কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৫)
মিথিলার কক্ষ শূন্য আপাতত। সবাই বেরিয়ে গিয়েছে বর দেখতে৷ নীচে খাওয়া-দাওয়ার তোরজোড়। তিনতলায়ও আসছে হৈচৈ আর চেঁচামেচির আওয়াজ! শুধু নুহা নির্বিকার বসে। তার এসবে মাথাব্যথা নেই। মিথিলার বর কালো না মোটা সেসব নিয়েও তরুণী মেয়েটা উদ্বেগহীন।
ওর সাথে কোনও রূপ কথাবার্তা ছাড়াই ফোন হাতে বসে সে। মাঝেমধ্যে, তাকাচ্ছে দরজায়। পুষ্পিতা বলেছিল হাতের সব কাজ সেড়ে আসবে। কখন যে একেবারে ফ্রি হবে মেয়েটা! কতদিন মন-প্রাণ খুলে গল্পে বসেনি দুজন।
ও একবার আড়চোখে মিথিলাকে দেখল। জিরিয়ে নেই সে। ক্রমাগত পায়চারি করছে,ছুটছে যেন। অশান্ত,অস্থির চিত্ত। বিচলিত চাউনী বারবার নিরীক্ষণ করছে দোরের দিক। পুষ্পিতাকে পাঠিয়েছে ঘন্টাখানেক,অথচ ফেরেনি। প্রথম দিকে উদগ্রীব ছিল আংটি নিয়ে। কখন হাতে পাবে, জ্বলজ্বলে পাথরখানা দেখবে দুচোখ ভরে। কিন্তু এতটা সময় পার হতেই তার চিন্তা প্রগাঢ় হয়। সে অধৈর্য হাতে ফের কল দিলো নাহিদকে। এর মধ্যে শ’খানেক কল দেওয়া শেষ! বন্ধ,এবারেও একইরকম বন্ধ শুনে মিথিলার ঘাম ছুটল কপালে। নাহিদ কী ওর জায়গায় পুষ্পিতাকে দেখে রে*গে গিয়েছে? উল্টোপাল্টা কিছু করল না তো? না না,আর যাই হোক ভেড়াটার অত সাহস নেই।
তাহলে পুষ্পিতা ফিরছে না কেন? ওতো অবাধ্য হওয়ার মেয়ে না। মিথিলার মস্তিষ্কে হঠাৎ এক অন্য ভাবনা দপদপিয়ে ওঠে। হাঁটা থেকে থেমে দাঁড়াল তৎক্ষনাৎ।
পুষ্পিতা সুরূপা! নাহিদ ওকে দেখে বেঁকে বসেনি তো আবার? নিজে বলদ হোক,পেছনে বিট্টুর মত দাপুটে গুন্ডা বন্ধু। তারওপর পুরুষ মানুষ! বোকা পুষ্পিতাটা কোনও বিপ*দে না পড়লে হয়!
মিথিলার বুক কাঁ*পে উৎকণ্ঠায়। ছেলেবেলা থেকে পুষ্পিতাকে তার সহ্য হয়না। রা*গ লাগে দেখলে। আত্মীয় স্বজনের নিকট ওর রুপ-গুণের বিশেষণ শুনতে শুনতে বিদ্বিষ্ট, অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছিল একরকম। অন্তঃপটে রোপিত ছিল হিং*সের বিরাট বৃক্ষ। পুষ্পিতাকে বোন তো দূর,প্রতিদন্দ্বী ভাবতেও ভেতরটা ফুঁসত ক্রো*ধে। কিন্তু তাই বলে, অনাথ মেয়েটা বি*পাকে পড়ুক,অবশ্যই তা চায়না। মিথিলা নাহিদকে আবার কল দিলো। বিফল হয়ে চ সূচক শব্দ করল রা*গে। বসে পড়ল বিছানায়৷
এর মধ্যে সালমা বেগম ঘরে ঢুকলেন। ওনাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল মিথিলা। উদগ্রীব হয়ে শুধাল,
‘ আম্মু পুষ্পিতাকে দেখেছো? ও কি নীচে?’
সালমা বেগম হা টুকু গিলে ফেললেন। সাথে গিলে নিলেন কণ্ঠে আসা প্রশ্ন। একটু থেমে পালটা শুধালেন,
‘ পুষ্পিতা এখানে নেই? ওকে তো অনেকক্ষণ যাবত দেখছিনা আমি। ভাবলাম নুহার কাছে হয়ত,তাই খুঁজতে এসেছি।’
মিথিলা ঢোক গেলে। এর মানে ও যা ভাবছে তা সত্যি নয়ত? পুষ্পিতা নীচে নেই,বাসায় নেই। এত রাতে যাবে কোথায়? নিশ্চয়ই নাহিদ কুত্তাটা কিছু করেছে। নুহা কথাটা শুনতেই উঠে এলো।
‘ খুঁজে পাচ্ছেন না মানে কী আন্টি? এই মিথিলা আপু,তুমি না ওকে তখন কোথায় পাঠালে দেখলাম।’
সালমা ভ্রু কুঁচকে চাইলেন। মিথিলা ধীর গলায় সময় নিয়ে নিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ,… আমিত চার্জার আনতে পাঠিয়েছিলাম ওই ঘরে। কিন্তু এতক্ষণে তো ওর আসার কথা তাইনা?’
সালমা বেগম এবার উদ্বীগ্ন হয়ে পড়লেন৷
‘ মেয়েটা তাহলে গেল কোথায়? ওতো আশেপাশের কিছু চেনেওনা যে একা যাবে। আর চিনলেও বা,আমাকে ছাড়া কোথাও নড়েনা যে সে….’
