#ইসরাত_মিতু
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
বাসর সাজানো হচ্ছে, তাজা গোলাপ আর রজনীগন্ধার ঘ্রাণে সারা ঘর ভরে গিয়েছে, সবাই যে যার মত বসে গল্প করছে। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি আর মেঘের বজ্রপাত শুরু হয়েছে, বর- কনের আসতে দেরী হবে এটাই স্বাভাবিক। অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে সিমা রুম থেকে বের হয়ে বাসর সাজানো কেমন হচ্ছে তা দেখতে গেল, যেতে যেতে কেমন যেন মনের মধ্যে নাড়া দিলো তার!
আচ্ছা শুনুন,ফুল কি বেশি আছে? একথা শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে একটা ছেলে উত্তর দিলো জ্বী আছে!
সিমা ওর রুমটা দেখিয়ে বললো- এই রুমটা সাজানো শেষ হলে বাকী ফুল দিয়ে ওইটাও সাজিয়ে দিবেন, হাল্কা ভাবে সাজালেই হবে, একথা বলেই হনুফা খালাকে ডাকলো সিমা..
খালা আমি গোসলটা সেড়ে নিচ্ছি, তুমি কারো কিছু লাগবে কিনা খেয়াল রেখো, আর সবার জন্য চা- নাস্তার ব্যবস্থা করো।
গোসল সেড়ে সিমা নিজের বিয়ের সেকেন্ড শাড়িটা বের করে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, এরপর সেটাকে গায়ে জড়িয়ে নিলো, ময়ূর কন্ঠী নীল চওড়া পাড়ের কাতান শাড়িতে ওকে একদম পরীর মত লাগছিলো, কপালে টিপ, হাত ভর্তি চুড়ি , বাদামী চোখ ভর্তি কাজল আর হাল্কা মেকাপ করে কিছু গয়না পরে নিলো সে, সিমার উজ্জল ত্বক আরো দীপ্তময় আভা ছড়াতে শুরু করলো।
বাসর ঘর সাজানো শেষ, এখন সিমার রুম সাজানো হচ্ছে, এসব কান্ড দেখে সায়রা বানু তার ননদকে (সিফাতের ফুফু)পাঠালেন কথা বলতে সিমার সাথে।
সিমাকে দেখার পর সেই ফুফু আর কোনো কথা না বলেই চলে এলেন আর বললেন- থাক ভাবী, তুমি এসব নিয়ে আর কথা বলতে যেয়ো না, মেয়েটা কত সুন্দর করে সেজেছে, একদম পরীর মত লাগছে, কিছু বললে ও কষ্ট পাবে। একথা শুনে সায়রা বানু আর কিছু বললেন না।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, সবাই দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে নতুন বউয়ের অপেক্ষায়। খুব তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হবার কারনে কেউ-ই আগে মেয়েটাকে দেখতে পারেনি, শুধু সিমার শশুড়, সিফাত আর একজন চাচা শশুড় দেখেছিলো, হঠাৎ খুব কলরব শুরু হলো – বউ এসেছে, বউ এসেছে, সবাই ফুল দিয়ে বরন করে নিলো বর- কনেকে।
সিমা দরজার আড়ালে দাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলো আর যা দেখলো তাতে তার দাড়িয়ে থাকার সামর্থ্যটুকু হারিয়ে গেলো। সিফাত তার নতুন বউকে কোলে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে, খুবই হাসিমাখা মুখে বউয়ের দিকে আছে, যেনো নতুন কোনো সিফাত, যাকে একদমই চেনা যাচ্ছেনা, আর ও ভাবতো বিয়ে করবে বলে তার হয়তো খুব মন খারাপ! সিমার ভিতরটা কাঁচের টুকরোর মত ভাঙতে শুরু করলো, আর সেই টুকরো গুলো যেন কলিজা ভেদ করে এফোঁড়-ওফোঁড় হতে লাগলো, সে এই কষ্ট সইবে কেমন করে, কিভাবে মানবে তার প্রিয় মানুষটার হাত অন্য কারো হাতে!
