#ইসরাত_মিতু
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
চার- পাঁচ মাস কেটে গেলো কিন্তু কোনো পজিটিভ রেজাল্ট আসলো না, কিন্তু তা নিয়ে ওদের মাথাব্যথা নেই, আল্লাহ্ যেদিন দিবেন হবে- এটাই বললো সিফাত সিমাকে!
এভাবে আরো কেটে গেলো একটি বছর, সিমা মনে মনে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো, কেনো এমন হচ্ছে, ওর কি কোনো সমস্যা আছে নাকি সিফাতের! ডাক্তার দেখানো দরকার, সিমা সিফাতকে এসব নিয়ে কথা বললো।
সিফাত তখনো কোনো পাত্তা দিলোনা, এত দুশ্চিন্তা করো নাতো, যখন সময় হবে তখন ঠিকই আমাদের আল্লাহ্ সন্তান দিবেন, এবার সামার ভ্যাকেশনে সুইজারল্যান্ড যাবো সেই প্রস্তুতি নাও,একথা বলে সে কাজে চলে গেলো।
তিন বছর অতিক্রম হলো, সিমার এখন মাঝে মাঝেই মন খারাপ থাকে এসব ভেবে! আল্লাহর কাছে খুব প্রার্থনা করে একটি সন্তানের জন্য, সিফাত সিমার মন খারাপ দেখলে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে, ওরা সিদ্ধান্ত নেয় ডাক্তারের কাছে যাবে, ডাক্তার দেখানো হলো, সবকিছু ঠিক আছে দুজনেরই, তবুও কেনো এমন হচ্ছে বুঝতে পারলোনা, কিছু মেডিসিন নিয়ে ফেরত আসলো।বাড়ি থেকে ফোন আসলে সিফাত বিষয়টা এড়িয়ে চলে, এখনি চাচ্ছে না বাচ্চা এসব বলে রেখে দেয়!
সিমা এখন আগের চেয়ে একটু মোটা হয়ে গিয়েছে, নিজের প্রতি খেয়াল কম। সিমা ওর আম্মার সাথে কথা হলে কান্না কাটি ও করে!
সিফাতের ভালোবাসা একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে, সে আগের চেয়ে বেশি সিমাকে সময় দিতে চেষ্টা করে, সিফাতের ভালোবাসায় সিমা সবকিছু ভুলে থাকে!
পাঁচ বছর পর ওরা দেশে আসে, ছয় মাস থেকে আবার চলে যাবে! সবাই ওদের পেয়ে অনেক খুশি, কিছুদিন পার হলো, আত্বীয়- স্বজনদের বাসায় ওদের দাওয়াতে যেতে হয় আর কেউ কেউ বাচ্চা নেবার কথাও বলে!
সিমা দেশে আসার পর থেকে একটি জিনিস লক্ষ্য করছে, ওর শশুড়- শাশুড়ি কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলছে না, খুব চিন্তিত ও মনে হচ্ছে, সব কিছু ঠিক চলছে তবুও যেনো কিছু একটার ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে!
এক সন্ধ্যায় তারা সিফাতকে রুমে ডাকলো একা, অনেক্ষণ পর সিফাত রুম থেকে বের হলো মুখ গোমরা করে, সিমাকে দেখে হাসিমুখের ভান করলো, এমন কিছু তারা বলেছে যা শুনে সিফাতের মন খারাপ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু বিষয়টা কী জানতেই দিলোনা সিফাত ওকে, শুধু বললো.. আব্বা চাচ্ছে আমি যেনো দেশে এসে ব্যবসা দেখি, তিনি একা একা সামাল দিতে পারছেন না, আর সিয়াম ( সিফাতের ছোটো ভাই) তো এম.বি.বি.এস শেষ করে এখন থিসিস করছে, ওর দ্বারা তো ব্যবসা কিছুতেই সম্ভব না। আর কিছু না বলে সিফাত রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো!
সিমা চুপ করে খাটের এক কোনায় গিয়ে বসে রইলো, অনেক্ষণ পর সিফাত সিমাকে ডেকে বললো- কাল আমরা গাইনি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি দুপুরের পর, তুমি রেডি থেকো। সিমার আর বুঝতে বাকী রইলো না কেন সিফাতের মন খারাপ!