মিথিলা জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। তার সব রা*গ বর্তাল অবলা নাহিদের ওপর। নির্ঘাত ওই কিছু করেছে পুষ্পিতাকে। সারাক্ষণ ওকে ভালোবাসি, ভালোবাসি বলে ফ্যানা তুলে ফেলে। অথচ চোখের সামনে পরমা সুন্দরী দেখেই লালা বেরিয়ে গেছে জ্বিভের। সে ক্ষুব্ধতায় অকথ্য দুটো গা*লি দিলো ওকে।
খোরশেদুল হাজির হলেন তখন। সালমাকে বললেন,
‘ তুমি এখানে কী করছো? বেয়াইন সাহেবা খুঁজছেন তোমাকে। ‘
সালমা বেগম দুশ্চিন্তায় ফ্যাসফ্যাস করে বললেন,’ ‘পুষ্পিতাকে কোথাও পাচ্ছিনা গো। তুমি কি দেখেছো ওকে? ‘
খোরশেদুল খানিক থমকালেন। মানস্পটে ভাসল একটি ছেলের পুষ্পিতার মুখ চেপে ধরা, আর তীব্রর সেই গাড়ি ছোটানোর দৃশ্য। পরপর চোখমুখ স্বাভাবিক করলেন নিমিষে। কঠোর স্বরে বললেন,
‘ আমি কী করে দেখব? কাজ ফেলে ওকে পাহারা দিতে বসে ছিলাম নাকী? আমি জানিনা। আছে হয়ত প্যান্ডেলের কোথাও।’
‘ কিন্তু আমিত ওখানে দেখলাম, ছিল না ও।’
‘ আশ্চর্য! এমন ওভার রিয়্যাক্ট কোরছো কেন সালমা? পুষ্পিতাতো বাচ্চা মেয়ে নয় যে হারিয়ে যাবে। তুমি এখন এসব ফালতু জিনিস না ভেবে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এটেন্ড করো যাও। আজ যদি এসবে কোনও ফাঁক রাখো,মেয়েটা ও বাড়ি গিয়ে সারাজীবন কথা শুনবে না? তখন কিন্তু হাত কাম*ড়ানো ছাড়া করার কিছু থাকবে না আমাদের।’
সালমা বললেন, ‘ কিন্তু,পুষ্পিতা?’
খোরশেদুল বেজায় বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ আবার পুষ্পিতা! রাহাত তো রাস্তায় খেলছে বন্ধুদের সঙ্গে। আছে হয়ত ওর সাথে। সারাজীবন ওর কথা ভাবলে,এবার নিজের মেয়ের বিদায়ের সময় অন্তত তার দিকটা ভাবো। চলো এখন…আহা এসো তো…’
রীতিমতো স্ত্রীর হাত টেনেটুনে নিয়ে চললেন খোরশেদুল। দরজায় গিয়ে থামলেন। পেছন ফিরে,সুক্ষ্ম চোখে মেয়ের ভাবুক অভিব্যক্তি নিরীক্ষণ করে বললেন,
‘ তুমি তৈরী থেকো,একটুপরেই কাজী আসবেন বিয়ে পড়াতে…’
মিথিলা ঘাড় হেলাল। ইঞ্চিখানেক অনুচিন্তন কমলনা তবে। ওনারা বেরিয়ে গেলেন।
ক্ষণিকের জন্য মিথিলা স্থির রইলেও, নূহা শান্ত থাকতে পারল না। তার ভেতরটা উত্তেজনায় ছটফটায়। পুষ্পিতা নীচে না ওপরে,আশে-পাশে আছে না নেই,এসব ভেবেও সময় নষ্ট করলনা। ওকে খুঁজতে হন্যে কদমে ঝটপট ঘর ছাড়ল।
******
বৈশাখ শুরু হতে না হতেই, শুরু তার অল্পস্বল্প দাপট। সারাদিন,সারাসন্ধ্যা আবহাওয়া ভালো গেলেও,নয়টার পর থেকে বাতাসের বেগ বেড়েছে। গাছপালা একটার ওপর আরেকটা বাড়ি খাচ্ছে ক্রমে। ঝড় ছোটার সম্ভাবনা জোড়াল।
পুষ্পিতার পিঠ দেয়ালে। পা দুটো বন্দি দশায় সম্মুখে লম্বা করে ছড়ানো। মাথাটা কাত হয়ে হেলে পড়েছে একদিক। হস্তযূগলেও শক্ত রশির প্যাঁচ। পুরো মুখমণ্ডল আবৃত তখনও। বড় অবহেলায় তাকে রেখে যাওয়া হয়েছে এখানে।
এই ঘর যতটা শব্দহীন,পাশের ঘরে ততটাই প্রমোদী পরিবেশ। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে তাস খেলায় মেতেছে পাঁচজন সসৈন্য যুবক। প্রত্যেকের আঙুলে, সিগারেট,আর পাশে ঝকঝকে বিয়ারের বোতল। খেলার ফাঁকে ঠোঁট বসছে ওতে।
জায়গাটা ঢাকার মূল শহর থেকে অনেক দূরে। বলতে গেলে,এক্কেবারে শেষ মাথায়। কোনও রকম উন্নত, তবে গ্রাম্য বেশ।
তীব্রদের গাড়ি একটানে এসে ভিড়েছে হেথায়। বাড়িটা মুশফিকদের। এক তলা সম্পুর্ন, বাকীটা ফাউন্ডেশন করা। কাজ শুরু হবে আবার আগামী মাস হতে। একমাত্র পাহাড়াদার হিসেবে দারোয়ান লোকটি থাকেন। পরিকল্পনা চমৎকার রূপে বাস্তবায়নের আশায়,তীব্রর কাছে এই জায়গাটিই নির্বাচিত হয়েছে। মুশফিক,আরমান আগেভাগে এসে সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। দারোয়ানকে ভালো মতন কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদেয় দেওয়া হয়েছে দুইদিনের জন্যে। আপাতত বাড়ি ফাঁকা,নির্জন। ওরা ব্যাতীত একটা কাকপক্ষীও নেই। যেহেতু বহুদিনের প্ল্যান,তাই তাড়াহুড়ো বাঁধেনি কিছুতে।
এবার শুধু নাহিদ আসার পালা!
তীব্র একবার বাইরে চাইল। হাওয়া চলচলের হুহু শব্দটা স্পষ্ট শোনা যায়। পরিপার্শ্বিক অবস্থা, গা ছমছমে,ভূতুড়ে।
নাহিদ আবার ঝড়ের কবলে না পরলে হয়!
তার চিন্তার মধ্যেই মুশফিক হাই তুলল। তন্দ্রায় ঢুলছে সে। চোখের পাতা মেলে রাখা মুশকিল। সে বিদেয় নিলো খেলা হতে। একটা বালিশ এনে,বন্ধুদের পাশেই মেঝেতে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল পরপর।
শাফিন সবার সম্মুখে একটা তাস ছু*ড়ে মা*রল। খুশি মনে আওড়াল,
‘ বিট্টু,এসেছি তো অনেকক্ষণ! এতক্ষনে ওখানে নিশ্চয়ই মেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গিয়েছে বল!’
তীব্র ছোট করে বলল, ‘ হয়ত।’
মিরাজ মেকি দুঃখ নিয়ে বলল,
‘ বেচারা নাহিদের শ্বশুর! মেয়ে গায়েব হয়েছে টেরও পেলেন না। ব্যাপার খানা অনেকটা মুরগীর পেছন থেকে ডিম চুরি হয়ে যাওয়ার মতো হয়ে গেল।’
শাফিন সুর মেলাল,
‘ আমিতো অসহায় বরের কথা ভাবছি। সেজেগুজে বিয়ে করতে এসে দেখবে বউ নেই। ইশ কী বেইজ্জতি ব্যাটার!’
