কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
৩০
ঘড়ির জ্বলজ্বলে কাঁটায় সাড়ে ছয়টা বাজে। মাগরিবের আযান পড়েছে সবে। মাইক ফুঁড়ে সেই মধুর সুর ছুঁয়ে যাচ্ছে গাজীপুরের অলি-গলি। পবনে পবনে সৃষ্টিকর্তার জয়ধ্বনি কেবল।
পুষ্পিতা নামাজ সেড়ে উঠতে না উঠতেই হাতখানা ছো মেরে লুফে নিলো নূহা। তারপর এক টানে থামল তীব্রদের দরজার সামনে। হতচেতন মেয়েটার বৃত্তাকার চোখ কোটর ছাড়ায় না আজ। নূহার হাবভাব আগাগোড়া নখদর্পণে কী না! তবে তীব্রর ঘর দেখে বক্ষঃস্থলে দ্রিমদ্রিম শব্দ শোনা গেল। সাথে ফিরে এলো অতীতের সমস্ত উচাটন। প্রশ্ন করল চাপা গলায়,
“ এখানে কেন আনলি?”
নূহা গলা উঁচিয়ে একবার ভেতরটা দেখে নেয়। পাছে নাহিদ এসে পড়ে!
স্বর নামিয়ে বলে,
“ তোর স্যারের কিছু মাছ কাটতে হবে বুঝলি! আমি তো এসব দেশী ছোটো মাছ ধরতেই পারি না। নাহলে আমিই কাটতাম। তুই একটু কেটে দিবি? তাহলে ওনাদের উপকার হোতো!”
পুষ্পিতা অবাক হয়ে বলল,
“ তুই আজকাল স্যারের উপকার নিয়েও ভাবছিস?”
নূহা নিভে এলো। আমতা-আমতা করে বলল,
“ না আসলে.. আম্মু মাঝেমধ্যে বলে না? প্রতিবেশীর প্রতিবেশীকে সাহায্য করার কথা। তাই আর কী!”
পুষ্পিতা দম ফেলল।
জিজ্ঞেস করল,
“ মাছ কোথায়?”
“ রান্নাঘরে,আয়।”
নূহা হেঁটে গেল সামনে। চোখে-মুখে খুশি। পুষ্পিতাটা শুনলে না করবে না,ও আগেই জানতো। চেনে তো মেয়েটাকে। পুষ্পিতা তখন ধীর পায়ে ওর পিছু নিয়েছে। অথচ সুনয়নার চাউনীদ্বয় ঘুরে বেড়ায় আশেপাশে। যে চাউনীতে হন্যে ভাব। কাউকে নিরন্তর খুঁজে চলা। নূহা পেছন ফেরেওনি এর মাঝে। কিন্তু ফটাফট বলে ফেলল,
“ এতো খুঁজে লাভ নেই রে গাধী। তোর স্যার এখনও বাসায় ফেরেনি।”
পুষ্পিতা অন্যমনস্ক ছিল,হঠাৎ কথায় চমকে উঠল একদম। মিইয়ে বলল,
“ আমি ওনাকে খুঁজব কেন?”
নূহা ফিরে চায়। টেনে টেনে বলে,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ সেই। কাকে খুঁজছিস,কাকে না খুঁজছিস আমার ঢেড় জানা আছে। যাক গে, চল কাজে লাগি। তুই মাছ কাট আর আমি সবার জন্য কফি বানাই।”
পুষ্পিতা ঠোঁট টিপে ঘাড় নাড়ল। কিন্তু মনটা ঝুপ করে খারাপ হলো বৈকি। স্যার এখনও ফেরেননি? ওর সাথেই তো বাড়ির গেইট অবধি এলেন। তবে কি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছেন কোথাও?
গেলে যে নাহিদ ভাইয়েরও যাওয়ার কথা। কই, তিনি তো বাসাতেই আছেন। পরপরই সতর্ক হয় মেয়েটা। স্যার ফিরতে না-ই পারেন। কাজে যেতেই পারেন নিজের৷ ও এতো ভাবছে কেন?
নূহা চকচকে কফি মেকারটা ধরে ধরে দেখছে। বেশ দামী! এটা গত সপ্তাহেই কিনে এনেছিল তীব্র। অনেক রাত অবধি পড়তে হয়, নোটস করতে হয়, সেজন্যে জেগে থাকতে কাজে লাগে। নূহা প্রথমে কফি পাউডার ঢালল ফিল্টারে,এরপর গুণে গুণে তিন কাপ পানি দিলো সেথায়। সুইচ টিপে এক পল ঘুরে চাইল পুষ্পিতার পানে। একটু আগের মাথায় জড়ানো সুতির ওড়নাটা এখন কোমরে প্যাচানো ওর। মেঝেতে ছোটো পলিথিন রেখে,তারওপর বটি পেতে বসেছে। অতিরিক্ত ফরসা হস্ত মুঠোয় কৈ মাছ গুলো চিহ্ন তুলেছে বড্ড।
পুষ্পিতার আনমনা মুখখানা নূহা মন দিয়ে দেখল। মেয়েটা যে কী সুন্দর! মাঝেমধ্যে ওরই নজর দিতে ইচ্ছে করে। মৃগনয়নের সাথে পুরন্ত ঠোঁট দুটোতে কী মায়া! কী সম্মোহ!
ছেলেরা কি আর এমনি এমনি পাগল হয়? নূহাই ছেলে হলে কবে পুষ্পিতাকে ধরেবেঁধে বিয়ে করে ফেলত! নিজের ভাবনায় নিজেই মজা পেলো মেয়েটা। ফিক করে হেসে ফেলল জোরে।
পুষ্পিতা আওয়াজ শুনে চোখ তোলে। বুঝতে না পেরে বলে,
“ হাসছিস কেন?”
নূহা ঠিক উত্তর দিলো না। বরং মাথা নাঁচিয়ে বলল,
“ পুষ্পিতা রে, তুই তো গেলি!”
ও নাক-চোখ গোটায়। নূহার কথা আমোলে না নিয়ে মন দেয় কাজে। এমনিতেই কিচ্ছু ভালো লাগছে না। তারওপর ফাজিল মেয়ে আরো মজা নিচ্ছে!
পুষ্পিতা বটির গায়ে আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে উদাস হলো। স্বচ্ছ চোখের পর্দায় ভেসে উঠল গতবারের কথা। সেবার রান্না করার পুরোটা সময় তীব্র দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। আজকে নেই। এজন্যেই কি সব ফাঁকা লাগছে ওর? নাহলে আসবাব দিয়ে ভরতি বসত এমন শূন্য ঠেকবে কেন? এই শূন্যতা আসলে কীসের?
ঘর-বাড়ির,না পুষ্পিতার হৃদয়ের?
