#ইসরাত_মিতু
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
সিফাতের বাবা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ লাগালেন পাত্রীর জন্য। বিধবা, ডিভোর্সী অথবা সন্তান আছে এমন পাত্রী দেখতে লাগলেন, কিন্তু সিফাত এমন মেয়ে বিয়ে করবে না , সে অবিবাহিত কম বয়সী সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করবে, সে অনুযায়ী পাত্রী খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু তেমন কোনো পাত্রী পাওয়া গেলো না, সিফাত বিবাহিত আর বয়স ও প্রায় ৩৯ , এ অবস্থায় ভালো পরিবারের মেয়ে না পাওয়াটা-ই স্বাভাবিক। তারপর সিফাতের বাবার এক বন্ধু সালমার খোঁজ দিলো।
সালমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না, কোনোরকম সংসার চলে, সালমার বয়স কম, অবিবাহিত , তেমন সুন্দরও না তবুও সিফাত দেখে রাজী হয়ে গেলো বিয়ের জন্য ,সালমাদের পরিবারে জানানো হল বর্তমান বউ বন্ধ্যা, কখনোই মা হতে পারবেনা! সালমাকে তারা সুখে রাখবে, কোনো সমস্যা হবে না কিছু নিয়ে, আরোও অনেক কথা হলো দু’পরিবারের মধ্যে, বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো, আংটিও পরানো হলো, এত কিছু হয়ে গেলো কিন্তু সিমা কিছুই জানতে পারলো না!
সিমা বসে আছে রুমে, সিফাত বাহির থেকে এসে একটি স্ট্যাম্প পেপার সিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো- পেপারটা তুমি পড়ো, তোমার একটা সাইন লাগবে , আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি বলে সিফাত ওয়াশরুমে চলে গেলো। সিমার চোখ পেপারটার উপরে, চোখের টপ টপ পানিতে পেপারটা ভিজে যাচ্ছে, পেপারটা হাতে নিয়ে বসে থাকতে পারছে না, সারা শরীর কাপঁছে!
সিফাত দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছে, তাতে সিমার কোনো আপত্তি নেই, তার কখনো বাচ্চা হবে না, তাই সে তার স্বামী সিফাতকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দিচ্ছে! এমন কিছুই লিখা আছে পেপারে, বিয়ের সময় যাতে কোনো ঝামেলা না হয় বা সিমা ও তার পরিবার যেনো কোনো রকম ঝামেলা না করতে পারে তাই এই ব্যবস্থা।
পেপারটা পড়া শেষ হলে একটা সাইন করে দাও নিচের দিকে, ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে একথা বলে সিমার দিকে তাকিয়ে দেখলো ও কান্না করছে!
আচ্ছা থাক তাহলে পরে করে দিও।
না, এক্ষুনি করে দিচ্ছি বলে সিমা পেপারে সাইন করে দিতে যেয়ে দেখলো ও চোখে কিছুই দেখছে না, সবকিছু অন্ধকার লাগছে, হাত কাপঁছে, ওর মনে হচ্ছিলো ও যেনো ডিভোর্স পেপারে সাইন করছে, খুব কষ্টে নিজের নামটা লিখে দিলো সে!
বিয়ের দু’দিন আগে সিফাত সিমাকে তার বিয়ের কথা জানালো, সিমা বিশ্বাসই করতে পারছিলো না এই কথা, সেই থেকে একদম চুপ হয়ে গেলো সে , যে যা বলে শুধু চুপ করে শোনে যায় আর সেভাবেই করে যায়!
আজ সেই বিয়ের দিন, আজ সিমার জীবন শূণ্য বাসর নিয়ে পুনরায় আরম্ভ, সিমার ভাবনা আর শেষ হয়না, রাত ভোর হয়ে যায়, বমি হয় কয়েকবার! দু’চোখ ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে, পুরো মুখে যেনো জলন্ত সূর্যের লাল আভা!
সিমা ভেবেছিলো, সিফাত হয়তো নতুন বউয়ের কাছে যেতে চাইবে না, ওর কাছেই থাকতে চাইবে, কিন্তু সব কিছুই মিথ্যে আশা, ছলনা!