রাতের খাবার কেউ তেমন মনোযোগ দিয়ে খেলোনা, খাবার টেবিলে বসে সবসময় অনেক কিছু নিয়ে কথা বলে সবাই কিন্তু আজ কোনো কথা হলোনা! সবাই চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলো।
পরের দিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে সবকিছু খুলে বললো ওরা , এত সময় ধরে বাচ্চার জন্য চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি, তাই সব ধরনের চিকিৎসা করানোর জন্য ওরা প্রস্তুত, এভাবেই বললো দুজনে মিলে।
ডাক্তার তাদের দুজনকেই অনেকগুলো টেস্ট আর মেডিসিন দিলো আর কিছু নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিলো, দুজনকেই নিয়মিত ব্যায়াম করার পরামর্শ দিলো। টেস্টগুলোর রিপোর্টগুলো নিয়ে আবার দেখা করতে বললো!
সিফাত সিমাকে বাসায় নিয়ে রুমটা লক করে দিয়ে বললো,
— সিমা তুমি মন খারাপ করো না, অনেকে হয়তো অনেক কিছু বলবে, তুমি একদম পাত্তা দিবেনা, সন্তানের কথা চিন্তা করে আমরা আমাদের সুখ নষ্ট করতে চাইনা! আমাদের ভাগ্যে থাকলে সন্তান হবে নয়তো না!
— আমার খুব কষ্ট হয় এসব নিয়ে ভাবলে, তোমার মত মনের মানুষ আছে বলেই আমি এখনো ঠিক আছি, একথা বলে সিমা সিফাতকে ধরে কান্না করে দিলো।
সিফাত সিমাকে আদর করে কিছুটা শান্ত করলো!
রিপোর্ট নিয়ে আবার দুদিন পর ওরা ডাক্তারের কাছে গেলো, রিপোর্টে তেমন কোনো কিছুই ধরা পড়লো না, কিন্তু সিমার থাইরয়েডের প্রবলেম ধরা পড়লো যার কারনে ডিম্বানু সঠিকভাবে বড় হতে পারছেনা তবে এটা তেমন বড় ইস্যু না বলে ডাক্তার কিছু মেডিসিন দিলো সিমাকে আর বললো অনেক সময় এমনও হয় দুজনেরই কোনো সমস্যা নেই কিন্তু বাচ্চা হচ্ছে না, তাই ধের্য্য ধরতে হবে এবং সঠিক ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যেতে হবে!
সিফাতের বাবা-মা দুজনেই অপেক্ষা করছে ওদের জন্য, ওরা দুজন বাসায় এসে সব কিছু নিয়ে কথা বললো!
সায়রা বানু সিমাকে ধৈর্য ধরতে বললেন আর নিয়মিত নিজের খেয়াল রাখতে বললেন।
আরো কয়েকজন ডাক্তারের পরামর্শ ও ওরা নিলো, নিয়মিত চেক-আপ করতে থাকলো, যতদিন ওরা দেশে ছিলো এভাবেই কেটে গেলো!
সিমার আব্বা-আম্মা ও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো, আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকলো যাতে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যায়!
একসময় ওদের যাওয়ার সময় হয়ে গেলো, সিফাতের বাবা সিফাতকে দেশে একবারে চলে আসার কথা বলে দিলো, সিফাত দেখা যাক্ বলে বিদায় নিলো সবার কাছ থেকে।
দু’জনে আবারও পাড়ি জমালো ইটালীতে, সিফাত তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে , মাঝে মাঝে সিমাকে নিয়ে এদিক-এদিক ঘুরে বেড়ায় কিন্তু সিমা মন থেকে ভালো থাকতে চাইলেও পারে না, বিয়ের প্রায় আট বছর হতে চললো তবুও তার কোল খালি!
বাড়ি থেকে প্রায়ই ফোন আসে দেশে ফিরে যাবার জন্য, দেশে এসে যেনো ভালোমত ডাক্তার, কবিরাজ যার কাছে যেতে হয় তাই যেনো যায়, সিমার আব্বা-আম্মাও তাই বলে!