রান্নাঘর থেকে কফির দারুণ সুঘ্রাণ ছুটে আসছে কক্ষে। নাক টেনে লম্বা করে শ্বাস টানল নাহিদ।
“ আহ,কী ঘ্রাণ!”
ঠিক সেসময় কাপ হাতে চৌকাঠে এসে দাঁড়াল নূহা। খোলা দরজার কাঠে দুটো টোকা দিয়ে শুধাল,
“ আসব?”
নাহিদ ল্যাপটপ মেলে বসেছিল। আগামীকাল থেকে তার অফিস জয়েনিং। স্ক্রিন অফ করতে করতে বলল,
“ আসুন আসুন।”
নূহা ভেতরে ঢোকে। কাপ বাড়িয়ে বলে,
“ নিন। চা বানাইনি। কফি বানালাম। মেকার, জল আর বিদ্যুৎ আপনাদের। তবে দুধ,চিনি,কফি আমি বাসা থেকে এনেছি।”
নাহিদ বলল,
“ ছি ছি আপনি এভাবে হিসেব কেন দিচ্ছেন? আমার-আপনার বলে কী কিছু আছে? সবই তো এক। একটা খেলেই হোলো!”
ঠিক সেদিনের মতো আরেকটা কথা।
আকার-ইঙ্গিতে এবার কী বোঝাল আজ? নূহার জিনিস আর ওর জিনিস একই? ছক সাজিয়ে মেয়েটার বুক কাঁপে ফের। কিন্তু আজ এই কাঁপুনি সে গিলে নিতে চায় না। উগড়ে দিতে অকারণে খ্যাক করে বলে,
“ এই আপনি সব সময় এভাবে কথা বলবেন না তো।”
নাহিদ সবে কাপের কোণায় ঠোঁট ছোঁয়াতে যাচ্ছিল। চোখ তুলল বিস্মিত বনে।
“ কী বললাম?”
নূহা জবাব নিয়ে সংশয়ী! এই ছেলেটা কি এসব বুঝে বলে,না কি না বুঝে সে জানে না। তবে এসব কথা শুনলে ওর কিছু একটা হয়। গলা শুকায়, সমান তালে বুক ধুকপুক করে।
প্রসঙ্গ এড়াল ছোটো করে,
“ কিছু না।”
বোকা ছেলেটা ‘কিছু না’ কেই সত্যি ভেবে বসল। মাথা দুলিয়ে শুধাল,
“ আপনার বান্ধুবির কি কাটাকাটি চলছে?”
“ শেষ অল্প কিছু বাকী।”
নাহিদ হাঁ করে বলল,
“ এত ফাস্ট উনি? মাই গড!”
“ হবে না? ওর যে কত গুণ আপনি-আমি গুণেও শেষ করতে পারব না।”
নূহার কথায় গর্ব।
নাহিদ মাথা নাড়ল ফের। বিড়বিড় করল,
“ গুণ তো আছেই। নাহলে আমার বখাটে বন্ধুকে এক তুড়িতে মানুষ বানাতে পারতো?”
নূহা বলল,
“ একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
“ হ্যাঁ বলুন না। আর আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।”
ও বসল। নাহিদের মুখোমুখি, বিছানার এক কোনে। রাখ-ডাকহীন প্রশ্ন ছুড়ল,
“ আপনার বন্ধু, মানে তীব্র স্যারের কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?”
প্রশ্নখানা অপ্রত্যাশিত৷ শুনে ভ্রু বাঁকাল নাহিদ।
“ কেন বলুন তো!”
নূহা মাথা নোয়াল। নিম্নোষ্ঠ কামড়ে রাখল শুভ্র দাঁতের ভাঁজে। এসব কথা কি খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত হবে? যদি হিতে-বিপরীত হয়?
কিন্তু নূহা একটা ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চিত এখন। তীব্রর মনে পুষ্পিতার জন্য কিছু একটা আছে। নাহলে ওইদিনের পর থেকেই পাশের বাড়ির ছেলেগুলোর উৎপাত হুট করে উবে গেছে। ওরা আর জ্বালাচ্ছে না। চেঁচিয়ে উত্তর পাঠাচ্ছে না। আর না যখন-তখন ঢিল ছুড়ছে জানলায়। এর পেছনের হোতা যে তীব্র নয় এটা স্বয়ং সে মানুষ বললেও নূহা বিশ্বাস করবে না।
নাহিদ ওকে চুপ দেখে গুরুতর হলো। তীব্র দেখতে-শুনতে তাক লাগানো পুরুষ। আবার মেয়েটাও টিনেইজার। কোনোও ভাবে আবার ক্রাশ-ট্রাশ খেলো না তো? এই রে,তাহলে তো খুব ঝামেলা হবে। বিট্টূটা যে পুষ্পিতার প্রতি গলা অবধি ভিজে। এখন শুধু মাথা নুইয়ে ডুব দেয়া বাকী। এই মেয়েটা এতো ভালো। একটু খ্যাপাটে! কিন্তু ভালো। এই যে,কী যত্ন করে কফি বানিয়েছে। খেতেই তো দারুণ স্বাদ। মেয়েটার মন ভাঙলে নাহিদের খারাপ লাগবে। তার উচিত ওর অনুভূতি বাড়ার আগেই সতর্ক করে দেয়া। যাতে আগেই সাবধান হয়ে আর না এগোয়।
জ্বিভে ঠোঁট চুবিয়ে বলল,
“ আসলে মানে ঠিক গার্লফ্রেন্ড নয়। তবে তীব্রর একটা মেয়েকে অনেক পছন্দ। আই মিন ভালোবাসে মেয়েটাকে। আর তার জন্য ও সব করতে পারবে। ইউ নো,যদি আকাশ থেকে চাঁদের খণ্ড ছিড়ে আনা যেত,হয়ত তাও করত ছেলেটা।”
নাহিদ ভেবেছিল নূহার মুখ কালো হবে,দুঃখ পাবে। অথচ উলটো ঘটনা ঘটল। শ্যামরঙা মুখশ্রী ঝলকে উঠল আলোতে। কণ্ঠে উৎকণ্ঠা,
“ কাকে পছন্দ করে? সেই মেয়েটি কে? আমি কি তাকে চিনি?”
নাহিদের চোখদুটোতে ড্যাবডেবে ভাব। তব্দা খেয়ে বলল,
“ ইয়ে মানে আপনি কি খুশি হয়েছেন?”
নূহা অধৈর্য,
“ ওহ হো,আপনি আমার কথা ছাড়ুন। আগে বলুন মেয়েটি কে? তাকে আমি চিনি কী না!”
নাহিদ দিশাহীন ভাবে মাথা চুলকাল। এটা যে বিট্টুর লাইফের টপ সিক্রেট। এভাবে কাউকে বলা কি উচিত?
