রুপকথা পর্ব ৮
পরেরদিন সকালেই মাহিয়া শপিং এর জন্য বের হলো। কক্সবাজারে পড়ার জন্য কিছু কাপড় কিনবে ও। ওর ইচ্ছা, দুই একটা ওয়েসটার্ন আউটফিট কেনা।
দোকানে যেয়ে কাপড় চুজ করতেই মাহিয়ার অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেল। সাধারণত ওর এতো সময় লাগেনা কিনতে। মাহিয়া নিজের পছন্দের ব্যাপারে খুবই ফোকাস্ড। ও জানে ওর কি ভালো লাগে। তাই সেইটাই ঝটপট কিনে ফেলে ও। কিন্তু আজ পরেছে ঝামেলায়। কারণ আজ ও নিজের না, নিহালের পছন্দে কেনাকাটা করতে চাচ্ছে। নিহাল ওকে যেটাতে দেখলে পছন্দ করবে তাই পরতে চাচ্ছে ও। কিন্তু নিহালের সামনে কিসে ওকে মানাবে তাই ঠাওর করতে পারছে না মাহিয়া। সেই কারণেই এত কনফিউস্ড সে আজ শপিংএ।
– ধুর! বিকালে ওকে সহ আসা উচিৎ ছিল। তাহলে ওই বলে দিত কি কিনব আমি।…
না থাক। ওকে জিজ্ঞেস করাটা একটু বেশী বেশী হয়ে যাবে। ও নাও পছন্দ করতে পারে বিষয়টা। আমি বরঞ্চ আন্দাজ করে নিয়ে নেই। ওর পছন্দের রং যেন কি? আমাকে বলেছিল তো একবার… হমম… ও হ্যা হ্যা নীল আর মেরুন। দেখি এই কালারের মধ্যেই কিছু নিয়ে নেই।
অনেক খোজাখুজির পর মাহিয়া তিনটা আউটফিট কিনলো। পছন্দ হলো সবগুলো ওর। এখন নিহালের ভালো লাগলেই হয়!
নিহাল সকাল বেলার মিটিংটা শেষ করে নিজের কেবিনেই বসে ছিল। হাতে এই মুহূর্তে সেরকম কাজ নেই। কালকের ব্যাপারে প্ল্যান করতে বসলো ও। তবে চিন্তা করতে গিয়ে কিছুই মাথায় আসলো না। পুরাই ব্ল্যাঙ্ক। আগে কখনো কারো জন্য এভাবে প্ল্যান করে নাই ও। তাই বুঝতে পারছে না কিভাবে করলে ব্যাপারটা ভালো হবে। অনেক্ষণ মাথা খাটিয়ে একটা রাফ আইডিয়া মাথায় আনলো ও। তবে সেইটার জন্য সাহায্য দরকার। ফোন তুললো নিহাল।
মাহিয়া বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং হলে গেল। আজ আয়েশার পায়ের ব্যাথাটা একটু বেড়েছে, তাই মাহিয়া বলেই দিয়েছে তাকে খাট থেকে না নামতে। বুয়াকে বলে ট্রেতে লাঞ্চ রেডি করিয়ে ফেললো ও। তারপর নিজ হাতে নিয়ে যেয়ে শাশুড়ির সামনে রাখলো। আয়েশা বৌয়ের আদর যত্নে পুলোকিত।
– আম্মু, তুমি আসার পর থেকে আমি একদম অথর্ব হয়ে গেছি। তুমি একটুও আমাকে কাজ করতে দাও না।
– কাজ তো আমিও করি না মা। সব তো বুয়ারাই করছে। তাদেরকে যতটুকু তদারকি করা দরকার ততটুকের জন্য আপনার ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমি করে দিব। এখন ভালো মানুষের মতন খাবারটা শেষ করে একটা ঘুম দিবেন আপনি। আমি আর আপনার ছেলে তো ক্লাসে বের হয়ে যাব। নাবিলের জন্য বিকালের নাস্তা রেডি রাখতে বলে দিয়েছি। ওকে নিয়েও চিন্তা করবেন না।
মাহিয়ার কথায় হেসে দিলেন আয়েশা,