সিমা পাথর হয়ে বসে রইলো রুমে।
হঠাৎ দরজার শব্দে সিমা চমকে উঠলো, সিফাত এসেছে তার সাথে কথা বলতে, রুমটা সাজানো দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লো সে আর সিমাকে দেখেও তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন, পরক্ষনেই সিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো তোমাকে কিছু কথা বলার আছে, সিমা বলার জন্য সায় দিলো-
– দ্যাখো সিমা, তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা, আমার জীবনের পুরোটা জুড়ে তুমি, আমার প্রথম স্ত্রী, তোমাকে কখনোই আমি ছেড়ে যাবোনা, তুমিও আমায় কথা দাও তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেনা, আমাকে তুমি ভুল বুঝবেনা।
– কী বলছো এসব, আজকে তো তোমার আনন্দের দিন, পরে হবে এসব কথা তুমি তোমার নতুন বউকে সময় দাও।
– তোমার স্থান কেউ নিতে পারবেনা, তুমি তোমার জায়গাতেই থাকবে, আমার ভালোবাসা শুধু তোমার জন্য, আর আজ যে এসেছে তার কাছে আমার সন্তান ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই, দেবার ও নেই
সিমা সিফাতের হাত দুটো কাঁধ থেকে নামিয়ে বলে, “ আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, এভাবেই ভালোবেসো সব সময়, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই”!
এখন যাও বলে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়, সিমা জানে বেশি কথা বললে সে নিজেকে সামলাতে পারবেনা, তাই চুপ থাকে!
সিফাতের নতুন বউয়ের নাম সালমা, দেখতে শ্যাম বর্না, চেহারায় কোনো মায়া নেই, বয়সও খুব কম,একদমই চিকন আর কিছুটা অগোছালো প্রকৃতির!
নতুন বউ সালমাকে দেখে আত্বীয়- স্বজন তেমন পছন্দ না করলেও মনে মনে খুশি এই ভেবে যে সিফাতের ঘরে এখন সন্তান আসবে!
সিফাত সালমাকে নিজের রুমে না নিয়ে সিমার রুমে নিয়ে যায় পরিচয় করানোর জন্য।
সালমা, এই হচ্ছে তোমার বড়বোন , আজ থেকে বড়ো আপু বলে ডাকবে আর সন্মান করবে, ঠিক তুমিও তার ছোটো বোনের মতই থাকবে।
সিমা চোখ তুলে সালমার দিকে তাকিয়ে থাকে আর বলে সিফাত ঠিক বলেছে, তুমি আমার ছোটো বোনের মতই ।
সালমা অবাক হয়ে সিমার সৌন্দর্য দেখতে থাকে আর ভাবতে থাকে এত সুন্দর একটা মানুষ শুধুমাত্র সন্তানের অভাবে এত কিছু মেনে নিচ্ছে, এত কষ্টেও কথা বলছে আমার সাথে! সালমা কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
সিফাত আর সালমাকে রেখে সিমা রুম থেকে বের হয়ে যায়। রাতের খাবারটা বাবুর্চি রান্না করেছে, সবাই বিরিয়ানী খাবে, টেবিলে হনুফা খালা খাবার দিয়ে রেখেছে! সবাইকে ডাকা হলো খাবার খেতে, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অনেকেই চলে গেলো আর কয়েকজন রয়ে গেলো যাদের বাড়ি একটু দূরে।
সারাদিন সিমা কিছুই খায়নি, রাতেও খেলো না, এখন ওর বমি বমি লাগছে, অস্থিরতায় আর মাথাব্যথা নিয়েও হনুফা খালাকে সকালের নাস্তার কথা বলে দিচ্ছে!
পিছন থেকে সিফাত এসে সিমাকে ডাকলো, জিজ্ঞেস করলো “ তুমি কিছু খেয়েছো?” হুম বলে সিমা মাথা নাড়ালো! হনুফা খালা রাগ করে চলে গেল রান্নাঘরে সিমার মিথ্যা কথা শুনে।
আমি আমার রুমে যাচ্ছি, আমি চাই তুমি সালমাকে আমার রুমে দিয়ে যাবে, ও এখনো তোমার রুমেই আছে, একথা বলে সিফাত তার বাসর ঘরে চলে গেলো।
কত সহজেই আমাদের রুমটা ভাগ হয়ে গেলো, যে আমাকে তুমি একদিনও একা ঘুমাতে দাওনি, তাকেই চিনিয়ে দিচ্ছ কোনটা কার রুম! তুমি আর আমি আর কখোনোই হয়তো আমরা হতে পারবোনা, সিমার পাষান দুটো চোখ জ্বালা করে উঠে!
