#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ১৪
_নীলাভ্র জহির
চিত্রার শাশুড়ি পাঁচ সের চাল সমেত তাকে আলাদা করে দিল । কান্না থামিয়ে স্থবির হয়ে চিত্রা উঠোনের মাঝখানে বসে আছে। একজন নতুন বউয়ের জন্য হঠাৎ করে পৃথক হয়ে যাওয়াটা ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনার মত। শ্বশুরবাড়িতে নতুন বউ হয়ে আসা মেয়েটি নিজেকে সামলে নিতে সময় লেগে যায় । কৈশোরদীপ্ত মেয়েগুলোর সংসার বুঝে উঠতে যেখানে কয়েক বছর লেগে যায় সেখানে মাত্র কয়েকদিনের মাথায় দুম করে তার কাঁধে সংসারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া রীতিমত অন্যায়। আকস্মিক এই ঘটনা তাকে একদম স্তব্ধ করে দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা মা ও বউয়ের মধ্যে এই কোন্দল দেখে চোখ কপালে উঠে গেল রূপকের। সে চিত্রাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে?
কান্নার কারনে চোখ মুখ ফুলে গিয়েছে চিত্রার। সে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, মা আমারে কইসে আইজ থাইকা আলাদা রাইন্দা খাইতে।
রূপক ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
জানতে চাইলো, কেন মা এই কাজ করল? তুমি মারে কিছু কইছিলা?
চিত্রা উত্তর দিল, না আমি তো কিছু কই নাই। আমি ভাত রানতে বইছিলাম। মা পাতিলটা চুলা থাইকা নামাইয়া ফেলছে। আমারে কইল সে নাকি আমার হাতের রান্ধন আর কোনদিনও খাইব না। আমারে হাড়ি-পাতিল ভাগ কইরা দিল। আমি এখন কি করমু আপনে কন?
রূপক কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রার দিকে। তার বৌকে এখন ভীষণ নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। কেঁদে চোখ ভিজিয়ে ফেলেছে চিত্রা। রূপকের ইচ্ছে করছে চিত্রাকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। সে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল দাঁড়াও আমি দেখতাছি।
জোসনা বেগম চুলের পাড়ে বসে ভাত জ্বাল দিচ্ছেন। রূপক এসে জিজ্ঞেস করল, আম্মা এসব কি করতাছো তুমি। সকাল সকাল ঘুম থাইকা উইঠা পাগলামি শুরু করছ কী জন্য?
জোসনা বেগম কিছুক্ষণ মুখ গম্ভীর করে রাখলেন। তারপর উত্তর দিলেন, তোমার এসব দেখতে হইবো না বাপু। বিয়া করতে না করতেই তো পর হইয়া গেছো। মায়ের কথা কাউরে চিন্তা করতে হইবো না।
কি হইছে তোমার?
আমার আর কি হইবো? পোড়া কপাল আমার। পোলারে বিয়া করায়সি এখন পোলা সুখে শান্তিতে সংসার করবো। এখানে আমার আর কিছু কওনের নাই।
আমিতো সুখে শান্তিতে আছি। তুমি কি জন্য আমাগো আলাদা কইরা দিলা? আমার বউ কি তোমারে কিছু কইছে?
