চিন এর আতঙ্ক সামুরাই সেনা
একশন সিনেমা পছন্দ করেন না এমন সিনেমাপ্রেমি খুব কমই আছেন। আর সেই একশন যদি হয় জাপানের সামুরাই দের নিয়ে তাহলে তো কথাই নেই। অহেতুক গাড়ি ঘোড়া আর ভিলেনদের উড়াউড়ি থেকে বাস্তবধর্মী একশন সিনেমাই আজকাল মানুষের বেশি পছন্দ।
তেমনই এক সত্য ঘটনা অবলম্বনে বাস্তবধর্মী একশন সিনেমা নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা।যেখানে হিংস্র পশু, বিকৃতিকার গবলিন,দক্ষ সামুরাই,ড্রাগন,ডেমন কিংবা ব্রুটাল হ্যাণ্ড টু হ্যান্ড মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। একশন,ফ্যান্টাসি,এডভেঞ্চার মিশ্রণে তৈরি এই সিনেমার নাম 47 Rolin.
৪৭ রোনিনের গল্প জাপানের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত গল্প।আর এটি একটি বাস্তব ঘটনা।এমনকি এও বলা হয় যে, এই সিনেমার ৪৭ রোনিনের গল্প জানা মানে পুরো জাপানের সত্যিকারের ইতিহাস জানা।আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এর আগের ইতিহাস যারা জানেন তাদের তো জাপান সম্পর্কে কৌতুহলের শেষ নেই।
গল্পটি শুরু করার আগে জানিয়ে রাখছি আজকের গল্পে আপনি এমন সব তথ্য জানতে পারবেন যা আপনি আগে কখনো শুনেন নি।সেই সঙ্গে গেরান্টি দিয়ে বলা যায়,আজকের গল্প আমাদের পাঠককে অবশ্যই টানটান উত্তেজনায় রাখবে। তো চলুন শুরু করা যাক আজকের গল্প।
যেহেতু এই সিনেমা সামুরাই দের নিয়ে
তাই চলুন আগে সামুরাইদের নিয়ে কিছু জেনে নেয়া যাক। কারা এই সামুরাই ? জাপানের সবাই কি সামুরাই? নাকি ঢাল তলোয়ার ভাল চালাতে পারলে তাকেই সামুরাই বলে। এসব প্রশ্নের উত্তরই আজ দেওয়ার চেষ্টা করব।আশা করি আজকের পর আর এসব নিয়ে কোন কিছুই আপনার অজানা থাকবেনা।
জাপানের উচ্চ বংশীয় অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি নোবেল ফ্যামিলি সামুরাই হচ্ছে এমন একটি সম্প্রদায়। ইংরেজদের যেমন লর্ড বা নাইটহুড উপাধি দেয়া হয়, তেমনি জাপানিদের সম্মান সূচক হিসাবে দেয়া হয় সামুরাই উপাধি।
