ইসরাত_মিতু
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
সিমা আজ খুব ব্যস্ত, সংসারের অনেক কাজ তাকে করতে হয় আবার তার উপর বিয়ে বাড়ি বলে কথা! অনেক ঘটা করে বিয়ের আয়োজন না হলেও চল্লিশ- পয়তাল্লিশজনের বেশিই লোকের সমাগম বাড়িতে।সব আত্বীয়-স্বজন বাড়িতে এসেঁছে। আজ এ বাড়ির ছেলের বিয়ে। বরপক্ষ কনেপক্ষের বাড়িতে যাবে আজকে, বিয়ে পড়িয়ে বউ নিয়ে ফিরবে। বাড়িতে কাজের লোক থাকলেও রান্নাঘরের সমস্ত দায়িত্ব সিমাকেই সামলাতে হয়, আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। সিমা নিজ হাতে সব কিছু আয়োজনে ব্যস্ত, নিজের প্রতি তার কোনো খেয়াল নেই, কাজ আর কাজ, মাঝে মাঝে হনুফা খালাকে ডেকে ডেকে এটা-ওটা করাচ্ছে। হনুফা খালা অনেক বছর ধরে এ বাড়িতে আছে, সিমা তাকে কখনো কাজের মানুষ হিসেবে ভাবে না বরং একজন অভিভাবকের মত গন্য করে!
বড় বউ আর কত পাষান হইবা তুমি, তোমার কী একটুও পরাণ অস্থির লাগেনা? হনুফা খালার এই কথা শুনেও না শুনার ভান করে সিমা, ছল ছল করা চোখদুটো আড়াল করে রুমে যেতে যেতে বলে, খালা একটু রান্নাটা খেয়াল রেখো, আমি ওয়াশরুম হয়ে আসছি!
রুমটা লক করে সিমা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে উচ্চস্বরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, নিজেকে বড় অসহায় লাগে, বুকের পাঁজরের প্রত্যেকটা হাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে, এ এমন এক ব্যথা যা কাউকে বুঝানো যাবে না!
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সিমা চমকে উঠে, দরজার ওপাশ থেকে সিমার শাশুড়ি সায়রা বানু ডেকে যাচ্ছে বার বার, কি হলো তোমার রুমে লক করে কী করছো এতক্ষন? এক্ষুনি বের হও, খাবারের সময় হয়েছে, এখনো তো কিছুই টেবিলে দেয়া হয়নি, মেহমানরা কি মনে করবে! জলদি করে খাবার দাও, আর মেয়ের বাড়িতে যাবারও তো সময় হয়েছে, সবাই কিছুক্ষন পরেই বের হয়ে যাবে!
সিমা দরজাটা খুলে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো , সায়রা বানু হন হন করে ভিতরে ঢুকতেই গয়নার বাক্স কোথায় জানতে চাইলো, সিমা তখনো চুপ করেই থাকলো।
গত রাতেই তো তোমাকে বলে রেখেছিলাম তোমার বিয়ের গয়নার সেট টা রেডি করে রাখতে, আর তুমি এখনো সেটা বেরই করোনি? এত ভারী সেট তো তোমার পড়াও হয়না, টুকটাক যা আছে তাতেই তো হয়ে যায়, তুমি তো জানো এক কথা বার বার বলতে আমার ভালো লাগে না, নাকি তুমি হিংসা করছো তোমার গয়না নতুন বউকে দিবো বলে?একদমে সায়রা বানু কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো।
সিমা গত রাতেই সব বের করে সাজিয়ে রেখেছিলো, শুধু কারো অপেক্ষায় ছিলো, যেনো সে মানুষটা এসে একবার হলেও বাঁধা দেয়, একবার হলেও বলে,” তুমি এ গয়না কাউকে দিবে না, এসব আমাদের ভালোবাসার স্মৃতি, আমার প্রথম উপহার, খুব যত্ন করে তোমার জন্য নিয়ে এসেছিলাম, তুমি ছাড়া এ গয়নার অধিকার আর কারো নেই!”
কিন্তু সে আসেনি, কোনো কথাও বলেনি! বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সিমা গয়নার বাক্সটা এগিয়ে দেয়!
মা, এই নিন! এখানে সব কিছু সাজানো আছে! আপনার কোনো টেনশন করার দরকার নেই, আর আমি সকাল থেকে ব্যস্ত থাকাতে দেয়া হয়নি!
সায়রা বানু বাক্সটা নিয়ে দ্রুতগতিতে বের হয়ে গেলো।
সিমা জানে, এ বাড়িতে টাকার অভাব নেই, এরা চাইলেই এরকম গয়না কিনে ফেলতে পারে, কিন্তু তারটা নেবার একটাই কারন যাতে সমস্ত অসহায়ত্ব তাকে খুবলে খায়, বেঁচে থেকেও যেনো ক্ষনে ক্ষনে মরতে থাকে সে! হঠাৎ করে অন্তরটা কেপেঁ উঠে তার, আরো খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে না তো?
