গল্প ##
বদলে যেন না যায়
*********************
বউমা ও বউমা তোমার বাপ আসছে
আমি আমার শ্বাশুড়ির গলার আওয়াজ বাথরুমে কাপড় কাচতে কাচতেই শুনতে পেলাম।
আব্বা আসছে ! আমার আব্বা আসছে।কান্নায় আমার গলা বুজে আসে।আমি ভেজা হাতের তালু দিয়ে দুই চোখ মুছি।ইচ্ছে করছিল এই ভেজা মেঝেতেই পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসি।কিন্তু আমি তা করলাম না।মুখটা স্বাভাবিক রাখলাম।আমার কোমল মনের সাদাসিদে বাবা যেন বুঝতে না পারে। তাহলে খুব খুব কষ্ট পাবেন।
আজ সাড়ে তিন মাস হল আমার বিয়ে হয়েছে । ফিরানির পর এই প্রথম আমার বাপের বাড়ি থেকে কেউ এলো । আমি সেই সকাল থেকে দুই বালতি কাপড় ধুতে বসেছি।দুই দেবরের মোটা মোটা চারটা জিন্সের প্যান্ট। অবিবাহিতা ননদের বাথ্রুমে ছেড়ে যাওয়া সালয়ার কামিজ বিছানার চাদর। অথচ বিয়ের আগে আমি এসব কিছুই করিনি শুধু নিজের কাপড় ছাড়া ।আমি চোখের পানি মুছে আধা ভিজা কাপড়েই উঠে দাড়ালাম।
দেওয়ান গঞ্জের আমার এই শ্বশুর বাড়িটা ষ্টেশনের একেবারে কাছে জানালায় দাঁড়ালে স্টেশনে মানুষের ট্রেনে ওঠা নামা দেখা যায় । আমি প্রতিদিন জানালায় দাঁড়িয়ে মানুষের আসা যাওয়া দেখি ।
আমার সমন্ধ করেই বিয়ে । আব্বা ফাতেমা নগর পোষ্ট অফিসের পোষ্ট মাষ্টার ছিলেন। আমরা দুই বোন এক ভাই । আমি বড় । আমার স্বামী মোশারফ ঢাকায় চাকরি করে থাকে মেসে। মাসে একবার বাড়িতে আসে ।আমি আমি খেয়াল করেছি ও আমাকে অনেক ভালবাসে কিন্তু ওর মায়ের সামনে এমন ভাব করে যেন আমি কত অচেনা । বাড়ি এলে আমার শাশুড়ি ছেলের দেখাশোনা করে । করুক তাতে আমার আপত্তি নেই ।
বিয়ে হওয়ার দুই আড়াই মাস পর থেকেই শাশুড়ির আমার প্রতি মন কষাকষি শুরু হয়ে যায় কারন আমার বাবা আমাকে যে গয়না দিয়েছে তা খুব ই পাতলা।শাশুড়ির কথা হল আমরা না হয় কিছুই চাই নি তাই বলে একটা ফ্রিজ তো দিতে পারত । ছেলের জন্যে একটা মোটর সাইকেল।
কিন্তু আমি ত জানি আমার বাবা কত সৎ একজন মানুষ কোন দিন উনি যৌতুক দিবেন না । বিয়ের সময় বাবা সব বলেই নিয়েছিলেন উনি খুশি হয়ে যা দিবেন তাই নিতে হবে ।
আমি পায়েপায়ে আব্বার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ভাল আছিস মা?