****এখন প্রশ্ন হচ্ছে সামুরাইদের কাজ কি?
সামুরাইদের কাজ হচ্ছে রাজার আদেশ পালন করা।যদিও সামুরাইরা একাধিক কাজে পারোদর্শি।যেমন- সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করা সহ সম্মুখ যেকোন যুদ্ধের জন্য তারা সর্বদা প্রস্তুত। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববতী যুদ্ধে কোরিয়া ও চীনের শোচনীয় পরাজয়ের নায়ক ছিল জাপানের এই সামুরাইরা। তাদের জন্যই কোরিয়া ও চীনের অনেক অংশ দখল করে রাখতে সক্ষম হয় জাপান।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, নিঞ্জা আর সামুরাই এক নয়।অনেকেই এদের এক মনে করে থাকেন। নিঞ্জা আর সামুরাইদের কাজের ধরণ ও পোশাকও ভিন্ন। নিঞ্জাদের নির্দৃস্ট পোশাক আছে কিন্তু সামুরাইদের নির্দৃষ্ট পোশাক নেই। নিঞ্জারা রাতের বেলায় বেশি সক্রিয় অর্থাৎ গুপ্ত হত্যায় এরা বেশি পারদর্শি।কিন্তু সামুরাই শুধু মাত্র রাজার জন্য কাজ করে,সার্বভৌমের জন্য কাজ করে। আর এদের নির্দৃষ্ট কোন পোশাক নেই। এছাড়াও এদের রণ কৌশলেও পার্থক্য আছে।
এখন আমরা শুরু করছি আমাদের মূল সিনের গল্প। সামুরাইরা তাইমিওর আন্ডারে কাজ করে।আর তাইমিও বলা হয় যে কোন রাজ্যের রাজাকে।এই তাইমিও আবার সোগানের আনুগত্য।আর এই সোগানেরাই হচ্ছে জাপানের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারি।এক কথায় জাপানের সম্রাট।
এখন প্রিয় পাঠক আপনাদের মনে নিশ্চয় প্রশ্ন উঠছে সিনেমার নাম রোনিন কিন্তু আলোচনা হচ্ছে সামুরাইদের নিয়ে বিষয়টা কি।এমন ভাবনা আশাই স্বাভাবিক। সামুরাই আর রোনিন এরা আলাদা কেউ না।যখন কোন সামুরাই রাজার সম্মান রক্ষায় ব্যার্থ হয় অর্থ্যাৎ যুদ্ধে পরাজিত হয় তখন তাকে রনিন ঘোষণা করা হয়। যা একজন সামুরাইয়ের কাছে সবচেয়ে অপমানের বিষয়। কথিত আছে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জাপানের শোচনীয় পরাজয়ের পর কয়েক হাজার সামুরাই সৈনিক একত্রে আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মহত্যা করে।
রোনিন হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে এভাবে মৃত্যু বরণ করাকে সামুরাইরা বেশি সম্মানের মনে করে থাকেন।
জাপানিদের নাম কঠিন হওয়াই তাদের স্থলে বাংলাদেশের নায়ক নায়িকার নাম ব্যাবিহার করা হলো।
সিনেমার নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে ৪৭ জন রোনিনদের নিয়ে সব ঘটনা প্রবাহ। এই ৪৭জন রোনিন থাকতেই আকু নামুক এক রাজ্যে। রহস্যে ঘেরা এই রাজ্য পিশাচ আর ভয়ঙ্কর সব জন্তু জানোয়ারের আবাস ভূমি। এই রাজ্যে বিদেশিদের প্রবেশেও আছে নিষেধাজ্ঞা। এই আকু রাজ্যের রাজা ছিলেন আবুল হায়াত। সিনেমার শুরু আকু রাজ্যে এক বাচ্চা ছেলে প্রবেশের মাধ্যমে।কেউ জানেনা কোথা থেকে সে এসেছে।চারেদিকে পিশাচ আর ডাইনিদের আবাস ভূমি হওয়াই সবাই ধরে নেয় এই ছেলে পিশাচেরই সন্তান।সাথে সাথে তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় কয়েক জন সামুরাই।কিন্তু আকুর রাজা আবুল হায়াতের মনে মায়া হয় এই ছোট্ট শিশুটির জন্য।