তাকে উশখুশ করতে দেখে নূহা বুঝে নিলো সব। অভয় দিয়ে বলল,
“ দেখুন,আমি কাউকে বলব না। স্যারকে তো নয়ই। তবে আমার মনে হচ্ছে উনি পুষ্পিতাকে পছন্দ করেন।”
নাহিদ চমকে তাকায়। ঠোঁট ফাঁকা করে বলে,
“ কী করে বুঝলেন?”
“ এর মানে আমি ঠিক বলেছি?”
উচ্ছ্বাসে, আনন্দে ফেটে পড়ল নূহা। উঠে দাঁড়িয়ে গেল ফূর্তিতে। চোখে-মুখে কী যে উল্লাস! নাহিদ আশ্বস্ত হয়। বুঝতে পারে ওর ভাবনা ভুল। মেয়েটা তাহলে বিট্টুর ওপর ক্রাশড হয়নি।
নিজেও দাঁড়িয়ে বলল,
“ হ্যাঁ, আসলে অনেকদিন আগে থেকেই পছন্দ করে। প্লিজ ওনাকে এসব বলবেন না।”
নূহা হেসেই গেল। মাঝে শ্বাস ফেলল বুক টেনে। কণ্ঠে হুল্লোড়,
“ আমার যে কী খুশি লাগছে আপনাকে বোঝাতে পারব না। স্যারের সাথে পুষ্পিতাকে যা মানাবে না।”
নাহিদ নিজেও হাসল এবার। মাথা ঝুলিয়ে ভাবল,
“ সত্যিই! দুজন নিখুঁত মানব-মানবী যখন পাশাপাশি দাঁড়াবে। কী আশ্চর্য সুন্দর লাগবে না ওদের?”
নূহা হুট করে হাসি থামাল। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“ আচ্ছা, উনি অনেক আগে থেকে পছন্দ করলে বলে দিচ্ছেন না কেন?”
নাহিদ কাঁধ উঁচায়,
“ কী জানি! হয়ত মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষা করছে। বা হয়ত চাইছে আপনার বন্ধুও ওর প্রেমে পড়ুক। ওর মনে কী যে আছে,সেসব কী আর আমরা বলতে পারব?”
নূহা কিছু একটা ভেবে বলল,
“ আচ্ছা আমরা নাহয় ওনার মনের কথা বলতে পারব না। কিন্তু চাইলে একটা কাজ তো করতেই পারি!”
“ কী বলুন তো!”
“ মানে দেখুন, আপনি স্যারের বন্ধু আর আমি পুষ্পিতার। আর আমার যা মনে হয় পুষ্পিতাও স্যারকে পছন্দ করে কিন্তু বুঝতে পারছে না। বা লোকটা সম্পর্কে ওর স্যার বলে সব বুঝেও অস্বীকার করতে চাইছে। তাই যদি আমরা দুজন মিলে প্ল্যান করে ওদের কাছাকাছি আনি,এবং সেটা রিপিটেডলি হতে থাকে ওরা এক না এক সময় তো মনের কথা বলবেই। এতে লাভ কী হবে জানেন? যেটা দেরিতে হোতো সেটার সময়সূচী এগিয়ে আসবে।”
নাহিদ চোখ বড়ো করল,
“ দারুণ আইডিয়া তো!”
নূহা হাতটা নিসংকোচে সামনে বাড়িয়ে দিলো,
“ তাহলে ডিল?”
নাহিদ হাতে হাত মেলায়। হেসে বলে,
“ ডিল!”
***
প্রায় পাঁচ মাস পর তালুকদার ভবনে পা রেখেছে তীব্র।
আর এতেই আনন্দের বাঁধ ভেঙেছে লুৎফার। ছেলেকে মাথায় রাখবেন, কোথায় বসাবেন ভদ্রমহিলার দ্বিধাদ্বন্দ্ব লেগে গেছে। তীব্র আসা থেকে এটা-সেটা বানাতে হুড়োহুড়ি লাগিয়েছেন তিনি। একবার লাচ্ছি দিচ্ছেন একবার পাকোড়া বানাচ্ছেন। তীব্র কপাল কুঁচকে মায়ের ছোটাছুটি দেখল কিছুক্ষণ। গোটা ব্যাপারটাই ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
বাবা না বললেন মা অসুস্থ? কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে না।
হিসেব মেলাতে ব্যর্থ হলেও,মায়ের হাসিতে জ্বলজ্বল করা মুখখানা দেখে তীব্রর মন খারাপ হলো৷ কোমলতার ভেতর হতে, ভালোবাসা ছিড়েখুঁড়ে এসে লুটিয়ে পড়ল বাইরে। এই রমনীটি ওকে চোখে হারান। দুনিয়ায় সবথেকে বেশি ভালোবাসেন। আর ও কী না কতগুলো মাস আসেনি বাড়িতে!
তীব্র আধখাওয়া লাচ্ছির গ্লাস নামিয়ে রাখল টেবিলে। লুৎফা তখন খাবার বাড়ায় ব্যস্ত। হাতে হাতে সব এগিয়ে দিচ্ছে ফুলি। পুরো খাবার টেবিল কানায়-কানায় পূর্ণ। কোরমার ঘ্রাণে ম ম করছে বাড়ি-ঘর। তীব্র এসে পাশে দাঁড়ায় মায়ের। মনের দ্বিধা মুখায়বে স্পষ্ট। কিছু বলতে চাইছে সে।
লুৎফা ঘাড় বাঁকাতেই অপ্রতিভ হয়ে নরম চাউনী নামিয়ে নিলো নিচে। উনি বললেন,
“ কী রে, খিদে পেয়েছে বুঝি? এইতো হয়ে গেছে আরেকটু বাকী।”
বলতে বলতে ফের কাজে মন দিলেন লুৎফা। উপুড় হওয়া গ্লাসগুলো একে একে সোজা করে দাঁড় করালেন। তীব্র হুট করে ব্যস্ত হাতটা মুঠোয় ধরল মায়ের। লুৎফা চমকান। ফিরে চান চকিতে।
তীব্রর হাত দুটো অতি মাত্রায় খসখসে। তালুতে বিন্দুমাত্র নম্রতা নেই। সেথায় মায়ের প্রৌঢ় হাতটা বড়ো যত্নে আগলে ধরল সে। দোনামনা করে ভীষণ আস্তে বলল,
“ আই মিসড ইউ মা!”
জান-প্রাণ শুকিয়ে দেয়া কড়া রোদে হঠাৎ কালবৈশাখী ধেয়ে এলে যেমন চমকে ওঠে মানুষ? ঠিক যেমন ভাবে থমকে থাকে বিস্ময়ে? লুৎফাও থেমে রইলেন তেমন। সুশ্রী নারীটির পুরু ওষ্ঠযুগল সরে গেল দুদিক৷
ছেলে মিস করেছে এতদিন,যে কোনো মায়ের কাছে এ বড়ো সহজ স্বীকারোক্তি। অথচ লুৎফার মস্তিষ্ক অনেকক্ষণ তা মেনে নিতে পারল না। পারবে কী করে? কোনোদিন কি এইভাবে বলেছে তীব্র?