সিমার খুব ইচ্ছে হলো সিফাত এখন কী করছে জানতে, ও রুম থেকে বের হয়ে সিফাতের রুমের দিকে গিয়ে দেখলো এখনো আলো জ্বলছে রুমে, দরজার নিচ দিয়ে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কিছু কথার আওয়াজ ও ভেসে আসছে অস্পষ্টভাবে , সিমা আর থাকতে পারলো না সেখানে, নিজের রুমের সামনে এসে বসে রইলো অনেকক্ষন , ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে, সিমা ওযু করে সালাত আদায় করে মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে অনেক কান্নাকাটি করলো, এরপর কখন যে ঘুম চলে এলো সে তা টের পেলো দরজায় নকের শব্দে!
সিমা ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানাতে গেলো, সাথে ফুফু শাশুড়ি, হনুফা খালা সাহায্য করলো, সবাইকে নাস্তার জন্য ডাকা হলো, সিফাত সিমাকে ডেকে আস্তে করে বললো- বেড সীট টা একটু চেন্জ করে দাও, কেউ রুমে যাওয়ার আগেই করে এসো! সিমা সিফাতের রুমে গিয়ে দেখলো সালমা গোসল সেড়ে বসে আছে, কেউই কিছু বললো না, সিমা চুপ করে অন্য কারো ভালোবাসার দাগ ঢেকে দিলো নতুন চাদরে!
সবাই নাস্তা করতে বসলো, আব্দুর রউফ সাহেব তার নতুন বউ মা’ কে মধুর সুরে ডাকলেন টেবিলে, সিফাতের ঠিক পাশের চেয়ারটায় বসতে বললেন, সিমার সেই স্থানটাও বুঝি আজ থেকে রইলো না, সিমা সবাইকে ঘুরে ঘুরে খাবার পরিবেশন করছে , কারো কোনো খেয়াল নেই সিমার প্রতি।
ফুফু শাশুড়ির হঠাৎ বলে উঠলো, সিমা তুমি তো কাল থেকে কিছুই খাওনি, কতবার রাতে বমিও করেছো, এক্ষুনি খেয়ে নাও বসো, সায়রা বানু তখন তাড়াতাড়ি খাওয়ার জন্য তাড়া দিলো!
সিমার শাশুড়ি এখন আরো কঠোর, সিমার অবহেলা দিন দিন বাড়তে লাগলো, সংসারের বোঝা দিন দিন ভারী হতে লাগলো সিমার উপর, সিফাত খুব কম সময়ই সিমার কাছে আসে, সালমাও হিংসা করা শুরু করে দিলো সিমাকে, সিফাতকে সিমার সাথে দেখলেই দূর থেকে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়!
কিছুদিন পর সিমার বাড়ি থেকে ফোন আসে, তাদেরকে কে যেনো ফোন করে সিফাতের বিয়ের কথা জানিয়েছে, সিমার আব্বা- আম্মা কে সিমা এতদিন কিছুই জানতে দেয় নি, এখন সে কী জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না!
— এগুলো আমরা কী শুনছি? তুই কিছু বলছিস্ না কেনো?
— হ্যাঁ, আম্মা ঠিকই শুনেছো, আমি তোমাদের জানাইনি বিষয়টা, আমাকে তোমরা মাফ করে দিও বলেই সিমা কেঁদে উঠলো!
— এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো আর আমরা কিছুই জানলাম না, সিফাতকে আমরা ছাড়বো না, ওকে পুলিশে দিবো, ওর পরিবারের সবার নামে মামলা করবো! তোকে আজকে এসেই নিয়ে আসবো, ওই নরকে তোর থাকার কোনো দরকার নেই!
— আম্মা তুমি থামো, আব্বাকে দাও ফোনটা।
ফোনটা লাউডেই ছিলো, আজাদ সাহেব পাশ থেকে জবাব দিলেন, বল্ মা, আমি শুনছি,
— আব্বা, তুমি আম্মাকে টেনশন করতে মানা করো, আমি ঠিক আছি, আর পুলিশের কথা বাদ দাও, এসব কিছুই করা যাবে না, আমি স্ট্যাম্প পেপারে বিয়ের অনুমতি দিয়ে সাইন করে দিয়েছি! আর আমি সিফাতদের বাসায়-ই থাকবো, কোথাও যাবো না!
