কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
২৯
কাচের দরজা আলতো হাতে ঠেললেন আবুল। উঁকি দিয়ে খুব বিনয়ে শুধোলেন,
“ আসব স্যার?”
জামশেদ সদ্য আয়োজন করেছেন বিশ্রামের। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দুদণ্ড চোখ বোজার মধ্যেই বাধ সাধলেন আবুল। ভদ্রলোক বিরক্ত হন। সোজা হয়ে বসে,ফোস করে শ্বাস ঝেড়ে বললেন,
“ এসো।”
আবুল ত্রস্ত ঢুকলেন ভেতর। তেমন ব্যস্ত ভঙ্গিতেই সালাম ঠুকলেন আবার।
“ সরি স্যার,এই সময় আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু খবরটা না দিলেও তো নয়। তাই এক্কেবারে ছুট্টে চলে এসেছি।”
জামশেদের সরল ভ্রুতে ভাঁজ বসল,
“ কী হয়েছে?’’
আবুলের চোখেমুখে ততোধিক উৎকণ্ঠা, জানালেন,
“ কী আর হবে স্যার! আজিমপুরের যে জায়গাটা পছন্দ করলেন আপনি। ওই যে সেদিন কথা বলে এলাম? একাব্বর তো এখন ওই দামে দিতে চাইছে না। প্রতি শতাংশে এক লাখ করে বাড়িয়েছে।”
জামশেদ খেকিয়ে উঠলেন।
“ মানে? বললেই হলো,এটা কি মগের মুল্লুক না কি?”
মিনমিন করে জানালেন আবুল,
“ ইয়ে স্যার এটা আমার কথা নয়,একাব্বরই ফোন করে বলেছে।”
ফুঁসে উঠলেন জামশেদ
“ এত বড়ো স্পর্ধা ওর? সামান্য ঠিকাদার কী না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার ওপর দিয়ে যায়? আমি যখন শতাংশের দাম ঠিক করে এসেছি তখন আমি ওই দামেই নেব।”
আবুলের কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ সেটাত আমি বলেই এলাম স্যার,কিন্তু ও বলছে আপনি জোরাজোরি করলে মিডিয়াকে জানিয়ে দেবে। “
জামশেদ রাগে থরথর করে উঠলেন। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন ক্রোশে। মুখায়ব খেয়াল করতেই আবুল প্রস্তাব ছুড়লেন,
“ স্যার আপনি বললে লোক পাঠাই? বড্ড বাড় বেড়েছে, ভেঙে দিই হাড়গোড় কী বলেন?”
জামশেদ নিম্নোষ্ঠ কামড়ে ডুব দিলেন ভাবনায়। আজিমপুরের ওই জায়গাটা মেন রোডের পাশেই। জায়গার দাম উনি যা বলে এসেছিলেন একাব্বর তো মেনেই নিলো। যদিও ওতে লস হোতো ওর। কিন্তু মন্ত্রীর ওপর দিয়ে কথা বলে লাভ-লস দেখার মতো ভুল সে করেনি। তাহলে ফট করে এখন সাপের মতো মাথা তুলছে কেন? প্রতিপক্ষের কারো উষ্কানি ছাড়া মামুলি লোক এমন করবে কী না সন্দেহ!
কী করা উচিত হবে এখন? গন্ধটা যে অনেক ভেতর থেকে আসছে জামশেদের রাজনৈতিক মস্তিষ্কে বুঝে নিতে বাকী নেই। এর পেছনের মূল হোতা কে,সেটা না জেনে এক্ষুনি একাব্বরের গায়ে হাত দেয়া বোকামো হবে। নিশ্চয়ই তার এমন ভুল চালের অপেক্ষাতেই বসে সে লোক। কোনোভাবে নিজের নাম উঠে এলেই সব শেষ। না না এসব তো করা যাবে না।
বরং এমন কিছু করতে হবে যাতে সাপও মরবে,লাঠিও ভাঙবে না। একাব্বর সুরসুর করে কম দাবে জমি বেচবে আবার তার নাম শুনলেও লাফিয়ে উঠবে ভয়ে! আবার সেটা লোককে জানানোর মতো প্রমাণও থাকবে না। হাত পা ভাঙলে সেসব প্রমাণ তো এগিয়েই দেয়া হচ্ছে।
নিজের মতো ছক কষে মাথা নাড়লেন জামশেদ। মেজাজ শান্ত করে বসলেন চেয়ারে। প্রথমেই মাথায় এলো তীব্রর কথা। এই কাজ ওকে দিয়ে করাতে হবে। এসব পূঙ্খানুপুঙ্খ মাস্তানিতে তার ছেলের ন্যায় ধূর্ত কেউ নেই।
টেবিল হতে শশব্যস্ত মোবাইল ফোন তুলতে গিয়েও থামলেন জামশেদ। আবুল সামনেই দাঁড়িয়ে। চোখজোড়ায় বিভ্রান্ত, প্রশ্নসূচক চাউনী। এই লোক তাঁর এসিস্ট্যান্ট। কিন্তু তবুও ওনার সামনে তীব্রর সঙ্গে এসব সিক্রেট আলাপ-আলোচনা করেন না জামশেদ। যেখানে জ্বিভ দাঁত কে বিশ্বাস করে না, সেখানে আবুল তো কোন ছাড়!