– আমার নামিরা যখন ছিল, ঠিক এইভাবেই আমাকে শাষণ করতো। ও বিদেশ চলে যাওয়ার পর আমি অনেক একা হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলে আর মেয়ের মাঝে অনেক তফাৎ রে মা। মেয়েদের সাথে যেভাবে কথা বলা যায়, কষ্ট শেয়ার করা যায়, ছেলেদের সাথে তা যায় না। কিন্তু মহান আল্লাহ আমার কষ্ট বুঝতে পেরেছেন। নামিরার জায়গায় তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনেক সুখী হও জীবনে মা। নিহাল আর তোমার বন্ধন যেন অটুট থাকে চিরজীবন।
এই বলে মাহিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তে রুমে ঢুকলো নিহাল। শাশুড়ি বউয়ের এহেন আদর আহ্লাদ দেখে মনে ভরে গেল ওর,
– আদর দেখি উতলে উতলে পড়ছে বউয়ের প্রতি আম্মু। কই, আমাকে আর নাবিলকে তো এভাবে আদর করো না।
-তোরা দুইটা আমার বৌমার মতন আগে হয়ে দেখা, ও ঠিক যেভাবে আমার খেয়াল রাখে সেভাবে খেয়াল রাখ্, তখন আমিও তোদেরকে আদর করবো এরকম করে।
আয়েশা ছেলের তালে দুষ্টুমি করলেন।
কিছুক্ষণ এরকম হাসাহাসির পর আয়েশা তার ছেলে আর ছেলের বউকে বললেন ওরা যেন লাঞ্চ করে নেয়। মাহিয়া ওনার খাওয়া শেষে একেবারে প্লেট নিয়েই রুম থেকে বের হয়ে আসলো।
লাঞ্চের সময় মাহিয়া দেখলো নিহাল একটু চুপচাপ হয়ে খাচ্ছে যেটা ওর স্বভাবের বাইরে,
– কি হয়েছে তোমার? খাওয়া ভালো লাগছে না?
মাহিয়ার দিকে একমুহূর্ত তাকালো নিহাল,
– আব্বু যখন বেঁচে ছিল, আমাদের ফ্যামিলিটা খুব মজা করতো জানো? আব্বু আম্মু দুজনই খুবি মডার্ন ওয়েতে সব কিছু চিন্তা করতেন। আমাদের তিন ভাই বোনকে এক ভাবে এক অধিকার দিয়ে তারা বড় করেছিলেন। কখনো ছেলে মেয়ের মাঝে তফাৎ করননি। আমাদের ছোটছোট জিনিসগুলোর খেয়াল আম্মুর থাকতো কারণ আব্বু খুব ব্যস্ত থাকতেন ফ্যাক্টরি নিয়ে। তবে আব্বু আমাদের জন্য কি ছিলেন তা তখন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম যখন তার ছায়াটা আমাদের ওপর থেকে সরে গেল।
একটু থামলো নিহাল। একটু পর শুরু করলো আবার,
-আপু তখন মাত্র গ্রাজুয়েশন কম্প্লিট করেছিল আর আমি এলেভেল্স। ভার্সিটিতে ঢুকবো আর এক মাসে, তখনই আব্বু চলে গেলেন। নাবিল তখন মাত্র এইটে পড়ে।
ফ্যাক্টরি, সংসার, আমাদের সহ সব দায়িত্ব এসে পড়লো আম্মুর ঘাড়ে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সহনশীলতা আর বুদ্ধিদীপ্ততার অসামান্য পরিচয় দিয়ে আসছেন তিনি।
আব্বু বেঁচে থাকা অবস্থায় নামিরার আপুর সাথে অয়ন ভাইয়ার এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। আব্বুর মৃত্যুর মাত্র আট মাসের মাথায় মেয়ের বিয়ে খুব ধুম ধাম করেই দেন আম্মু। বাবার অনুপস্থিতি কোনো ভাবেই আপুকে টের পেতে দেননি তিনি। বিয়ের প্রত্যেকটা দায়িত্ব পালন করেছেন এক হাতে।
তুমি তো জানোই, দুইটা টেক্সটাইলস ইন্ডাস্ট্রি আছে আমাদের ফ্যামিলির। আম্মু, আব্বুর সাথে গোড়া থেকেই এই বিজনেসে ইনভল্ভড ছিলেন বলে আব্বুর চলে যাওয়ার পর পুরাপুরি হাল ধরতে বেশি কাঠখোর পোড়াতে হয়নি তাকে। তবে ওইযে সমাজের জাত দোষ!