স্বশব্দে হেসে উঠল সবাই। মুশফিকের কান সজাগ। সদ্য ঘুমোলেও কথাটা শুনে হাসি চাপাতে পারেনি। ফুরফুর করে আওয়াজ বেরিয়ে এলো বাইরে।
একমাত্র আরমানের মুখ-চোখ গম্ভীর। ওমন গোমড়া থেকেই বলল,
‘ কিন্তু আমার এসব ভালো লাগছেনা। কোনও আনন্দই পেলাম না।’
তাকাল ওরা। মিরাজ শুধাল, ‘ কেন?’
‘ কী কেন? আরে আমরা হলাম এলাকার প্রতাপী শীর্ষ মাস্তান বিট্টুর গ্যাং। আমরা কী না একটা মেয়েকে চুরি করে আনলাম? ইটস হার্টিং মাই ইগো বিট্টু। চাইলে মেয়েটাকে সবার সামনে দিয়ে তুলে আনা যেত। এলাকাবাসীর ভ*য়টা চারগুন হোতো,সাথে আমাদের উৎসব টাও।’
শাফিন বলল, ‘ শালা গর্দভ! তিন-চারশ মানুষের মধ্য দিয়ে একটা মেয়েকে তুলে আনবে তুমি? আবার তাও যে মেয়ে রাজীইনা এই বিয়েতে! তোর বুদ্ধিতে কাজ করলে,এতক্ষণে জেলে থাকতাম। এমন মদ খেয়ে তাস খেলা বেরিয়ে যেত। ‘
মিরাজ বলল, ‘ তাছাড়া রাস্তায় মেয়েদের উত্যক্ত করা আর সবার সামনে দিয়ে তুলে আনা এক না বন্ধু। এই দেশে কিছু হোক না হোক,ভিডিও একটা করলেই ভাইরাল হতে জানে।’
আরমান বলল ‘ তবুও, চোরের মত মেয়ে আনায় কেমন কেমন লাগছে!’
শাফিন চেঁতে কিছু বলতে গেলে তীব্র থামাল। ওর দিক ফিরে বলল,
‘ তুই হয়ত ঠিক। আমাদের সাথে ব্যাপারটা ঠিক যাচ্ছে না। কিন্তু তুই ভুলে যাচ্ছিস,বিট্টু মাস্তানের গুন্ডামির ক্যারিয়ারে মেয়েঘটিত কোনও রেকর্ড নেই। গ্যারান্টি,হবেওনা। নাহলে যে খোলেমেলা মা*স্তানি করে, রাস্তাঘাটে লোকজন পে*টায় সে নিশ্চয়ই জেলে ঢোকার ভ*য় পায়না! আমি চাইলে চারশ কেন,চার হাজার লোকের মধ্য থেকেও মিথিলাকে উঠিয়ে আনতে পারতাম।’
আরমান স্বায় মেলাল এবার।
‘ কথাটা ঠিক। আমরা মেয়েদের সঙ্গে যতই ফাজলামো করি,বিরক্ত করি না কেন, তুই নিজে এই ব্যাপারে অন্তত কখনও কিছু করিস নি।’
‘ কারণটা আগেই বলেছি, নারীজাতি দূর্বল। একটা সবল পুরুষকে আ*ঘাত করে যেই আনন্দ,দুটো বাজে কথা শুনিয়ে একজন শক্তিহীন নারীকে ভ*য় দেখানোয় সেই আনন্দ নেই। অন্তত এসবের রুচি আমার আসেনা।
তবে সবথেকে বড় কথা হলো,আমরা যদি প্রকাশ্যে মিথিলাকে আনতে যেতাম,পুলিশি ঝামেলা হতো নিশ্চিত। আর তাতে সবার আগে ফাঁসত নাহিদ। ছা পোষা গরুটাকে শুধু শুধু বিপদে ফেলে কী লাভ হোতো? প্রথম বার আমাদের বন্ধুদের কাছে কেঁদেকেটে একটা মেয়েকে চেয়েছে সে,বিয়ে করার এত শখ! পুলিশ নিয়ে গেলে বিয়ে তো দূর,সংসার হোতো চৌদ্দ সিকের ভেতরে।’
সবাই মাথা ঝোলাল,’ ঠিক,ঠিক।’
তীব্র বিয়ারে চুমুক বসায়। গলবিল পার করিয়ে ফের বলে,
‘ এইভাবে এনেছি কেউ টেরও পায়নি। আমাদের সন্দেহের বদলে, সন্দেহ করবে মেয়েকে। ভাববে, কোনও ছেলের সাথে পালিয়েছে। ওরা ওদিকে খুঁজবে,এদিকে নাহিদের সঙ্গে বিয়ে হবে। বাঙালী মেয়ে তো,আপত্তি যতই থাকুক,বিয়ে, বাসর হলে সংসার করতে বাধ্য হবে। আর এক বছর পর যদি দুজন থেকে তিনজন হয়ে ফেরে,তখন মেয়ের পরিবার চাইলেও করতে পারবে কিছু ?’
তীব্র ভ্রু নাঁচাল। সে থামতেই হৈহৈ করে উঠল ওরা। উজ্জ্বল চেহারায়,সমস্বরে আওড়াল ‘ মারহাবা! মারহাবা! কী বুদ্ধি… ‘
তীব্র স্বল্প হাসে। সিগারেটের ক্ষীণ আ*গুনে ঝলসে যাওয়া তামাটে ঠোঁটে উঁকি দেয় প্রচ্ছন্ন চতুরতা।
দরজায় খটখট আওয়াজ হলো তখন। খেলা থামিয়ে সবাই সজাগ কান তাক করল ওদিকে।
আরমান শুধাল, ‘ কে?’
