প্রাক্তন
……..
কাল আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী। বউকে নিয়ে ইনফিনিটি তে এলাম। বউ ঘুরে ঘুরে আমাদের জন্য ম্যাচিং শাড়ি পাঞ্জাবি দেখছে। বউয়ের এই ব্যাপারটা আমার ভালই লাগে। কোন অকেশন হলেই সে ম্যাচিং ড্রেস কিনবে। বেশ রোমান্টিক লাগে। সে মিলিয়ে দেখছে পোষাক আর আমি চারপাশের মানুষ দেখছিলাম। হটাৎ একটা মুখে চোখ আটকে গেল৷। এক সময়ের সবেচেয়ে প্রিয় মুখ এভাবে সামনে আসবে ভাবিনি।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ” তুমি এখানে? ”
সে হঠাৎ চমকে গেল কিন্তু সাথে সাথে নিজেকে সামিলে নিয়ে উত্তর দিল ” দেখতেই তো পাচ্ছ। “
” সেলসগার্লের কাজ করছো। তোমার তো খুব ধনী ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয়েছিল৷ জামাই কোথায়? “
” ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
” মানে! কেন? কি হয়েছিল? ”
” সে আগে বিয়ে করেছিল। আগের বউ জানার পর মামলা করে। ”
” আমি বেকার ছিলাম সেজন্য তোমার বাবা আমার সাথে তোমার বিয়ে দিলেন না। আর কিনা বিবাহিত ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে বসলেন। ”
বুকের চাপা কষ্ট টা মনে হলো হালকা হচ্ছে। হাসি ও পাচ্ছে। হায়রে ভাগ্য!
বললাম ” অন্য কোন জব পেলে না, এখানে? ”
অন্য দিকে তাকিয়ে সে উত্তর দিলো ” স্কুলে তো তোমার সাথে প্রেম করে লেখাপড়াটা ঠিক মত হয়নি। ভাল জব পাবো কিভাবে! “
তখনই মাহি মানে আমার স্ত্রী ডাক দিলো। তার ম্যাচিং শাড়ি পাঞ্জাবি পাওয়া হয়ে গেছে। ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে বিল দিতে হবে।
জুথির মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম ” চলি, ভাল থেকো। ”
তখনই লক্ষ্য করলাম জুথির চোখের নিচটা খুব কালো হয়ে আছে৷ মনটা ভিষন খারাপ হয়ে গেল।
রিক্সায় বউয়ের সাথে তেমন কথা হলো না। বউ বুঝতে পারলো আমার কিছু একটা হয়েছে কিন্তু কি সেটা ধরতে পারলো না।
জুথির কথা বউকে কখনো বলিনি। কী দরকার। জুথি আমার জীবনে একটা ব্যার্থতার গল্প। প্রচন্ড ভালবাসতাম মেয়েটাকে। ক্লাস এইটে থাকতে আমাদের সম্পর্ক হয়। লুকিয়ে চিঠি দেয়া হতো। সারা রাত বসে সেই চিঠি লিখতাম। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। ঝুম বৃষ্টি। আমি আর জুথি ভিজে চুপচুপে হয়ে একটা পরিত্যক্ত ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এখনো জীবনের সবচেয়ে ভাল লাগা স্মৃতি সেই বৃষ্টিভেজা দিনটাই জুথির সাথে আমার।
বউকে ভালবাসি। মাহি অনেক ম্যাচিউর আমাকে খুব বুঝে। সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আমাকে সুখে রাখার আর আমি ও। আমাদের একজনের সুখের মধ্যেই তো আরেকজনের সুখ। সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু আজ জুথিকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে,আমি কী আসলেই সুখী নাকি সুখের একটা মেকি মুখোস পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার সুখ কী মাহির কাছে নাকি জুথির কাছে ছিল বুঝতে পারছি না।