তোর বউ আমারে কি কইবো? পোলা যখন পর হইয়া যায় তখন কি আর মানষের কথায় কষ্ট পাওনের সময় আছে।
আমি কখন পর হইয়া গেছি মা? উল্টাপাল্টা কথা কইবা না।
এখন তো কইবি মা উল্টাপাল্টা কথা কয়।
জোসনা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তিনি যেহেতু চিত্রার কোন বদনাম করছেন না। পুরো দোষটায় দিয়ে দিচ্ছেন রূপকের কাঁধে। রূপক নিশ্চিত হলো জোসনা বেগম তার সাইকেল কেনার ঘটনায় কষ্ট পেয়েছেন। মায়ের পাশে পিড়ি টেনে বসল রূপক। বেশ নরম গলায় বললো মা তুমি কি কষ্ট পাইছো আমি সাইকেল কিনছি বইলা। তুমিতো আমারে কইছিলা একটা সাইকেল কিইনা লইতে। তুমি না কইলে তো আমি কিনতাম না।
জোসনা বেগমের কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেল।
রূপক বললো, মা তুমি থামো। পাড়ার লোকে কি কইবো? মানুষে ভাবব আমি তোমারে কি না কি কইছি। সাইকেলটা কিন্তু তুমি আমারে কিনতে কইছিলা। এখন যদি তুমি আমার লগে এমন করো তাহলে আমি কই যামু?
জোসনা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ গুজিয়ে রাখা অবস্থাতেই বললেন, হ, বাজান পোলা বিয়া দিয়ে ভুল করছি। বিয়া হইলে পোলা আর পোলা থাকে না। যা হওনের হইছে। তুই আর তোর বউ আজ থাইকা আলাদা খাবি। তোরা যেহেতু সবাই নিজেগো ভালো বুঝতে শিখছস। এখন আর মায়েরে কাউরো লাগবো না। সবাই বড় হইয়া গেছোস। নিজের সংসার নিজে বুইজা লও।
মা তুমি এমন কইরো না। আমি নতুন বিয়া করছি। আমার বউডা এখনো সংসারের কিছুই বুঝে না। আমিও কিছুই বুঝিনা। তুমি আমাগোরে শিখাইয়া পড়াইয়া দিবা। এখন যদি তুমি আমার লগে এমন করো তাইলে কেমনে হইব?
কে কইছে তোরা কিছুই বুঝস না? তোরা বাপ মায়ের চাইতে বেশী বুঝস। বুঝি না তো আমরাই। আমরা আগের দিনের মানুষ। মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি নাই।
রূপক আর কিছু বলার সাহস করলো না। সে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আমার বউ তোমার লগে থাকব। ভাত এক হাড়িতে রান্না হইবো। যদি তুমি তাও আমাগোরে আলাদা কইরা দেও তাইলে আমি কোনোদিনও আর ভাত খামু না। না খাইয়া মইরা যামু।
কথাটা বলে রাগত মুখে রূপক বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। জোসনা বেগমের কান্নার রোল পড়ে গেল বাড়িতে। তার নিজেকে দিশেহারা লাগছে। কি করবেন বুঝতে পারলেন না। নিভে গেল চুলার আগুন। তিনি চোখমুখ শক্ত করে গাল ফুলিয়ে বসে রইলেন রান্না ঘরের দাওয়ায়। এদিকে তার পুত্রবধু তখন ঘরের দাওয়ায় হেলান দিয়ে দিশেহারা চোখে পথের দিকে চেয়ে আছে। কোথায় গেল তার স্বামী?