সব থেকে বড়ো কথা, অভদ্র ছেলে তো আজকাল ফোন ধরে না। কয় বার যে মুখের ওপর লাইন কেটে দিয়েছে! অথচ যাওয়ার সময় কী বলে গেল? আপনার যখন লাগবে ডাকবেন,চলে আসব। আর এখন! কী চালাকি! বাপকে ঘোল খাওয়ানো?
জামশেদের ভাবুক মুখখানা চশমার ওপর দিয়ে মেপে নিলেন আবুল। নিজের প্রভুভক্তি প্রকাশ করলেন নরম সুরে,
“ কাকে ফোন করতে হবে স্যার? আমায় বলুন আমি করছি। আপনি আবার শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন?”
জামশেদের উত্তর তৈরি,
“ ব্যক্তিগত ফোনকল। তীব্রর সাথে একটু দরকার ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল সে তো এখনও কলেজে বোধ হয়।”
বলতে বলতে চোখ ঘুরিয়ে দেয়ালঘড়ি দেখে নিলেন তিনি।
তীব্রর নাম শুনতেই ভেতর ভেতর মেজাজখানা খিচড়ে গেল আবুলের। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল অসভ্য ছেলের চড় খেয়ে চেয়ারের ওপর নিজের উলটে পড়ার কথা। ইজ্জতে থাবা বসল যেন।
একটু চুপ থেকে নিজেকে সামলালেন আবুল। রয়ে সয়ে বললেন,
“ স্যার,আপনি যদি অভয় দেন একটা কথা বলতে পারি?”
“ বলো।”
“ ইয়ে মানে, ছোটো স্যার আজ কতগুলো মাস হয়ে গেছে গাজীপুরে আছেন। ওখানে যাওয়ার পর থেকে আপনি কি কোনও খোঁজ নেননি ওনার ব্যাপারে?”
জামশেদ বললেন,
“ নিয়েছি। কলেজে রেগুলার যাচ্ছে,ছাত্র-ছাত্রী পড়াচ্ছে। ভালো লেগেছে শুনে।”
আবুলের খটকা বাড়ল। উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন,
“ কী বলছেন স্যার? ছোটো স্যার কলেজে পড়াচ্ছেন এখন?”
“ তেমনই তো শুনলাম। কেন বলো তো!”
“ না মানে স্যার আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন ঘোলা ঘোলা লাগছে। আপনার যে ছেলে সারাদিন বাড্ডার মোড়ে জিপ নিয়ে পড়ে থাকতো। বন্ধুবান্ধব নিয়ে রাত বিরেতে ক্লাবে ক্লাবে ঘুরতো। বাড়ি ফিরত গলা অবধি মদ গিলে। ওলিতে গলিতে বিট্টু মাস্তান নামে যার কুখ্যাতি সে হঠাৎ একটা কলেজের শিক্ষক হতে অতদূর গিয়েছে? এটা নিয়ে আপনার কোনো সন্দেহ হচ্ছে না স্যার? এর ভেতরে অন্য কোনো রহস্য আছে কি না, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি না, আমার মনে হয় আপনার এ বিষয়ে একবার জোরদার খোঁজ নেওয়া উচিত। আপনি বললে আমিও নিতে পারি।”
জামশেদ চোখ-নাক গুটিয়ে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। যতই বাপ-ছেলের নিরব দন্দ্ব চলুক উনি তো পিতা। নিজের ছেলের নামে অমোঘ সত্য গুলো কোনো বাবাই শুনতে চাইবে না। খুব রেগে বললেন,
“ তোমার ডিউটি আমার ওপর আবুল। আমার ছেলেকে নিয়ে এত তদন্ত করতে তোমাকে কে বলেছে?”
এসির বাতাস বওয়া ঝিমঝিমে কক্ষে জামশেদের কণ্ঠস্বর আরো দ্বিগুণ ভারি শোনায়। আবুল ঘাবড়ে গেলেন। মাথা নামিয়ে বললেন,
“ সরি স্যার!”
“ সরির কিছু নেই। এটা তোমার ভুল নয়,এটা তোমার ধৃষ্টতা। আর কোনোদিন যেন তীব্রর ব্যাপারে এভাবে নাক গলাতে না দেখি।”
ভদ্রলোক মিইয়ে যান। যুক্তিতর্কের সুযোগ হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পরাস্ত বেশে। বাপ-ছেলের তো গদগদ সম্পর্ক নয়। যথেষ্ট খাপছাড়া। সেজন্যে ঝোঁপ বুঝে কোপাতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেলেন।
জামশেদ গম্ভীর বনে শুধালেন,
“ আর কিছু বলবে?”
দুপাশে মাথা নাড়লেন আবুল।
“ এসো তাহলে।”
“ ওই ব্যাপার নিয়ে কী করবেন বললেন না যে স্যার।”
“ জানাব। যাও।”
কালো মুখে ঘুরে হাঁটা ধরলেন আবুল। নিজের প্রতি ভীষণ রকম মেজাজ খারাপ হলো বৈকি। কী দরকার ছিল আগ বাড়িয়ে এসব বলার! স্যারের চোখে ভালো হওয়ার বদলে হিতে-বিপরীত ঘটে গেল। উফ!
আবুল বেরিয়ে গেলে, জামশেদ ফের পিঠ হেলালেন কেদারায়। ব্যাপারটা নিয়ে তার যে খচখচ লাগছে না, বা লাগেনি তা নয়।
আবুলের কথায় আরো প্রকট হলো এই যা!