সালমাকে নিয়ে সিমা সিফাতের কাছে যায়, রুমে দিয়ে বের হয়ে যাবে আর সালমা আচঁল টেনে ধরে একটু বসতে বলে, সিমা তবুও চলে যেতে থাকে, সালমা আবারও বসতে বলে।
সিফাত চুপ করে থাকে, একটু পরে বলে, বসো সিমা।
সিমা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না, ও বুঝতে পারে সিফাত সালমাকে একা করে পেতে চাইছে, তাই অতি দ্রুত চলে আসে। এক দৌড়ে রুমে চলে আসে, চিৎকার করে কাঁদতে যাবে আর দেখে সিফাতের বোন ইরা বসে আছে রুমে, তবুও কান্না থামাতে না পেরে ইরাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কান্না করে! ইরা তার ভাবীকে খুব পছন্দ করে, ইরাও কান্না করে কিছুক্ষণ!
কেন তুমি অনুমতি দিলে ভাইয়্যাকে বিয়ে করার, এত বড় ভুল কেন করলে তুমি? সারাজীবন তোমার কান্নাই করতে হবে, সন্তান কী মানুষের জীবনের চেয়েও বড়? তুমি নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছো, কোনোদিনও আর সুখি হতে পারবে না তুমি ভাবী, ইরা এসব বলছে আর চোখের জল ফেলছে।
বাসার সবাই চাচ্ছিলো তুমি আমার সাথে আমার বাসায় গিয়ে দুদিন থেকে আসো, হয়তো চোখের সামনে এসব দেখে যদি সহ্য না করতে পারো, চলো যাই ভাবী, আমার বাসা এখন একদম খালি আর তোমাদের জামাই ও ব্যবসার কাজে একটু অন্য জেলাতে আছে।
সিমা চোখ মুছে ইরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ না ইরা, আমি কোথাও যাবোনা, যদি মৃত্যু হয় তবুও যেন আমি তোমার ভাইয়্যার চোখের সামনেই থাকি! তাকে ছাড়া আমি কোথাও একমুহুর্তও থাকতে পারবোনা, তোমার ভাইয়্যাকে আমি অনেক ভালোবাসি!”
আন্টি ফোন দিয়েছিলো, তোমার ফোন নাকি বন্ধ পেয়েছে, আমি কিছুই বলিনি, তুমি কি একটু কথা বলবে?তিনি খুব চিন্তিত তোমাকে নিয়ে, তুমি কি কিছুই জানাওনি তাদের?
না, ইরা কিছুই জানাইনি। জানালে আমার আব্বা আম্মা দুজনেই ছুটে আসতো, একটা ঝগড়া- বিবাদের সৃষ্টি হতো, আর আমাকে উনারা কিছুতেই এখানে রেখে যেতেন না। আর আমি কিছুতেই চাইনি এসব হোক, আমি তোমার ভাইয়্যাকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা!
ইরা সিমার কথা শুনে খুব রেগে যায়, আর বলে- দ্যাখো ভাবী , তোমাকে ভাইয়্যা যদি এতই ভালোবাসতো তবে আরেকজনকে নিয়ে বাসর করতে পারতো না, অন্য জীবনসঙ্গী বেছে নিত না, তুমি তার কাছে এখন শুধু করুনার পাত্রী মাত্র, এক সময় সেটাও থাকবে কি না সন্দেহ, এসব বলে ইরা চলে যায়।
সিমা জানে, সব কথাগুলোই সত্যি, সবকিছু এখন অন্যরকম, অন্যকারো জন্য, অন্ধকারের কালো থেকেও তার জীবন এখন বেশি কালোময়।
সিমা তার জীবনের পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে থাকে, স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে__ সে এক গহীনে ডুব দিয়ে হারিয়ে যায় স্মৃতির চাদরে…
চলবে…….