ভেসে এলো নাহিদের ফিসফিসে কণ্ঠ,
‘ আমি,আমি। দরজা খোল।’
মিরাজ ভ্রু নাঁচিয়ে বলল, ‘ এসেছে গরুটা। যাই খুলে দিই।’
সে উঠতে গেলে তীব্র আটকাল।
‘ দাঁড়া। ওর সাথে কাজী আছেনা? মাস্ক পর সবাই।’
মিনিটে সেই আগের রূপে ফিরল ওরা। নাকের ডগা অবধি মাস্ক,আর বড় ক্যাপ ঝোলাল মাথায়। মুশফিক উঠে বসল। এত হুজুগের মধ্যে আজ আর ঘুম হওয়ার নয়।
মিরাজ দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকল নাহিদ। পড়নে শেরওয়ানি। একেবারে ফিটফাট হয়ে এসেছে। বাইরে, বাতাসের সঙ্গে অল্প বৃষ্টির ছাটে ভিজেছে গা। তবে তীব্রর কড়া আদেশে তার চেহারাও ব্যপ্ত।
পেছনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, টুপি পরিহিত মৌলভী সাহেব ঢুকলেন। প্রথমেই নজর বিঁধল মদের বোতল,আর তাসের ওপর। সবার দিক চাইলে, দেখলেন ওদের বেষ্টিত মুখমণ্ডল। বহু বছরের অভিজ্ঞ মাথায় খটকা জাগল এবার। একে তো এত্ত দূরের জায়গা,ফাঁকা- শূনশান বাড়ি। তারওপর এতগুলো বলবাণ ছেলে একসাথে আসর মেলে বসেছে। মেয়ে কোথায়? কোনও ভাবে কী….। তিনি সচেতন, তীক্ষ্ণ চাউনী আশেপাশে বোলালেন। প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ পাত্রী কোথায়? আর এত রাতে বিয়ে পড়াবেন কেন? এখানে আবার জোরজবরদস্তির বিষয় নেইত?’
সবাই কিছুটা অপ্রস্তুত চোখে চাইল তীব্রর দিকে। ব্যাটা মৌলভী ধরে ফেললে কী হবে? সব তো ফাঁস করে দেবে বাইরে গিয়ে। তীব্র স্বাভাবিক। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। চোখের ইশারা দেখেই ধড়াম করে দরজা আটকাল মিরাজ।
ভদ্রলোক সেদিকে একপল চেয়ে তীব্রর দিক ফিরলেন ফ। ওর হাতের চকচকে ছু*রিটা দেখেই শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল ওমনি। ত্রাসে আর্ত*নাদ করে উঠলেন, ‘ একী!’
তীব্র বাহুতে টান মেরে ওনাকে ফেলল কাঠের চেয়ারটায়। হকচকালেন তিনি। ঠিকঠাক হয়ে বসলেন। টুপিটা মেঝেতে পড়ে গেছে। মিরাজ ভদ্রের ন্যায় উঠিয়ে মাথায় পড়িয়ে দিলো আবার। তীব্র ধাঁরাল ছু*রিটা ওনার সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,
‘ বিয়ে পড়াতে এসছিস, চুপচাপ পড়াবি। এখানে কী হচ্ছে,কেন হচ্ছে একটা প্রশ্ন করলেও তোর জ্বিভ কে*টে ঝুলিয়ে রাখব। ‘
মৌলভি আ*তঙ্কে ঢোক গিললেন,
‘ জি।’
তীব্র ছু*রি ভাঁজ করে শাফিনের দিক ছুড়ে মা*রে। সে ক্যাচ নিয়ে পকেটে ঢোকায়।
নাহিদ অধৈর্য! চারপাশে খোঁজে তার প্রেয়সীকে। জিজ্ঞেস করে,
‘ মিথিলা কোথায়?’
আরমানের জবাব ‘ পাশের ঘরে। কিন্তু তোর হাতে কী?’
নাহিদ ব্যাগের দিক দেখল একবার। স্বলজ্জে জানাল, ‘ ওর জন্য কিছু কেনাকাটা করেছি। আরেকজনের দেওয়া বেনারসি পড়িয়ে আমি আমার বউকে বিয়ে করব নাকী!’
মিরাজ বিড়বিড় করে বলল, ‘ এহ শখ কত! মেয়ে তো পায়েও মোছেনা।’
স্পষ্ট বিদ্বিষ্ট গলায় বলল,
‘এই শালা, সর তো সামনে থেকে। ‘
নাহিদ নাক ফোলাল। তীব্রর দিক চেয়ে নালিশ জানাল,
‘ দেখেছিস বি…’
এইটুকুতেই তীব্র চোখ রাঙায়। নাম উচ্চারণে পরিচ্ছন্ন নিষেধাজ্ঞা মনে পড়তেই, হুশ ফিরল নাহিদের। থামল সেখানেই। শাফিন বলল,
‘ তোর ফুলটুসি পাশের ঘরে। যা গিয়ে হাত-পা খোল।’
নাহিদ চোখ কপালে তুলল,
‘ মানে কী? তোরা কি আমার মিথিলাকে বেঁ*ধে রেখেছিস নাকী?’
মিরাজ কটমট করে বলল,
‘ কথা বেশি বললে তোকেও বাঁ*ধব শালা। যা ভাগ এখন…’
নাহিদ দাঁত পিষল,ফুঁসল। তবে মনে মনে। মুখে রা করার হিম্মত তার নেই। চোটপাটে কদমে ঢুকে গেল ভেতরে। কাজী সাহেব হকচকিত হয়ে সবকিছু দেখছেন। তীব্র বটগাছের মতোন দাঁড়িয়ে তার সামনে। গা থেকে সিগারেট আর অ্যালকোহলের মিশ্র গন্ধ ছুটে ছুটে আসছে। ঠিকঠাক শ্বাস ও নেওয়া যাচ্ছেনা। মাথা নাড়লেন তিনি। এখানে টাকার অঙ্ক বেশি বলে রাত-বিরেত ভাবেননি। লোভে পড়ে সুরসুর করে এসেছেন। কে জানত, এমন গুন্ডা আছে! এখন কী হবে? বিয়ে পড়ানোর পর, সাক্ষী মোছার জন্য ওরা যদি মে*রে ফেলে তাকে?
খাটের ওপর অবজ্ঞায় ফেলে রাখা পুষ্পিতাকে দেখেই নাহিদের বক্ষ বে*দনা বাড়ল। ইশ, কী অবস্থা তার মিথিলার! বন্ধুদের প্রতি কটমটিয়ে বলল,
‘ জ*ল্লাদগুলো আমার মিথুকে কীভাবে বেঁ*ধেছে! বদমাশ সব। একটুও মায়া-দয়া নেই।
ব্যাগগুলো নামিয়ে রেখে ত্রস্ত এগিয়ে এলো সে। প্রথমে ঝুঁকল ওর পায়ের বাঁধন খুলতে। দড়িতে হাত ছোঁয়াতে যেতেই দৃষ্টি থামে, মনোযোগী হয়। কী ভেবে চোখ পিটপিট করল নাহিদ। সুক্ষ্ম নিরীক্ষা মুহুর্তে পালটে এলো বিস্ময়ে। সচকিতে চাইল, পুষ্পিতার হাতের দিক। মস্তিষ্কে উদ্ভব হলো, মস্ত ভুলের আঁচ। শ্বাস থামল তার। গলা ফাঁটিয়ে চি*ৎকার ছু*ড়ল,
‘ বিট্টুউউউ…….’