বরপক্ষ বের হবার সময় হলো, কিছু মুরুব্বী আর কয়েকজন ছেলেরা বরের সাথে গেলো। বাকিদের জন্য খাবার দেয়া হলো টেবিলে, সবাই খাবার নিতে ব্যস্ত, এক টেবিলে বসার জায়গা হবে না বলে সবাই সবার মত খাবারের প্লেট নিয়ে অন্যান্য রুমে চলে গেলো। সিমা সবাইকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ই পাশের রুম থেকে ফিসফিস করে কেউ কিছু একটা বলে উঠল যা সিমাকে মুহুর্তের মধ্যেই পৃথিবীতে থেকেও নরকের যন্ত্রনায় পৌঁছে দিলো!
বাসর ঘর সাজানোর জন্য সিমার রুমটা-ই বেছে নেয়া হয়েছে, এই রুমটা একটু বড়, আর সুন্দর একটা খোলা বারান্দাও আছে, ওয়াশরুমের ভিতরেও অনেক জায়গা।এমনটাই ভেসে আসছিলো পাশের রুমের আলোচনায়।
সিফাত কি আজ একটা কথাও বলবেনা, যদি এমনটা করা হয় তবে কি সে বাঁধা দিবে না? তার এত বছরের সংসার জীবন, এই রুম ঘিরে কত স্মৃতি, কত আবেগ, ভালোবাসা, এক দিনেই সব শেষ করে দিবে সবাই! সিমা আর ভাবতে পারেনা! নিজের স্বামী সিফাতের এত পরিবর্তন সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না!
সায়রা বানু সিমাকে ডাকলেন তার রুমে, জরুরী কথা আছে তোমার সাথে ভিতরে এসে বস!
জ্বী মা বলেন, সিমার চোখে মুখে আতংঙ্ক। শোনো সিমা, তুমি আজকের জন্য তোমার রুমটা ছেড়ে দাও, তোমার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে উত্তর দিকের রুমটায় চলে যাও, ওখানে থাকো আজকে, কালকে না হয় আবার চলে এসো। আজকে নতুন বর- কনেকে থাকতে দাও, একটু পর বাসর সাজাতে লোক আসবে তার আগেই গুছিয়ে নাও সব কিছু। বাসর ঘরটা একটু বড় হলে দেখতে ভালো লাগবে তাই বললাম, আর সিফাতের সাথেও বিষয়টা আলোচনা করেছি, ওর কোনো সমস্যা নেই!
সিমা বুঝতে পারে আজকেই ওর শেষ দিন, ও আর কখনোই এই রুমে ঢুকতে পারবেনা। ওর সারা শরীর অবশ হয়ে আসে, সকাল থেকে কিছু খাওয়াও হয়নি, গোসল ও করতে পারেনি, চোখের জল ফেলতে গেলেও লোকজনের প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয়, কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে, আচ্ছা আমি ঠিক করে দিচ্ছি বলে রুমে চলে এলো সে!
রুমের চারদিক খুব ভালো করে তাকালো .. অনেক স্মৃতি সিফাতের সাথে তার, দেয়ালে তাদের দুজনের ছবি ঝোলানো আছে বেশকিছু, সযত্নে সেগুলো নামিয়ে নিলো। বিশেষ দিনগুলোতে সিফাতের দেয়া উপহারগুলো তাকে আরো ব্যথিত করে তুললো!
একে একে সব মনে পড়তে লাগলো। এমন জীবনতো সে চায়নি, তাহলে কেন এমন হলো? কেন বেঁচে থেকেও মরার মত বেঁচে আছে সে? কেন অবহেলায়, অযত্নে নিজে শেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, কেন তার প্রিয় মানুষটিও আর আগের মত নেই? বুক ভেসে যাচ্ছে কান্নার স্রোতে কিন্তু কেউ দেখার নেই! চোখ মুছতে মুছতে সিমা বের হয়ে এলো রুম থেকে! হনুফা খালাকে ডেকে যা যা আনার সব বের করে আনলো।
বড় বউ, তোমাকে বললো রুমটা ছাইড়া দিতে আর তুমি রাজি হইয়্যা গেলা, কাজটা মোটেও ঠিক হয়নাই, তোমার সাথে অন্যায় হইছে, তুমি কি কওতো, একটাবার একটা কথারও প্রতিবাদ করলা না? এমনে চললে তো তোমার মরন ছাড়া গতি নাই, একথা বলেই হনুফা খালা চোখের জল ছেড়ে দিলো!
সিমা তখন জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে, ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ…
চলবে….
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক একসাথে