কলমেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)
অথৈ আর লতা দুই জা মিলে দুপুরের জন্য রান্না করছে। লতা বসে রান্না করছে আর অথৈ হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে। টুকটাক গল্পের মাঝে মাঝে হাসি ঠাট্টাও করছে দুজন। এমন সময় মরিয়ম বেগম রান্না ঘরে ঢুকে বললেন,
— মেজো বউ রান্না কতদূর?
— এইতো মা প্রায় হয়ে এলো। আপনি গোসল সেরে আসতে আসতে আমার হয়ে যাবে।
— আচ্ছা আমি গোসলে যাচ্ছি তাড়াতাড়ি হাত চালাও। সবার খিদে লেগে গেছে।
— আচ্ছা মা, আপনি আসার আগেই আমার হয়ে যাবে।
— আর শোনো এখানেই দুই বউই আছো, এখনই বলে দেই।
— কি বলবেন মা বলুন!
— সামনে রোজা আসছে, তাই নতুন করে বলার কিছু নাই তোমরা যা জানানোর তা তোমাদের বাড়িতে জানিয়ে দিও।
অথৈ অনেকটা অবাক হয়ে মরিয়ম বেগমের দিকে তাকালেন। অথৈ বুঝতে পারলোনা বাড়িতে কি জানানোর কথা বললো তার শাশুড়ি। লতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো লতার মুখটা শুকিয়ে গেছে। মাথা নিচু করে ফেলেছে মেয়েটা। অথৈ কিছু একটা বলতে চাইলে লতা তার হাত চেপে ধরে ইশারা করলো কিছু না বলার জন্য। অথৈকে কিছু না বলার জন্য বললেও অথৈ চুপ করে থাকলোনা। লতা বিষয়টা জানলেও অথৈ জানেনা কারন সে এইবাড়িতে নতুন। তাই অথৈ মরিয়ম বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
— আমাদের বাড়ি বলতে কি আপনি বাবার বাড়ি বুঝালেন মা?
— হ্যাঁ।
— কিন্তু কি জানানোর কথা বললেন? আমি তো নতুন, কি জানাতে হবে সেটা তো আমি জানিনা। যদি পরিষ্কার করে বলতেন তাহলে ভালো হতো।
— সামনে রোজা, আর রোজার মাসে ইফতারি পাঠানোটা আমাদের এলাকার রেওয়াজ। সেটাই তোমার বাবাকে বলবে।
— আচ্ছা বলবো মা।
মরিয়ম বেগম চলে গেলো। অথৈ লতার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আপা সত্যিইকি এটা এই এলাকার রেওয়াজ?
— দেয় কেও কেও সবাই দেয় এমন না। যার বাবার অনেক আছে তারা খুশি হয়ে হয়তো দেয় কেও কেও।
— দেয় সেটা ঠিক আছে, অনেকে দেখা যায় খুশি হয়ে হয়তো মেয়ের বাড়িতে পাঠায়, কিন্তু মা যেভাবে বলে গেলেন সেটা শুনে তো মনে হলো বাধ্যতা মূলক নিয়ম! এমন অনেক পরিবার আছে যাদের তিন বেলা ঠিক মতো খাবার জোটেনা তারা কিভাবে তাদের মেয়ের বাড়ি পন্য সামগ্রি পাঠাবে!
— এইবাড়িতে অনেকটা বাধ্যতা মূলকই। কিভাবে পাঠাবে সেটা দেখার বিষয় এদের না, পাঠাতে হবে এটাই মূল কথা।
— কই আমাদের বাড়িতে তো এমন কোনো নিয়ম নেই। তাহলে এখানে কেনো?
— জানিনা।
কথা গুলো বলতে গিয়ে লতার দু চোখ ভিজে গেছে সেটা অথৈ এর চোখ এড়ালো না। অথৈ লতার কাঁধে হাত রেখে বললো,
— কি হয়েছে আপা তুমি কাঁদছো কেনো?
— কই কাঁদছিনা তো! আগুনের ধোঁয়া লেগেছে তাই চোখ থেকে পানি পড়ছে।
— কোনটা ধোঁয়ার পানি আর কোনটা কান্নার পানি সেটা আমি বুঝি। আমি দেখছি তুমি কাঁদছো তাহলে লুকাতে চাইছো কেনো? কি হয়েছে আপা?