কখনও নিজে যেচে এসে কাছে বসেছে দুদণ্ড? কবে যে চোখের পলকে ছেলেটা বড়ো হয়ে গেল,আর কবে আস্তে আস্তে দুরুত্ব বাড়াল টেরও পাননি। এইত
কিছুদিন আগের কথা। যেবার ওর ঘরে যেচে পরে জিজ্ঞেস করলেন লুৎফা,
“ তুই আমাকে ভালোবাসিস না বিট্টু? কী ত্যারা উত্তর দিয়েছিল সে লুৎফার এখনও পরিষ্কার মনে আছে। সেই ছেলে আজ! আবেগে হোক কিংবা আশ্চর্যে,লুৎফার চোখের কোণে জল ছুটে এলো সবেগে। পুরূ ঠোঁট চেপে ধরলেন একে অন্যের গায়ে৷ যেন নরম ত্বক দুটোতে বনিয়াদ সাজালেন,কান্নার জোয়ার ছুটে আসার৷
তীব্রর এতো খারাপ লাগল! প্রসস্থ বুকটা অগাধ মায়ায় কেমন হুহু করে ওঠে। একটু আগের আফসোসটাই বেড়ে বিকট হলো আরো। হাত ছেড়ে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয় সে।
প্রশ্ন ছোড়ে সাবলীল,
“ কাঁদছো কেন? তোমার ছেলে তোমায় মিস করেছে এটা কি কেঁদে ফেলার মতো কথা?”
লুৎফা কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন,হঠাৎ সিঁড়িপথ হতে আওয়াজ এলো,
“ তা এতই যখন মিস করেছ মাকে, তখন এভাবে ডেকে আনতে হলো কেন? এই বুঝি তোমার মিস করার নমুনা?”
চওড়া দেহ নিয়ে ঘুরে চাইল তীব্র। জামশেদ নেমে এলেন নিচে। চোখ মুখে মেঘমন্দ্র ছাপ। যা দিয়ে বোঝাতে চাইছেন , তোমার ওপর আমি সাংঘাতিক রেগে আছি। তেমন ভাবেই টেবিলের কাছে হেঁটে এলেন।
খাবারের এত আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন দেখে বললেন,
“ বাবাহ, ছেলে আসতে না আসতেই দেখি বাড়িটাকে পুরো বিয়ে বাড়ি বানিয়ে ফেলেছ। অথচ তোমার সেই ছেলে এতদিন গাজীপুরে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। ঢাকাতে পা রাখলে তার পা খসে যাবে কি না!”
“ ঘাপটি মেরে বসে থাকতে আর পারলাম কই বলুন,যে হাড়ে কল দিয়ে জ্বালিয়েছেন আপনি। পা খসাতে সেই ঢাকায় আসতেই হলো।”
জামশেদ দাঁত কটমট করতে চেয়েও করলেন না আজ। শ্বাস ফেলে রাগটুকু গিলে নিলেন স্বার্থে। ঘাড়ত্যাড়া ছেলেকে আজ ঘাটানো যাবে না। তাহলে যে জন্যে এভাবে মিথ্যে বলে এনেছেন,জীবনেও করবে না। বেঁকে বসবে।
তীব্রর বক্র জবাবে এই প্রথম বার হাসলেন জামশেদ। খুব নরম কণ্ঠে বললেন,
“ রেগে যাচ্ছো কেন? বাবা মা এখানে রেখে তুমি একা একা গাজীপুর পড়ে আছো দেখেই না বললাম। আফটার অল চিন্তা হয় তো!”
ভদ্রলোক বড়ো কষ্টে হাসি টেনেছিলেন ঠোঁটে। তাতে যত না অস্বস্তি হয়েছিল,ততোধিক অস্বস্তি লাগল স্ত্রীর চোখমুখ দেখে। আমাবস্যায় চাঁদ দেখলে কেউ মেনে নিতে পারে? লুৎফাও পারলেন না। কান্না ভুলে স্বামীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। শেষ কবে ছেলের সাথে জামশেদ হেসে কথা বলেছেন,মনে পড়ে না ওনার। অবশ্য ছেলের সাথে কী,তাঁর নিজের সঙ্গেই যে মানুষ হাসে না সে হঠাৎ!
জামশেদ গলা ঝাড়লেন। দলা পাঁকানো অপ্রতিভের শ্লেষাটুকুন কাটাতে চাইলেন কেশে। এর মধ্যেই তীব্র বলে বসল,
“ বাবাহ! কোনদিকে সূর্য উঠেছে আজ? হোম মিনিস্টার আজকাল নিজের কাজ ফেলে আমাকে নিয়ে চিন্তাও করে? ইম্রেসিভ!”
জামশেদ ভেতর ভেতর চটে গেলেও বুঝতে দিলেন না। ছেলের পিঠ চাপড়ে বললেন,
“ এসো খেয়ে নাও। বেশি রাত করে খাবার খাওয়া ঠিক নয়। ডিনার টাইম অলওয়েজ আটটার মধ্যে থাকা উচিত।”
তীব্রর চাউনী তীক্ষ্ণ। বাবার দিক চেয়ে চেয়ে একবার মায়ের দিক তাকাল। ভদ্রমহিলার অবস্থা ভালো নয়। একটু আগে ছেলে চমকে দিয়েছেন,এখন আবার স্বামী। একইদিনে দু দুটো চমক পেয়ে মুখমণ্ডলের নাজেহাল দশা৷
জামশেদ নিজের জন্যে বরাদ্দ থাকা কেদারা টেনে বসলেন। তীব্রও বসল। লুৎফা জোর করে মনযোগ টেনে এনে ফেললেন কাজে। কোনোরকম ধাতস্থ হয়ে প্লেট এগিয়ে দিলেন স্বামীর সামনে। ভাত দিতে গেলে হাত উঁচিয়ে থামালেন জামশেদ। বললেন,
“ আগে ওকে দাও।”
তীব্র হোচট খায়। ডান ভ্রুটা উঁচিয়ে রাখে বিস্ময়ে।
কিছু না বলে চুপচাপ হাত দেয় ভাতে। লুৎফারও মাথা চক্কর কাটার দশা।
হঠাৎ হলো কি ওনার? শরীর-টরির খারাপ করল না তো?