আজ বাড়িতে আর রান্না হলো না। পুত্রবধূ ও শাশুড়ি দুজনেই চরম মন খারাপ করে নিজেদের মত হতাশায় ভুগছেন। দুজনের কেউই বুঝতে পারছেন না তার এখন কি করনীয়। এদিকে রূপকের কোন খোঁজখবর নেই। সে কোথায় গেছে সেটাও কেউ জানেন না? দুপুর গড়িয়ে গেল। রূপকের বাবা ফোন করে জানালেন রূপক আজকে দোকানে যায়নি। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল জোসনা বেগমের। তিনি উঠানে বসে উঁচু গলায় বলতে লাগলেন, ওরে আমার সোনা বাজানরে। না, খাইয়া কই গিয়া পইরা রইছস। বাড়ি ফিইরা আয়। আমি আর তোর লগে এমন করুম না।
জ্যোৎস্না বেগমের বিলাপ শুনে নিজের ঘরে শুয়ে কান্না করছে চিত্রা। আজ তার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। সব দোষ তার নিজের। একটামাত্র সাইকেলের কারণে তার সংসারে নেমে এসেছে অশান্তি। রূপক যেন তাকে কখনো ভালবাসতে ভুলে না যায়। এই মা মরা দুখিনী মেয়েটা তখন কার কাছে যাবে ।
রূপক বাড়ি ফিরল তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দুপুরের পরপরই নিজের হাতে যত্ন করে রান্নাবান্না করেছেন জোসনা বেগম। ছেলে উঠানে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে বেরিয়ে গেলেন। নরম গলায় বললেন, আছিলি কই? তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুইয়া আয়। আমি খাওয়ান দিতাছি। দুইটা ভাত খাইয়া ল।
রূপকের মুখে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই জোসনা বেগম ছুটে রান্না ঘরে গেলেন। দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে তড়িঘড়ি করে খাবার প্রস্তুত করলেন তিনি।
রুপক ঘরে ঢোকা মাত্র চিত্রা এসে দরজা ধরে দাঁড়াল, আছিলেন কই সারাটা দিন?
রূপক কোন উত্তর দিল না।
চিত্রার বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। মনে হতে লাগল স্বামী তাকে আর আগের মত ভালবাসে না। মানুষটা কি তবে বদলে যাবে আজ থেকে? সারাদিন চিত্রার ভীষণ কষ্ট হয়েছে। এই মুহূর্তে কষ্টের তীব্রতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল তার।
রূপক চলে গেল পুকুরে হাতমুখ ধুতে। তার পিছু পিছু পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালো চিত্রা।
জানতে চাইল, আপনি কথা কইতাছেন না কেন? আমারে কষ্ট দিতাছেন। রাগ কইরা রইছেন আমার লগে। আপনার দুইটা পায়ে পড়ি আপনে সাইকেলটা ফিরাইয়া দিয়া আসেন। আমি আমার বাপের বাড়িতে কালকে খবর পাঠামু। দুই দিনের মধ্যে তারা যেমনে পারে আমারে জানি সাইকেলটা জোগাড় কইরা পাঠায়।
পানিতে খলখল শব্দ তুলে রূপক হাত মুখ ধুয়ে নিল। চিত্রার কথার কোন উত্তর দিল না। পুকুর ঘাট থেকে উঠতে উঠতে এসে বলল, গামছাটা আইনা দাও।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে নেমেছে। চিত্রা দৌড়ে গিয়ে গামছা এনে দিল। রূপক গামছা নিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে বলল, গরম পড়ছে। মুখ হাত ধুইয়া শান্তি পাইলাম না। একটা ডুব দিয়া লই। লুঙ্গিডাও আইনা রাখ।