বাসায় কখন পৌছে গেলাম বলতে পারবো না। মাহি এটা সেটা কি যেন বলে চলেছে কিছু মাথায় ঢুকছে না। কিসের একটা ঘোরের মধ্যে আছি। কেমন যেন একটা কষ্ট। টুকরা টুকরো অতীত গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
গোসলে গেলাম৷ গেলাম বললে ভুল হবে। মাহি একপ্রকার ঠেলে পাঠালো। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে মনে পরে গেল জুথির কাঁন্না। তার বিয়ের আগের দিন আমাদের বাড়ির পেছন দিকটায় একটা ঝার আছে সেখানে এসেছিল।
তাও আবার রাতে। অন্য সময় হলে ভুতের ভয়ে এখানে আমরা দাঁড়াতেই পারতাম না কিন্তু সেদিন সেখান থেকে ফিরতেই চাইছলাম না। জুথিকে শেষবারের মত বুকে জড়িয়ে রেখেছিলাম। মেয়েটার নাকের পানি আর চোখের পানিতে শার্ট ভিজে গেল। গলা বসে গেল।
ও যখন চলে যাচ্ছিল বুকের ভিতরটা একদম শুন্য হয়ে গেল। আর কাউকে এই বুকে জায়গা দেয়া সম্ভব হয়নি। আজ ও না। মাহি আছে আমার দায়িত্ববোধে, আমার অধিকারে। বুকের বা পাশটা তাকে দিতে পারিনি। চোখের পানিতে জুথি আগেই সেটা ভিজিয়ে রেখেছে৷
জুথি বিয়ের পর প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল ওর বাবার প্রতি। আমার মা বাবাকে বুঝিয়ে ওদের বাড়ি পাঠিয়ে ছিলাম কিন্তু জুথির বাবা অপমান করেছিল আমার বাবামাকে। দোষ আমার। আমি অযোগ্য, আমি বেকার। কয়টা মাস যে কিভাবে কেটেছে। খাওয়া আর ঘুম তো ছেড়েই দিয়েছিলাম। মা দিন রাত সেজদায় বসে কাঁদতো। একদিন দেখি জুথি তাদের বাড়ি এসেছে। বাহ, কী সুন্দর বউ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার চোখে আমার মত কান্না নেই।
আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করে ” কেমন আছো? এতো শুকিয়ে গেছ কেন? নিজের খেয়াল রেখো। ”
সেদিন থেকেই ঘুড়ে দাঁড়ালাম। পড়ালেখায় মন দিলাম তারপর তো আজ এখানে। একজন প্রতিষ্টিত সরকারি কর্মকর্তা।
গোসল থেকে বের হলে মাহি বললো, ”তোমার চোখ লাল কেন? ”
আমি বললাম, “বেশি সময় শাওয়ারের নিচে ছিলাম তাই হয়তো৷ “
মাহি ভাত বেড়ে দিল। খেয়ে শুয়ে পরলাম। ঘুমাতে দেরি হলো না। সকালে উঠে দেখি প্রচন্ড মাথা ব্যাথা। মাহি নাস্তা দিল। খেতে ইচ্ছে হলো না। মাহি এক কাপ চা দিল। আমার পাশে এসে বলো চায়ের চুমুক দিয়ে মাহির দিকে তাকালাম। দেখি ওর চোখ ফোলা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমার কি হয়েছে? ‘
মাহি বলো, ” কাল থেকে তুমি খুব আপসেট হয়ে আছো। কেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি ঘুমের মধ্যে ও গোংরানি করছিলে। তাই আমার আর ঘুম হয়নি। তোমাকে জেগে দেখছিলাম।”
আমার নিঃশ্বাস ভাবী হয়ে এলো। চায়ের কাপ টা রেখে মাহিকে বুকের কাছে টেনে নিলাম। মাহি শুনতে পাচ্ছে আমার হার্টবিট। নাহ, সেখানে ওর নাম ছাড়া আর কারো নাম থাকতে পারে না।