সত্যিই তো, ওখানে কী এমন মৌচাক পেলো তীব্র,যার জন্য বাড্ডাতে পা-ই রাখতে চাইছে না? আর সব ছেড়েছুড়ে ওখানে গেলই বা কেন? জামশেদ খবর নিয়েছেন, বাড্ডায় তীব্রর দলবল এখন আর বসে না। হুট করে সব না কি উৎখাত হয়ে গিয়েছে। কে উৎখাত করল? অন্য কেউ, না তীব্র নিজেই? জামশেদের মস্তিষ্ক প্রশ্নে ভরতি হয়ে যায়। সব কিছু এলোমেলো লাগে। নিজের ভাগ্যের ওপর মেজাজ বিগড়ে যায় সাথে। কোথায় এখন ব্যবসা-বানিজ্য ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে আরাম করবেন। তা না! উলটো সেই নবাবজাদার পেছনেও এখন গোয়েন্দা লাগাতে হবে। নাহ,ব্যাপারটা সাধারণ বলে মনে হচ্ছে না। কলেজে শিক্ষক আদৌ মন থেকে হয়েছে কী না একটা খোঁজ নিতেই হবে এবার। কলেজ বাদ দিয়ে ওর জীবনের ওপর নজরদারি করতে হবে। কোথায় যায়, কী করে সব জানা চাই।
বলা তো যায় না,কেঁচো খুড়তে গিয়ে যদি কেউটে বেরিয়ে আসে?
******
পুষ্পিতা ভীষণ রকম দোটানায় পড়েছে। তীব্রর পাশাপাশি সিটে বসে একবার লজ্জা লাগছে একবার হচ্ছে অস্বস্তি। অন্য সময়ের মতো কুণ্ঠায় ঠিকঠাক নুইয়ে যেতে পারছে না। লজ্জার কারণ অতীতে তীব্রর ঘটিয়ে আসা ঘটনা হলেও,অস্বস্তির কারণ তনুজা। সে মেয়ে স্যারের জন্য এতো পাগল জানার পর পুষ্পিতার কেন যেন কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সব রঙচটা দেয়ালের ন্যায় ঠেকছে। ও মেরুদণ্ড সোজা করে বসে থাকার প্রয়াস চালায়। বুকের উচাটন সামলাতে চায় শক্ত হাতে।
হঠাৎই ড্রাইভিং-এ ব্যস্ত তীব্র সিটি বাজিয়ে উঠল। কালচে ওষ্ঠপুট গোল করে সুর তুলেছে গানের। ভরা স্বরে দারুণ তাল। শাহরুখ খানের সেই,
❝ তুঝে দেখা তো এ জানা সানাম।
পেয়ার হোতা হে দিওয়ানা সানাম।
আভ ইহাসে কাহা যায়ে হাম
তেরি বাহোমে মার জায়ে হাম…❞
পুষ্পিতা চমকে তাকায়। স্যার গান গাইছেন? তাও এই গান? সেদিনের সেই “ চ্যালেঞ্জ দিবি না শালা”
মারকুটে গান চালানো তীব্রর সাথে আজকের এই রোমান্টিক গান গাওয়া তীব্রকে পুষ্পিতা গুলিয়ে ফেলে।
পরপর মাথায় ভিড়ে নতুন কোনো ভাবনা। হঠাৎ এই গান গাইলেন কেন স্যার? কী অর্থ এর? কোনো ভাবে কি ওকে শোনাতেই….”
পুষ্পিতা বক্ষঃস্থলে তোলপাড় ঘটে না আজ। বরং থমকে থাকে সব কিছু। স্যার কি সত্যিই ওকে পছন্দ করেন? মেয়েটা মাথা নামাল। খুশি হবে না কী করবে সন্দিহান সব। শিক্ষক পছন্দ করলে ছাত্রীর কি খুশি হওয়া উচিত? না কি দুঃখ পাওয়া উচিত?
প্রেম সম্পর্কে আনাড়ি পুষ্পিতা কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারল না। ঠোঁট টিপে এক পল চোখ তুলে তীব্রর দিক চাইল শুধু ।
মানুষটা ফিরল তখনই। পাশে বসা এক রূপসীর বিস্মিত,বিভ্রমে চুবানো নজরে সন্ধি হলো সহসা। বিব্রত হওয়ার বদলে হাসল তীব্র। সাথে ডান ভ্রু নাঁচাল। সেই হাসি এত সুন্দর! পুষ্পিতার দুচোখ ছাপানো বিস্ময়ে রাতারাতি বিমোহ নেমে আসে। সব ভুলে তীব্রর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। পুষ্পিতা ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিলো আজ। কিংবা হাজার যুদ্ধ করেও চোখ সরাতে পারে না। তীব্র সুদর্শন ঠিক আছে। কিন্তু আজকের এই দর্শনের সৌন্দর্য যেন কয়েক গুণ ধারালো। যেই শাণে পুষ্পিতার একটু আগের অস্বস্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আর এই যে হাসল তীব্র? সে হাসি যেন শতকোটি ঐশ্বর্য ঘেরা। পুষ্পিতার কী হলো ও নিজেই জানে না। শুধু মনে হচ্ছে, এমন চেয়ে থাকাতেই শান্তি। এমন মুগ্ধ হওয়াতেই সব সুখ। নারীর হাসিতে প্রান দেয়া পুরুষ আছে কী না কে জানে! কিন্তু এমন পুরুষের হাসিতে প্রান দেয়া? এ যেন বহুগুণ গৌরবের। তীব্রর খেয়াল পড়ল পুষ্পিতার হাঁ হয়ে থাকা। ভ্রু যুগল বেঁকে গেল অমনি। তীরস্থ চাউনীতে নেমে এলো তীক্ষ্ণতা। মুখের ওপর বলল,
“ এভাবে কী দেখছ?”