তাই তিনি তাকে মেরে না ফেলে জায়গা দেন তার রাজ্য। এই ছোট্ট ছেলে আর কেউ নয় আমাদের গল্পের নায়ক বাপ্পারাজ।অনেক দুঃখ কস্ট সহ্য করে ধিরে ধিরে বড় হতে থাকে পিশাচ পুত্র বাপ্পারাজ। উড়ে এসে জুড়ে বসা উদ্বাস্তুর মতো ব্যাবহার করা হয় বাপ্পার সাথে।কিন্তু শত বঞ্চনা পাশে ঠেলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেয় বাপ্পা। হিংস্র দানবের আক্রমনে যখন শত শত সৈনিক দিশেহারা তখন বাপ্পারাজ একাই দানবকে পরাজিত করেন।তারপরেও নিজে ক্রেডিট নিতে চাননা। যেন নিজের যোগ্যতা নিজের মাঝেই চেপে রাখতে চান তিনি।
এদিকে নিজ গোর্তের বাহিরের কুল স্বভাবের বাপ্পার প্রেমে পড়ে আবুল হায়াতের মেয়ে শাবনূর।কিন্তু তাদের এই ভালোবাসা চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ।কেননা রাজার মেয়ের সাথে বাপ্পা প্রেম করছে, এটা জানতে পারলে আবুল হায়াত তাকে আর এই দেশে রাখবেন না। তাই বাপ্পা, সাবনূরকে বুঝায় তাদের এই প্রেম সম্ভব নয়। তারপরেও তাদের এই প্রেম লুকিয়ে লুকিয়ে চলছিল।
অন্যদিকে পুরো জাপানের সম্রাট যাকে সোগান বলা হয় সে অতিথি হয়ে আসতে চলেছে আকু রাজ্যে। সোগানের আগমনকে কেন্দ্র করে বিশাল আয়োজন করা হয় আকু রাজ্যে। জাপান সম্রাট ডিপজল(সোগান) এর সাথে আতিথি হিসাবে আরো অনেক রাজা আসছে,কিন্তু তাদের মধ্য সবচেয়ে অন্যতম হচ্ছে মিশা সওদাগর। অতিথি হিসাবে এসেই মিশা আকুর রাজা আবুল হায়াত এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, তার রাজ্য দখল ও মেয়েকে বিয়ে করার লোভে। মিশা সওদাগর তার পালিত ডায়নির মাধ্যমে আকুর রাজা আবুল হায়াতকে বশ করে এমন কাণ্ড করায় যে আবুল হায়াত অবচেতন মনে ঘুমন্ত মিশার উপর আক্রমন করে বসে। অতিথির উপর আক্রমন করায় জাপান সম্রাট ডিপজল আবুল হায়াতের মৃত্যুদন্ড দেয়।
এদিকে ঝোক বুঝে কোপ দেয় মিশা।সে রাজাহীন রাজ্য দখল করায় ব্যাস্ত।কিন্তু রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার জন্য তাকে বিয়ে করতে হবে শাবনূরকে।জাপানের আইন অনুযায়ী শাবনূর বাবার মৃত্যুর একবছর পর কাউকে বিয়ে করতে পারবে। মিশা এই একবছর শাবনূরকে আটকিয়ে রাখে,আর অন্য সামুরাইদেরকে রোনিন ঘোষণা করে রাজ্য থেকে বিতারিত করে।
মিশা যখন বুঝতে পারে শাবনূর বাপ্পারাজকে ভালবাসে তখন সে বাপ্পারেজকে কারওয়ান বাজারে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়।আবুল হায়াতের আরেক সেনাপতি কাটাপ্পাকে যে কি না সামুরাইদের প্রধান তাকেও মিশা একবছরের জন্য কূপে আটকে রাখে যেন অন্যান্য সামুরাইদের মনোবল ভেঙে দেওয়া যায়। এক কথায় ডাইনি মন্ত্রের বলে মিশা সওদাগর আবুল হায়াতকে বশ করে পুর রাজ্য তার দখলে নেয় এবং আকু রাজ্যর দক্ষ সেনাবাহিনী ও সামুরাই সব কিছু ভেঙে চুরে একাকার করে ফেলে।আর অপেক্ষা করতে থাকে একবছর পেরুলে সে শাবনূরকে বিয়ে করতে পারবে এই লোভে।
