও নিজেও তো আড়চোখে মাহিয়াকেই দেখছিলো। দুষ্টুমি খেলে গেল নিহালের মাথায়। অন্য সময় ড্রেসিং রুমে গেলেও এইসময় ইচ্ছা করে বেড রুমেই, উল্টো পাশ ঘুরে মাহিয়ার সামনে টিশার্ট টা চেঞ্জ করলো নিহাল। নিহালের এই কাজ দেখে মাহিয়ার তো চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলে আবার একটু ওঠালো ও।নিহালের খোলা পিঠটা লুকিয়ে দেখতে গিয়ে কেমন একটা লোভ জন্মালো মনের মাঝে। অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করে আবার চোখ সরাতে গিয়েই নিহালের চোখে ধরা খেল ও। তাড়াতাড়ি চেহারার এক্সপ্রেশন সোজা করলো মাহিয়া। নিহাল এক পলক ওর দিকে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
-কি নির্লজ্জ ছেলে! বিরবির করলো মাহিয়া।
রাতের ডিনারের পরে মাহিয়া প্রথমে ওর শাশুড়িকে ঔষধ খাইয়ে, রান্নাঘরে গেল সকালে নাস্তায় কি হবে তা বুয়াকে বুঝিয়ে দিতে। ইদানিং এই কাজগুলো মাহিয়া রেগুলারলি নিজেই করে কারণ ওর ভালো লাগে করতে। শাশুড়ির আর দেবরের সাথে ভালো ঘুলেমিলে গেছে ও আর নামিরা বিদেশ থেকে ফোন দিলে দুইজনের কথার জোড়ে বাকিরা কেউ কথাই বলতে পারে না।
সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রুমে আসলো মাহিয়া। নিহাল ল্যাপটপে কাজ করছিল দেখে প্রথমে ডিস্টার্ব করতে চাইলো না ওকে। কিন্তু ভার্সিটির ক্ষোভটা এখনো মাথায় চড়ে আছে। আর তনুর কথাগুলো তো মাথায় ভন ভন করছিলোই। তাই নিহালের সামনে যেয়ে দাড়ালো মাহিয়া।
-নিহাল, কথা আছে একটু।
মাহিয়ার এভাবে বলাতেই নিহাল বুঝলো ঘটনা ভাল না।
-হমম বলো।
– লিমাকে চেনো কিভাবে তুমি?
– লিমা, লিমা… ওওও লিমা? ওই লাইব্রেরীতে পরিচয় হয়েছিল। তোমার ডিপার্টমেন্টেরইতো।
-হ্যা। তা লাইব্রেরীতে দেখা হয়ে এতো খাতির হয়ে গেছে তোমাদের?
-খাতির মানে? মাঝে মধ্যে গল্প টল্প হয় এই যা।
-আজ ক্যান্টিনে দেখে তো তা মনে হলো না।
-তো কি মনে হলো দেখে?
– বোঝাই যাচ্ছিলো দ্যাট শি ওয়াজ ট্রাইং টু ফ্লার্ট উইথ ইউ।
-ওওও সো প্রবলেমটা এখানে হচ্ছে তোমার?