পুষ্পিতা থতমত খায়। চোখ নামায় জলদি।
“ না মানে..”
তীব্রর মুখবিবর হাস্যহীন। পুষ্পিতার অপ্রতিভ চিত্ত কমাতে, চেয়েও কিছু বলল না। শুষ্ক গলায় খাঁকারি দিয়ে শুধাল,
“ ওই ছেলেটাকে তুমি চেনো?”
প্রসঙ্গ ঘুরে যাওয়ায় মনে মনে হাঁপ ছাড়ল পুষ্পিতা। স্যার তবে কিছু মনে করেননি।
জবাব দিলো বিলম্বহীন,
” শরিফ হাসান ছেলেটা? যাকে শেষ দিকে বকলেন?”
সঠিক উত্তর! অথচ তীব্র এমন ভাবে চাইল যেন পৃথিবী উলটে গেছে। হুট করে ব্রেক কষল গাড়িতে। পুষ্পিতা অপ্রস্তুতিতে ঝুঁকে যায়। ভরকে তাকায় ওর দিক।
তীব্রর সরু নাকটা জোয়ারের মত ফুলতে দেখা গেল। মেয়েটা ঘাবড়ে গেল তাতে। মিনমিনে কণ্ঠে বলে,
“ আমি কি কিছু ভুল বলেছি স্যার?”
তীব্রর কণ্ঠে তেজ,
“ এর মধ্যে ছেলেটার নামও মুখস্থ করে ফেলেছ?”
পুষ্পিতা চোখ বড়ো করল।
“ না না। মুখস্থ করব কেন? তখন শুনেছিলাম তাই মনে ছিল।”
তীব্র সূচাল নেত্রে চেয়ে,
“ একবার শুনেই মনে রেখেছ? কেন? কোনো ইন্টারেস্ট আছে ওর ওপর?”
প্রশ্ন ছুড়ে অপেক্ষায় রইল সে। ঠিক যেন ডোবার মাঝে ছিপ ফেলে রাখা বর্শির মতো। দাঁত খিঁচে ভাবল,
“ শুধু একবার শুনি হ্যাঁ। তোমাকে কী করব জানি না,তবে ওটাকে আজকেই পিষে ফেলব মাটিতে।” পুষ্পিতা জ্বিভ কাটল সবেগে।
“ ছি ছি কী বলছেন,ওনাকে আমি দেখলামই তো আজ।”
তীব্রর শান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু হতে পারল না। তার মেজাজ খুব গুছিয়ে বিগড়ে গেছে।
চুপচাপ হুইল ঘোরাতে দেখেই পুষ্পিতার মুখে আমাবস্যা নামল। স্যার কী ওকে ভুল বুঝলেন?
কী ভাবলেন,শরিফ ছেলেটাকে ওর পছন্দ? নিশ্চয়ই রাগ করেছেন খুব!
পরপরই প্রশ্ন উঠল মনে। স্যার রাগ করলে ওর কী?
এই জবাব পুষ্পিতার কাছে নেই। সত্যিই তো, তীব্র রেগে গেলে তার কিছু হওয়া উচিত না।
কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপার গুলো সব সময় স্বাভাবিক থাকে না। কখনো কখনো অস্বাভাবিকত্বের দোলাচলে খেই হারাতে হয়। প্রতাপী হাতে মানুষের হৃদয়কে কব্জা করে তারা।
পুষ্পিতারও এখন তেমনই হচ্ছে। যেন এক্ষুনি তীব্রর কাছে সাফাই দেয়া জরুরি। নাহলে ব্যর্থ তার ভুবন। বিফল ছোট্টো জীবন।
পুষ্পিতা বারবার কিছু বলার চেষ্টা করে।
পারে না। জ্বিভখানা ভীষণ রকম দোনামনা করে চুপসে থাকে ভেতরে। পরাজয়ের অসহায় ভাব লেপ্টে আসে চেহারায়।
সুরূপার সেই বিধ্বস্তততা হয়ত টের পেয়েছে তীব্র। সম্মুখে চেয়ে চেয়েই ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসল সে। গাড়ি ব্রেক যখন গন্তব্য ছোঁয়,ছোটো করে বলল,
“ নামো।”
পুষ্পিতার মুখের মেঘ বাড়ল। মনের আনাচে-কানাচে ছুটে গিয়ে, খুঁটি গেড়ে ঘর-বাড়ি বানাল। তীব্রর থমথমে চেহারা অমানিশার তাণ্ডব প্রকট করল আরো। স্যার সত্যিই ভেবে নিয়েছেন শরিফ ছেলেটির সাথে ওর কিছু আছে। ইশ,কী বাজে ব্যাপার!
ও গুটিগুটি কদমে নেমে দাঁড়ায়। তীব্রও জিপ লক করে নামল। পুষ্পিতা নিম্নোষ্ঠ চেপে পেছনে ফিরল বাড়ি যাওয়ার জন্যে। আচমকা চারটে ছেলে হুড়মুড়ে ভঙ্গিতে দৌড়ে এলো কাছে। সমস্বরে চিল্লিয়ে বলল,
“ আসসালামু আলাইকুম!”