পুরুষ শাষিত ময়দানে একা আয়েশা রহমান নামক মহিলাটিকে যেন পেয়ে বসতে চেয়েছিল ক্লাইনট্স আর বিজনেস রাইভেল্স নামক হায়েনার দল। যে যেদিক থেকে পারে বিজনেসে নিজেদের লাভ আর আমার মায়ের মান সন্মান হানির চিন্তা করতে থাকলো। সেই সময় আম্মুর পাশে তার দ্বার রক্ষী হয়ে দাড়াই আমি।
সেই রকম এক দ্বার রক্ষী যে তার মাকে বিজনেসে পুরোপুরি সাহায্য না করতে পারলেও তার আত্মসম্মান রক্ষায় সবসময় তার পাশে দাড়িয়ে থাকি। আমি পাশে থেকে আজ পর্যন্ত কাউকে সাহস দেইনি আম্মুর দিকে চোখ উঠিয়ে তাকানোর। তবে এখনো অনেক কিছু করা বাকি আমার। আর মাত্র তিনটা মাস মাহিয়া। পোস্টগ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করেই আমি পুরোদস্তুর কোম্পানি জয়েন করবো। তখন পুরোপুরি ভাড় কমবে আম্মুর কাধ থেকে। আম্মুর জন্য খুব খারাপ লাগে আমার। মানুষটা আব্বুর চলে যাওয়ার পর অনেকটা বদলে গেছে।
নিহালের কথাগুলো শুনতে শুনতে কোন সময় যে ওর দুই চোখ ভরে জল বের হয়ে গড়াতে লাগলো, মাহিয়া খেয়াল করেনি। নিহালের বাম হাতটা ধরলো ও।
-তুমি চিন্তা করো না নিহাল। মা কে আমরা সবাই মিলে খেয়াল রাখবো। ওনাকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিব না। শি উইল নট সাফার এনিমোর।
নিহাল ওর হাতের ওপর মাহিয়ার হাতটা দেখলো একবার, তারপর তাকালো ওর চেহারার দিকে। মুখ ভরে একটা হাসি দিল যেই হাসি ছড়িয়ে পড়লো মাহিয়ার চেহারাতেও।
খাবার খাওয়ার সময় এতো গল্প করতে গিয়ে আজ অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল তাই রুমে যেয়ে কেউই আর রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পেল না। সোজা রেডি হয়ে বের হয়ে যেতে হলো ওদের।
গাড়ি যখন ভার্সিটির পার্কিংয়ে এসে থামলো, মাহিয়া যথারীতি নিজের জিনিস পত্র নিয়ে নেমে চলে যাচ্ছিলো,
-মাহিয়া।
নিহালের ডাকে ফিরে তাকালো ও। নিহাল একদম কাছে এসে পরলো মাহিয়ার,
– থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং ইউ আর ডুইং ফর মাই ফ্যামিলি। তুমি আসার পর থেকে আমার বাসার পরিবেশ অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। আমি সত্যি এই জন্য তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।
মাহিয়া লজ্জায় হেসে দিল। নিহাল বলে পাশে সরে গিয়ে মাহিয়াকে যাওয়ার জায়গা করে দিল। মাহিয়া একবার হেসে নিহালকে দেখে দ্রুত চলে গেল ওখান থেকে। প্রথম প্রথম কাউকে পছন্দ হলে মনে যা হয় তাই হচ্ছিলো তখন মাহিয়ার। আজ ও নিহালের হাত ধরেছিল। সেই মুহূর্তে কোনো কিছু না ফিল করলেও এখন সেই হাতের পরশটা মনে হতে লাগলো ওর। নিজের হাতের তালুটা আরেক হাত দিয়ে ছুয়ে দেখলো ও। লজ্জায় হাসতে লাগলো মাহিয়া।
তনু মাহিয়াকে আজ দেখেই বুঝেছে যে কিছু একটা হয়েছে। মেয়েটার চেহারাটা লাল হয়ে আছে আর ও একনাগারে হাসছে।
-কি ব্যাপার? এত খুশি ক্যান তুই?