জামশেদের মাঝে উশখুশে ভাব। কথাটা কি তুলবেন এখন? একবার চোখের কোণা দিয়ে দেখলেন ছেলেকে।
তীব্র তখন তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। কত মাস পর বাড়ির খাবার,মায়ের রান্না। শেষ এমন চেটেপুটে খেয়েছে পুষ্পিতা যেদিন খিচুড়ি রেঁধে দিয়ে গেল। তাও,সেই স্বাদ এক জায়গায়। আর এই স্বাদ আরেক জায়গায়। মায়ের রান্নার সাথে কোনো কিছুর তুলনা চলে?
সহসা প্রসঙ্গ গিলে নিলেন তিনি। ছেলের এমন হাত চেটে খাওয়া দেখে মন-প্রাণ জুড়িয়ে এলো যেন। তুষ্ট চিত্তে ভাবলেন,
“ খেয়ে নিক। এসব কাজের কথা পরে হবে না হয়!”
***
খাওয়া শেষ!
জামশেদ আরাম করে সোফায় এসে বসলেন। স্বাস্থ্যবাণ দেহের পুরো ভর ছেড়ে রাখলেন ফোমে। তীব্র এলো কিছু সময় বাদে। যেমন গতিতে এসে দাঁড়াল, অমন করে বলল,
“ আপনি যে ম্যাসেজে লিখেছিলেন মা অসুস্থ? কই মা তো দেখছি ঠিকঠাকই আছে।”
জামশেদ তৈরিই ছিলেন। ছেলে যে এই প্রশ্ন করবে বহু আগেই জানা। গুছিয়ে রাখা জবাবটাই উগড়ে দিলেন এবার,
“ আমিও তো জানতাম তোমার মা অসুস্থ। চেহারা দেখে তাই মনে হয়েছিল। এখন তুমি তার আদরের ছেলে, হয়ত বাড়ি ফিরেছো বলে আনন্দে এক লাফে সুস্থ হয়ে গেছে!”
তীব্র বিশ্বাস করেছে কী না বোঝা গেল না। বরং চোখ ছোট করে একভাবে চেয়ে রইল। জামশেদ অপ্রস্তুত হলেও গলার জোর বাড়িয়ে বললেন,
“ এভাবে তাকানোর কিছু নেই। মিথ্যে বলে আনাইনি তোমাকে। আর মিথ্যে বলবই বা কেন? তোমাকে এখানে আনিয়ে আমার লাভ কী?”
তীব্র হেসে ফেলল। মুখোমুখি সোফাটায় বসে পড়ল ধপ করে ৷ বলল,
“ আমি কখন বললাম আপনি আমাকে মিথ্যে বলে এনেছেন?”
ছেলের হাসির বহর দেখে ভেতর ভেতর ভ্যাবাচেকা খেলেন ভদ্রলোক। নির্ঘাত সব বুঝে ফেলেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে প্রসঙ্গ এড়ালেন,
“ তোমার ওখানে রান্না করে কে?”
“ কে আর করবে? আমি,নাহলে নাহিদ।”
দুটো নকশা আঁকা বাটিতে তুলতুলে ডেজার্ট নিয়ে হাজির হয়েছেন লুৎফা। স্বামী-ছেলের মাঝামাঝি এসে দাঁড়ালেন কেবল। তীব্রর কথা কানে যাওয়া মাত্রই গতরখানা স্তম্ভ বনে গেল। জামশেদ নিজেও বড়োসড় ধাক্কা খেয়েছেন যেন। দুজনে একইসাথে আর্তনাদ করে উঠলেন,
“ কী?”
তীব্র বিব্রত হয়। চোখ তুলে চায় না।
লুৎফা হা-হুতাশ করে বললেন,
“ তুই রান্না করিস? ওমা কেন? এসব কি তোর কাজ না কি? ওখানে কি রান্নার কোনো লোক পাওয়া যায় না?”
“ জানি না। হয়ত যায়। ওসব ঠিক করার সময় কোথায়?”
জামশেদ বললেন,
“ তাই বলে তোমাকে রান্না করতে হবে কেন? খাবার বাইরে থেকে আনাও। রেস্তোরাঁয় খাও।”
তীব্র আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল,
“ একজন কলেজ লেকচারারের কি এত হাইফাই লাইফস্টাইল মানায় মন্ত্রীমশাই! বেতন যেমন তার তো তেমন লাইফ লিড করা উচিত।”
জামশেদ নাক ফুলিয়ে বললেন,
“ নিজের বাবাকে এসব উদ্ভট সম্বোধন করো কেন সব সময়? বাবা ডাকলে জ্বিভ পচে যাবে?”
তীব্র খুব আশ্চর্য বনে চাইল,
“ কেন? শুনতে ভালো লাগছে না? আমি তো ভেবেছিলাম বাবার থেকে এই শব্দটা আপনার বেশি ভালো লাগবে।”
“ তোমাকে এত বেশি বেশি ভাবতে কেউ বলেনি। যাক গে, কোথায় উঠেছ ওখানে? নিশ্চয়ই ভাড়া বাড়িতে।”
তীব্র কাঁধ উঁচাল,
“ তো আর কোথায় উঠব? আপনি কি আমার জন্যে প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন?”
লুৎফা বললেন,
“ তোর তো তাহলে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে রে বাবা! ভাড়া বাড়িতে তো একদমই থাকার অভ্যেস নেই । কী করছিস না করছিস কিছু তো জানাসও না। হ্যাঁ রে,আমি একদিন যাই? গিয়ে সব গুছিয়ে দিয়ে আসি?”
ও বলল,
“ দরকার নেই। এতদিন মুখের সামনে সব তুলে দিয়েছো তো? অভ্যেস খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তবে আমার খুব একটা কষ্ট হচ্ছে তাও না। আ’ম ইঞ্জয়িং দিস লাইফ মা।”
লুৎফা ব্যর্থ চোখে চাইলেন। নিজে রান্না করে খায় যখন, বাজারটাও নিশ্চয়ই একা একাই করে? আহারে,সোনার টুকরো ছেলেটাকে এক গ্লাস জল অবধি ঢেলে খেতে দেননি তিনি। আর সে কী না হাত পুড়িয়ে খাবার বানায়!
জামশেদ বললেন,
“ আমি তো এটাই বুঝলাম না তোমার গাজীপুরে গিয়ে টিচারগিরি করতে হচ্ছে কেন? ঢাকায় কি কোনো কলেজ/ভার্সিটি নেই? সেখানে পড়াও। আমি না হয় ব্যবস্থা করে দেব।”
তীব্র নিষ্পৃহ
“ লাগবে না।”
“ কেন লাগবে না? ওরকম একটা মফস্বল,ঠিকঠাক কিছু পাওয়া যায় কী না সন্দেহ! বাসা-বাড়িও তো পুরোনো আমলের। কী ভাবে ওই পরিবেশে থাকবে তুমি?”