— ভাইয়েরা যখন সব একসাথে ছিলো, আর বাবার শরীরে শক্তি ছিলো। কষ্ট হলেও যেভাবেই হোক ইফতারি সামগ্রী পাঠিয়েছে। কিন্তু গত দুই বছর তো বাবা অসুস্থ, বাবার সমস্ত ওষুধ পত্রের খরচও ভাইদেরই চালাতে হয়। মা কোনো রকমে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, তারও অনেক ওষুধ লাগে। এবার বলো ভাইদের কি করে বলবো ইফতারি সামগ্রী পাঠাতে!
— আপা এটা বাধ্যতা মূলক কোনো নিয়ম না, তুমি মন খারাপ করোনা। তোমাকে ও বাড়িতে কিছু জানাতে হবেনা। আমি বলবো আমার বাবাকে উনি দিয়ে গেলেই হবে, তুমি এটা নিয়ে কষ্ট পেওনা।
— গতবারও রোজাতেও বাবার বাড়ি থেকে কিছু এনে দিতে পারিনি। আবার এবারও যদি না আনতে পারি তাহলে তো আর রক্ষে থাকবেনা।
— কিচ্ছু হবেনা তুমি এসব নিয়ে মন খারাপ করোনা। মাকে আমি বুঝিয়ে বলবো।
— গতবারের মারের দাগ হয়তো এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে দু একটা। আমার অপরাধ ছিলো আমি ও বাড়িতে বলতেই পারিনি ইফতারি সামগ্রী পাঠাতে।
অথৈ লতার কথা গুলো শুনে থ মেরে গেলো। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলোনা। তবুও বললো,
— আপা তুমি এখনই এতো চিন্তা করোনা তো! সময় আসুক তখন সব দেখা যাবে।
অথৈ এর বাবার বাড়ির অবস্থা মোটামুটি ভালো, খবর গেলেই হয়তো মেয়ের সুখের জন্য সব পাঠিয়ে দেবে। তাই এসব নিয়ে অথৈ এর কোনো খারাপ লাগা নেই। তার খারাপ লাগছে লতার কথা ভেবে। লতা ব্যাচারি কি করবে এখন! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রান্না শেষ করলো দুজনে।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ সুমন আর অথৈ শুয়ে আছে। সুমন বই পড়ছে আর অথৈ শুয়ে আছে পাশে। অথৈ মনে মনে ভাবছে, সুমনকে কি লতার বাবার বাড়ি থেকে ইফতারি সামগ্রী পাঠানোর কথাটা কি বলবো! ভয়ও লাগছে আবার লতার জন্য খারাপও লাগছে। লতা যদি তার বাবার বাড়ি থেকে কিছু আনতে না পারে তাহলে তো লতাকে উঠতে বসতে কথা শোনাবে মা। আবার এদিকে সুজনের অত্যাচার তো আছেই।
একবার সাহস করে বলেই ফেলি যা হবে পরে দেখা যাবে। সুমনের দিকে পাশ ফিরে অথৈ বললো,
— তোমার কিছুটা সময় হবে? কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে।
— পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো, এই পৃষ্ঠাটা শেষ করে তোমার কথা শুনছি।
— আচ্ছা।
অথৈ আরেক পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলো অথৈ এর চোখে ঘুম ধরে গেছে। সুমন বইটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,
— অথৈ! ঘুমিয়ে গেলে নাকি?
অথৈ চোখে ঘুম নিয়েই বললো ,
— হুম ঘুম আসছে।
— কিছু একটা বলবে বলছিলে, বলো এবার।
— কাল সকালে বলি! ঘুমে ধরে গেছে।
— আচ্ছা তাহলে ঘুমাও।
কথাটা বলার পরপরই, লতার কান্না ভেজা চোখের কথা মনে পড়ে গেলো। না না সকালে হবেনা এখনই বলতে হবে।
— আচ্ছা শোনো, আগে তুমি বলো রাগারাগি করবেনা?
— কি এমন কথা বলবে যে, হঠাৎ আমার রাগের কথা আগে তোমার মাথায় আসলো!