নিহাল এবার সোজা বসে দুই হাত বুকে পেচিয়ে সরাসরি মাহিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো এটা। ওর কন্ঠে দুষ্টামির আঁচ পেয়ে একটু সতর্ক হয়ে গেল মাহিয়া। তাড়াতাড়ি জবাব দিল ও,
– দেয়ার ইস নো প্রবলেম। আমার কেন প্রবলেম হবে? এটা তো আমি এর জন্য বলছিলাম যে তুমি এখন ম্যারিড। এইসব অন্য মেয়ে মানুষের সাথে কথা বার্তা এখন ফ্রেন্ডসদের মাঝে খারাপ দেখায়। নানান কথা ওঠে।
– প্রবলেম তো এখানেই মিসেস রহমান যে আপনি আমাদের বিয়েটা নিয়ে নিজের ডিপার্টমেন্টে কিছুই বলেননি। আর এইটা জানার পর আমিও আমার বন্ধুদের বলে দিয়েছি কারও সাথে এই ব্যাপারে কথা না বলতে। সো বেচারি লিমার কি দোষ বলো? ও তো আমাকে ব্যাচেলার ভেবেই ফ্লার্ট করছে, যদি করে থাকে আই মিন। তুমি যদি আগেই আমাদের কথা সবাইকে জানিয়ে দিতা তাহলে এতো কনফিউশনই হতো না।
মাহিয়া নিহালের কথা শুনে পুরা বোবা হয়ে গেল। নিহালের সাথে তর্ক করে পারবে না বুঝে কপট রাগ দেখিয়ে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়লো ও।
পরের দিন ভার্সিটিতে আবার লিমার সাথে নিহালের ক্যান্টিনে আড্ডা জমলো। আগের দিনের থেকে বরঞ্চ একটু বেশিই। নিহাল পাশ দিয়ে মাহিয়ার রিএ্যাকশন দেখতে চাচ্ছিলো সেই মুহূর্তে।
মাহিয়া কিছুক্ষণ কিছুই করলো না। শুধু চুপচাপ বসে দেখতে লাগলো ওদেরকে। এরপর হুট করে উঠে দাড়িয়ে গট গট করে পা চালিয়ে নিহালের টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো।
-নিহাল, একটু আসোতো?
লিমা আর নিহাল দুইজনই তাকালো ওর দিকে। নিহাল জিজ্ঞেস করলো,
-কোথায়?
-আমার একটা কাজ আছে।
– পরে করলে হয় না?
-না এক্ষণি লাগবে তোমাকে।
-আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।
-না, এক্ষণি আসো।
শেষের কথাটা একটু জোর খাটিয়েই বললো মাহিয়া। লিমা এবার মাঝখান দিয়ে বলে উঠলো,
– মাহিয়া জোর করছো কেন? কান্ট ইউ সি হি ইস আ বিট বিজি হিয়ার? তুমি যাও, নিহাল পরে আসবে।
-এক্সকিউজমি লিমা, আই এ্যাম নট টকিং উইথ ইউ।
– সো ওয়াট? এমন ভাব নিয়ে কথা বলছো নিহালের সাথে এস ইফ ও তোমার বয়ফ্রেন্ড লাগে?
– নিহাল আমার বয়ফ্রেন্ড না, আমার হাসবেন্ড বুজছো? সো নাও ইউ সি, কেন আমি ওর সাথে এভাবে কথা বলছি?
মাহিয়া উত্তরটা এতো জোরে দিল যে সেই টেবিলের বাকিরা তো শুনলোই, আশপাশের দুইটা টেবিলও সবাই শুনতে পেল।
আর লিমার এক্সপ্রেশনটা ছিল দেখার মতন।
-কি বললা তুমি? নিহাল তোমার হাসবেন্ড?
মানে নিহাল ম্যারিড?
– ইয়েস। সন্দেহ থাকলে ওকেই জিজ্ঞেস করে নাও। আর এখন আমার হাসবেন্ডকে কি আমি নিতে পারি? এই, তুমি বসে বসে কি দেখছো? চলো?
নিহাল মাহিয়ার ঝারি খেয়ে তাড়াতাড়ি দাড়িয়ে গেল। এতক্ষণ এই তর্ক দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলো ও। তবে তার চাইতে বেশী ওর মন ছুয়ে দিল মাহিয়ার স্বীকারোক্তি । যেভাবে আজ সবার সামনে মাহিয়া ওকে ওউন করেছে, ওর অপর দাবি খাটিয়েছে তাতে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এখন ও নিহালকে মেনে নিতে পারছে নিজের স্বামী হিসাবে।
চলবে………