তীব্র দায়সারা জানাল,
“ আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি।”
জামশেদ ভ্রু উঁচালেন। সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,
“ ম্যানেজ? বাবাহ,তুমি আবার কবে থেকে এসব ম্যানেজ ফ্যানেজ করা শিখলে? আচ্ছা,সত্যি করে বলো তো,কী ঘটাচ্ছো ওখানে বসে? কী এমন পেলে যে মুখ তুলে কোথাও তাকাতেই চাইছো না।”
তীব্র রহস্য হেসে বলল,
“ মধু।”
জামশেদ চেতে বললেন,
“ ইয়ার্কি করছো আমার সাথে? ম্যানার্স লেস ছেলে কোথাকার। বাপকে কীভাবে সম্মান দিতে হয় শেখোনি?”
ও মাথা নাড়ল দুপাশে। মুখের ওপর বলল,
“ কীভাবে শিখব বলুন? ম্যানার্স কী জিনিস আমার বাপ আমাকে কোনোদিন শেখালোই না।”
জামশেদ হাঁ করলেন উত্তর দিতে। মাঝপথেই নম্র কণ্ঠে থামিয়ে দিলেন লুৎফা,
“ আচ্ছা আচ্ছা শুনুন না! ছেলেটা এতদিন পর বাড়ি ফিরল আজকে অন্তত এসব তর্কাতর্কি ছেড়ে দিন।”
ভদ্রলোক দমলেন। শ্বাস ফেললেন ঠোঁট ফুলিয়ে।
বললেন,
“ এক গ্লাস পানি দাও। আইস দিও।”
ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন তিনি। তীব্র হাত উলটে ঘড়ি দেখে। আটটা বেজে ত্রিশ। এখন না বের হলে পৌঁছাতে অনেকটা দেরি হবে। চটপট উঠল। ব্যস্ত ভঙ্গি দেখে জামশেদ শুধান,
“ কোথায় যাচ্ছো?”
“ ফিরছি।”
“ সে কি,এলেই তো বিকেলে।”
“ পরে আবার আসব।”
তীব্র পা বাড়াতে নিলেই জামশেদ মুখ ছোটালেন,
“ আব,ভাবছিলাম ওখানে তোমায় একটা ফ্ল্যাট দেখে দেই। এভাবে অন্যের বাড়িতে থাকবে বিষয়টা ভালো দেখাচ্ছে না।”
ও ফিরে চাইল। সন্দেহী কণ্ঠে বলল,
“ আজকে মনে হচ্ছে আমার প্রতি একটু বেশিই চিন্তা হচ্ছে আপনার।”
জামশেদ অপ্রতিভ হন। থেমে থেমে বললেন,
“ কী আশ্চর্য, তুমি আমার ছেলে তোমায় নিয়ে চিন্তা করা অন্যায়?”
তীব্র বক্ষপটে হাত গুঁজে দাঁড়াল। ভণিতাহীন শুধাল,
“ আপনি কি আমার ঘাড়ে গছানোর জন্য কোনো কাজ পেতে রেখেছেন?”
প্রকাণ্ড হোচট খেলেন জামশেদ। ছেলের লা জাবাব বুদ্ধি দেখে চোখ দুটো না চাইতেও মারবেল হয়ে এলো। বাবার সেই হতচেতন চেহারা দেখে হাসি পায় তীব্রর। ভ্রু নাঁচিয়ে বলে,
“ ঠিক জায়গায় ঢিল পড়েছে তাই না?”
জামশেদের মনে হলো, ছেলে বুঝে যখন গিয়েছেই আর রাখ-ঢাকের দরকার নেই। এখন হোক পরে, কথা তো তুলতেই হোতো । এই অসময়ে বাড়িতে ওনার থেকে যাওয়ার অন্যতম কারণটাকে তো আর বিফল করা যায় না। জবাবে স্বরের হাল অনুচ্চ হলো,
“ আসলে আজিমপুরের দিকে কয়েক একর জমি দেখেছিলাম। এতো দারুণ জায়গা, নিজে দেখলে বুঝতে! মানুষের আনাগোনাও বেশ। শতাংশের দাম দশ লাখ বলেছি আমি। মালিক যে,একাব্বর সে রাজিও হয়েছিল। হুট করে কাল ফোন করল ওইদামে জমি না কি দেবে না। প্রতি শতাংশে তাকে বারো লাখ করে দিতে হবে।”
তীব্র গায়েই মাখল না। নিরুৎসাহিত বলল,
“ তো দিয়ে দিন। টাকা-পয়সা তো কম নেই আপনার। এতো কিপটামো করে কী হবে?”
জামশেদ রেগেমেগে বললেন,
“ তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলছো। এখানে কিপটামোর ব্যাপার হলো? একাব্বর আমার সঙ্গে বেয়াদবি করছে।”
“ ও আচ্ছা। তাহলে আর কী,লোক পাঠিয়ে কয়েক ঘা দিন পিঠে, সোজা হয়ে যাবে।”
জামশেদ বিরক্ত হয়ে বললেন,
“ উফ! তাহলে কি আর তোমাকে বলতাম আমি? ও আমাকে থ্রেড করছে,কিছু করলে প্রেস মিডিয়া ডেকে সব জানিয়ে দেবে।”
তীব্র থুত্নী চুলকে বলল,
“ তো আমাকে কী করতে বলছেন?”
“ কী করবে সেটাতো আমার চেয়ে তুমি ভালো জানো। এমন কিছু করো যাতে সুরসুর করে দশ লাখেই জমি বেচে দেয়। আর খবরটা পাঁচ কানও হ…।”
লুৎফা এর মাঝে পানি নিয়ে এলেন। ওনাকে দেখেই থেমে গেলেন জামশেদ। গ্লাস ধরতে ধরতে বললেন,
“ এক গ্লাস পানি আনতে তোমার এত সময় লাগে?”
“ আইস বার এত শক্ত হয়ে ছিল! ছোটাতেই পারছিলাম না।”
“ আচ্ছা যাও এখন। ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
উনি যেতে নিলেই
তীব্র আটকে দেয়। বলে,
“ যেতে হবে না। যা বলার আমি মায়ের সামনেই বলছি।”
জামশেদের প্রতাপি মুখটায় ঘাবড়ে যাওয়ার চিহ্ন। তিনি যে নিজের কাজে ছেলের মাস্তানিকে মাঝেমধ্যে কাজে লাগান এসব কাকপক্ষীকেও জানতে দিতে চান না। বলতে গেলেন
“ তার আবার কী দর…”
তীব্র হাত উঁচাল,
“ আমাকে বলতে দিন।”
থমকালেন ভদ্রলোক।
ও বলল,
“ আপনি কাজের কথা বললেন,আমি শুনলাম। কিন্তু এরকম কিছু করতে পারব না এটাই হচ্ছে একমাত্র উত্তর।”
জামশেদ উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“ করবে না। করবে না মানে কী?”