-মানে? খুশি থাকা যাবে না নাকি?
– অবশ্যই যাবে। তবে কারণটা কি তা জানতে চাচ্ছি।
– তোকে বলবো কেন?
– ওওওও, তো এই ব্যাপার। এখন বেস্ট ফ্রেন্ডকেই কিছু বলা যাবে না? এতো পার্সোনাল?
-হা হা হা। না রে তেমন কিছু না। এমনিতেই আজ আমি খুশি।
-হমম। নিশ্চই নিহালের সাথে কিছু হয়েছে। এই তোদের মাঝে কি সব হয়ে গেছে? এই বলনা, বলনা মাহি।
– তুই চুপ করবি তনু? কি আবল তাবল বকছিশ।
-আবল তাবলের কি হলো, তোরা তো হাসবেন্ড ওয়াইফ। তোদের মাঝেই তো হবে এগুলা। দেখ কি লাল হয়ে যাচ্ছিশ তুই মাহি। দাড়া, এই ছবিটা তুলে নিহালকে পাঠাবো আমি। তারপর জানবো নিহালের রিয়্যাকশন।
তনু যেই ওর মোবাইল হাতে নিতে গেল, নিজের মুখ ঢেকে ফেললো মাহিয়া। দুই বান্ধবীর মাঝে এই নিয়ে খুনশুটি চললো অনেক্ষণ।
রাতের বেলা বাসায় ফেরার পথে গাড়িতেও নিজেদের মাঝে অনেক কিছু নিয়ে আলাপ মেতেছিল মাহিয়া আর নিহাল। ওদের হাসি মুখে বাসায় ঢুকতে দেখে আয়েশা মনে মনে আল্লাহ্কে অনেক ধন্যবাদ দিলেন।
যখন নিহালের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মাহিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন তখনো নিহাল কিন্তু কিছুই জানতো না। যখন ও খবরটা পেল, আয়েশা ওর মাঝে কোনো উতফুল্লোতা দেখতে পাননি। অবাক হয়েছিলেন তখন তিনি। সাথে একটু শংসয়তেও ভুগছিলেন। নিহাল খুশি হলো না কেন? ও তো মাহিয়াকে অবশ্যই পছন্দ করে। তাহলে ওর পছন্দটা কি একতরফা? মাহিয়া কি পছন্দ করে না ওকে। কিন্তু মাহিয়াও তো বিয়েতে মত দিয়েছে।
মাহিয়াকে পুরো প্রোগ্রামের সময়টা আয়েশা খুব ভালো মতন লক্ষ্য করেছিলেন। মেয়েটা খুব চুপচাপ ছিল। তার বাসায় যেবার প্রথম বন্ধুদের সাথে এসেছিল সেটার থেকে এই সময়ের মাহিয়া একদমই আলাদা। হাল্কা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন আয়েশা তখন। দুইটা বাচ্চার সাথে ভুল কিছু করে ফেললেন নাকি তিনি?
সেই ভয় ওদের বিয়ের পরেও তার মনের মাঝে ছিল যখন দেখতেন মাহিয়া আর নিহাল একে অপরের পাশে একটু ইতস্ততবোধ করতো। তবে এখন সেই ভয়টা আস্তে আস্তে দূর হয়ে যাচ্ছে। আর আজকে তো পুরোপুরিই চলে গেছে সেটা। কি সুন্দর জুটি দুজনের। কতো ঘুলে মিলে আছে নিজেদের মাঝে। আল্লাহ যেন ওদের এভাবেই রাখেন চিরকাল। আমিন।
রাতে খাবার খেয়ে বরাবরের মতন যে যার রুমে চলে গেল রেস্ট নিতে। মাহিয়া খাটে বসে বই পড়ছিল আর নিহাল তার অফিসের কাজ নিয়ে স্টাডি টেবিলে ব্যস্ত। হঠাৎ মাহিয়ার ফোনে ম্যাসেজিং টোন বেজে উঠলো। ফোন তুলে দেখলো মাহিয়া একটা মেসেজ এসেছে। নাম্বারটা অচেনা। মেসেজটা খুললো মাহিয়া। আর খুলে ম্যাসেজটা পড়তেই ভুরুজোড়া কুচকে গেল ওর।
চলবে……..