গামছাখানি পুকুরঘাটে রেখে ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে নেমে পড়ল রূপক। তার স্বাভাবিক আচরণ ও নরম গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে যেন কিছুই ঘটেনি। বেশ অবাক লাগছে চিত্রার। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও তার স্বামীর এই স্বাভাবিক আচরন তাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিচ্ছে। ধীর পায়ে পায়ে ঘরে গিয়ে লুঙ্গি নিয়ে এসে চিত্রা স্তব্ধ হয়ে পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে রইল। আজান হয়ে গেছে মাগরিবের। অন্ধকারে মশার তীব্রতা প্রখর। মশার কামড়ে গায়ের জ্বালা ধরে গেছে। তবুও রূপকের কলকল শব্দ তুলে পানিতে ডুব দেয়ার শব্দ চিত্রার ভালো লাগলো। মনের মেঘটা আস্তে আস্তে কেটে যেতে শুরু করেছে। রূপক ঘাট থেকে উঠে এসে গা মুছে লুঙ্গি বদলে ফেলল। ভেজা লুঙ্গিটা ঘাটের উপর রেখে উঠে গেল ঘাট থেকে চিত্রা দ্রুতপদে পুকুরে নেমে এসে লুঙ্গিটা পানিতে ধুয়ে শুকাতে দিতে গেল। বাড়ি ফিরে দেখল দাওয়ায় বসে রূপক ভাত খাচ্ছে। পাশে বসে আছেন জোসনা বেগম। তিনি চামচে করে তরকারি তুলে ছেলের পাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছেন আর দুইটা মাছ দেই তোরে।
রূপক হাত দিয়ে না না করে বলছে, আর নিমুনা।
তোর লাইগা রানছি বাবা। তুই টেংরা মাছ খাইতে খুব পছন্দ করস।
তোমরা খাইও।
তুই আর দুইটা মাছ নে বাবা।
চিত্রার উপস্থিতি বুঝতে পেরে রূপক ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল, তুমি একটা থাল নিয়ে আসো। আমার লগে দুইটা খাইয়া লও।
চোখ ভিজে উঠলো চিত্রার। দখিনা বাতাসের মত মিষ্টি একটা হাওয়া তাকে মুহূর্তে আবিষ্ট করে তুলল। সে আজকে সারা দিন ভাত খায়নি সেটা কিভাবে বুঝতে পারলো রূপক? তার স্বামীকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মানুষটা মনে হচ্ছে তার। এই মানুষটাকে ভালোবেসে সারাজীবন সেবা করার বিনিময়ে চিত্রা আর কিছুই চায় না। ভয়ে ভয়ে থালা ধুয়ে নিয়ে এসে চিত্রা রুপক ও জোসনা বেগম এর চাইতে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসল। রূপক বলল, ভাত নাও। মা, তুমি মাছটা ওরে দাও।
জ্যোৎস্না বেগমের মুখের দিকে তাকানোর সাহস পেল না চিত্রা। তবে কোনো প্রতিউত্তর বা বিলম্ব না করেই জোসনা বেগম দুই পিস মাছ ঝোল সহ চিত্রার পাতে তুলে দিলেন। চিত্রা মাথা নিচু করা অবস্থায় বলল আম্মা সারাদিন ভাত খায় নাই। ওনি না খাইলে আমিও খামু না।
রূপক বললো, আম্মা তো আমারে কইল ভাত খাইছে। কি গো মা তুমি ভাত খাও নাই কেন? বউ আরো একটা থাল নিয়া আসো। এই থাল আম্মারে দিয়া দাও।
চিত্রার সামনে থেকে ভাতের প্লেট টা নিয়ে রূপক তার মায়ের হাতে তুলে দিল। তারপর চিত্রা কে বলল আরেকটা থাল নিয়া আইসা তুমিও বসো।
মনটা ভীষণ ভাল হয়ে গেল চিত্রার। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে আরেকটা প্লেট নিয়ে শাশুড়ির পাশে বসলো। জোসনা বেগম আর কোন ঝামেলা করলেন না। তার অভিমান হয়তো বুকে চাপা রয়েছে তবুও তিনি নিঃশব্দে ভাত খেতে লাগলেন।
হঠাৎ করে চিত্রার শরীরটা গুলিয়ে উঠলো। ভাত খেতে পারল না সে। কাউকে কিছু না বলে হুট করে উঠে গেল বারান্দা থেকে। জোসনা বেগম সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে অভিযোগ করলেন, তোর বউ আমার হাতের রান্না খাইবো না। বুঝবার পারছি। কেমন কইরা উইঠা গেল দেখছোস? মনে হইতাছে আমি ওর ভাতে বিষ মিশাইয়া দিসি।
রূপক কোন জবাব না দিয়ে তার বউয়ের দিকে তাকালো। উঠানের মাঝখানে গিয়ে তার বউটা ছটফট করছে। আর ভাত খেতে পারো না রূপক। সে দ্রুত উঠে ছুটে গেল চিত্রার কাছে। জানতে চাইলো বউ তোমার কি হইছে? তুমি এমন করতেছ কেন?
চলবে..