এ ঘরে থাকা লোকগুলো চমকে উঠল। বাদ পড়লেন না, অসহায় রুপি কাজী সাহেব। এমনিতেই শ*ঙ্কায় নেতিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। নিনাদ শুনেই যেন লাফিয়ে উঠল দেহটা।
ওরা মুখ দেখাদেখি করল। তড়িৎ বেগে ছুট লাগাল পরপর। মুশফিক যেতে নিয়েও থামল। ঘাড় বাঁকাল কাজীর দিক। লোকটি ঘাবড়ে,শক্ত হয়ে গেলেন। মুশফিক এদিক-ওদিক তাকায়। জানলায় টাঙানো রশিতে গামছা ঝুলতে দেখেই দ্রুত নিয়ে আসে। কাজীর হাত-দুটো পেছনে নিয়ে পিঠের সঙ্গে বাঁধল। দৃঢ় কণ্ঠে হুশিয়ারী দিলো
‘ আমরা না ফেরা অবধি এক চুল নড়বিনা। ‘
জবাবে তিনি চুপচাপ মাথা কাত করলেন।
নাহিদ চিৎকারই দেয়নি,একেবারে উঠে লেপ্টে এসেছে দেয়ালে। দ্রুতগামী পা গুলো একসাথে এসে থামল। বিচলিত চাউনী নিক্ষেপ হলো ওর দিক। নাহিদের শ্বাস-প্রশ্বাসে উৎপীড়ন। অসামাল,অস্বাভাবিক দৃষ্টির নিশানায় অবচেতন পুষ্পিতা।
তীব্র কপালে ভাঁজ ফেলে শুধাল,
‘ কী হয়েছে?’
নাহিদ গতিতে আঙুল ওঠাল পুষ্পিতার দিকে। থেমে থেমে, বেগ পুহিয়ে জানাল,
‘ এটা মিথিলা নয়। এ, এ অন্য মেয়ে। ‘
চোখ-মুখ পালটে গেল ওদের। শশব্যস্ত তাকাল পুষ্পিতার পানে। শাফিন চটে বলল,
‘ যা হোক একটা বললেই হলো? তুইত মুখই দেখিসনি এখনও। না দেখেই বুঝে গেছিস এটা মিথিলা নয়। ইয়ার্কি মা*রাস?’
শান্ত নাহিদ জ্ব*লে উঠল,
‘ মিথিলাকে চিনতে আমার মুখ দেখতে হবে? এতদিনের সম্পর্ক! ওকে দশ মাঈল দূর থেকে দেখলেও আমি বুঝতে পারি যেখানে, সেখানে এত কাছ থেকে বুঝব না? ‘
তীব্রর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এটা মিথিলা নাহলে কে? গরুটা মুখ না দেখেই হাম্বা হাম্বা করছে। শাফিনদের তো ভুল হওয়ার কথা না। ওরাতো ছবি দেখেই গিয়েছিল।
কিন্তু নাহিদের গুরুতর ভাবভঙ্গি,আর অস্থির আচরণ ফেলে দেওয়ার মত নয়। বিষয়টা চিন্তার। সে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় শুধাল,
‘ তুই শিওর এটা তোর গার্লফ্রেন্ড না?’
নাহিদের প্রত্যয় সুদৃঢ়। উতলা হয়ে বলল,
‘ বিশ্বাস কর,এটা মিথিলা না।
এই মেয়েটা,এই মেয়েটা অনেক ফর্সা! আমার মিথিলা তো শ্যামলা। তাছাড়া, মিথিলার হাত-পায়ের নখ এমন নয়। এতটা হ্যাংলা-পাতলাও নয় ও।’
তীব্র তপ্ত,আড়চোখে শাফিনের দিক চাইল। ওমনি গুটিয়ে এলো সে। আমতা-আমতা করে বলল,
‘ এমন করে দেখছিস কেন? আমি কী করেছি? নাহিদতো বলেছিল, মিথিলা বাড়ির পেছনে আসবে। আমিতো সেভাবেই আনলাম।’
‘ এর মানে তুই মুখ দেখিসনি?’
শাফিন যেই মাথা নাড়ল,তীব্রর খরখরে হাতের সপাটে এক চ*ড় পড়ল গালে। ফের মা*রতে গেলেই শাফিন এক লাফে পেছনে লুকাল মুশফিকের। কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল,
‘ আমার কী দোষ? ওখানে তখন অন্য মেয়ে আসবে আমি কী করে বুঝব! মিরাজটাও তো কিছু বলেনি।’
তীব্র মিরাজের দিক চাইতেই, সে সাফাই দিতে মিনমিন করে বলল,
‘ কিন্তু আমি তখন….’
‘ এদিকে আয়।’
জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে মিরাজের কথা ফুরাল। বলতে চাইল,
‘ বিট্টু আ…’
‘ তোকে আসতে বলেছি?’
তীব্র চিল্লিয়ে উঠতেই মিরাজ ঝড়ের বেগে এসে দাঁড়াল সামনে। সে আদেশ করল
‘ ওদিকে ঘোর।’
‘ হ্যাঁ? ‘
‘ ঘুরতে বলেছি।’
মিরাজ আস্তে আস্তে ঘুরল। সহসা পেছন বরাবর দূর্দান্ত এক লা*থি মা*রল তীব্র। হুমড়ি খেয়ে পরতে পরতেও খাটের কাঠ ধরে সামলাল ছেলেটা। আ*হত স্থান ডলতে ডলতে কিড়মিড় করল,
‘ শাফিনের বাচ্চা! আমি বলেছিলাম মেয়ের গায়ে বেনারসি নেই। তুই শুনিসনি আমার কথা। ‘
তীব্র গর্জে উঠল।
‘ চুপ! আরেকটা কথা বলবিনা কেউ। কত্তগুলো অকর্মা পুষছি দলে। একটা মেয়েকে তুলে আনতে গিয়ে এত্ত বড় ব্লান্ডার করে ফেললি?’