“ বাংলাতেই তো বললাম। বুঝতে এতো অসুবিধে হওয়ার কী আছে? আমি এখন আর এসব গুণ্ডামিতে নেই। আই হ্যাভ বিকেইম পলাইট নাও। আপনি অন্য লোক খুঁজে নিন।”
ঘরে যেন বাঁজ পড়ল। মেঝের সাথে দুজন প্রৌড় মানুষের মাথা চৌচির হলো অচিরে। বাকরুদ্ধ জামশেদ গোল চোখে স্ত্রীর দিকে চাইলেন। তাঁর দৃষ্টিও সমান বিহ্বলিত। কেবল ঠোঁট নাড়লেন কথা বলায়,
“ তুই আর গুণ্ডামিতে নেই বিট্টু? ভদ্র হয়ে গেছিস? এসব কি আমি সত্যি শুনছি?”
তীব্রর ললাট কুঁচকে থাকে। এটা এমন কী কথা! যে শোনে সেই নড়তে ভুলে যায়। আশ্চর্য, দুনিয়ায় সেই একমাত্র মানুষ যে কী না ভদ্র শব্দটা উচ্চারণ করলেও বিপদ। বলল থমথমে গলায়,
“ মিথ্যে শোনার কী আছে? আমাকে দেখছো না? কত সভ্য পোশাক পরেছি?
আর মন্ত্রীমশাই আজ আমাকে বলছে মাস্তানি করে ওনাকে জমি এনে দিতে। অথচ যখন সত্যিই মাস্তানি করতাম দিন রাত তো এসির হাওয়া খাওয়ার খোটা দিয়ে বেড়াতেন।”
পরপরই বক্র হাসে ছেলেটা। দুপাশে মাথা নেড়ে বলে,
“ সত্যিই! দেশের সরকারের যে কী হাল! এরা যে জনগণের কাছে কোথায়, কখন, কী চাইবে নিজেরাই জানে না।”
জামশেদ তখনো হতবুদ্ধি। তীব্র বলেই গেল,
“ আমি এখন থেকে এসব মাস্তানি টাস্তানি করব না। মিরাজরাও করবে না। বাড্ডায় আমার কোনো আড্ডার আসর নেই। বিট্টু মাস্তানের থেকে লেকচারার তীব্র রেজা তালুকদার সাউন্ডস কোয়াইট গুড আই থিংক!”
বাবা হিসেবে জামশেদের খুশি হওয়া উচিত। যেমন খুশিতে কেঁদে ফেললেন লুৎফা। আঁচুল মুড়িয়ে আনলেন চোখের কাছে। কিন্তু উনি চূড়ান্ত হতে পারলেন না দৃঢ়ীভূতের তোপে। এমন কান ঝাঁঝানো সত্যবাণ কারো সহ্য জয়? যে ছেলে দুদিন আগেও বলল মানুষকে ভয় পেতে দেখলে তার ভালো লাগে,সে আজ সাউন্ডস গুড নিয়ে ভাবছে?
লুৎফার আওয়াজে ঘোর ভাঙল ওনার। ভদ্রমহিলা ছেলের গায়ে-মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। কণ্ঠ জুড়ে উপচে পরছে তুষ্টি,
“ আল্লাহ এতদিনে আমার কথা শুনেছে তাহলে। তুই সব ছেড়ে দিয়েছিস বিট্টু। আমি যে কতটা খুশি হয়েছি! আমি আজকেই এতিম মিসকিন বাড়িতে ডেকে খাওয়াব।
”
তীব্র বাবার বিস্ময়,মায়ের কান্না কিছুতে মন দিলো না। আবার ঘড়ি দেখল। বলল,
“ আমি এখন আসি মা। কাল কলেজ আছে,আজ থেকে গেলে মিস হবে।”
লুৎফা আটকালেন না। প্রসন্নতায় চোখ ভরতি পারাবার নিয়ে বললেন,
“ আচ্ছা বাবা। কিছু খাবার বাটি ভরে দিয়ে দেব সাথে? ফ্রিজে রেখে রেখে খেলে দুদিন যাবে।”
তীব্র মানা করল না।
মাথা দোলাল। ফুলিকে ডাকলেন লুৎফা। মেয়েটা ছুটে এলে নির্দেশ দিলেন কাজের। মস্তক ঝাঁকিয়ে ফের ছুটে যায় সে।
উনি বললেন,
“ আবার কবে আসবি বিট্টু?”
তীব্র মায়ের গাল ছুঁলো। অমসৃণ কণ্ঠস্বরে নম্রতা আনল,
“ প্রত্যেক মাসের শুরুতে এসে দেখা করে যাব। হবে?”
লুৎফা মাথা কাত করলেন। তীব্র মৃদূ হাসল। অঞ্জলিপুটে রাখা মায়ের চাউনীতে মায়া-মমতা। সাথে বিস্ময়ের হাতছানিতে মাখা এক আকাশ মুগ্ধতা। ছেলেটা যে সঠিক পথে ফিরছে এখনও বিশ্বাসেই কূলোচ্ছে না।
পাশে দাঁড়ানো জামশেদ তখন স্তম্ভিত। তীব্র আড়চোখে এক বার চেয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ওনার নড়চড় নেই তখনও৷ লুৎফা যখন শিশুর মতো হইহই করে বললেন,
“ আপনি ভাবতে পারছেন বিট্টুর বাবা, আমাদের ছেলের এতদিনে সুবুদ্ধি হয়েছে। ও সব ছেড়ে শিক্ষকতা করতে চাইছে। আল্লাহ তোমার কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আল্লাহ। আমার সব মানত আস্তে আস্তে পূরণ করব এবার। ”
জামশেদের হু-হা এলো না। বরং বিশদ ভাবনায় পড়ে গিয়েছেন তিনি। ছেলেটার লক্ষ্মন সুবিধের লাগেনি। এত বছর ধরে মোড়ের মাথায় যে দাপট চালালো, ক মাসে এমনি ছেড়ে দিচ্ছে? তাও ওই সস্তা চাকরি করার জন্যে? উহুম,সব কিছু কেমন রহস্য রহস্য লাগছে। এবার একবার নিজেকেই মাঠে নামতে হচ্ছে তো!