পুষ্পিতা এমনিই ভিতু। ভয়-ডর তার রক্তে মিশে। চার-চারটে সমর্থ্য যুবক অকষাৎ সামনে আসায়, রুগ্ন বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। চিৎকার ছুড়ল নিজেও,
“ ও মাগো!”
পিছিয়ে যেতে নিলেই কারো নিরেট বক্ষে, পিঠের সংঘর্ষ লাগে। হকচকিয়ে ফিরে চাইল মেয়েটা। তীব্র সবে দাঁড়িয়েছে এসে।
থৈথৈ পারাবারে সাঁতার কেটে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ কোনো দ্বীপের দেখা পেলে, যেমন ঝলকে ওঠে? পুষ্পিতারও ঠিক সেরকম হলো।
এক লাফে চট করে পেছনে গিয়ে দাঁড়াল তীব্রর। দূর্বল আঙুল আঁকড়ে নিলো ওর বাহুর গোছানো শার্ট। চোখে-মুখে শঙ্কা। আতঙ্কিত নজর। অথচ বক্ষের চারিধার
জুড়িয়ে গেছে তীব্রর। একবার নিজের বাহু ধরা পুষ্পিতার হাত দেখল সে। সামনে ফিরে চোখ বুজে গভীর শ্বাস টানল
আস্তে করে বলল,
“ ভয় নেই। ওরা আমার বন্ধু।”
পুষ্পিতা হোচট খেল। ওষ্ঠযুগল ফাঁকা করে মুখ তুলল তীব্রর দিকে।
পরপর কাচুমাচু চেহারায় মিরাজদের দিক তাকাতেই ওরা বিস্তর হাসি ঝোলায় ঠোঁটে। আবারও সেই মিলিত কণ্ঠ,
“ আসসালামু আলাইকুম।”
পুষ্পিতার মুখটা এইটুকুন হয়ে আসে। এবার ভয়ে নয়,লজ্জায়। কী বোকামি টাই না করে ফেলল! ইশ কী ভাবল সবাই?
নিভু স্বরে উত্তর দিলো সালামের। সরে এসে বলল,
“ সরি! আমি আসলে আপনাদের চিনি না তো। তাই একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
আরমানের কণ্ঠ প্রফুল্ল,
“ কোনো ব্যাপার না। আজকেই তো প্রথম দেখা হলো। আস্তে আস্তে ঠিক চিনে যাবেন।”
তার মুখ থেকে ভাবি শব্দটা ছিটকে বের হতে চাইছিল। খুব কৌশলে গিলে নিলো তাও। কথা শেষে চোখ ফেরাল তীব্রর দিকে। নীরবে জানতে চাইল,
“ সব ঠিকঠাক বলেছি তো?”
তীব্র সে জবাব দিলো না। পুষ্পিতাকে বলল,
“ ওরা আমার খুব পুরোনো বন্ধু। এখানে এসেছে অল্প কিছু দিন। পরিচয় করিয়ে দেই,
ও শাফিন,ও মিরাজ, ও আরমান আর ও মুশফিক।”
আলাপচারিতার সময় একটু হাসল মুশফিক। পরপরই আড়চোখে শাফিনের দিক দেখল। সেদিন তো অত করে বুঝিয়েছিল ওকে। বুঝতে চাইল পুষ্পিতাকে এত কাছ থেকে দেখে আজ তার মতিগতি কী হয়! কিন্তু না,শাফিন হাসছে। কপটতাশূন্য, ফুরফুরে হাসি।
মিরাজ আগ বাড়িয়ে শুধাল,
“ কেমন আছেন?”
পুষ্পিতা বলল,
“ জি ভালো,আপনি?”
“ ভালো ভালো। খুব ভালো।”
শাফিন জিজ্ঞেস করল,
“ পড়াশোনা ঠিকঠাক চলছে তো?”
“ জি।”
তীব্র বলল এবার,
“ বাসায় যাও।”
পুষ্পিতা বাধ্যের ন্যায় মাথা কাত করল। চোখের কোণা দিয়ে লম্বা পুরুষটিকে দেখে চলে গেল নিশ্চুপ।
সঙ্গে সঙ্গে মুখ ছোটাল মিরাজ। কণ্ঠে হইহই ভাব,
“ ভাই তুই কত এগিয়ে গেছিস! যে মেয়ে সেদিনও তোকে দেখে ভয়ে দৌড়ে পালাল আজ সে ভয় পেয়ে তোর পেছনে গিয়ে লুকাচ্ছে? মাই গড!”
তীব্র একপেশে হাসে। সোজাসুজি জানায়,
“ শী অলসো লাইক্স মি..”
মুশফিক অবাক হয়ে বলল,
“ কী করে বুঝলি?”
তীব্র এত জবাব দিলো না। শুধু হেসে গেল শব্দহীন। তারপর চিলের মতো দক্ষ নজর বোলাল বন্ধুদের দেহে। হুবহু তার মতো করে বসনভূষণ পাল্টে এসেছে ওরাও। গুছিয়ে শার্ট পরেছে, চুল পরিপাটি। সবাইকে সুন্দর, ভদ্র লাগলেও আরমানের সাথে এই পোশাক এখনও ঠিক মানায়নি। তার বাম ভ্রুতে একটা আড়াআড়ি কাটা দাগ আছে। ফ্যাশনের জন্য নিজেই কেটেছিল। সেজন্যে গুণ্ডা গুণ্ডা ছাপটা এখনো স্পষ্ট আদলে। কিন্তু সন্তুষ্ট তীব্র।
নিজের জন্য বন্ধুদের এইটুকুন কাজ সত্যিই তার মন ছুঁয়েছে। নির্ভেজাল হাসি টানল ঠোঁটে। প্রশ্ন করল কোমল গলায়,
“ তোরা এখানে কেন?”