ওরা মাথা নামাল চুপচাপ।
নাহিদ হাঁসফাঁস করে বলল,
‘ এখন কী হবে বিট্টু? এ অন্য মেয়ে হলে আমার মিথিলা কোথায়? আমার মিথিলার বিয়ে হয়ে যায়নি তো? এই বিট্টু,তুই তো কথা দিয়েছিলি, আমায় এনে দিবি ওকে। এখন তাহলে আমার মিথিলাকে আমি পাব না? ‘
গলা ধরে আসছে নাহিদের। প্রেমিকাকে হারানোর আ*শঙ্কায় হৃদপিণ্ড কাঁপছে। তীব্র ক্যাপ নামাল,সোনালী চুল খা*মচাল জেদে। আবার পড়ল। দু কদম পায়চারি করল ফুঁসতে ফুঁসতে।
আরমান কাছে এসে বলল,
‘ শান্ত হ। মেয়েটার জ্ঞান ফেরাই, তারপর ওর থেকেই জেনে নেওয়া যাবে সব। মিথিলার আসার কথা যখন,ও কেন এসেছিল সেটাত ওর মুখেই শোনা যাবে।’
তীব্র ক্রো*ধ থামেনা। ক্ষোভে লা*থি বসায় খাটের পায়ায়। চুপসে দাঁড়িয়ে থাকে,শাফিন আর মিরাজ। সে খ্যাক করে ডাকে,
‘ এই মেয়ে, ওঠ।’
মুশফিকের ঘুম হাওয়া। মশলাযুক্ত কান্ডকারখানা গোল গোল চোখে দেখছিল সে। তীব্র রা*গে সব ভুলেছে। এভাবে ডাকলে কেউ উঠবে? তাও যার জ্ঞান নেই।
সে ছুটে গিয়ে জগ আনল। শাফিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ নে। আকাম করেছিস যখন, এবার তোল মেয়েটাকে।’
ও ঠোঁট ওল্টায়৷ বিড়বিড় করে, ‘ যত দোষ, শাফিন ঘোষ!’
এগিয়ে যায়। উষ্ণ নজরে চায় পুষ্পিতার দিক। সমস্ত রাগ,ক্রোধ এইবার গিয়ে পড়ল ওর ওপর। সব দোষ এই মেয়ের! ওখানে কেন এসেছিলো ম*রতে?
তিরিক্ষ মেজাজে জগের ঢাকনা খুলেই পুরো পানিটা ছুড়ে মা*রল ওর মুখের ওপর। শরীর ঈষৎ নড়ে উঠল পুষ্পিতার।
তীব্র সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা চ*ড় বসাল মাথায়। শাফিন আর্ত*নাদ করে বলল,
‘ আবার কী করলাম?
সে ক্ষেপে বলল,
‘ কাপড়টা সরাবে কে?’
‘ সরাচ্ছি, সরাচ্ছি। ‘
শাফিন ঝুঁকে যায়। পুষ্পিতার মুখোশে টান বসায় অভঙ্গুর হস্তে। প্রকোপে পাঞ্চক্লিপ সহ, কয়েদী কেশ খসে, ছড়িয়ে আসে পিঠে। কাছাকাছি কোথাও আর্তচিৎকারে বাঁজ পড়ল তখন। কেউ ভালো করে চাইতেও পারল না, সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং। সমস্ত এলাকার বিদুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো নিমিষে।
শাফিন মহাবিরক্ত হয়ে বলল,
‘ শালার এখনই কারেন্ট যেতে হলো?’
পুষ্পিতার চেতনা ফিরেছে। ধীরেসুস্থে চোখ মেলল। ভারি মস্তক সোজা করল। নড়তে গিয়ে বুঝল হাত দুটো বাঁধা। অবশ পদযূগলেও কঠোর কিছুর স্পর্শ। চোখের সামনে ঘুটঘুটে তিঁমির। তুষারের ন্যায় জমে গেল ওমনি। মনে পড়ল, পেছনের কথা। হঠাৎ কেউ এসে মুখে কিছু একটা চেপে ধরার চিত্র। পুষ্পিতার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে আসে। অজ্ঞাত শ*ঙ্কায় ধড়ফড় করে বুক।
পরপর অচেনা পুরুষালি স্বর, প্রখর গতিতে কর্ণকুহরে হা*মলা চালায়। শিরায় শিরায় রক্তসঞ্চালন থমকে যায় তার।
‘মোম কোথায় পাই এখন? এই ব্যাটা, মোম আছে এখানে?’
মুশফিক উত্তর দিলো,
‘ থাকার তো কথা। দেখছি দাঁড়া।’
ফ্ল্যাশ জ্বা*লাবে যে, সাথে ফোনও আনেনি কেউ। লোকেশন ট্রাক না হওয়ার জন্য, কাটায় কাটায় চূড়ান্ত সতর্কতা তাদের।
পকেটে থেকে অধৈর্য হাতে ম্যাচ বক্স বের করল তীব্র। দপ করে জ্ব*লে উঠল কাঠি। অল্প সময়ের ওই আলোতে ওর মুখটা ভাসল আবছা, স্পষ্ট। তবে কালো মাস্ক আর ক্যাপের ভিড়ে দেখাল শুধু সাদাটে দুই চোখ। আবৃত মুখমন্ডল ছাপিয়ে পুষ্পিতার নজর, সরাসরি পৌঁছাল তীব্রর বিলাতি নয়নে। আগুনের স্পর্শে কেমন ভৌতিক লাগল তা। সহসা ভ*য়ে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ সাপ! সাপ!’
উপস্থিত সকলে ভড়কে যায় হঠাৎ নিনাদে। মিরাজ সাপ শব্দটা শুনেই, লাফ দিয়ে আরমানের কোলে উঠে গেল। রীতিমতো দুই পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল ওর কোমড়। ছেলেটা নড়বড়ে খুঁটির ন্যায় দুলে ওঠে। হিমশীমে কণ্ঠে ধমকায়,
‘ শালা আলুর বস্তা! নাম।’
‘ না না সাপ।’
শাফিনের মনে পড়ল তার পকেটে মিনি টর্চ আছে। সবসময় থাকে। এক পাশে লাইটার,অন্য পাশে আলো। সে চটপট বের করে জ্বালাল। ফেলল পুষ্পিতার মুখের ওপর।
আকষ্মিক কড়া আলোর তোপে চোখ কুঁচকে ফেলল পুষ্পিতা। মুচড়ে উঠল শরীর।
তীব্র চারপাশ দেখছিল। নীরবে সাপ খুঁজে না পেয়ে মাথা গরম হয় আবার। তেঁতে বলল ,
‘ মিথ্যে বললি কেন? কোথায় সা…’
বলতে বলতে তপ্ত মেজাজ,আর রুষ্ট চোখে চাইল সে। বিলাতি নজর সোজাসুজি অর্শায় পুষ্পিতার নির্মল আননে।
মুহুর্তে ঠোঁট দুটো থামল তার। অসম্পূর্ণ রইল গোছানো ধমক। পুষ্পিতার মুখশ্রীতে উগ্র করের তীর্যক রেখা। চক্ষুগহ্বর সেই উৎপাতে বেশামাল। ললাটের সূক্ষ্ণ ঘামে লেপ্টে থাকা ক্ষুদ্র কেশ, খিচে নেওয়া পল্লবে এক অন্যরকম অভিভূতি!