****
সকাল বেলা! পলাশের আজ ছুটির দিন। কিন্তু তাও বেলা করে ঘুমানোর অভ্যেস ওর নেই। এমনিতেও প্রতিদিন ভোর ভোর বাইরে গিয়ে টুকিটাকি ব্যায়াম করে পলাশ। আজকেও তেমনই কাকভোরে উঠল। কাঁধে তোয়ালে আর বোতল ভরা জল নিয়ে চলে গেল ছাদে।
যাওয়ার আগে মিথিলাকেও জোর করে তুলে দিয়ে গিয়েছে। আরামের ঘুম ভাঙাতে মেয়েটার বিরক্তির শেষ নেই। তারওপর হুকুম পড়েছে নাস্তা বানানোর। এখন এই ঘুমকাতুরে চোখে, আঙুলে চটকে চটকে আটা মাখতে হবে। ভাবলেই মিথিলার শরীর গুলিয়ে আসছে। তাও রা বিহীন কাজে লাগে সে। জলে বাস করে কুমিরের সাথে তো আর লড়াই করা যায় না। কানাডায় মিথিলার চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ থাকে না। এমন একা এক দেশে কি আর গলার জোরে জেতা যায়?
মিথিলা রুটি বেলতে বলতে আজও বিড়বিড় করে। পলাশের জ্ঞাতিগুষ্টি গালাগালিতে উড়িয়ে দেয়। কখনো দোষারোপ করে নিজেকে,নিজের কপালকে। ভেবেছিল হবে রাজরানী। অথচ বানিয়ে দিলো চাকরানী। ধুর!
পলাশ বাইরে যাওয়ার সময় সদর দরজা ভিজিয়ে রেখেছিল। খোলা দোর হতে আরামসে ঘরে ঢুকল জেনি। এদিক-ওদিক চেয়ে ডাক ছুড়ল,
“ ফালাস,হোয়্যার আর ইউ?”
মিথিলার ধ্যান ভাঙে। চকিতে ফিরে চায়। ত্রস্ত পায়ে ছুটে আসে রান্নাঘর হতে। জেনির উৎপাত এ কদিন ছিল না। কোথাও একটা গিয়েছিল ঘুরতে। এখন আবার এসছে?
মিথিলা চেঁচিয়ে ওঠে,
“ এই, এই শাকচূন্নি! তুই আবার এসছিস আমার স্বামীর সাথে ঢলাঢলি করতে?”
জেনি বুঝল না। ইংরেজিতে বলল,
“ কী বোলছো?”
মিথিলা কটমটিয়ে বলে,
“ আহারে আমার ইংরেজের বাচ্চা রে। বাঙালি ছেলের বুকে সাবানের মত লেপ্টে থাকে আর এখন বাংলা বোঝে না।
সাত সকালে এই পোড়া মুখ নিয়ে হাজির হয়েছিস কেন?”
জেনির কপালে ভাঁজ পড়ে। মেয়ে হিসেবে সে যথেষ্ট শান্ত,মিশুকে। কিন্তু এই মেয়েটা তাকে দেখলেই তেলেবেগুনে জ্বলে যায় একদম। কী যে বলে রেগেমেগে, কিচ্ছু বোঝেও না।
জেনি তর্কে গেল না।
এসব তার ধাতে নেই। প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,
“ ফালাশ কোথায়?”
মিথিলার কাট কাট জবাব,
“ জাহান্নামে। তোর তাতে কী? অন্যের বরের খোঁজ না করে নিজে বিয়ে করে নে। আমার বরটার ধারেকাছে ঘিষলে কিন্তু এই খুন্তি দিয়ে মেরে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলব।”
এক হাত কোমরে রেখে,আরেক হাতের খুন্তিটা তুলে দেখাল মিথিলা। জেনি হতবাক হয়ে বলল,
“ তুমি কি আমাকে পেটানোর কথা বলছো?”
“ এতক্ষনে ঘটে ঢুকেছে তাহলে? এই তুই যা তো সামনে থেকে। সক্কাল সক্কাল মেজাজ গরম করিস না। পলাশটা এখন জিম করছে, এলেই তো আবার রঙ্গতামাশা শুরু করবি৷ আমি মেরে দেয়ার আগে বিদেয় হ।”
সমস্ত বাংলার মধ্যে জিম শব্দটা স্পষ্ট বুঝল জেনি। সচেতন চিত্তে মনে পড়ল, আজ তো অফ ডে। পলাশ এখন ব্যায়ামে থাকার কথা। ও দাঁড়ায় না। দ্রুত বেরিয়ে যায়। মিথিলা নিশ্চিন্ত হলো। হাঁপ ছেড়ে ভাবল,
যাক চলে গেছে।
রান্নাঘরে আসতে নেবে, হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ল আবার। পলাশ বাইরে। শাঁকচুন্নিটা সেখানে যায়নি তো?
পলাশের গায়ে একটা সফেদ সেন্ডো গ্যাঞ্জি। স্বাস্থ্য ভালো। উচ্চতায় বেশ লম্বা বলে পুরুষ হিসেবে চোখে লাগে। ডাম্বেল ওঠানামা করায় পরনের ট্রাউজার নেমে এসেছে কিছুটা। ঘামে প্রসস্থ পিঠ চটচটে। বৃষ্টির ফোঁটার মত গেঁথে থাকা নীর,সকালের কোমল আলোয় হীরের মতো লাগছে। জেনি পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের চাউনীতে পরিষ্কার মোহ!
পলাশ ডাম্বেল পায়ের কাছে রাখল। হাত ছোড়াছুড়ি করে ব্যায়াম সাড়ার মাঝেই আচমকা দৌড়ে এসে পিঠ জাপটে ধরল জেনি। ছেলেটা চমকায়, থেমে যায়।
মিথিলাও হন্তদন্ত পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তখনই। এই দৃশ্যে রাগে ফেঁপে উঠল শরীর। পলাশ জেনির দিকে ফিরে চাইল। ঠোঁট ভরে হেসে কিছু বলতে যাবে, এক ছুটে এসেই জেনির গায়ে থাবা বসায় মিথিলা। জ্যান্ত গাছের শরীর হতে ছাল ছাড়ানোর মতো টেনে নিলো যেন। ওরা হকচকায়,তাজ্জব হয়। মিথিলার পায়ের রক্ত কোপে মাথায় উঠেছে। খুইয়ে বসেছে হিতাহিত জ্ঞান। গায়ের সর্বস্ব জোর দিয়ে এক ধাক্কা দিলো জেনিকে। মেয়েটা আগের টানাটানিতেই ধাতস্থ হতে পারেনি। পরপর ধাক্কার তোপে ছিটকে পড়ে গেল। উরু সমান গোলাপের গাছটার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল একে বারে।
নরম -সাদা চামড়া কাঁটায় লেগে ছিড়ে যায়। বেরিয়ে আসে রক্ত। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে সজোরে।
স্তব্ধ পলাশ ক্ষেপে গেল অমনি। রুষ্টতায়, ক্রুদ্ধতায় অন্ধকার নামল চোখে। বাক্যব্যয় হীন সপাটে এক চড় বসিয়ে দিলো মিথিলার টসটসে গালে।
(পরের পর্ব দিতে একটু দেরি হতে পারে। তাই আজকে একটা বড়ো পর্ব দিয়ে রাখলাম।)
চলবে