— কী বলিস্ সিমা, এত কিছু হয়ে গেলো তুই আমাদের কিছুই জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না! আমরা আজকেই আসবো!
— না, তোমরা কেউ আসবে না এখন, আমিই আসবো তোমাদের সাথে দেখা করতে তবে এখন না কিছুদিন পর!
সিমা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলো!
দু’মাস পর, সালমার পিরিয়ডের ডেট ওভার হওয়াতে বাসাতেই প্রেগন্যান্সি টেস্ট করলো, রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে, সালমা সিফাতকে ফোন দিয়ে জানালো, সিফাত তখনি বাসায় চলে এলো আনন্দে, বাসার সবাই অনেক খুশি, সিমাও মন থেকে খুব খুশি হলো, সিফাতকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো সিমা, সাথে সিফাতও কান্না করলো!
সালমা এখন সবার চোখের মধ্যমনি হয়ে গেলো, সবাই মিলে সালমার খেয়াল রাখে, সিফাতও অনেক সময় কাটায় সালমার সাথে। নিয়মিত ডাক্তারে চেক-আপ করানো হচ্ছে সালমাকে, সিমাও মন থেকে সালমা ও তার বাচ্চার জন্য দোয়া করে!
এভাবেই পাঁচ মাস কেটে গেলো, হঠাৎ সিমার ছোটো বোন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো, হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যাথা, অপারেশন করাতে হবে, সিমার আম্মা ফোন দিয়ে জানালো, তখন অনেক রাত ছিলো তবুও সিমা সিফাতকে নিয়ে বাইকে চড়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। দু’ঘন্টার পথ পেরিয়ে ওরা হসপিটালে পৌঁছালো, সিমা রয়ে গেলো আর সিফাত সকালে চলে আসলো। অপারেশন ঠিকমত হলো, হসপিটালে থাকতে হবে কয়েকদিন, সিমা ওর আম্মার সাথে হসপিটালেই থাকলো!
তিনদিন পর সিমার নিজেকে কেমন যেনো অন্যরকম মনে হতে লাগলো, পিরিয়ডের ডেট অনেক আগেই ওভার হয়েছে, এমন অনেক সময় লেট করে পিরিয়ড হলেও এবার একটু অন্যরকম শারিরীক পরিবর্তন খেয়াল করছে, খাবারের প্রতিও অনিহা কাজ করছে, আর বমি বমি লাগছে কয়েকদিন যাবত!
আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে সিমা ফার্মেসী থেকে ওয়ান টাইম প্রেগন্যান্সী টেস্টার নিয়ে নিজেই টেস্ট করলো, রেজাল্ট দেখে ওর মাথাটা একদম ঘুরে গেলো, জোড়ে একটা চিৎকার করে উঠলো আম্মা বলে, ওয়াশরুম থেকে কাঁপতে কাঁপতে বের হয়ে ওর আম্মার হাতে কিট টা দিলো, খুব পরিষ্কার ভাবে দুইটা লাল দাগ দেখে ওর আম্মা, বোন সবাই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো, অনেকক্ষন কারো মুখে কোনো কথা নাই, হঠাৎ নিরবতা ভেঙে সবাই মিলে কান্না শুরু করে দিলো, কতক্ষন কাঁদলো তা ওদের নিজেদেরই অজানা!
সিমা তখনি দৌড়ে হসপিটালের নিচে চলে গেলো, কনফার্ম হওয়ার জন্য ব্লাড আর ইউরিন দুটোর টেস্টই করাতে দিয়ে আসলো, বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকলো, এই অপেক্ষা যেনো আর শেষ হয় না , অবশেষে রিপোর্ট হাতে পেলো, সিমা সত্যিই মা হতে যাচ্ছে, সিমা মা ডাক শুনবে, কেউ তাকে আর বন্ধ্যা বলে গালি দিতে পারবে না, সিমার আজ কান্নার দিন, অনেক অনেক কান্নার দিন, এ কান্না মানুষ চাইলেই কাঁদতে পারেনা….
চলবে…