“ শাফিন ঢাকা ব্যাক করবে আজ। ওকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছি। তোকে দেখে এলাম আর কী।” আরমানের চটপটে জবাব।
তীব্র শাফিনের দিক ফিরলে,এক টুকরো হাসল সে। যে হাসি ফের সুক্ষ্ণতা দিয়ে মেপে নিলো মুশফিক। এটা টেনে হিঁচড়ে আনা হাসি নয়ত? শাফিন, তীব্রর কাছে এগিয়ে আসে। কাঁধ পেঁচিয়ে বলে,
“ চলে যাচ্ছি রে। বোনু আর মা একা বললাম না? পরে আবার আসব।”
“ কোনো কিছু দরকার হলে জানাস আমায়।”
ও ঘাড় কাত করল,
“ ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস। আর অল দ্য বেস্ট ফর এভ্রিথিং!”
তীব্র কিছু বলতেই যাচ্ছিল,এর মাঝে ফোন বাজল ওর। পকেট হতে বের করে দেখল জামশেদ তালুকদার আবার কল করেছেন। ও বীতঃস্পৃহায় চ সূচক শব্দ তুলল জ্বিভে। লাইন কাটল না। রিংটোন বেজে বেজে নিজেই বিচ্ছিন্ন হয়। হুট করে মেসেজ এলো তারপর। তীব্র যখন মেসেজে মন দেয়, এপাশে মুশফিক শাফিনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। কণ্ঠ চেপে বলল,
“ একটু কথা আছে। এদিকে আয়।”
শাফিন পেছনে যায়। একটু দূরে এসে থামে।
“ কী বলবি?”
“ বলব না। একটা সত্যি কথা জানতে চাইব।”
শাফিন কপাল গোছাল,
“ এখন আবার কী কথা? “
মুশফিকের মাঝে ভণিতা নেই। ফটাফট বলল,
“ তোর কি এখনও পুষ্পিতার প্রতি কোনো ফিলিংস আছে?”
শাফিন জ্বিভ কাটে। মাথা নাড়ে ঝড়ের গতিতে। অবিলম্বে জবাব দেয়,
“ কী যে বলিস! সেদিন আমায় অত সুন্দর করে বোঝালি। এরপরেও আমি এই ভুল করব? সত্যিইত,বিট্টু পাশে না থাকলে কী হতো আমার? মা হারা হতাম। একটা সামান্য মেয়ের জন্যে বন্ধুত্বে ফাটল ধরানোর মত বেইমান আমি নই রে। আর এখানে এসে যা দেখছি,বিট্টুটা যেভাবে মেয়েটার প্রেমে ডুবেছে, এরপরেও তাকে নিয়ে দুঃস্বপ্নেও আমি কোনোকিছু ভাবতে চাই না। ও এখন তোদেরও ভাবি,আমারও।
এতক্ষণে শ্বাস নিলো মুশফিক। হাসল বড়ো নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে। তৎক্ষনাৎ জড়িয়ে ধরে বলল,
“ শুনে খুব খুশি হলাম বন্ধু৷ খুব ভালো থাক তুই।”
জামশেদের নম্বরের জন্যে বরাদ্দ ইনবক্সটা এতদিন খালি পড়ে ছিল। আজ প্রথম বার ম্যাসেজ এসেছে সেখানে। তীব্রর খটকা লাগল খানিক৷ কিছু কি ঘটেছে ওখানে?
ইনবক্সে অন করল চিন্তা সমেত। জামশেদ সমস্ত রাগ-ক্ষোভ উগলে দিতে লিখেছেন,
“ অভদ্র, অসভ্য ছেলে। কতবার কল দিয়েছি ধরার নাম নেই। তোমার মা অসুস্থ,সেই খবরটা অবধি নিচ্ছো না। এই তার প্রতি এত দরদ তোমার তাই না?”
তীব্রর বিরক্তি উবে গেল। টানটান হলো শুভ্র ললাট। মা অসুস্থ? এরপরে ছেলেটা থেমে থাকবে? তুরন্ত জিপের দরজা খুলে উঠে বসল সে। ইঞ্জিন চালু করতেই মিরাজ বলল,
“ কী ব্যাপার, কোথায় যাচ্ছিস?”
“ বাড়ি। মা অসুস্থ। ”
মুশফিক বলল,
“ আন্টি অসুস্থ? সে কী! আমরা আসব?”
“ না। এখানে থাক। পুষ্পিতার দিকে খেয়াল রাখবি।
সাথে আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“ কোনোরকম উল্টোপাল্টা করলে কিন্তু.. ”
মিরাজ সচেতন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে,
“ না না কিচ্ছু করব না ভাই। ও এখন আমাদের সমগ্র জাতির ভাবি। ভাবির সাথে কি অসভ্যতা মানায়?”
শাফিন বলল,
“ বিট্টু যখন ঢাকায় যাচ্ছিস, তাহলে আমি তোর সাথেই যাই?”