ছোট জানলার কপাট ডিঙিয়ে শনশন হাওয়া সবেগে আসে। হুড়মুড় করে স্পর্শ করে তীব্রর হাতের কাঠি। বুড়ো আঙুল ছোঁয়ার পূর্বেই দপ করে নিভে যায় কিরণ৷ উষ্ণ বায়ু আজ বড্ড শীতল! সেই শীতলতা এক লহমায় ভিজিয়ে দেয়, মাস্তান তীব্রর শক্তপোক্ত নিরেট হৃদয়।
পুষ্পিতা ধাতস্থ হয়ে,টেনে-হিচড়ে আঁখি মেলল। ভেজা,পদ্মের ন্যায় পল্লব কেঁ*পে, সরে গেল দুইদিক। তিরতির করে নড়ল,দোলনচাপার মতোন ওষ্ঠপুট। বৃহৎ,সরল চক্ষুদুটির দৃষ্টি বক্ষস্পন্দন থমকে রাখল তীব্রর।
শুধু সে নয়,বাকীরাও ড্যাবড্যাব করে চেয়ে। মেয়ে দেখলেই নেঁচে ওঠা শাফিন, ইগজগতে নেই। হা করে লাইট ধরে আছে এখনও। মিরাজ সাপের কথা ভুলে গেল। মুগ্ধের মত তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
মুশফিক মোম জ্বালিয়ে এনেছে। সবাইকে স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কোঁচকাল । দৃষ্টি অনুসরণ করে পুষ্পিতাকে দেখল। বুঝল যা বোঝার! রূপসী মেয়ে দেখে সব কটা হুশ হারিয়েছে। সে অতীষ্ঠ বেগে মাথা নাড়ে। তীব্রর দিক চায়। এইবার চোখ কোটর ফুড়েই বেরিয়ে এলো প্রায়। পল্লব ঝাপটাল মুশফিক। একটা মেয়ের দিক তীব্রর আবিল অক্ষির ওমন অনড় চাউনী দেখে নিজেই বোকা বনে গেল।
ও ঘর থেকে মোলভী সাহেব বিনয়ী স্বরে ডাকলেন,
‘ ইয়ে, শুনছেন বাবারা? আমাকে একটু আলো দিন না! ভ*য় লাগছে।’
সবাই নড়েচড়ে উঠল। আরমান, শাফিনের হাত থেকে টর্চ নিয়ে চলে গেল ওদিকে। এ ঘরে কেবল মোমের নির্ভেজাল জ্যোতি। কামড়ার চতুর্দিকে ঈষৎ বেগে লুটোপুটি খায় তা।
এদিকে সম্মুখে,মুখোশধারী এত গুলো ছেলে দেখেই গলা শুকিয়ে গেল পুষ্পিতার। নিভু, ভয়ার্ত নেত্রে একে একে সবার দিক চাইল সে। তীব্রর সময় এলো যখন,ওই দীঘল, হরিনী চোখের চাউনী বুক ভেদ করে মধুর দহনে পু*ড়িয়ে দিলো তাকে।
শুধু নাহিদের এসবে ধ্যান নেই। মিথিলার স্থানে অন্য মেয়ে আসায় তার মাথায় জ্বলছে দাউদাউ অগ্নিশিখা।
কর্কশ স্বরে ধমক দিলো,
‘ এই মেয়ে, কীসের সাপ? ফাজলামো মা*** আমাদের সাথে?’
পুষ্পিতার দুর্বল দেহ ছল্কে উঠল। রূঢ়ভাষী নাহিদের দিক ভীতশশস্ত্র হয়ে চাইল। কী দেখে সাপ ভেবেছিল নিজেই তো জানেনা। শুধু মনে আছে,সিরিয়ালে দেখা সাপের মতো দুটো পঙ্কিল চোখের মণি। পরক্ষণে নিজেই লজ্জা পেল বোকামির। হুট করে জ্ঞান ফেরা,আবার অন্ধকারে হঠাৎ ওইভাবে দেখায় বাস্তব,অবাস্তব গুলিয়ে ফেলেছিল।
পুষ্পিতা মাথা নুইয়ে চুপটি করে রইল। তার ভেতরটা থরথর করছে। ছেলেগুলো এখন ওকে নিয়ে কী করবে? ভাবলেই গলবিলটা মরুভূমির মতো শুষ্ক হচ্ছে ক্রমে।
শাফিনের ঠোঁটদ্বয় তীব্রর দিকে ধেঁয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল,
‘ ভাই,এই এলাকায় এমন চোখ ধাঁধানো মেয়ে আর আমরা দেখলাম আজ? হাউ ইজ ইট পসিবল!’
তীব্র উত্তর দিলো না। ফোস করে শ্বাস ফেলল। শান্ত নজর ফিরিয়ে নিলো আরেকদিক। ছোট দৃষ্টি গেঁথে রইল রঙচটা ওই দেয়ালে।
নাহিদ রু*ক্ষ মেজাজে চেঁচিয়ে উঠল, ,
‘ তোরা স্ট্যাচু বনে আছিস কেন? কিছু করবি না? এই মেয়ে কী করছিল ওখানে জিজ্ঞেস কর। আমার কিন্তু মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বলে দিলাম।’
মুশফিক বলল, ‘ আরে ব্যাটা থাম। এখন জিজ্ঞেস করলেও বা! রাত কয়টা বাজে জানিস? তোর কী মনে হয়, এখনও তোর গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে থেমে আছে? এতক্ষণে দ্যাখ গিয়ে শ্বশুর বাড়িও চলে গেছে।’
নাহিদ থমকে যায়। হাঁসফাঁস করে, মাথার চুল খা*মচে বসে পড়ল মুহুর্তে । বি*ধ্বস্ত ভঙিতে আওড়াল,
‘ আমার মিথিলা তাহলে আমার হোলোনা? ‘
পুষ্পিতা ভ*য়ডর ভুলে অবাক চোখে চাইল। মিথিলার নাম শুনে, কোটরের আশপাশে ছড়িয়ে গেল বিস্ময়।
মিরাজ পাশে বসল। নরম গলায় সান্ত্বনা দিলো,
‘ কাঁদিস না। যা হবার তাতো হবেই। ও তোর ভাগ্যে নেই।’
নাহিদ শুনল না। সে হা-হুতাশ করে কাঁ*দছে।
তীব্র হাত পাতলে, নীরবে মোম ধরিয়ে দিলো মুশফিক। পুষ্পিতা টের পেলো কেউ এগিয়ে আসছে। নাহিদ থেকে দৃষ্টি এনে তাকাল সে। তীব্রকে কাছে আসতে দেখেই চকিতে পিঠ লেগে গেল দেয়ালে। বাঁধা পা সেটে আসতে চাইল। শঙ্কায় ঠকঠক করে ভূমিকম্প নামল হাঁটুতে।
তীব্র ঝুঁকে আসে। পুষ্পিতা চমকে, গুটিয়ে যায় আরো। কম্পিত, বড় চোখ কোনও মতে তাকায় মাস্ক পরিহিত তার দিক। চোখাচোখি হয় দুজনের। বাইরে কালবৈশাখির দুঃসহ তা*ন্ডব। সে এক প্রকান্ড ঘূর্ণিঝড়!