— জানিনা কেনো আসলো, তবে মনে হলো তুমি রাগ করতে পারো তাই বললাম।
— আচ্ছা রাগ করবোনা বলো।
— তোমার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা হবে? আসার সময় মা কিছু টাকা দিয়েছিলো তার থেকে কিছু আছে আমার কাছে আর বাকিটা তুমি দিলে হয়ে যেতো।
সুমন বেশ অবাক হয়ে অথৈ এর দিকে তাকালো। অথৈ টাকা কি করবে! কিছুক্ষণ অথৈ এর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
— সে না হয় দিলাম, কিন্তু হঠাৎ টাকা দিয়ে কি করবে তুমি?
— আজ দুপুরে মা আমাকে আর মেজো আপাকে বলেছে আমাদের বাড়িতে জানাতে যে, সামনে রোজা তাই ইফতারি সামগ্রী পাঠাতে।
— কি বলছো এসব! মা একথা বলেছে?
— হ্যাঁ, প্রতিবারই নাকি মেজো আপার বাড়ি থেকে পাঠায়। এবার তো আমিও আছি তাই আমার বাবাকেও বলতে বলেছে। কিন্তু আমি না হয় বাড়িতে বললে বাবা সব পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু আপার বাবার বাড়ির অবস্থা তো তুমি জানোই। তারপরও উনার বাবা নাকি অসুস্থ। আর উনার এবং ভাবির মায়ের সমস্ত ওষুধ খরচ তার ভাইয়েরাই বহন করে। তার উপরে আপা কি করে বলবে এগুলো পাঠানোর কথা! তাই খুব কান্না কাটি করছিলো। সেই দুপুর থেকে মন খারাপ করে বেড়াচ্ছে।
— কই আমাকে তো কেও কখনও এ কথা জানায়নি! আর আমিও তো কখনও কিছু বুঝতে পরিনি।
— তুমি তো দেশের বাইরে ছিলে তাই হয়তো নজরে আসেনি বিষয়টা।
— সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুমি টাকা দিয়ে কি করবে?
— আমি চাইছিলাম ইফতারি সামগ্রী হিসাবে যা যা লাগে সবটা তুমি আর আমি মিলে কিনে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। সবাই জানলো আপার বাবার বাড়ি থেকে এসেছে।
— এটা কি এই সমস্যার সমাধান হলো?
— তা ছাড়া আর কি! না হলে তো মা উঠতে বসতে আপাকে কথা শুনাবে আর মেজো ভাইও নাকি মারবে। ও ব্যাচারি কি করবে বলো!
— কি! সুজন লতাকে মারধর করে?
— হ্যাঁ।
— এভাবে নিজের টাকা দিয়ে কয়টা রোজা পার করবে তুমি?
— এবারের মতো তো করি তারপর দেখা যাবে।
— না, এই ব্যাধির চিকিৎসা এটা না।
— মানে!
— মানে কিছুই না। এবছর না হয় তুমি মায়ের মুখ আর সুজনের মাইর আটকালে। সারাবছর তো আর তুমি সেটা পারবেনা। তাই এই ইফতারি সামগ্রী রোগের চিকিৎসা অন্যভাবে করতে হবে। গোটা সমাজ থেকে দুর করা দরকার। কিন্তু সেটা তো আর আমি পারবোনা। কিন্তু আমার বাড়ির টা তো আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
— দয়া করে তুমি এসব নিয়ে নতুন করে কোনো ঝামেলা করোনা।
— তুমি কি চাওনা লতার এই সমস্যা চিরতরে দুর হোক?
— চাই।
— তাহলে চুপ করে থাকো।
— কি করতে চাইছো তুমি?
— যা করি সেটা শুধু চুপচাপ দেখে যাও। আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমাও। তোমার আবার সকাল সকাল উঠতে হবে।
অথৈ আর কথা বাড়ালো না, শুয়ে পড়লো। সুমনের উপর অথৈ এর বিশ্বাস আছে ও এমন কিছু করবেনা যেটাতে আমি বা লতা কেও ছোটো হই।
চলবে……
(আপনাদের রেসপন্স কমে গেছে, যারা গল্পটা পড়ছেন তারা সাড়া দিবেন প্লিজ)