তীব্র বলল,
“ আয়।
শাফিন ঝটপট উঠে বসল। নিমিষে শাই শাই বেগে ছুটে চলল গাড়ি।
***
নাহিদ খুব বড়ো বিপাকে পড়েছে। একটা নয়,আধটা নয় দু দুটো মুসিবত যাকে বলে। প্রথমটা হলো বাজার থেকে কিছু কৈ মাছ এনেছে ও। একেবারে জ্যান্ত,হাত পা ছোড়া মাছ। কিন্তু কাটাকাটি তো দূর,কীভাবে ধরবে কোন এ্যাঙ্গেলে বেচারা সেটাই বুঝতে পারছে না। টাটকা, দেশী মাছ গুলো দেখে লোভ সামলাতে পারেনি ছেলেটা। অথচ এখন নিজেই হা-পিত্তেস করছে এই বোকা বোকা সিদ্ধান্তের জন্যে।
প্রথমটা সাদাসিধে সমস্যা হলেও দ্বিতীয় বিপদ তুখোড়। প্রায় অনেকটা সময় পেরিয়েছে তীব্র ফোন ধরছে না। সেই সকালে কলেজের জন্য বের হলো এখন প্রায় সন্ধ্যে। এখনও বাসায় আসেনি। নাহিদের মাথা ফেটে যাচ্ছে চিন্তায়। বিট্টুটা এখানে আসতে না আসতেই মারপিট করেছে। তারওপর অচেনা,নতুন জায়গা। ছেলেগুলো ওকে একা পেয়ে কিছু করল কী না সেই শঙ্কায় বুক কাঁপছে ওর।
নাহিদ তার ষষ্ঠইন্দ্রিয়ের প্রতি বরাবরের ন্যায় আজকেও বিরক্ত হলো । কোনোরকম কিছু আন্দাজে কূলাচ্ছে না । কোথায় যেতে পারে বিট্টু?
এই যে আজ তার জীবনের একটা খুশির দিন। অথচ ওকেই জানাতে পারছে না। নাহিদের চাকরি হয়েছে। মোটামুটি বেতন। এই মফস্বলে অমন হাইফাই স্কেল কে আর দেবে? সে হতাশ চোখে একবার টেবিলে রাখা মিষ্টির প্যাকেটটাকে দেখল। সেই কখন এনেছে ফ্ল্যাটে বিলি করবে বলে। কিন্তু এখনো পরে আছে অমন। বিট্টুকে আগে না খাইয়ে বাকীদের কীভাবে দেবে সে? কিন্তু ওদের বাসায় ফ্রিজ নেই। শুকনো মিষ্টি হলে চিন্তা ছিল না। তবে রসগোল্লা তো টিকবে না গরমে।
নাহিদ ফোস করে শ্বাস ঝাড়ে। বাটি এনে মিষ্টি তুলে রওনা করে নূহাদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে।
অন্যমনস্ক হাতে দরজা খুলল যখন,ওপাশে কেবল এসে দাঁড়িয়েছে নূহা। আচমকা মেয়েটাকে দেখে ভরকে গেল নাহিদ। নূহার ওসবে খেয়াল নেই। ওকে দেখেই ঢেউয়ের মতো উচ্ছ্বসিত হাসল সে। আনন্দে হড়বড় করে বলল,
“ থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ মিস্টার ঢেঁড়স। আপনার জন্য আমি আজ হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছি জানেন! কী বলে যে এখন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাব মিস্টার ঢেঁড়স! আপনি এসাইনমেন্ট গুলো না করে দিলে কী যে হোতো আমার! অনেক গুলো থ্যাংক ইউ হ্যাঁ?”
নাহিদের গোলগোল চোখ দুটো ঠিকড়ে আসার দশা হলো। নিজেকে ধাতস্থ করল সময় নিয়ে। তারপর মাথা নেড়ে বলল,
“ ঠিক আছে।”
মুখে হাসি নেই।
নূহা ভ্রু বাঁকাল। কণ্ঠ সন্দিহান,,
“ কিছু হয়েছে আপনার?”
পরপরই খেয়াল হলো ওর হাতের দিকে। টসটসে মিষ্টি দেখে বলল,
“ মিষ্টি কেন?”
নাহিদ শিশুর মতো ঠোঁট উল্টেপাল্টে বলল,
“ আমার চাকরি হয়েছে। নিন।”
নূহার হাতটা নিয়ে সেখানে বাটি ধরিয়ে দেয় সে। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে বলে,
“ এমন খুশির খবর কেউ এভাবে দেয় বাপের জন্মে দেখিনি। আপনি আসলে কী দিয়ে তৈরি বলুন তো!”
নাহিদের কিছু এলো গেল না। নিজের মত মুখ ভার করে বলল,
“ আমার মনটা ভালো নেই। আমার বন্ধু এখনো বাড়ি ফেরেনি। চিন্তায় আছি।”
নূহা সাবলীল,
“ চিন্তার কী আছে? আপনার বন্ধু কি ছোটো বাবু? হয়ত গিয়েছে কোনো কাজে। ফোন করলেই তো পারেন।”
নাহিদ একেবারে রুষ্ট চোখে চাইল।
“ আপনার কী মনে হয় আমি ফোন করিনি? সব সময় এত বেশি কথা বলেন কেন?”
নরম ছেলের হঠাৎ চেতে যাওয়ায় দমে গেল নূহা। হাত তুলে বলল,
“ আচ্ছা আচ্ছা কাল্ম ডাউন! অল্পতে এতো রেগে যাওয়ার কী আছে? সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখবেন আমার মতো বুঝলেন?”