ওমন ঝড়ের মাঝে,কেবল মাত্র মোমের ক্ষীণ দীপ্তিতে এক জোড়া ভীত, অস্থির কালো মণির সঙ্গে,মিশে গেল তীক্ষ্ণ,খুরখার দুটো সাদাটে নজর।
তীব্রর চাউনী সেকেন্ডে ঘুরে আসে পুষ্পিতার সমগ্র ঘর্মাক্ত চেহারা হতে। কমলা আলোয়, খুব কাছ থেকে মুখখানি দেখল এবার। সীমান্তহীন আকাশে উড়ে বেড়ানো বলাকার ন্যায় ভ্রুযূগলের নীচে সদ্য ফোটা শালুক রুপী আশ্চর্য সুন্দর দুটি চোখ। কম্পমান অধরভাঁজে ঝর্ণাসম রিমঝিমে স্নিগ্ধতা।
তীব্র এত নিকটে আসায় পুষ্পিতার রুহু শুদ্ধ কাঁ*পছে। লোকটা কী এক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়বে? কিংবা খুব নোংরা ভাবে স্পর্শ করবে ওকে? পুষ্পিতা আল্লাহকে ডাকছে। মনে মনে অবিশ্রান্ত দোয়া-দরুদ পড়ছে।
এদিকে শাফিন ওরা একে-অপরকে দেখছে। তীব্রর হাবভাব নিয়ে বিভ্রান্তিতে, নিজেদের ভ্রু উঁচাচ্ছে একেকজন।
পুষ্পিতা চোখ নামিয়ে নেয়। তক্ষুণি শুনতে পায় তীব্রর প্রশ্ন। ফের চাইল সে। তীব্র উন্মুখ মোটা ভ্রু, নাঁচিয়ে,স্থূল গলায় শুধাল,
‘ নাম কী?’
পুষ্পিতা ঢোক গেলে। কুকড়ে আসে। পিপাসায় কাতর কণ্ঠনালী, অবরুদ্ধ। কোনও রকম উত্তর দেয়,
‘ পু..পু..’
শাফিব ধৈর্য হারিয়ে বলল, ‘ পুপু?’
মন্থর বেগে মাথা নাড়ল পুষ্পিতা।
‘ তাহলে কী?’
‘ পু..পুষ্পিতা!’
শাফিন কপাল গোছায়, ‘ কার পিতা?’
মিরাজ বাহুতে কিল মে*রে বলল, ‘ পুষ্পিতা গর্দভ!’
‘ ও আচ্ছা।’
এদিকে নাহিদ কাঁ*দছে। আহাজারিতে কপাল চাপড়াচ্ছে। মুশফিক খেই হারিয়ে বলল,
‘ নাম ধাম বাদ দে। জিজ্ঞেস কর, ওই সময় বাড়ির পেছনে মিথিলার জায়গায় কী করছিল ও?’
শাফিন শার্টের হাতা ভাঁজ করল। ভাব-সাব নিয়ে বলল,
‘ আমি জিজ্ঞেস করছি ওয়েট!’
সেকেন্ডে ছুরি বের করেই উঁচিয়ে ধরল ওর সামনে। তর্জন দিলো গম্ভীর গলায়,
‘ এই মেয়ে,তুমি সুন্দরী বলে ছেড়ে দেব ভেব না। যা জিজ্ঞেস করব ঠিকঠাক উত্তর দেবে বুঝলে? নাহলে কে*টে পিস পিস করে ফেলব।’
সঙ্গে ছুরিটা দিয়ে ক্রস দেখাল শাফিন।
যে মেয়ে টেলিভিশনে র*ক্তা-র*ক্তি দেখলেও ভ*য় পায়, সামনে থেকে প্রথম বার কোনও গুন্ডার হাতে ছুরি দেখল সে। আবার কী বিভৎস হুমকি! অচিরেই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল পুষ্পিতার। মোমের হলদে প্রভায় চিকচিক করছে ধার। এখন এই ছুরি দিয়েই কী প্রহার চালাবে এরা? পুষ্পিতা আতঙ্কে স্তম্ভ বনে গেল। বক্ষস্পন্দন চমকে,থমকে, লুটিয়েই পড়ল এবার।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সবাই। তব্দা খেয়ে একে অন্যকে দেখল। শাফিন হতভম্ব হয়ে বলল,
‘ কী হলো ব্যাপারটা! ‘
তীব্র সোজা হয়ে দাঁড়াল। কটমটিয়ে বলল,
‘ ছুড়ি দেখাতে বলেছি তোকে?’
‘ আমি ভাবলাম ভয় পাবে।’
মিরাজ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ পেয়েছে তো। এমন ভয় পেয়েছে যে একেবারে চিৎপটাং হয়ে পড়ল। এখন নে,আবার জ্ঞান ফেরা। ‘
সব দোষ ঘাড়ে পরায় চেহারা ছোট করল শাফিন। পানি নিয়ে পুষ্পিতার মুখে ছেটাতে ছেটাতে বলল,
‘ জীবনে প্রথম কোনও মেয়ে দেখলাম,ছুরি দেখেই অজ্ঞান হয়ে যায়। এমন ভীতু মেয়ে আল্লাহ!’
এই মেয়ের নাম পুষ্পিতা কেন,ভীতুর ডিম রাখা উচিত। ‘
চলবে।