একবছর পর কাটাপ্পা মুক্তপায়, তার মনে প্রতিশোধের আগুন। পিতার মতো রাজা আবুল হায়াতের এই করুন পরিণতি সে মেনে নিতে পারেনি, মেনে নিতে পারেনি আকুর মতো সুন্দর রাজ্যের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া। কাটাপ্পা প্লান করে সে মিশার অধিনে থাকা আকু রাজ্য হামলা করবে এবং পুনরায় ক্ষমতা ফিরিয়ে আনবে। তার এখন প্রয়োজন দক্ষ যোদ্ধা, তাই সে কারোয়ান বাজার থেকে মুক্ত করে আনতে যায় বাপ্পারাজকে। কারোয়ান বাজারের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও নির্মম পরিবেশে থাকতে থাকতে হিংস্র দানবে পরিণত হয়েছে বাপ্পা,এখানে সে বাজির খোরাক। জীবনের বিনিময়ে মালিকের হয়ে যুদ্ধে জিতে সে ,যে যুদ্ধের মঞ্চে শুধু মানুষই না গবলিনদের পর্যন্ত লড়ানো হয়।
কাটাপ্পা কোন রকমে সেখান থেকে বাপ্পাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন।তারপর একে একে জড়ো করেন ৪৭জন রোনেন কে, প্রস্তুতি নেন যুদ্ধের। কিন্তু মিশা সওদাগর ৎ আর সাধারণ কোন মানুষ নয়, তার সাথে আছে ভয়ঙ্কর সব ডায়নি ও হিংস্র সব পশু।যাদের মাধ্যমে পুরো রাজ্য নিয়ন্ত্রনে রাখে মিশা।বাপ্পা,কাটাপ্পাকে কথা দেয় যে সে তাকে এমন অস্ত্রের সন্ধান দিতে পারে যার সামনে ভয়ঙ্কর ডায়নি ও হিংস্র জানোয়ার কিছুই নয়।কথা অনুযায়ি অস্ত্র সংগ্রহে গেলে আমরা দেখি বাপ্পা এমন শক্তিধর এক ডেমন যার কাছে পৃথিবীর কোন অশুভ শক্তিই কিছুই না।
৪৭জন রোনিন নিয়ে রাজ্য উদ্ধারে নামে কাটাপ্পা, তার সাথে ভয়ঙ্কর এক ডেমন বাপ্পা। শুধু রাজ্য উদ্ধারই নয়,শাবনূরকে উদ্ধার করাও গুরু দায়িত্ব বাপ্পার। পরিকল্পনা অনুযায়ি ৪৭জন রোনিন মিশার উপর হামলা করে। ৪৭জন রোনিন নিয়ে ভয়ানক যুদ্ধের মাধ্যমে মিশার অধিনে থাকে আকু রাজ্য দখলে নেয় কাটাপ্পা। এদিকে ডায়নি ও হিংস্র জানোয়ারদের একাই সামলাই বাপ্পা,সে এক ভয়ানক ব্যাটেল যাকে বলে।
পরাজয় ঘটে মিশা সওদাগরের, আকু রাজ্য দখলে নেয় কাটাপ্পা।কিন্তু মূল ঝামেলার শুরু হয় এখানে।আকু রাজ্যের রাজা আবুল হায়াতকে মৃত্যু দন্ড দেওয়ার পর জাপান সম্রাট ডিপজল নিষেধ করেছিল কেউ যেন কোন প্রতিশোধ না নেয় মিশার উপর যেন কোন হামলা না হয়। কিন্তু ডিপজলের নিষেধ অমান্য করে প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছে এই ৪৭ জন রোনিন।তাই জাপান সম্রাট ডিপজল তাঁদের মৃত্য দন্ড দেয়। ইতিসের পাতায় অমর হিসাবে স্বর্ণাক্ষরে নাম লেখান এই ৪৭জন মৃত্যুঞ্জয়ি। বাপ্পা হয়তো চাইলে স্বয়ং ডিপজলকে শেষ করে দিতে পারত কিন্তু রাজ্যের নিতির বিরুদ্ধে গিয়ে ঘৃণা নিয়ে বাচার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় মনে করেন বাপ্পা।
শেষ করার আগে যে তথ্য জানলে আপনি আরো অবাক হবেন তা হচ্ছে, ২০১৩সালে এই সিনেমা মুক্তির পর যখন সবাই এই ৪৭জন বীরের ইতিহাস জানতে পারে তখন থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জাপানে গিয়ে তাঁদের সমাধিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা শুরু হয় নতুন করে।
শেষ করছি আজকের গল্প।জানাতে ভুলবেন না কেমন লাগলো।