নাহিদ আশ্চর্য বনে বলল,
“ আপনার মাথা ঠান্ডা?”
“ ঠান্ডাই তো। শুধু ,মাঝেমধ্যে একটু-আধটু রেগে যাই।
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝল এই মেয়ের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তার দুঃখ বুঝবে না।
বলল মুখ কালো করে,
“ আচ্ছা, আপনি যা বলেছেন সেটাই ঠিক। তাহলে এখন আলোচনা এখানেই থামিয়ে দেই।”
নূহা বেগ নিয়ে বলল,
“ থামাব কী? আমি তো ভাবলাম আজকে আপনাকে আমার হাতে বানানো এক কাপ চা খাওয়াব। এটা আমার এসাইনমেন্ট করে দেয়ায় আপনার জন্যে একটা ট্রীট। তাছাড়া ঐদিন কী দারুণ ভাবে আপনি আমাকে চা বানিয়ে খাওয়ালেন,আজ আমি আপনাকে দেখাতে চাই আমার হাতের চা-ও ফেলে দেয়ার মতো হয় না।”
নাহিদ খুশি হতে পারল না। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
“ পরে একদিন খাব মিস নূহা। আসলে আমি একে তীব্রকে নিয়ে চিন্তায় আছি। আবার আমার একটা কাজও বাকী।”
নূহা বলল,
“ আপনার চিন্তা চা খেলেই দূর হয়ে যেত ঢেঁড়স। প্লিজ না করবেন না। নাহলে আমার খারাপ লাগবে।”
“ আপনি আসলে বুঝতে পারছেন না। আচ্ছা ভেঙেই বলি,আমি কিছু জ্যান্ত ছোটো কৈ মাছ কিনে এনেছি বুঝেছেন। কিন্তু কীভাবে কী কাটব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কোনোরকম কড়াইয়ে ঢেকে রেখে এসছি। এত লাফাচ্ছে ওগুলো! তীব্র আসার আগে না কাটলে রাগে আমাকে জ্বালিয়েই দেবে।”
তার সংকীর্ণ মুখখানা, আর দুঃখে উথলে আসা কণ্ঠ শুনে নূহার সমব্যথীত হওয়ার কথা ছিল। এরকমই ভেবেছিল নাহিদ। অথচ মেয়েটা কেমন কর্কশ স্বরে বলল,
“ কাটতে যখন পারেন না কিনতে গেলেন কেন? আমি তো শুনেছি আপনারা রান্নাও ঠিকঠাক জানেন না। একটা পেয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলা লোকজন যদি কৈ মাছ কিনে আনে তাকে শুধু জ্বালিয়ে কেন,পুড়িয়ে ভস্ম করা উচিত।”
নাহিদ হতবুদ্ধি হয়। তাজ্জব বনে চেয়ে থাকে।
এটা মেয়ে না আর কিছু!
নূহা কিছুক্ষণ ভাবল।
সমান চিন্তিত হয়ে বলল,
“ আপনি আমার এত বড়ো একটা উপকার করলেন, আপনার বিপদেও আমার পাশে থাকা উচিত। কিন্তু আমি তো শুধু ইলিশ মাছ কাটতে পারি। এই স্যাতস্যাতে কৈ মাছ দেখলেই আমার গা গুলোয়। সেখানে ধরব কী করে?”
প্রথম দু লাইন শুনে নাহিদের মুখটা উজ্জ্বল হচ্ছিলই,শেষদিকে এসে চিমসে এলো আবার। বলল দুঃখী গলায়,
“ থাক দরকার নেই। আপনি বলেছেন ওতেই হবে।”
নূহা চট করে চুটকি বাজাল আঙুলে। উৎফুল্ল চিত্তে বলল,
“ আইডিয়া। পুষ্পিতা তো সব পারে। ওকে ডেকে আনব?”
“ কিছু মনে করবে না?”
“ কী মনে করবে? ও যা পরপকারি। আমার জায়গায় থাকলে এত কথাও বাড়াতো না। আবার ওর স্যারের কাজ। এক দৌড়ে আসবে। দাঁড়ান আমি নিয়ে আসি।”
নাহিদ মাথা দোলাল। নূহা কয়েক পা গিয়ে আবার ফিরে চেয়ে বলল,
“ শুধু কিন্তু কেটে দেয়া হবে। গতবারের মতো রান্না করবে না। চলবে?”
নাহিদ আবার মাথা দোলাল।
“ জি দৌড়াবে।”
নূহা হাসল। হাতে তার মিষ্টির বাটি। এরপর ঢুকে গেল ঘরে। এপাশে ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে নাহিদ। মেয়েটা ঝগড়ুটে হলেও মন ভালো। এরকম একটা মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে দারুণ হোতো!
( গল্পটা একটু ধীর গতিতে যাচ্ছে। এটা আমার সমস্যা। যারা শুরু থেকে আমার পাঠক তারা জানেন। আমি কোনও কিছুতে তাড়াহুড়ো করতে পারি না। গল্পে ভাত খেলে দাঁনা শক্ত না নরম তাও উল্লেখ করতে আনন্দ পাই। আর তাই নতুন যারা তারা অনেকেই হয়ত আগ্রহ হারাবেন। তবে বলে রাখি টুইস্ট এখনও বাকী। আস্তেধীরে পড়ুন ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু পাবেন।)
চলবে…