আব্বার এই কথা শুনে আমি আর চোখের পানি লুকাতে পারিনা । হাতের তালু দিয়ে পানি মুছতে মুছতে ফোঁপাতে থাকি । আব্বা মাথা নিচু করে নিজের চোখের পানি লুকায় ।
আমি আব্বার হাত ধরে ঘরে এনে বসাই। ফ্যান ছেড়ে দেই। আহা গরমে আব্বা কেমন নেতিয়ে গেছেন । এই কয়েক মাসে মাথার চুল অনেকটাই পাকা । আব্বাকে বসিয়ে রেখে দৌড়ে গিয়ে লেবুর সরবত বানিয়ে আনতেই আব্বা আমার হাতে একটা চটের ব্যাগ এগিয়ে দেয় । আমি ব্যাগ খুলে দেখলাম সেখানে একটা ডাল ঘুটণী এক পাতা কাল চুলের ক্লিপ , একটা সাবান কেস একটা টিপের পাতা একটা নারিকেলের তেলের কৌটা দুইটা লুসনি ।
তোর আম্মা ঘন দুধের পায়েশ বানিয়ে দিয়েছিল বুঝলি? সেই ব্যাগ সিটে রেখে বাথরুমে গিয়েছিলাম ফিরে এসে দেখি সেই পায়েশের বাটি উধাও । বলেই আব্বা আমার দিকে করুন চোখে তাকায় ।
আমি বলি আব্বা মন খারাপ করিয়েন না ।
আমার সহজ সরল আব্বা ভালবেসে মেয়ের জন্যে এই সব কিনে এনেছে । আমি বলি ” এই সব কেন আনছেন আব্বা ” ? আমার আব্বা মুখটা কাচুমাচু করে বলে আসার পথে দেখলাম বেচতেছিল তাই কিনলাম। তুই টিপ দিতে ভালবাসিস ।
আমি এই কয় মাসে ভুলে গিয়েছিলাম আমি টিপ পরতে পছন্দ করি
সেদিন
আমার আব্বার জন্যে আলাদা স্পেশাল কিছুই রান্না হলনা । আলাদা কোন আদর যত্ন হলনা । আকাশ সমান অবহেলা নিয়ে ফাতেমা নগর পোষ্ট অফিসের অবসরে যাওয়া পোষ্ট মাস্টার আমার আব্বা মনসুর আলি বিকেলের ট্রেন ধরার জন্যে বেরিয়ে গেলেন। আমি গেট ধরে দাঁড়িয়ে আব্বার চলে যাওয়া দেখলাম । আব্বা রেলস্টেশনের জনারণ্যে মিশে গেলেন ।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর বারান্দায় আমার হাসবেন্ডের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম । অবাক হলাম এই অসময়ে তো তার আসবার কথা নয়। আমি দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াতেই এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে পেলাম। দেখলাম মোশারফ মানে আমার হাসবেন্ডের সাথে আব্বা । কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই মোশারফ জানালো ও ট্রেন থেকে নামতেই দেখে আব্বা স্টেশনে বসে আছে তাই সাথে করে আবার নিয়ে এসেছে। আব্বা নাকি কিছুতেই আসতে চাইছিলেন না । আমার শাশুড়ির মুখ দেখলাম থমথমে ।
চা খেয়েই মোশারফ ব্যাগ হাতে বাজারে চলে গেল । মনটা নিমিষেই কি এক ভাললাগায় ভরে গেল ।
রাতে আমার শাশুড়ি গজগজ করতে করতে পোলাও মুরগীর কোরমা ইলিশ মাছ ভাজি করলেন । করুক গজগজ আমি আজ কিছু মনে করব না ।আমার আব্বাকে পেট ভরে তার পছন্দের মুরগির কোরমা ইলিশ মাছ দিয়ে খাওয়াতে পারব এতেই আমি খুশি।
রাতে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে একসাথে সবাই খেতে বসেছি ।আব্বা কি পরম তৃপ্তি নিয়েই না খাচ্ছেন । আর খেতে খেতেই মোশারফ বলে উঠলো
”আম্মা আমার ঢাকায় মেসে থাকতে খুব সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে খাওয়া দাওয়ার । আমি রুবিকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে আসছি খিলগাঁওয়ে ছোট একটা বাসাও নিছি ”। মোশারফের এই কথায় ঘরে যেন পিনপতন নীরবতা নেমে এলো ।আব্বা নিজেও খাওয়া বাদ দিয়ে মোশারফের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন । আমি নিজেও হতবাক । আমার শাশুড়ি মুখ অন্ধকার করে কোনরকম খেয়েই উঠে গেলেন ।
আমি রান্নাঘর গুছিয়ে ,হাতে করে দুই কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে
মোশারফের পাশে বসলাম। মানুষটা চা খুব ভালবাসে। আব্বা শুয়ে পড়েছে । দেবর আর ননদ তাঁদের যে যার ঘরে । কিছুক্ষন আগেও এই বাড়িতে থমথমে পরিবেশ ছিল । এখন অনেকটাই স্বাভাবিক । মোশারফ মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কথা বলে ঠাণ্ডা করেছে । ও কথা দিয়েছে আমরা প্রতি বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে এখানে চলে আসব মোশারফ মায়ের মশারী টাঙিয়ে দিয়ে এসে এখানে বসেছে ।
এখন দিনের ভ্যাপসা গরম কমে গিয়ে দক্ষিন দিক থেকে শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে মনে হয় দুরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। হুইশিল বাজিয়ে ঢাকামুখী লোকাল ট্রেনটা বুঝি ছেড়ে গেলো !
রুবি !
হু
এই যে তোমাকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছি তুমি আনন্দ পাওনি ?
পেয়েছি ! তবে বেশী আনন্দ পেয়েছি আব্বাকে তুমি আবার এই বাড়ীতে ফিরিয়ে আনাতে । তাকে সম্মান দেওয়াতে ।
আধো আলো ছায়ায় দেখলাম মোশারফ কি আগ্রহ নিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে ।
আমি মনে মনে বলি তুমি বদলে যেওনা এমনি করে সারাক্ষন আমার পাশে থেকো ।
.
.