সিফাত কি করবে ভাবতে থাকে, পরে সম্মিলিত ভাবে চিন্তা করে দুজনেই দেশে ফিরে আসবে সিদ্ধান্ত নেয়, যাওয়ার তিন বছর পর ওরা একবারের জন্য চলে আসে!
দেশে ফিরে কিছুদিনের মধ্যে সিফাত তার বাবার সাথে ব্যবসায় যোগ দেয়, সিমা সংসারের দ্বায়িত্ব নেয়া শুরু করে, আস্তে আস্তে সিমা পুরো সংসারী হয়ে উঠে, কার কী লাগবে , কে কী খাবে, কাকে কী দিতে হবে, সব কিছু নিজে নিজে সামলাতে থাকে!
দেশে এসে এবার ওরা স্বিদ্ধান্ত নেয় যদি কোনো ট্রিটমেন্টে কাজ না হয় তবে টেষ্টটিউব বেবি নিবে। সে অনুযায়ী ভালো একটা হসপিটালের ডাক্তারের কাছে যায়, নিজেদের সব রিপোর্ট আর সমস্যার কথা তুলে ধরে, সব কিছু শুনে ডাক্তার টেস্টটিউব বেবি নিতে বলে, সেভাবেই ট্রিটমেন্ট চলতে থাকে, আইভিএফ প্রণালী শুরু করে ডাক্তার।
সিফাতের বাবা-মা বিষয় টা একটুও ভালো চোখে নিচ্ছেন না, আর এতদিন ধরে কত টাকা-পয়সা খরচ হচ্ছে সেটা নিয়েও কথা বলছেন!
টাকা-পয়সা খরচ করে যদি ভালো কিছু হত তখন না হয় বুঝতাম, এসব করে কিছুই হবে না, সমাজের লোকেরা নানান কথা বলে, এতগুলো বছরে কোনো নাতি-নাতনির মুখ দেখার সৌভাগ্য হলো না, আর এসব টেস্টটিউব বেবি নিতে হবে কেন, আর কি কোনো পথ নেই ? এসব কথা সিফাতের বাবা বলতে বলতে বাসা থেকে বের হয়ে বাহিরে চলে গেলেন!
সিফাত আর সিমা চুপ করে শুনলো, কারো মুখেই কোনো কথা নেই, তবুও ওরা হাল ছাড়লো না, নিয়মিত চেক-আপ এর উপরেই থাকলো, কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন এক বার নয় দুবার নয় তিন বার আইভিএফ এ নেগেটিভ রেজাল্ট আসলো, সিফাত আর সিমা দুজনেই একদম ভেঙে পড়লো…
আচ্ছা, আল্লাহ্ যদি আমাদের সন্তান না-ই দেন তবে আমরা একটি বাচ্চা দত্তক নিবো, তাতে এমন কি হবে! বাচ্চার শখ তো পূরণ হবে, আর আমার এক বন্ধু ইন্ডিয়ার এক ভালো ডাক্তারের কথা বললো, দরকার হয় সেখানেও যাবো, তুমি দুশ্চিন্তা করোনা, সিফাত সিমাকে কথাগুলো বললো। সিমা একটু আশ্বস্ত হলো সিফাতের কথা শুনে।
সিফাত মনে মনে এসব কথা বললেও ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছিলো, যখন বন্ধু- বান্ধবের সাথে দেখা হয় তখনও সবাই এসব নিয়ে মজা করে, বিয়ে করার কথা বলে। সিফাতের বাবা-মাও চায় সিফাত আরেকটি বিয়ে করুক….
এর আগে যখন ওরা দেশে এসেছিলো তখন সিফাতকে বিয়ে করার কথা বলেছিলো তারা, সিফাত খুব রেগে গিয়েছিলো সেদিন, আর বলেছিলো এটা কখনোই সম্ভব নয়, কিন্তু এখন যখন তারা এসব কিছু বলে সিফাত চুপ হয়ে শুনে…
চলবে….